চাঁদের_আলোয়_জোছনা_ভাঙ্গে পর্ব ৬৩
আশিকা জামান
ব্যস্ত রাস্তার বুক চিরে সাঁই সাঁই করে এগিয়ে চলেছে গাড়ি। চারপাশে কেবল গাড়ি, রিক্সা, লোকজন কোলাহল, বাড়ি ফেরার তাগিদ। অন্বেষা এক ধ্যাণে তাকিয়ে আছে।
অনিক একটা বড় রাস্তার মাথায় এসে খেঁই হারিয়ে ফেললো রাস্তাটা দুই দিকে ভাগ হয়ে গেছে। এক্সাক্টলি কোনদিকে মোড় নিবে সেটাই বুঝতে পারছে না। অন্বেষার মনোযোগ আকর্ষণের জন্য গলা খাঁকারি দেয়। কিন্তু সে নির্বিকার।
” শুনছেন, অন্বেষা! শুনছেন?”
মুহুর্তেই অন্বেষাকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে দেখে সে বলল,
” কোন দিকে যাব?”
অন্বেষা ইশারায় ডানদিকে যেতে বলে। অনিক গাড়ি ঘুরাতে ঘুরাতে বলল,” এখান থেকে আর কতদূর?”
” এই-তো প্রায় এসে পড়েছি।” অন্বেষা মিষ্টি করে হাসলো।
” আপনি মনে হয় আমার সাথে আনকম্ফোর্টেবল ফিল করছেন? তখন থেকে দেখছি! ”
” না সেরকম কিছু না। একটু চিন্তিত তাই হয়তো এরকম মনে হচ্ছে।”
” একদম চিন্তা করবেন না। আই থিংক আপনার মা সেইফ জোনেই আছেন।”
অন্বেষা মৃদু হাসে। অনিক কিছুক্ষণ থেমে আবার বলল, ” একটা কথা বলব! ”
” হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।”
” আজকের এই শান্ত স্বভাবের অন্বেষার সাথে সেদিনের সেই ডেস্পারেট অন্বেষার কোন মিলই যে খুঁজে পাচ্ছিনা। ওটা আপনি ছিলেন তো! নাকি আপনার আইডেন্টিক্যাল টুইন!”
কথাটা বলেই অনিক হাসলো।
সেই হাসিটা যেন অন্বেষার হৃদয় ছুঁয়ে গেল। তবে বিড়বিড় করে বলল, ” অন্যের বয়ফ্রেন্ডের জন্য ডেস্পারেট হয়ে কী লাভ! আমার স্বভাব ভালো অন্যের জীনিসে নজর দেই না।”
অন্বেষার সেই বিড়বিড় করে বলা কথাটা অনিক কিছুটা শুনতে পায়। চোখ কপালে তুলে অনিক বলল, ” কার বয়ফ্রেন্ড, কিসের নজর কী বলছেন এগুলো বুঝলাম না।”
” কিছু না৷ ধূর কী বলতে কী বলি এসব শুনা লাগবে না।”
অনিক অধৈর্য্য চোখে তাকায়। সেই দৃষ্টি অনুসরণ করে অন্বেষা নিষ্পলক চেয়ে থাকে। এরপর বাহিরের দিকে তাকিয়ে আৎকে উঠে বলল,” আরে গাড়ি ঘুরান, বাড়িটা তো পেছনে ফেলে এলাম।”
★★★★★
গাড়িটা অনন্যাদের বাড়ির সামনের রাস্তায়। অনন্যা আড়চোখে অঙ্কনের দিকে তাকায় এখনো সে নির্বিকারভাবে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।
অনীলা বাড়ি ফিরে এসেছেন। এসেই উনি অঙ্কনকে পাঠিয়েছেন অনন্যাকে বাসায় পৌছে দিতে। যদিও অনন্যা চেয়েছিল একাই যেতে তবে উনি শুনেন নি।
” অঙ্কন, চলো বাসায় যাই। তুমি গেলে সবাই খুশি হবে।”
অঙ্কন তাচ্ছিল্য ভরে হাসলো। অনন্যা অবাক চোখে তাকায়। কিছুক্ষণ চুপচাপ হজম করে বলল,” অঙ্কন! তাকাও আমার দিকে। তাকাও বলছি! তাকাও।”
অঙ্কন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। অনন্যা দু’হাতে অঙ্কনের অবনত মুখটা টেনে তুলে। কিছুক্ষণ নীরব দৃষ্টি বিনিময়ের পর অনন্যা আবার বলল,
” তোমাকে এভাবে দেখতে আমার ভালো লাগছে না। প্লিজ বিহেভ ইউর সেল্ফ প্লিইজ!”
অনন্যার চোখে করুণ আকুতি! অঙ্কন চোখে চোখ রাখে আবার নামিয়ে নেয়।
” আমি বুঝতে পারছি সামথিং রং! কিছু একটা ঠিক নেই। যেটা তুমি আমার কাছে শেয়ার করতে চাইছো না। আমি জানিনা কেন তুমি এরকম টা করছো। তবে তোমার কোন পাস্ট জানার প্রতি আমার তেমন আগ্রহ নেই। সেটা যা-ই হোক না কেন আমি তোমাকে ভালোবাসি এর চেয়ে বড় কোন সত্যি নেই। তবে তুমি যদি আমার কাছে পুরো ব্যাপারটাই ক্লিয়ার করতে তবে তোমাকে বুঝতে একটু সুবিধে হতো!”
অনন্যা আরও কিছু বলতে চাইছিলো কিন্তু তার পূর্বেই অঙ্কন মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল,
” কেন এখন বুঝতে কী খুব অসুবিধে হচ্ছে।”
অনন্যা থতমত খেয়ে বলল, ” না মানে আমি সেরকম কিছু মিন করিনি। তোমাকে আসলে বুঝাতে পারছি না, আগে পুরো কথাটা শোন।”
” কী শুনবো আমি! আমাকে বুঝতে হলে যদি আমার অতীত জানতে হয় তবে আমাকে বুঝার দরকার নেই। নেই কোন স্যামপেথির প্রয়োজন। যে অতীত আমি নিজে মানিনা, মানতে পারিনা। মুখে আনতেও ঘৃণা জন্মে নিজের প্রতি, তা শেয়ার করা আমার পক্ষে সম্ভব না। মাফ চাইছি। নাথিং টু সে। প্লিজ লিভ মি এলোন!”
অঙ্কন মুহুর্তেই রাগে অন্ধ হয়ে অনন্যার সাথে উচ্চ্ববাক্যে কথা বলতে লাগল।
অনন্যা ধৈর্য্য ধরে চুপ করে থাকলো। অঙ্কন ওঁকে চুপ থাকতে দেখে দ্বিগুণ রাগে স্থান ত্যাগ করতে উদ্যত হয়। অনন্যা কেবল নিষ্পলক চোখে পথের দিকে চেয়ে থাকলো।
মুহুর্তেই ব্যাস্ত রাস্তায় সুনসান নীরবতা নেমে এলো। মনের আকাশে অহর্নিশ ডানা ঝাঁপটাতে থাকা রঙ্গিন পাখিগুলোও তাদের বিচরণ বন্ধ করে দিয়ে বিশালাকার তালা ঝুলিয়ে দিয়ে গেল। এ তালা ভাঙ্গার সাধ্য কার?
” অনন্যা!, দাঁড়িয়ে আছিস কেন?” ধীর পায়ে কখন অনিক এসে দাঁড়িয়েছে অনন্যা জানে না।
এতক্ষণ এই মান-অভিমানের কিয়দংশ ছাদে দাঁড়িয়ে থেকে অনিকের অবলোকন করার ভাগ্য হয়েছে। বোনকে উদাস হয়ে পথের পানে তাকাতে দেখে অনিক নেমে আসে।
” ভাইয়া, চারপাশটা যখন অন্ধকারে ছেঁয়ে ধরে তখন এক চিলতে আলো কী অন্ধকারের বিরুদ্ধে লডাই করার ক্ষমতা রাখে! কার শক্তি বেশি আলো না-কি আধারঁ!” নিকষ আধাঁরে অবগাহন করতে করতে হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে অনন্যা প্রশ্ন করলো।
প্রশ্নটা শুনে অনিক হকচকিয়ে গেলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলল,
” ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে হঠাৎ মোমবাতির আলো কিন্তু চারপাশটা আস্তে আস্তে উজ্জ্বল করার ক্ষমতা রাখে। তেমনি মানুষের মনের অন্ধকার কিন্তু এক চিলতে ভালোবাসার কাছেই হেরে যায়। অন্ধকার যত বিস্তৃত-ই হোক না কেন আলোর কাছে তা ম্রিয়মাণ!
ভালোবাসা সহজ কিন্তু ধরে রাখাটা খুব কঠিন রে ময়না ! ভালোবাসাটাকে জীবনের শেষ দিন অব্দি যারা টেনে নিয়ে যেতে পারে তারাই তো প্রকৃত প্রেমিক।” অনিক থামলো কিছুক্ষণ। এরপর বোনের উন্মিলিত চোখের দিকে তাকায়। আর ভাবে জীবন যেন এক আস্ত জটিল সমীকরণ! একটা দীর্ঘশ্বাস আছড়ে পড়ে শূন্যে মিলিয়ে যায়।
” চল, বাসায় চল। আকাশে মেঘ করেছে আবার বৃষ্টি নামলো বলে!” অনিক অনন্যাকে টেনে টেনে বাসার গেটের ভেতর ঢুকে যায়।
★★★★★
বাসায় ফিরে অনীলার স্বাভাবিক রুপ দেখে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। অনীহা, তানভীর এসেছে তাই রান্না বান্নায় কিছুটা সময় দেন উনি। ওঁদিকে অঙ্কন বাসায় ফিরে নিজের ঘরে বসে আছে। তার প্রচন্ড মাথা ধরেছে। ইচ্ছে করছে এখনি শুয়ে ঘুমাতে। কিন্তু সেই সুযোগটা আর পাওয়া যাচ্ছেনা তানভীর, অন্বেষা, অনীহার যন্ত্রণায়। ইচ্ছে ছিল ডিনারটাও স্কিপ করে যেতে কিন্তু আজ আর অনীলা ছেলেকে ছাড়বেন না এটুকু অঙ্কণ বেশ ভালো করেই জানে।
” ভাইয়া, মা মেবি কালই যাবে অনন্যা আপুর বাসায়। তোমার এই বৈরাগ্য আমাদের আর ভালো লাগেনা। তাই না তানভীর তুমি কিছু বলো!”
অনিহা কোন কথা খুঁজে পাচ্ছে না কী বলবে! এদিকে অনীলা পই পই করে বলে দিয়েছে অঙ্কন যেন একদম একা একা না থাকে। তাই কথার মাঝখানে তানভীরের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে।
তানভীর আড়ঁচোখে অঙ্কনের রক্তিম চোখের দিকে তাকিয়ে থেমে যায়। এর মাথা ভালোই গরম আছে। থাক বাবা, সে কিছু বলবে না।
” হ্যালো!”
অপরিচিত নম্বর কিন্তু গলাটা পরিচিত অনিক স্মিতহাস্যে বলল,
” জি, শুনতে পাচ্ছি! অন্বেষা বলছেন এম আই রাইট!”
” চিনলেন কী করে!”
” আরেকদিন দেখা হলে বলবো। আপনাদের বাসার খবর বলুন। কী অবস্থা ওঁদিকে?”
” নো ক্যাটক্যাট সব ঠিক ঠাঁক।”
অন্বেষার বলার ভঙ্গি শুনে অনিক হো হো করে হাসলো।
” হাসছেন যে! হাসির কথা বলেছি নাকি! ”
” আচ্ছা আর হাসছি না এবার বলুন কী বলবেন?”
অন্বেষা ঠোঁট কামড়ে ধরে। এবার তার রাগ লাগছে। যেঁচে ফোন যে কেন করতে গেল। ধুর।
” আসলে ফোনটা আমি আপনাকে করি নাই মানে..”
অনিক মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল,
” নাহ্ ফোনের মালিক যেহেতু আমি সেহেতু আপনি আমাকেই করেছেন এটা ভাবা কি খুব বেশি ভুল।”
” ফোনটা অনন্যা আপুকে দিন। উনি ফোন তুলছে না তাই আপনাকে ফোন করা।” অন্বেষা প্রচন্ড রাগে দুম করে বলে দিল।
অনিক কিছু বলল না ফোনটা নিয়ে অনন্যার কাছে যায়। সে দিব্যি ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে। যা বোঝার বোঝে যায় তবুও অনন্যাকে ডাকল, ” তোর ফোনে ফোন এসেছে ধরছিস না কেন? এই নে অন্বেষা কথা বলবে! ”
” ফোন এসেছে! আমার ফোনে.. ” অনন্যা আকাশ থেকে যেন পড়লো। পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে নিয়ে সে মুচকি হেসে ফোন কানে তুলে নেয়।
” এই তুমি আমার ভাইয়াকে কী করেছো বলোতো রাম গরুরের ছানার মতো মুখ বানিয়ে রেখেছে! এক্ষুনি আমার ভাইয়ার মুড ঠিক করে দাও বলছি! কীভাবে কি করবে জানি না। নাউ লেট’স স্টার্ট!” অন্বেষা একদমে কথাটা বলেই নিজেই হাসতে লাগল।
সেই হাসিতে অনন্যাও যোগ দিয়ে বলল, ” আমি তোমার ভাইয়ার নম্বর ডায়াল করছি। আর ফোনটা আমার ভাইয়ার কাছে দিয়ে দিলাম।”
অনন্যা ফোনটা অনিকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়।
” ফোনটা অনন্যার কাছে না করে অনিকের কাছে করলেও সে কিছু মনে করতো না। আর এই মিথ্যেটাও বলতে হতো না।” অনিক মৃদু হেসে বলল।
অন্বেষা লজ্জা পেয়ে যায়। ধুর বুঝে গেল। রাগে দুঃখে, লজ্জায় ফোন কেটে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে।
” ধুর! ফোনটাই কেটে দিল। আগ বাড়িয়ে কেন যে বলতে গেলাম।” আপনমনে নিজেই কতক্ষণ বিড়বিড় করলো অনিক।
চলবে…
আর সম্ভবতঃ ২/১ পর্ব এরপরই এই গল্পের প্রথম খন্ড শেষ হবে।
সবাই ফিডব্যাক দিবেন । এটা অনেক বড় গল্প আমি গল্পটা লিখে মজা পাচ্ছি না কষ্ট করে লিখতে হচ্ছে। খুব বেশি ভুল না হলে আপনারাও মজা পাচ্ছেন না৷
Khub sundor hycha golpo ta… pls happy happy ending deban
Oneek shundor golpota.
golpota osadharon
Amar khub valo lage ata. Next joldi diben pls.
Nxt part ki diben na?
Khub sundor hoyeche golpo ta