চাঁদের_আলোয়_জোছনা_ভাঙ্গে পর্ব ৫৬

0
968

চাঁদের_আলোয়_জোছনা_ভাঙ্গে পর্ব ৫৬
লেখা আশিকা জামান

তখন সন্ধ্যে! কনে দেখা আলোর সমাপ্তি বোধ হয় কিছুক্ষণ আগেই ঘটেছে। কৃষ্ণচূড়া গাছের মগডালে বসা জোড়া শালিকের কিচিঁরমিচিঁর থেমেছে। হয়তো নীড়ে ফিরেছে। নিস্তব্ধতা যেন নেমে আসলো বলে! শখের দোলনায় দোল খেতে খেতে স্বপ্নে বিভোর অনন্যার ভাবনঘরের দুয়ারে হানা পড়েছে। গোটা দু’দিন পর বাবা তাকে ডেকেছে। পড়িমরি করে সে দৌড় লাগিয়েছে। সেদিন এয়ারপোর্টে বাবা তাকে নিতে আসেনি এটা অবিশ্বাস্য! তবুও এটাই ঘটেছে। আরও আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো এই প্রথম বাবা তার সাথে দু’দিন কথা না বলে থাকলআ। আর মা, তার তো উৎসুক হয়ে এটা সেটা জিজ্ঞেস করে করে অনন্যার মাথা খাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেসব একদমই হলোনা। এই প্রথম মায়ের অতিকথন নামক ব্যামোটাকে সে ভীষণ ভীষণ পরিমাণে মিস করল। ইচ্ছে করছিলো মায়ের আঁচলের তলায় লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে। কিন্তু সেসব হলোনা। হলোনা! তার আর আগের অনন্যার হয়ে উঠা হলোনা! সে এখন বদলে গেছে। বদলে গেছে তার পৃথিবী।

” মৌমিতা ম্যামের ফোন ধরছো না কেন!” আহনাফ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল।

অনন্যা চাঁপা অভিমানে কুঁকড়ে গেল। কী বলবে বুঝতে পারলনা। চুপ করে রইল।

” চুপ করে রইলে যে, কী সিদ্ধান্ত নিলে আমাদের জানাও।” আহনাফের শান্ত শিষ্ট প্রশ্ন।

” কী ব্যাপারে!” এই প্রথম অনন্যা মুখ খুলল।

” তোমার নিজের ব্যপারে! তোমার জীবন তোমার সিদ্ধান্ত, ইজ ইট!” গলাটা হঠাৎ অভিমানী হয়ে উঠে।

” বাবা, আমি এখন পর্যন্ত নিজের কোন সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েছি! নেইনি! তোমরা যেমন আমার মতামতের গুরুত্ব দাও তেমনি তোমাদের মতামতের গুরুত্ব আমার কাছে অনেক অনেক ইম্পোর্টেন্ট।”

” তা বললে তো হচ্ছেনা। তুমি এখন যথেষ্ট বড় হয়েছো। নিজের খেয়াল খুশিমতো চলতে শিখেছো। আমাদের তো তোমার মতামতকেই এখন সবচেয়ে বেশি প্রায়োরিটি দিতে হবে।”

” বাবা, লেট মি এক্সপ্লেইন প্লিইজ! আমাকে এইভাবে ভুল বুঝোনা। অন্ততঃ তুমি! মানছি আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি জানতাম অঙ্কন নেপালে আছে তবুও জেনেশুনে সেখানেই গিয়েছি। বাবা, আমি ওঁকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি…”
কথা বলতে বলতে অনন্যার গলাটা ধরে আসে।

” তা গিয়েছিস, বেশ করেছিস। এটা নিয়ে
মেয়েকে এত কথা শোনানোর কি আছে?” আয়েশা হঠাৎ মেয়ের পক্ষই টানলেন।

” অবশ্যই বেশ করেছিস। ভালোবাসায় হিতাহিতজ্ঞান লোপ পেয়েছিল যার দরুন মিডিয়া এমন নিউজ কাভার করল তোমরা বুঝতেও পারলেনা। ভালো করেছো৷ আমি তোমাকে অনেক বিচক্ষণ ভাবতাম। আর তুমি কিনা!… ”
আহনাফ কথাটা শেষ করতে পারলনা। অনন্যা মুহুর্তেই আকুলিবিকুলি করে উঠে,
” বাবা, নিউজে যা লেখা হয়েছে এমন কিছুই ঘটে নাই।”

” সেটা আমি তোমার বাবা, বিশ্বাস করলেও বাকিরাও কি করে নিবে।”

” সরি বাবা৷ ”
অনন্যা নতমুখে কিছুক্ষণ বসে থেকে হঠাৎ বাঁকা চোখে তাকায়। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠে,
” বাবা, আমি ইউ এস এ যাচ্ছিনা। তাই বিষয়টা লুকিয়েছি। এরজন্য আবারও সরি।”

আহনাফ সাহেব লাফিয়ে উঠেন। তাল সামলাতে না পেরে চেয়ারটাও ক্যাঁত ক্যাঁত করে দুলে উঠে।
” অনন্যা নির্বুদ্ধিতার সীমা তুমি ছাড়িয়ে যাচ্ছো। এতবড় সুযোগ হেলায় হারাবে! হ্যাভ য়্যু গন ম্যাড! এতবছর পাগলের মতো খেটেছো কেন? এইরকম বোকামো করার জন্য।”

অনন্যা দু’চোখে নোনা জলের লহর বইছে। আহনাফ চৌধুরী মুখ চুন করে বসে থাকলেন। আয়েশা না পেরে বলেই বসল,
” যেতে চাচ্ছেনা, যাবেনা। মেয়ে বিয়েসাদী করে থিতু হতে চাইছে আর তুমি কিনা তাকে বিদেশ বিভূইয়ে পাঠাতে মরিয়া হয়ে পড়েছো। কেন গো আমার ছেলেকে তো মনে চাইলেই দেখতে পারিনা। এখন মেয়েটাকেও দূরে সরাতে হবে৷ না হলে তো তোমার শান্তি হচ্ছে না।”

” বোধ বিবেচনা তো মানুষ মায়ের থেকেই পায়। এতদিন না আমি ঠুলে পরে ছিলাম। কেমন বুঝতে পারিনি, ভেবেছিলাম মেয়েটা অঅন্ততঃ বুদ্ধিমতি, বিচক্ষণ। ”
আহনাফ নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।

★★★★★★

ভর সন্ধেবেলায় কলিংবেলের শব্দে তারান্নুম বিরক্ত হয়। নিনিত টিভি দেখছে। শব্দটা কানে বাজছে। মেয়েটা কি শব্দ শুনতে পাচ্ছেনা। কি জানি কি হয় মেয়ের কে জানে! ইদানীং প্রায়ই মনমরা চুপচাপ।
পা টিপে টিপে উঠে সে সদর দরজার কাছে এগোয়। নিনিত নেই ঘরে। গেল কোথায়।
” আরে সাইমুন যে! এসো ভেতরে এসো।”

সাইমুন মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকে। পেছনে তার মা সাজেদা৷ তারান্নুম খেয়াল-ই করেনি।
” আরে, আপা যে! আমিতো খেয়ালই করিনি। ইদানীং চোখটা বড় খারাপ হয়েছে। চশমায় কাজই করছেনা। তা ভাবি খবর দিয়ে আসবেন না।”

” আপনার মেয়ের বিশ্বাস নেই খবর দিয়ে আসলে নির্ঘাত পালাবে।”
কথাটা বলেই সাইমুন জিভ কাটে।

তারান্নুম আড়চোখে তাকিয়ে বলে,
” ওঁ কি কথা! কিছু কি হয়েছে।”

সাজেদা সহাস্যে বললেন,
” সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে আপা। সেজন্যেই তো খবর না দিয়ে আসা৷”

তারান্নুম ঘাবড়ে যায়৷ সাজেদা সোফায় বসতে বসতে বলল,
” অমন ঘামছেন কেন! ঘাবড়াবেন না! এই দেখুন কেমন চমকে দিলাম। খবর দিয়ে আসলে কি এই চমকানো মুখটা দেখতে পেতাম।”

তারান্নুম মৃদু হাসে। সাইমুনের মা এখনো সেই আগের মতোই রসিক।
সাইমুনের উৎসুক দৃষ্টিতে আশপাশে তাকানো দেখে সে বলে,
” নিনিত, ঘরেই আছে মনে হয়। যাও না দেখা করা এসো।”

সাইমুন এক আকাশ সাহস স্বঞ্চয় করে ঘরের দিকে আগায়।

ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নিনিত নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে। আপাতত কিছুক্ষণের জন্য হলেও সে নিজের জগতে ডুবে থাকবে। এই সময়টা একান্ত তার। কারো সাধ্য নেই এই নীরবতা ভঙ্গ করার এমনটাই প্রতিজ্ঞা ছিল।
কিন্তু হঠাৎ কোমড় জুড়ে শীতল স্পর্শ অনুভব করে। তাতেও সে ভ্রুক্ষেপহীন। নাকের জলে চোখের জলে এক করে বিড়বিড় করে বলতে লাগল,
” এখানেও হ্যালুসিনেশন! সাইমুন আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। নিজেকে তো গুটিয়েই নিয়েছি তবুও শান্তি পাচ্ছিনা। কালকেই সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে যাব।”

হঠাৎ কানের কাছে উষ্ণ নিঃশ্বাস। চমকে উঠে পেছনে তাকায়। সাইমুন দ্রুত সামনে থেকে তাকে জাপটে ধরে।
” সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে যেতে হবেনা। আমার এমন পাগল বউই চাই।”
কথাটা বলেই ললাটে ছোঁয়ায় উষ্ণ অধর।

নিনিতের আবেশে চোখ বুজে আসে। পরক্ষনেই দূরে সরে যেতে চায়। ছটফট করে উঠে। সাইমুনের বুকের উত্তাপকে নিমিষেই অগ্রাহ্য করে সে সরে যায়।
” তুই এখানে! কি করে এলি।”

” পা দিয়ে হেটে হেটে। ”

” কেন এসেছিস!”

” আমার লক্ষ্ণী বউটাকে দেখতে।”

” এই তুই যাবি! ফালতু কথা বলবিনা।”

” ফালতু কথা সাইমুন বলেনা। যা ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখ তোর শ্বাশুড়ি এসেছে।”

নিনিত মুখ চুন করে বের হয়ে যায়। ওর ঘর থেকে উঁকি দিয়ে দেখে সত্যিই সাজেদা আন্টি আর তার মা গলা জড়িয়ে ধরে কথা বলছে। কী বলছে সে জানেনা। তবে তার অকারণ ভয় হচ্ছে।

” ওঁখানে কি কথা হচ্ছে জানিস !”
কখন সে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে নিনিত জানেনা। ভাবলেশহীন ভাবে তাকায় । এভাবে তাকাতে দেখে সাইমুন হাসতে হাসতে বলল,
” আমারতো আর তর সইছেনারে, কবে যে তোকে বউ সাজে দেখব। কিরে আমার জন্য বউ সাজবিনা?”

” মানে!” নিনিতে গলায় ঝাজ।

” আমার লজ্জা লাগছে। কী করে বলি!”

” তোর লজ্জা আছে। তোরে দেখেতো লজ্জাও লজ্জা পায়।” নিনিত ভ্রুকুটি করে বলল।

” খালি তুই-ই লজ্জা পেলিনা। আচ্ছা আমাদের বাসর রাতেও কি তুই এমন কাটখোট্টাভাবে তাকাইয়া থাকবি। আমাকে দেখা লজ্জা পাবিনা।”
নিনিত রাগে সাইমুনের হাত কামড়ে ধরে।

সাইমুন লাফায়। অস্ফুট স্বরে ‘উঁহু’ করে উঠে।

” যতবার ফাজলামি করবি ততবার কামড় খাবি।”
কথাটা বলে নিনিত সাইমুনকে ছেড়ে দেয়।

” ফাজলামো কই করলাম। ওদিকে তোর আর আমার বিয়ের কথা হচ্ছে। এদিকে তুই হবু বরের হাতে কামড় দিচ্ছিস।”

নিনিত আকস্মিকভাবে বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সাইমুন বকবক করেই যাচ্ছে,
” নিনিতের বাচ্চা নিনিত। ওহ্ সরি নিনিতের বাচ্চা তো হবে অন্যকিছু। যাই হোক সেসব এখন ভাবছিনা। আগে বাচ্চার মাকে সাইজ করে নেই। নিনিত এই কামড়ের প্রতিশোধ আমি অন্যভাবে তুলব শোধে আসলে। দেখবি আর লজ্জায় লাল হবি। মিলিয়ে নিস না হলে ন্যাড়া মাথায় ঘুরব।”
চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে