চাঁদের_আলোয়_জোছনা_ভাঙে পর্ব ৫৯

0
879

চাঁদের_আলোয়_জোছনা_ভাঙে পর্ব ৫৯
লেখা- আশিকা জামান

সিয়েলো রুফটপ রেস্টুরেন্টে দাঁড়িয়ে নীলচে আকাশের দিকে একমনে তাকিয়ে আছে অনিক। সাদা তুলোর মত মেঘগুলো যেন দল বেধে ভেসে বেড়াচ্ছে ঈষৎ হলুদাভ চাঁদের চারপাশে। জোছনা ভরা রাতের আকাশ যেন এক অন্যরকম ভালোলাগার আবহ তৈরী করেছে। চারপাশে ঝিরিঝিরি বাতাস শরীরে কাঁপন ধরিয়ে দিলেও বেশ লাগছে। লাল, নীল স্পট লাইটের মৃদু আলো ভেদ করে মেধা পাশে এসে দাঁড়ায়।

” কীরে বলেছিলাম না তোর ভালো লাগবে!”

অনিক পেছন ঘুরে তাকায়। মেধার শ্যামবর্ণ মুখে স্পট লাইটের আলো পড়ায় একপার্শ্ব লালচে রঙ ধারণ করেছে! ধারালো নাক আর আয়তাকার চোখে নীল আলোর ঝলকানি। চোখ মুখ দেখলেই বুঝা যায় সবসময় মুখিয়ে থাকে কিছু না বলা কথা বলার জন্য। ওর কাছে মনে হয় এটাই ভালো! বললেই’তো সব শেষ! সেই বিব্রতকর পরিস্থিতি!

” কোথায় হারিয়ে গেলি! এতোটাই মুগ্ধ হয়েছিস যে কথাই বলতে পারছিস না তাই না!” অনিককে চুপ থাকতে দেখে অস্থিরমতি মেধা বলল। এটা তার চিরাচরিত স্বভাব। ওপাশের মানুষটার সম্পূর্ণ মনোযোগ না পেলে অস্বস্তি হয়। বড় অস্বস্তি।

” অসাধারণ! এক কথায় অসাধারন। উপর থেকে ঢাকা শহর এমন মাইন্ডব্লুয়িং ভিউ! সামনে রমনা, ইন্টারকন্টিনেন্টাল,ঢাকা ইউনিভার্সিটি, শাহবাগ থেকে ফার্মগেট এমনকি গুলশান পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। থ্যাংকস মেধা গুগলিকে এমন সুন্দর যায়গায় নিয়ে আসার জন্যে।”

অনিককে নিজের ফর্মে ফিরে আসতে দেখে মেধার এবার বেশ লাগছে! হাসতে হাসতে বলে,
” হইছে! আর ঠ্যাং খাওয়াইতে হইবে না! বিলটা ঝামেলা বিহীনভাবে পে করলেই হবে।”

” আমাকে কী সেই আগের অনিক পাইছিস! সবাই খায়া দায়া আমার ঘাড়ে বিল ফালাইয়া চম্পট!” অনিক হো হো করে হেসে উঠে।

” তাহলে তুই বিল দিবিনা তাই-তো!” মেধা ভ্রু কুচঁকে বলল।

” সেটা, কখন বললাম! চল আগে পেট গরম করি পরে বিলের চিন্তা আয় তো!” অনিক মেধার হাত টেনে ওদের জন্য বরাদ্দকৃত চেয়ার টেবিলে বসে পড়ে।

মেধা একধ্যাণে ওঁদের যুক্ত হাত যুগলের দিকে তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে এই জগৎ-এ সে আর নেই! অনিক মুহুর্তেই হাত সরিয়ে নেয়।
এদিকে ওঁদের অর্ডারকৃত খাবার এসে হাজির।
হেজেল নাট ফ্রাপে, চিকেন স্টেক, চিজি চিকেন সব মেধার চয়েজ!

সুইং চেয়ারে বসে দুঃখী দুঃখী ভাব নিয়ে বসে আছে অন্বেষা ! ইচ্ছে করছে হাত-পা ছুড়ে কাঁদতে! তাকে স্বান্তনা দিতে উঠে পড়ে লেগেছে দুই বান্ধবী!
” আহারে বাবু, তুই এমন খ্যাপে যাচ্ছিস কেন! চলনা ডিনারটা শেষ করি! বিশ্বাস কর পেটে গরম হইলে এইসব ভালুপাশা ঠালুপাশা কিছুই না! উঠ উঠ উঠ!”
স্নিগ্ধা আর জেসমিন দুইজন দুইহাত ধরে অন্বেষাকে উঠানোর চেষ্টা করে।

” তোদের কী আমাকে পেটুক মনে হয়! আমি পেটুক! ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড আমি জীবনে প্রথম কারো প্রেমে পড়েছি! লাভ এট ফাস্ট সাইট বুঝস! এইটুকু হলে ঠিক ছিলো! কিন্তু প্রেমের আগেই ছ্যাঁকা বুঝস! ছ্যাঁকা!
দেখ কেমনে হাত ধইরা টাইনা লইয়া গেল। উফ্ কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে। মনে হয় বেডির চুল ছিড়ি।”

” আহা! বেডির চুল ছিড়ি!” স্নিগ্ধা স্বগতোক্তি করে উঠলো। “অন্য বেডির বয়ফ্রেন্ডের প্রেমে পড়স শাকচুন্নি! চুল তোমার ছিড়ব ওই বেডি জানলে!”

” আহা! অন্বেষা উঠ-তো! দশটা বাজতেছে বাসায় যাইতে হবে। আর তোর যদি আন্টির প্যানপ্যানানি শুনতে মজা লাগে’তো সারারাত বইসা থাক!” জেসমিন রাগী গলায় বলে উঠল।

অন্বেষা, আরেকবার অনিকের দিকে তাকায়। হেসে হেসে খাচ্ছে খাওয়ার স্টাইলটা দেখলেও কলিজায় লাগে! খাওয়া বাদ দিয়ে একধ্যাণে সে সেদিকেই তাকিয়ে থাকল!

★★★★

লুকিং গ্লাসে অনন্যাকে দেখতে পেয়ে অঙ্কন বিস্মিত! সাথে একরাশ ভালোলাগাও চারপাশ ঘিরে ধরে। দরজা খুলতে খুলতে বলে,
” তুমি আসবে বলনি’তো!”

” তুমি ঘুমুচ্ছিলে! দরজা খুলতে এজন্যই দেরি হচ্ছিলো তাই না!” প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কাচের গোল টি টেবিলে ব্যাগ রেখে অনন্যা হাত পা ছড়িয়ে সোফায় বসে পড়ে।

অঙ্কন টি-শার্ট এর বোতাম লাগাতে লাগাতে অনন্যার গা ঘেঁষে বসে। ” হ্যাঁ ঘুমুচ্ছিলাম। আমি যে এখানে তোমাকে কে বলল!”

” কে আবার জিহাদ!” অনন্যার সোজাসাপ্টা উত্তর।

” ভালো’তো! তুমি আজকাল আমার উপর স্পাইগিরি করতে জিহাদকে লাগিয়েছ নাকি!
ইদানীং আমার কোন কথা কিচ্ছু শুনেনা উলটা জ্ঞান দেয়। এইগুলা সব তোমার কারসাজি তাই না!” অঙ্কন হাসতে হাসতে বলল।

” কথা না শুনলে তো শাসন করতেই হবে! আমার হয়ে না হয় জিহাদ করুক।” অনন্যা দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে। অঙ্কনের কান এড়ায় না। ইদানীং প্রায়ই কথার মাঝখানে চাপা উদ্বেগ আর দীর্ঘশ্বাসরা হামলে পড়ে। কিছুতেই দমানো যায়না।
অঙ্কন দু’হাতে অনন্যাকে আঁকড়ে ধরে। আর সে বাচ্চাদের মতো বুকে মুখ গুঁজে পরম নির্ভরতায়। হঠাৎ আঙ্গুল ধাবিত হয় অনন্যার প্রতি গুচ্ছ চুলের ফাঁকে ফাঁকে। আবেশে যেন সারা শরীর বিবশ হয়ে আসে । নিস্তব্ধতা নেমে আসে অস্থিরমতি অনন্যাকে আর অনুভব করতে পারেনা সে।

” বাড়ি ফিরে যাও! আন্টি খুব কষ্ট পাচ্ছে অঙ্কন।” অনন্যা হঠাৎ শান্ত গলায় বলল।

অঙ্কন এই প্রসঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছুক নয়। তাই সাবধানে এড়িয়ে গেল।” তুমি আজ আসবে আমি না বিশ্বাসই করতে পারছিনা।”

” আসা হতো না! নিনিতের বিয়ের শপিং-এ আসছি! আন্টি জোর করে পাঠালেন, না করতে পারিনি। মাঝখানে মনে হলো নিনিত আর সাইমুনের মাঝে কাবাব মে হাড্ডি হচ্ছি! তাই তোমার কাছে চলে আসছি।”

” বেশ করেছো!” কিছুক্ষণ থেমে অঙ্কন আবার বলল, ” একটু উঠে বসো! আমি ফোন করে খাবারের অর্ডারটা দিয়ে দেই।”

অনন্যা উঠে বসে না৷ আরও প্রবলভাবে আকঁড়ে ধরে। গলাটা খাদে নামিয়ে বলে,
” ব্যস্ত হয়ে খাবার অর্ডার করতে হবেনা। যা আছে তাই খেয়ে নিব।”

অঙ্কন তীর্যকভাবে তাকায়। অনন্যা হঠাৎ অঙ্কনের নাক চেপে ধরে বলে,
” ওভাবে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই আমি একমুহুর্তের জন্যেও সরতে রাজি নই! আর আঙ্গুলগুলো চুল থেকে সরিয়েছেন কেন!” কথাটা বলেই অঙ্কনের আঙ্গুলগুলো নিজের মাথায় চালিয়ে নেয় সে।

” তোমার ভালো লাগে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে!” অঙ্কন অনন্যার ললাটে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিয়ে বলল।

” ভীষণ। তবে ঘুম পেয়ে যাচ্ছে।” অনন্যার চোখ মুদে আসছে। তাই দেখে অঙ্কন আৎকে উঠার ভাণ ধরে বলল, ” এই না, এখন একদম ঘুমানো যাবেনা। উঠ, নো ঘুম!”

” আচ্ছা উঠতে পারি। না ঘুমোলে কী দেবে তাই বলো!” অনন্যা ভ্রুকুটি করে বলল।

অঙ্কন বড় চিন্তায় পড়ে যায়। কী দেবে! কী দেবে! মাথা চুলকাতে-চুলকাতে বলল, ” ঠিকাছে আমি না হয় তোমায় রান্না করে খাওয়াবো!”

অনন্যা তীক্ষ্ণ চোখে নির্বোধ মানুষটার দিকে তাকায়। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। মনে হয় খাওয়ার জন্য অনন্যা মরে যাচ্ছে! এত সাধ করে বাধা বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে যেন জামাইয়ের হাতে খেতে এসেছে সে! কিন্তু আশ্চর্য কোন রাগ দেখাতে পারছেনা। ভেতর থেকে এক অন্য অনন্যা গলা চড়িয়ে বলল, ” দ্যাটস গ্রেট! তাহলে কী খাচ্ছি!”

” পাস্তা! এটা ছাড়া আর কিছু সম্ভবতঃ পারিনা।” অঙ্কন কাচুঁমাচুঁ করে বলল।

” ঠিক আছে এতেই চলবে!” অনন্যা কথাটা বলেই ব্যাগের চেইন খুলে ফোন হাতে তুলে নেয়। একবার অনিককে ফোন করবে। বাড়ি পৌছে গেছে নাকি এখনো বাহিরে আছে জানলে একটু সুবিধে হয়।

★★★★★

অন্বেষা সত্যি সত্যিই উঠে যাচ্ছে যারপরনাই খাওয়া বাদ দিয়ে স্নিগ্ধা জেসমিন দু’জনেই হতভম্ব। একজন আরেকজনকে খোঁচা মেরে বলল, ” এই ছেমরি কী সত্যিই পাগল হইলোরে! চল ভাগি নির্ঘাৎ এখন চুলাচুলি লাগব।”
” সব দোষ তোর! তুই কেন চ্যালেঞ্জ দিলি। এখন আরেক বেডির বয়ফ্রেন্ডকে প্রপোজ করতে যাচ্ছে কান্ডজ্ঞানহীন মাইয়া। আল্লাহ রক্ষা কর। এই নির্বোধ মাইয়ার উপর সদয় হও।” জেসমিনকে গলা চড়াতে দেখে স্নিগ্ধা চুপ করে। এবার মনে হচ্ছে এইরকম চ্যালেঞ্জ না দিলেই ভালো হতো।

” এক্সিউজ মি!” কানের কাছে মিষ্টি একটা রিণরিণে গলার আওয়াজ শোনা যায়। মেধা, অনিক দু’জনেই খাওয়া ছেড়ে ডানপার্শ্বে তাকাতে বাধ্য হয়।

বোটল গ্রিণ চুড়িদার পড়া বেশ লম্বা গোছের এক মেয়ে দাঁড়িয়ে। বুকের একপার্শ্বে মেঘের মতো কয়েক গাছি চুল পড়ে রয়েছে। তীর্যক নাকে বিন্দু বিন্দু ঘাম। লম্বাটে মুখমন্ডলে দ্বিধা আর সংশয় খেলা করছে। গায়ের রঙ বলা যায় বেশ ফর্সা। গাল দু’টো যেন ক্ষণে ক্ষণে রক্তিম হয়ে উঠছে। এভাবে অনিকের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখাটা মেধার চোখ এড়ায়না।
ওদিকে পটল চেরা চোখের মেয়েটিও বোধ হয় কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল! অনিকের তাই মনে হচ্ছে। দৃষ্টি অবনত করে অনিক প্রশ্ন করল,
” আমাকে কিছু বলছেন..!”
” জ্বি, আসলে আমার ফোনটা খুঁজে পাচ্ছিনা। আমি নাম্বারটা বলছি কাইন্ডলি একটু…..” অন্বেষা ইতস্তত করে বলল।

মেধা তীর্যক চোখে তাকিয়ে আছে। কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই অনিকে বলে উঠে,
” হ্যাঁ, শিউর! আপনি নাম্বারটা বলুন। ”

মুহুর্তেই অন্বেষার ফোনটা বেজে উঠে। অনিক উঠে দাঁড়ায়। ফোন খুঁজার জব্য এদিক সেদিক তাকায়। অন্বেষা সরাসরি সুইং চেয়ারের দিকে ধাবিত হয়। অনিকও পেছন পেছন আসে ফোনটা সেখানেই সযত্নে পড়ে থাকতে দেখা যায়। ফোনটা হাতে তুলে যেন অন্বেষা চোখেমুখে যুদ্ধ জয়ের হাসি খেলে যায়।
” থ্যাংকস! ” অন্বেষা মুখ ফুটে বলে।
অনিক ঠোঁট কামড়ে কুঞ্চিত চোখে তাকায়।
চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে