চাঁদের_আলোয়_জোছনা_ভাঙ্গে পর্ব ৫৭
লেখা আশিকা জামান
অনীলা মুখ চুন করে বসে আছে। ইমতিয়াজ সাহেব আড়ঁচোখে ব্যাপারটা উপভোগ করছেন বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ।
” ভেবেছিলাম এই মেয়ের মধ্যে লাজ, শরম কিছু হলেও আছে। এখনতো দেখি পুরাই উলটা।” বিড়বিড় করে বলা কথাটা ইমতিয়াজ সাহেবের কানে এড়ায় না। খ্যাঁক করে কাশতে কাশতে বললেন,” তোমার না খুব লাজ শরম বুঝছো!”
” মানে কী! আমার লাজ শরম নাই।” অনীলা তড়িৎ গতিতে লাফিয়ে উঠলো।
” মেয়ে মানুষের এই এক দোষ কথা না শুনে আগেই লাফায়।” অনীলা চোখ বড় বড় করে তাকায়। ইমতিয়াজ সাহেব ঠোঁট বাকিয়ে আবার বলে, ” বিয়ের আগে তুমিও কিন্তু এইভাবেই আমার কোলে উঠেছিলে এই ছবিটা দেখে কী সেটা একবারও মনে হচ্ছেনা!”
অনীলা তিরিক্ষি মেজাজে কিছু বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই সুযোগটা উনি পেলেন না। অন্বেষা মুখে দুষ্ট হাসি মেখে বলে উঠলো,
” হাউ রোমান্টিক আম্মু, মাই লাভিং বাবা।”
অনীলার লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে।মেয়েটা কখন এসে ঢুকে গেছে আল্লাহ মালুম। গলা চড়াতে গিয়েও পারলেন না। অবস্থা বেগতিক দেখে ইমতিয়াজ কেটে পড়ার বন্দোবস্ত করতে লাগলেন। আজ কপাল ভালোই খারাপ আছে।
” হেই, মাদার বাংলাদেশ, আপনি এমন স্ট্যাচু হয়ে রইলেন কেন? আপনার তো এটলিস্ট কিচেনে যাওয়া উচিৎ। আন্টি আংকেলরা এই আসলো বলে।” অনীলা উঠে দাঁড়ায়। মেয়ে ভালো কথা মনে করেছে। অনন্যার বাবা মা না আসতে চাইলে উনি নিজেই যেতেন। এভাবে আর ছেলে মেয়েদের ছেড়ে রাখা যাচ্ছেনা। সময় মতো রাশ টানতে হয়। অঙ্কন ফিরলেই সোজা বিয়ের পীড়ি এমনটাই এখন ভাবছেন।
★★★★★★
” চোখ মুখ ফুলিয়ে বসে আছ এটা দেখতে আমার খুব ভালো লাগছে, তাই না!”
এই কথায় অনন্যার কোন হেলদুল হলনা। ফোনের ওপাশে সে ঠিক আগের মতোই মূর্তি হয়ে বসে রইল।
“তোমার যখন আরও কাঁদতে ইচ্ছে করছে, তো কাঁদ বেশি করে। তোমার যখন এটাই ভালো লাগে তো আমি নিজেই তোমাকে ইচ্ছেমতো কাঁদাব। মেন্টালি প্রিপেয়ার হও।” অঙ্কনের গলায় রাগ ঝরে পড়ছে।
” অঙ্কন! তোমার মুখে কোন কিছুই আটকায় না। যা খুশি তাই বলে ফেল আগা গোড়া না ভেবেই। আমি যখন কাঁদছিলাম তখন তোমাকে কে ফোন করতে বলেছিলো! আর আমি কি এখন কাঁদছি! চুপচাপ তোমাকে দেখছিলাম এটাও তোমার ভালো লাগছেনা। আমি এখন কী করলে তোমার ভালো লাগবে?”
” শোন তোমাকে দেখে কানার ভাই অন্ধও বলে দিবে যে তুমি কাঁদছ। কেন কাঁদছিলে সেটা বল।”
” কারণ আজকে আমার কান্না দিবস তাই!” অনন্যার সোজাসাপ্টা নির্লিপ্ত উত্তর।
” হ্যাঁ, আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম তুমি এরকম বহুদিবস পালন কর। আচ্ছা বিগ কুয়েশ্চেন, আপনার চুমু দিবসটা কবে? একটু আগে থাকতেই বলিয়েন! এই দিবসটা তো আর হেলায় ফেলায় হাতছাড়া করা যায়না। আর একা একা চুমুও খাওয়া যায়না।”
” আমার ডিকশিনারিতে কোন চুমু দিবস নাই আছে মাইর আর খাঁমচি দিবস! এইটা সামনেই। আপনি যেদিন আসছেন সেদিন হবে মাইর আর খাঁমচি মেন্টালি প্রিপেয়ার হয়ে আইসেন।”
” হ্যাঁ নিশ্চয়ই। ভালো কথা, আমার কাছে হেরে গেলে কিন্তু মাইরের বদলে চুমু দিবস পালন করা হবে ঠিক আছে। তখন কিন্তু নো ছাড়াছাড়ি। ”
ফোনের ওপাশ থেকেই অনন্যা লজ্জায় লাল হয়ে উঠল।
★★★★★
আহনাফ আর আয়েশা ঘন্টাখানেকের মধ্যেই অঙ্কনদের বাসায় উপস্থিত হয়। রাতের ডিনার সেরেই সবাই মিলে বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে বসেন। প্রথমে ইমতয়াজ আর অনীলা বিষয়টা নিয়ে ঠিক যতোটা এক্সাইটেড হয়েছিল এইমুহুর্তে যেন আনন্দে ভাঁটা পড়ে গেল। মাথায় যেন এক আকাশ ভেঙে পড়েছে এমন একটা ভাব নিয়ে অনীলা বলে উঠলেন,
” আয়েশা, তোর মেয়ের এই আমেরিকা যাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে আমাকে আগেই জানাতে পারতি। তাহলে তোর মেয়ের ব্যাপারে আরও না হলেও পাঁচবার ভাবতাম। এতদূর এসে এই কথা শুনতে কিন্তু আমার মোটেও ভালো লাগছেনা।”
আয়েশা কপাল কুঁচকে স্বামীর দিকে তাকালেন। মেজাজ খারাপ হচ্ছে। যেখানে মেয়ে যেতে চাচ্ছেনা সেখানে স্বামীর এত বাড়াবাড়ি উনার ভালো লাগছেনা। এবার কী বলবে এদের। আগে যদি ঘূনাক্ষরেও টের পেত বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে এসে মেয়ের বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারটা তুলবে তাহলে আগেই সাবধান করে দিত।
” আসলে কী হয়েছে জানিস! ব্যাপারটা তোর কাছে আগেই শেয়ার করতাম। কিন্তু আমি ভাবতাম মেয়ের এমনিই বোধ হয় ছেলেমানুষি খেয়াল। ফাইনালি এই সুযোগটা যে সামনে আসবে আমি ভাবতেই পারিনাই রে। তুই চিন্তা করিস না মেয়ে আমার অঙ্কনের জন্য সব ছাড়তে পারে।”
অনীলা মনে মনে নিশ্চিন্ত হলেন। কিন্তু আহনাফ সাহেব ঝাঁঝিয়ে উঠলেন,
” মেয়ে কেন এতবড় সুযোগ হাতছাড়া করবে? সে অবুঝ হলেও এতবড় ভুলটা ওকে আমি করতে দিতে পারিনা।” আয়েশার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল।
” দেখুন ভাইজান, আমার এক মেয়ে বিয়ে হয়ে গেছে এখন অন্বেষাকেও বিয়ে দিতে হবে। অঙ্কন বাহিরে বাহিরে বেশি থাকে। আমি তো একলা হয়ে পড়ব। ভেবেছিলাম ছেলের বউ নাতি নাতনিদের নিয়ে বাকি দিনগুলি হেসে খেলে কাটাব। সেক্ষেত্রে আপনার মেয়ে যদি বিদেশ চলে যায় তাহলে কী করে আমার সংসার চলবে! এই বুড়ো বুড়িদের আর কী অবশিষ্ট থাকবে বলেন! এই চাওয়াটা কি আমার দোষের!” অনীলা কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বললেন।
আহনাফ সাহেব কী বলবেন ভেবে পেলেন না৷ তবে তিনি হাল ছাড়লেন না।,
” দেখুন, মেয়ে তো আমার সারা জীবনের জন্য চলে যাচ্ছেনা। থিসিস শেষ হলেই চলে আসবে।”
” একবার বিদেশ বিভূঁইয়ে কেউ গেলে যে আর ফিরে আসেনা এটা আমি ভালোভাবেই বুঝি। তাছাড়া আজকাল কার ছেলেমেয়েদের কী বিশ্বাস!” মুহুর্তেই অনীলার গলার স্বর পালটে যায়। ইমতিয়াজ জোর গলায় বলল,
” অনীলা কি বলছ এসব!”
” যা সত্যি তাই। চারপাশে যা ঘটছে তাই বলছি।” অনীলা সাথে সাথেই উত্তর দেয়।
আহনাফ সাহেব মুখ হাড়ি করে বসে থাকলেন। তবে উনি উনার সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। আর যাই হোক মেয়েকে কোন ভুল সিদ্ধান্ত উনি নিতে দেবেন না। হয়তো আবেগের বসে এসব বলছে অনন্যা। ঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত অনন্যা নিবে এটুকু বিশ্বাস উনার আছে৷
আলোচনা বেশিদূর আর এগোলো না। মাঝপথে ভাঁটা পড়ল। উনারাও উঠার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়লেন। বিদায়ের বেলায় ইমতিয়াজ কেবল বললেন,
” চিন্তা করবেন না। নিশ্চিন্তে থাকুন। অঙ্কন ফিরে এলে একটা ব্যাবস্থা নেয়া হবে।”
★★★★★★
অঙ্কন পুল সাইডে বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেলসিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। চেলসিয়া বেশ টাইট একটা শার্ট পড়েছে সামনের বোতাম খোলা। সরাসরি তাকালে যে কারো চোখেই ক্লিভেজ দৃশ্যমান হবে। নিচে টাইট জিন্স৷ চুলগুলো উঁচুতে বাঁধা। চোখে সানগ্লাস। চেলসিয়ার চোখেমুখে খুশির আভা জ্বলজ্বল করছে। এতদিন পর অঙকন তাকে ডেকেছে। নীরবতা ভেঙ্গে চেলসিয় বলল,
” কী হলো কিছু বলো।”
” তোমাকে দেখছিলাম।”
চেলসিয়া খুশি হয়ে বলল,
” কী দেখছো!”
” এই যে, ঘটে বুদ্ধি ছাড়া কেবল ফিগার দেখালেই উদ্দেশ্য হাসিল হয়না। সবাই পাগল হয়ে যায়না।”
” মানে কী!”
” এই যে অতি বাড় বাড়তে নেই। যাই হোক চেলসিয়া তুমি কিন্তু কাজটা খারাপ করনি। ছবিটা কিন্তু জোশ হয়েছে। ফটোগ্রাফারের নামটা কী?”
” কোন ফটোগ্রাফার! কিসের ছবি।”
অঙ্কন পেপার কাটিংটা চেলসিয়ার মুখের উপর ছুড়ে মারে।
চেলসিয়া ঢোঁক গিলে সামনে তাকায়।
” আমাদের হানিমুনটা কিন্তু জোশ হয়েছে। আমার সুইটহার্ট অনন্যাকে এতকাছে পাব স্বপ্নেও ভাবিনি। তুমি ঠিক বুঝে গেছ। না ঘটে বুদ্ধি আছে তবে কূট বুদ্ধি।” কথাটা বলেই ফিঁচেল হাসল।
” অঙ্কন তুমি কিন্তু আমাকে অপমান করছো!”
” রিয়েলি! তুমি অপমান বুঝো। ওহ সরি তোমাকে তো থ্যাংকস দেয়া উচিৎ। উফ্ ভুলেই গিয়েছিলাম। ইশ্ তুমি আমার বউকে মদ খাইয়ে যা ভালো কাজ করেছিলে। আমাকে সেদিন যেসব মোমেন্ট উপহার দিয়েছে আমি সারাজীবনেও ভুলতে পারবনা। তোমাকে আজীবন থ্যাংকস চেলস।” কথাটা বলেই অঙ্কন ধাক্কা দিয়ে চেলসিয়া সুইমিং পুলে ফেলে দেয়। যারপরনাই সে হতভম্ব।
ঠিক সেই মুহুর্তে রিচার্ড এসে দাঁড়ায়। বেশ কিছুদিন যাবৎ অঙ্কন খেয়াল করছিলো সে চেলসিয়ার সাথে বেশ ঘেঁষাঘেঁষি করার চেষ্টায়।
তাকে দেখেই সে সহাস্যে বলল,
” চেলসিয়া ওয়ান্ট’স অ্যা সুইমিং পার্টনার..”
অঙ্কন কথা শেষ করার আগেই রিচার্ড নীল জলে গ্রীক দেবতার মতো ঝাপিয়ে পড়ে।
” ইয়েস! আই ডু…..”
চেলসিয়ার চিৎকার অঙ্কনের কানে যতবার আসছে ততবার সে মুখ ছাপিয়ে হাসতে লাগল।
চলবে…