চাঁদের বাড়ি বহুদূর পর্ব-০৪

0
414

#চাঁদের_বাড়ি_বহুদূর(৪র্থ পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda

মায়ার মায়ের সাথে নাকি আমার বাবার সম্পর্ক ছিলো বিয়ের আগে।
বাবার অমতের আসল কারণই এটা। বাবা আর মায়ার মায়ের সম্পর্কে জানতে পেরেছি আমাদেরই এক আত্মীয়ের কাছে।

এই কদিনে আমি বাবার আসল রহস্য বের করলাম। কিন্তু তার ব্যপারে কথাগুলো শুনে আমি ভড়কে গেলাম। মায়ার মা আর বাবার যে সম্পর্ক ছিলো এটা কোনোদিন প্রকাশ করেনি। এবং আমাদের সম্পর্ক মেনে না নেওয়ার এটাই মূল কারণ।

আগে যতটা চিন্তায় না ছিলাম এখন আমার আরো কয়েকগুণ চিন্তা বেড়ে গেলো। যদি সত্যিই এমনটা হয়ে থাকে তাহলে কোনো ভাবেই মানবে না। আর মায়া যদি জানতে পারে তাহলে তো আরো সমস্যা হয়ে যাবে।

এসবের কথা বাদ। আজ তিনদিন হয়ে গেলো মায়ার কোনো খোঁজ নেই। সম্পুর্ন চাপ এখন আমার উপরে। থানা থেকেও আমার উপরে চাপ আসছে। বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে যদি মায়াকে হাজির করতে না পারি তাহলে আমাকে জেলে ঢুকতে হবে। জেলে যাওয়ার চেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো।

আমি কি করবো কোথায় যাবো বুঝতে পারছি না। বাবার হেরে যাওয়ার জীবন থেকেই আমি এখন আমার ভালোবাসাকে হারাতে বসেছি। আমাদের ভালোবাসার আগে থেকে যদি আমি জানতাম তাহলে মায়ার সাথে সম্পর্কে যেতাম না। কিন্তু মাঝ পথে এখন এসব কি হচ্ছে।

আমি গুটিগুটি পায়ে বাবার সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়ালাম। আমাকে দেখতেই বাবা বলে উঠলেন…

– আবিদ কিছু বলবে?

– হ্যাঁ বাবা আমার বলার আছে।

– কি বলবে বলো।

– আসলে কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না।

– ছয়নয় না করে যা বলার সরাসরি বলে ফেল।

– বাবা শুনেছি আপনার আর মায়ার মায়ের মাঝে নাকি আগে একটা সম্পর্ক ছিলো। বাবা আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন এভাবে বলার জন্য।

– তোমাকে এসব কে বলেছে।

– বাবা আমি কোনো একজনের মাধ্যমে শুনেছি। সত্যিটা আমাকে বলুন।

বাবা চুপচাপ হয়ে গেলেন। তার দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম বাবার মুখটা মলিন হয়ে আছে। আমিও তার সামনে নিরব হয়ে আছি। আমার প্রশ্নের জন্য হয়তো বাবা প্রস্তুত ছিলেন না। তার মাথাটা নিচু করে কিছুক্ষণ ভাবলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন…

– যা শুনেছো সত্যি।

– কিন্তু আপনাদের জন্য আমরা শাস্তি কেনো পাবো বাবা?

– মায়ার মা আমার ভালোবাসার মানুষ ছিলো। আমাদের সম্পর্ক ছিলো মাত্র তিন বছরের। ওদের বাড়ি আমাদের পাশের গ্রামেই। আমাদের যে সম্পর্ক ছিলো এটা কেউই জানতো না, আমাদের কাছের দুইএকজন ছাড়া। আমাদের যুগে মোবাইল ছিলো না। টুকিটাকি চিঠির মাধ্যমে কথা হতো। আর আমার গঞ্জে একটা দোকান ছিলো। সেখানে প্রায়ই মায়ার মা আসতো। আমরা যে প্রেম করছি তা বুঝতে কেউ পারেনি। আমাদের কথা ছিলো পালিয়ে যাবো। কারণ মায়ার বাবা সেই সময়ের মেম্বার ছিলো। এবং খুবই রাগী মানুষ ছিলো। আর আমরা তখন গ্রামে হাল চাষ করতাম এবং আমার ছোট্ট একটা দোকান ছিলো। এর চেয়ে বড় কথা হলো মায়ার মা ছিলো অনেক সুন্দরী মেয়ে। মোট কথা আমাদের সাথে এবং ওর পরিবাদের সাথে মানানোর মত অবস্থায় আমরা ছিলাম না। তাই সিদ্ধান্ত নেই আমরা পালিয়ে যাবো। মায়ার মা, অহ মায়ার মায়ের নাম নূর জাহান। ওর নামটা যেমন নূর,ওর চেহারাও ছিলো নূরের মত। যাইহোক, নূর জাহান পারেনি ওর বাবার কাছে এই সম্পর্কের কথা জানাতে,আর আমিও পারিনি আমার পরিবারকে জানাতে। তাই একটাই রাস্তা ছিল আমরা পালিয়ে যাবো। সব কিছুই পরিকল্পনা মাফিক রেখে দিয়েছিলাম। দিন তারিখ সব কিছুই রেডি। এবং কোথায়, কার বাসায় যাবো সবই আগে থেকে আমি রেডি করে রেখেছিলো। পালিয়ে যেদিন যাবো তার দুই দিন আগে শুনি নূর জাহান বিয়ে করে নিয়েছে। সেই মূহুর্তে আমি ঠিক ছিলাম না। বলা যায় পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলাম। আত্মহত্যা করার চেষ্টাও করেছি। আমার আব্বা মানে তোর দাদা ভাবছে আমাকে বোধহয় ভূত-জীনে ধরেছে। বিভিন্ন কবিরাজ দেখাতে থাকে। কিন্তু তারাও বুঝতে পারেনি,ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে আমি এমন হয়ে গিয়েছি। আর আমিও মুখ ফুটে এত কিছু বলিনি। কারণ আমি নূর জাহানকে ভালোবাসছি। ওর বিয়ের পরে যদি এই সম্পর্কের কথা জানাজানি হয়ে যায়,তাহলে নূর জাহান শান্তিতে সংসার করতে পারবে না। ভালোবাসার সম্মান দেখিয়ে আমি আর ওর আর আমার সম্পর্কের কথা প্রকাশ করিনি। নূর জাহান যখন বিয়ে করে,সেই বছর মায়ার বাবা হাইস্কুলে শিক্ষক হিসেবে জয়েন করে। আগেরকার দিনে গ্রামে কেউ শিক্ষক হলে তার সম্মান ছিলো অপরিসীম। গ্রামে গঞ্জে শিক্ষিতরাই শিক্ষকতার সুযোগ পায়। আর অন্যদিকে আমি ছিলাম প্রায় বলতে গেলে অশিক্ষিত। তখন আমি ধরে নিয়েছিলাম ভালো পাত্র পেয়েই নূর জাহান ওর বাবার পছন্দে বিয়ে করে নিয়েছে। সেই থেকে আমি মায়ার বাবাকে চোখে দেখতে পারতাম না।

– কিন্তু এখানে মায়ার অন্যায় কোথায়? কিংবা আমি শাস্তি পাচ্ছি কেনো?

– মায়ার কোনো অন্যায় নেই। মায়া নিতান্ত গরীব পরিবারের হলেও আমার কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু ওইযে নূর জাহান এবং মায়ার বাবাকে যে আমি সহ্য করতে পারি না। আমার ধারণা মনে এখনো আমার সম্ভবত মায়ার বাবা এবং তোর মা এই সম্পর্কের কথা জানে না। দেখ আবিদ আমি ভালোবাসার মানুষকে হারিয়েছি। ভালোবাসার মূল্য আমি বুঝি। কিন্তু তুই এমন একজনকে ভালোবাসলি যে কিনা আমার শত্রুদের মেয়ে। আমি কি করে মায়ার মায়ের সামনে যাবো কিংবা মায়ার মা আমার সামনে আসবে? তুই বিদেশ যাওয়ার আগে আমি জানতাম না মায়া তাদেরই মেয়ে। তুই চলে যাওয়ার পরে যখন মানুষ কানাঘুষা করছিলো তখন আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারি মায়ার পরিবার সম্পর্কে। এর পরে ভেবেছিলাম এই সম্পর্ক হয়তো থাকবে না। কিন্তু এখন পর্যন্ত মায়া তোর অপেক্ষায় থাকবে বুঝতে পারিনি।

– বাবা আপনি আগেরদিনের কথা ভুলে যান আমার কথা চিন্তা করে। আমার মনে হয় এখনো আপনি কষ্ট পাচ্ছেন, কিন্তু আমিও যদি মায়াকে হারিয়ে ফেলি আমিও তো সারাজীবন কষ্টে থাকব বাবা।

– তোর যদি মায়াকে বিয়েই করতে হয় তাহলে তুই আমার কখনো পরিচয় দিস না। আর এই বাড়িতে মায়াকে নিয়ে কখনো আসতে পারবি না। আর না হয় আমিই এই বাড়ি থেকে চলে যাবো।

বাবার কথা শুনে আমি আর না দাঁড়িয়ে সেখান থেকে চলে গেলাম। হঠাৎ করে একটা প্রশ্ন মনে জাগলো তাই আবারো বাবার কাছে ফিরে এসে জিজ্ঞেস করলাম…

“বাবা মায়া কোথায়?”

– সেটা আমি কি করে জানবো?

– আপনি জানেন না?

– না।

এর পরে আর কথা বাড়াতে চাইনি।

মায়ার বাবার চাপ আর অন্যদিকে থানার চাপে আমি ঠিক মত থাকতে পারছি না। এতদিন হয়ে গেলো কিন্তু মায়া নিঁখোজ এখনো। অন্যদিকে মায়ার জন্য যে ছেলে পছন্দ করে রেখেছিলো তারাও ব্যপারটা জেনে গিয়েছে। তাই তারাও বিয়েতে অমত পোষণ করছে। যাক কিছুটা বাঁচা গেলো কিন্তু মায়া? বা আমার বাবা তো যা বলার বলেই দিয়েছে। মায়া এবং আমার ভালোবাসার মাঝে যে এত কিছু ঘটার জন্য প্রস্তুত ছিলো সেটা আমি কল্পনা করতেও পারিনি। একজনের ভালোবাসার ব্যর্থতার জন্য আমাদের ভালোবাসা আজ মূল্যহীন হয়ে গেলো। এমন ভালোবাসার গল্প তো বহু রয়েছে এই পৃথিবীতে। কই তারাও তো ভালোবাসাকে পেয়েছে,কিংবা সংসার করতে পেরেছে।

অনেক রাত হলো বাবা বাবায় ফিরেনি। মা খাবার রেডি করে বাবার জন্য অপেক্ষা করছে। বাবার দেরি হওয়াতে মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন…

” আজ যে অনেক সময় তোর বাবার সাথে কথা বললি, সে কিছু বলেছে? দেখলাম তার মন খারাপ।”

– না সে কি বলবে?

– ভাবলাম তার মন নরম হয়েছে কিনা। আচ্ছা মায়ার সাথে কি তোর যোগাযোগ হয়েছে?

– মা কিসব বলছো? আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না।

-আমি কিছু জানি না,মায়াকে তুই এই বাড়ির বউ করে আনবি।

আমি মনে মনে বললাম ” মা তুমি যদি কিছু জানতে তাহলে তুমিও মায়াকে দুই চোখে দেখতেও পারতে না।”

#চলবে…..
(ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। )

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে