#চাঁদের_বাড়ি_বহুদূর(৬ষ্ঠ এবং শেষ পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda
পরের দিন সকালে বাসা থেকে বের হলাম মায়াকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে। এরপরে যেটা আমি শুনলাম তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। আমার হাত পা অবশ হয়ে আসছে। আমি যেনো ঠিক মত দাঁড়াতে পারছি না।
এক অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসলো। ফোন দিয়ে বলে আমার মা এক্সিডেন্ট করেছে। লোকটি মেডিকেলের ঠিকানা দিয়ে দ্রুত আমাকে যেতে বললো।
আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মেডিকেলে গেলাম। আমি যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই বাবা সেখানে উপস্থিত। কিন্তু আমি মায়ের কাছে যেতে পারলাম না। অপারেশন থিয়েটারে মাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ এক ডাক্তারের কাছে জানতে পারলাম মায়ের অবস্থা গুরুতর। মাথায় প্রচন্ডভাবে আঘাত পেয়েছে, জ্ঞান তো ফিরছেই নাই,এবং শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। আমি ডাক্তারের কথা শুনে মেডিকেলে মধ্যেই লুটিয়ে পরলাম।
আমার মাথার কাছে মায়া বসে আছে। মেডিকেলের একটা রুমে আমাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। আমি বাবাকে ডাকলাম,কিন্তু তাকে পাচ্ছি না। উঠে বসে তাকে কয়েকবার ফোন দিলাম,সে ফোনটাও রিসিভ করলো না। আমার চিন্তা বেড়েই চলছে। আমি রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। মায়াও আমার সাথে আছে। মায়ার কাছে আমার মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলাম। মায়া আমাকে শান্ত হতে বলে।” মা এখন আইসিউতে আছে। চিন্তা করো না। আল্লাহ তায়ালা সুস্থ্য করে দিবেন।”
আমার গলা শুকিয়ে আসছে, চারিদিক অন্ধকার মনে হচ্ছে। আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। ডাক্তারদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমার মায়ের কাছে যেতে পারবো কিনা। ডাক্তার জানালেন তিনি এখন আইসিউতে অবজারভেশনে আছেন। এই মুহূর্তে কোনো ভাবেই যাওয়া যাবে না।
মায়াকে আমার সাথে দেখে বাবা সম্ভবত আমার সামনে আসছে না। মায়া আমাকে বললো….
– তোমার বাবা সম্ভবত আমাকে দেখে সামনে আসছে না। আমি বরং বাসায় চলে যাই।
– ওকে।
এখন আমার কিছুই ভালো লাগছে না। বাবাকে দেখলাম রিসিপশনের সামনের চেয়ারের এক কোনো বসে আছে। আমি বাবার দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম,তার চোখে পানি। মাথা নিচু করে বাবা নীরবে চোখের পানি ফেলছে। এই প্রথম আমি বাবার চোখে পানি দেখলাম। আগে কখনো আমার এই রাগি বাবার চোখে পানি দেখিনি। তাও আবার আমার মায়ের জন্য কাঁদছে৷ যে মানুষটা সব সময় মায়ের সাথে রাগারাগি করতেন। সেই মানুষটাই আজ মায়ের জন্য কাঁদে। আসলে কাউকে দেখে বুঝার উপায় নেই তার ভেতরটা কেমন,বা ভেতরে কি চলছে। হয়তো বাবা মাকে ভালোবাসতেন,কিন্তু প্রকাশ করেনি। অথবা এটাও হতে পারে এই প্রথম মাকে হারানোর ভয়টা তার ভেতরে কাজ করছে। আমি তার পাশের চেয়ারে বসলাম। আস্তে করে বাবার একটা হাত আমি ধরে বললাম…
– আপনি এভাবে ভেঙে পরবেন না বাবা, দেখবেন মা তাড়াতাড়ি সুস্থ্য হয়ে যাবে।
বাবা আমার কথায় কোনো সাড়া দিলো না। একদম চুপচাপ বসে আছে। আমি বুঝতে পারলাম সে চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করছে। আমি আর কিছু না বলে বাবার কাঁধে হাত রেখে আবারো বললাম…
– প্লিজ শান্ত হোন বাবা।
এইবার তিনি আমাকে উত্তর দিলেন, উত্তরে বললেন…
– সকালে তোর মা যখন বাসা থেকে কোথাও যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিলো তখন ওকে আমি প্রচুর গালাগালি করেছিলাম। কিন্তু তোর মা আমাকে কোনো জবাবই দিচ্ছিলো না। শুধু বললো “আপনি সন্তানের পিতা হতে পারেন নি, সন্তানেরা কি চায় সেইটা বুঝার ক্ষমতা আপনার হয়ে উঠেনি। আমি আবিদের জন্য টাকা আনতে যাচ্ছি। আপনি তো সন্তানকে টাকা দিবেন না। অথচ আবিদই আপনার সকল সমস্যা থেকে কাটিয়ে আপনাকে এই পর্যন্ত নিয়ে আসছে। ছেলেটা এত বছর পরে দেশে এসে যখন আপনার কাছে টাকা চাইলো তখন আপনি তাড়িয়ে দিলেন। আমাকে প্লিজ বাঁধা দিবেন না।”
একটু থমকে গিয়ে বাবা আবারো বললেন..
– তোর মায়ের দিকে তাকিয়ে আজ আমি অনুভব করতে পারছিলাম,তোর জন্য তার ভেতরটা কতটা পুড়ে যাচ্ছে। যে মানুষটা এতদিনে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলেনি,সেই মানুষটা তোর জন্যই আমাকে কথা গুলো বলার সাহসটা খুঁজে পেয়েছে।
– কিন্তু বাবা, আমাকে তো মা বলেনি আজ আমার জন্য টাকা নিতে বের হবে।
– দেখ আজকের এই পরিস্থিতির জন্য দ্বায়ী একমাত্র আমি। এখন আমি কি করবো বুঝতে পারছি না।
আমি বাবার সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম বাবা আমার মাকে অসম্ভব ভাবে ভালোবাসে। কিন্তু সে সব সময় রাগটাই দেখিয়ে গিয়েছে৷ এমন হতে পারে,পুরনো ব্যথা বাবা আর কাটিয়ে উঠতে পারছিলো না। তাই তার ব্যবহারটা এমন হয়ে গিয়েছিলো। সে যেনো কোনো ভাবেই পুরনো দিনের কথা গুলো ভুলতে পারছিলো না।
ডাক্তার আমাদের ডাক দিয়ে বললেন, মায়ের অবস্থা নাকি আগের চেয়ে ভালো। তবে শঙ্কা কাটাতে অনেক সময় লাগবে। মায়ের কাছে একজনই যেতে পারবে। চাইলে আমাদের ভেতরে যে কেউ যেতে পারি। বাবা বললেন তিনি মায়ের কাছে যাবে। সেই থেকে বাবা আর মায়ের কাছ থেকে দূরে যায়নি। সব সময় মায়ের কাছাকাছি থাকছে। হয়তো তার ভেতরে অনুশোচনা কাজ করছে। কিন্তু তিনি অনেক দেরি করে ফেলেছেন। আমার মাকে আঘাত যা দেওয়ার তা তিনি আগে দিয়ে ফেলেছেন। বাবা যতই মাকে ভালোবাসুক কিংবা ভুল বুঝতে পেরে মায়ের কাছাকাছি থাকুক,তবুও মায়ের অন্তরের ক্ষত শুকাতে পারবে না।
চার দিন পরে মাকে বেডে নেওয়া হলো। এই কদিন বাবা মায়ের কাছ থেকে একটুও নড়াচড়া করেনি। সব সময় মায়ে কাছাকাছি থেকেছেন।
প্রায় বারোদিন আমরা মেডিকেলে ছিলাম। এই বারোদিন বাবা মায়ের সকল সেবাযত্ন করেছেন। আমার মা হয়তো ভাবতেই পারেনি,বুড়া বয়সে এসে বাবার ভালোবাসা দেখতে পারবেন। বাবার যত্ন দেখে আমার মা ফেলফেলিয়ে তাকিয়ে থাকতে। হয়তো বাবাকে কিছু বলতে চাচ্ছেন। কিন্তু শারিরীক কষ্টে বাবার সাথে ভালোমত কথাও বলতে পারেনি।
এই কদিনে মায়া বেশ কয়েকবার খোঁজ খবর নিয়েছে। কিন্তু বাবার জন্য মায়া হসপিটালে আর আসেনি। আমিও ব্যস্ততার জন্য মায়ার সাথে সেভাবে কথা বলতে পারি নি। যতটুকু সম্ভব কথা বলেছি।
যখন দেখলাম মা একটু সুস্থ্যের দিকে তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, দেশে আর থাকা যাবে না। আমার কর্মস্থলে চলে যাবো। এভাবে আর দেশে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না। কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিঁটে আর দিতে চাইনি। তাই মায়াকে বিয়ে করার কথা মন থেকে ভুলে গেলাম। কাপুরুষের মত ভালোবাসা ছেড়ে দিয়ে দেশটা ছাড়বো আমি। এই মুহূর্তে বিয়ে করার কথা মাথায় আনাও বোকামি। বাবাকে আর রাগাতে চাইনি। যদি বিয়ের প্রসঙ্গ উঠাই বাবা তাতে রেগেও যেতে পারে। তাই আমি আর চাই না বাবার রাগটা আমার মায়ের উপরে পরুক। এই কদিনে মা,বাবার কাছে বেশ ভালোবাসা পেয়েছে। পেয়েছে বাবার যত্ন। তাই আর নতুন করে ঝামেলা করতে চাচ্ছি না।
রুমের ভেতর চুপচাপ বসে আছি। প্রায় দেড় মাস হলো দেশে আসলাম কিন্তু একটা দিনও ভালোমত থাকতে পারলাম না। মানুষ কয়েকবছর পরে দেশে আসে ভালোবাসার মানুষ গুলোর সাথে সময় কাটাতে, নিজেকে একটু রিলাক্স করতে। আমি তো কিছুই পারলাম না বরং আমার ভালোবাসার মানুষকে হারাতে বসেছি। এমনকি আমার কারণে আমার মায়ের অবস্থা এরকম। আমার জন্য টাকা আনতে যদি না বের হতো,তাহলে মায়ের এতবড় দূর্ঘটনা হতো না। নিজের কাছে এখন নিজেকেই খারাপ লাগছে।
হঠাৎ বাবা আমার রুমে আসলেন। রুমে এসে বাবা আমার পাশে বসে কাঁধে হাত রাখলেন। তিনি বললেন…
– তোর ছুটি এখনো দেড় মাস আছে,এখনি বাইরে যেতে হবে কেন?
– বাবা অফিস থেকে ফোন আসছিলো,তাই আমার যেতে হবে।
– টিকেট কাটিস না আর কিছুদিন থেকে যা।
– না বাবা, আমার যেতে হবে। আপনি এসেছেন ভালো হয়েছে,আপনাকে কিছু বলার ছিলো।
– আপাতত আমি কিছুই শুনবো না। তোর মা এখনো অসুস্থ। এই পরিস্থিতিতে তাকে রেখে যাস না। সে খুব কষ্ট পাবে।
– কিন্তু বাবা দেশে থাকলে যে আমি কষ্ট পাবো।
বাবা আমার হাতটা চেপে ধরলেন। তিনি সম্ভবত আমার ফোনে বলা কথাগুলো শুনে নিয়েছেন। তাই জানতে পেরেছেন যে আমি দেশ থেকে চলে যাচ্ছি। আমি কাউকে জানাতে চাইনি যে হঠাৎ করেই চলে যাবো। এমনকি মায়াকেও না।
মায়ার চোখে আমি ঘৃণার পাত্র হয়ে যাবো। আমি মায়াকে এতদিন অপেক্ষা করিয়ে শেষ পর্যায়ে আমি তাকে ঠকাতে চলছি। ওইদিন বিয়েটাও করতে পারলাম না,মায়ের এক্সিডেন্টের জন্য। হয়তো ভাগ্য আমার সহায় ছিলো না। তা না হলে এতবার বাজে সিচুয়েশনে পরতে হত না। আমি নিজের ইচ্ছায় মায়াকে এতদিন বিয়ে করিনি শুধুমাত্র আমার মায়ের জন্য। বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে যদি বিয়েটা করতাম তাহলে এই বাড়িতে আমার মায়ের ঠাঁই হত না। যখন সব কিছু বাদ দিয়ে মায়াকে আপন করতে গেলাম,তখন আল্লাহের পক্ষ থেকে একটা বাঁধা পেলাম। এমনটাও হতে পারে যে যদি বিয়েটা আমি করেই ফেলতাম তাহলে হয়তো মায়ের প্রতি বাবার ভালোবাসা দেখতে পেতাম না।
বাবার কথায় কি করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। অন্যদিকে মায়ার সাথে যোগাযোগটাও কমিয়ে দিয়েছি। খুব একটা কথা বলি না। কারণ এতটা বছর মায়াকে আমার জন্য অপেক্ষা করিয়ে মায়াকে আপন করে নিতে পারলাম না।
তিনদিনের মত দেশে আছি। তিনদিন পরে রাতের ফ্লাইটে সুদূর দুবাই চলে যাবো। তাই আর আমার মায়ের কাছ থেকে দূরে কোথাও যাচ্ছি না। সব সময় মায়ের কাছাকাছি থাকি। মাকে কয়েকবার বলতে চেয়েছিলাম ‘ মা আমি দুবাই চলে যাচ্ছি।’ কিন্তু মাকে বলার সাহসটা পাচ্ছি না। কারণ এই মুহূর্তে মা নিতে পারবে না।
রাতের দিকে দেখলাম আমার বাবা মায়ার পরিবারসহ সবাইকে নিয়ে এসেছেন। মায়াকে দেখে আমি বেশ অবাক হয়ে গেলাম। এই কদিনে ওর চাহারা আগের মত নেই। কান্না করে সম্ভবত চোখমুখ ফুলিয়ে রেখেছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না।
সবাই আমার মায়ের রুমে এসেছেন। এদের ভেতরে শুধু মায়ার মাকে দেখতে পেলাম না। বাবার মুখ খুব হাসিখুশি। আমি তাকে যত দেখছি,তত চমকে উঠছ। এ আমি কি দেখছি। মায়ার বাবা হাসতে হাসতে বললেন…
“আবিদ তোমার বাবার জন্য আর পারলাম না। আমার বাসায় গিয়ে যেভাবে রিকোয়েস্ট করলেন তাতে আর না এসে পারলাম না। সে নাকি তার বউমাকে মানে মায়াকে ছাড়া বাড়িতেই ফিরবে না।”
আমি কিছুই বললাম না। দেখলাম বাবা আমার মায়ের হাত ধরে কিছু একটা বলতে যাবে। তখনি মা আস্তে আস্তে বললো….
“তুমি কি বলবে আমি জানি। এটা আর বলতে হবে না নতুন করে। ওসব আমি ভুলে গিয়েছি। তুমি ভাবছো তোমার ব্যপারে আমরা কেউই কিছু জানি না? আমি জানার পরেই মায়ার মায়ের সাথে কথা বলে, মায়াকে বাড়ি থেকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। মানে মায়া যে নিখোঁজ হয়েছে,তা আমার এবং মায়ার মায়ের যুক্তিতেই আবিদের মামার বাড়িতে পাঠিয়ে ছিলাম।”
মায়ার বাবা আমার বাবার হাত ধরে বললেন ” ভাই সাহেব সব কিছু ভুলে গিয়ে ওদের জন্য দোয়া করে দেন।”
বাবা সবার মাঝে আমার উদ্দ্যেশ্যে বললেন…
– আবিদের কাছে আমার কিছু চাওয়ার আছে।
মা জবাবে বললেন”আবার কি?”
– আবিদ আমাদের ছেড়ে আর বিদেশে যেতে পারবে না। এই ক’বছর থেকেছে তাতেই হবে। আবিদের ইনকামের সব কিছুই আবিদের জন্য রেখে দিয়েছি। ও হয়তো আমাকে ভুল বুঝেছে। আর আমি ক্ষমা চাচ্ছি এতদিনের ব্যবহারের জন্য। আমি এই জীবনের সব কিছুই ভুলের ভেতর ছিলাম,এবং সবার সাথে অন্যায় করেছি। তাই জীবনের বাকি দিন গুলো সবাইকে নিয়ে একসাথেই কাটাতে চাই।
মায়া আর আমি ছাদে চলে গেলাম। মায়াকে একটু জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মায়া বাঁধা দিয়ে, অভিমান সূরে বললো…
“কাজি সাহেব আসুক তারপর পরে জড়িয়ে ধরবে।”
আমিও গাল ফুলিয়ে বসে রইলাম। মায়া আমার কাঁধে মাথা রেখে…..
-আমাকে রেখে তো পালিয়ে যেতে চেয়েছিলে।
কিন্তু তুমি কি জানো আমাদের আলাদা হতে, চাঁদের বাড়ি যতদূর,
ততদূর গেলে হয়তো আমরা আলাদা হয়ে যেতাম। ওই যে দেখো “চাঁদের বাড়ি বহুদূর।”
(সমাপ্ত)