#চাঁদের_বাড়ি_বহুদূর(২য় পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda
কয়েকদিন পরেই মায়ার বিয়ে। যে ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে, সেই ছেলে শহরে চাকরি করে। তাই ছুটি নিয়ে আসতে কয়েকদিন সময় লাগবে। আমার জানা মতে মায়া সেই ছেলেকে দেখেনি। ওর বাবার পছন্দেই মায়া মত দিয়েছে।
মায়া আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। দেখা করতে চাইলেও আমার সামনে আসছে না। আমরা একই গ্রামে থাকি,তবুও এখন মায়াকে অপরিচিত মনে হচ্ছে। আমার বাবার বন্ধুদের দিয়ে বাবাকে রিকোয়েস্ট করালাম। তাতেও কাজ হলো না। আমার বাবার একটাই কথা মায়াকে আমার বউ হিসেবে মানবে না।
এক সুত্রে জানতে পারি। গতকাল বাবা নাকি মায়াদের বাসায় গিয়েছিলো। সেই বাসায় গিয়ে মায়ার বাবাকে অনেক কথা শুনিয়ে এসেছে। মায়ার বাবা একজন প্রাক্তন স্কুল শিক্ষক। তাই সে সম্মানের খাতিরে মায়ার কাছে অনুনয় বিনয় করেছে। এমনকি আমার বাবার আচরনে মায়ার কাছে খুব খারাপ লেগেছে। তাই মায়া সব কিছু চিন্তা ভাবনা করে আমার জীবন থেকে সরে যাচ্ছে।
গতকাল মায়া আমাকে বলেছিলো। আমি যদি মায়ার সাথে সিনক্রিয়েট করি কিংবা ওর পরিবারের সম্মান নিয়ে টান দেই তাহলে মায়া নাকি আত্মহত্যা করবে। মায়া খুবই জেদি মেয়ে। ছয় বছরের সম্পর্কে মায়া আমার সাথে জেদ না দেখালেও, ও খুব জেদি। যদি কোনো কিছুর সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে সেখান থেকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা কষ্টকর।
আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছি না। আমাকে দেশে এনে, বাবা এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করবে তা কখনো ভাবতে পারিনি। বিদেশ গিয়ে নিজের কথা না ভেবে পরিবারের কথা আমি সব সময় ভেবেছি। সবার চাওয়া পূরণ করেছি। শেষ পর্যন্ত আমার চাওয়াটা কেউ পূরণ করছে না। যখন যেটা আমার কাছে চেয়েছে,সবই আমি দিয়েছি। কিন্তু আমার বেলায় একেবারে শূন্য।
আমি সাহস করে বাবার সামনে গেলাম। গিয়ে বাবাকে বললাম….
– বাবা আমি কখনো নিজের জন্য কিছুই চাইনি। চাওয়ার ভেতর চেয়েছি বিদেশ যেতে। তাও আমার পরিবারের কথা চিন্তা করে। এর বাহিরে কিছুই আপনাদের কাছে আমি চাইনি। আমার আপনাদের কাছে প্রথম এবং শেষ চাওয়া মায়াকে। আমি মায়াকে প্রচন্ড ভালোবাসি। মায়াও আমাকে ভালোবাসে। আমি বিদেশ যাওয়ার আগে থেকেই আপনারা কিছুটা হলেও জানতেন। আপনি যদি সব কিছুতেই সিদ্ধান্ত নেন,তাহলে আমার এই জীবনের মূল্য কোথায়?
– সব সময় তোর ভালো চেয়েছি,এখনো চাই।
– প্লিজ বাবা আমাকে বলতে দেন। আমি অনেক আশা নিয়ে দেশে ফিরেছি। ভালোবাসার মানুষকে আপন করে নেওয়ার আনন্দ নিয়েই দেশে ফিরেছি। দেশের বাহিরে গিয়ে আমার থাকতে কষ্ট হচ্ছিলো। তারপরেও আপনাদের কথা চিন্তা করে কখনো কিছুই প্রকাশ করিনি আমি। যে ছেলে বাবা মাকে ছাড়া দুইটা রাত কোথাও থাকিনি,সেই আমি পাঁচটা বছর সবাইকে ছেড়ে বাহিরে সময় কাটিয়ে দিয়েছি। শুধু মাত্র আপনাদের জন্য। আপনাদের সুখের জন্য। আমি কিছুই নিজের জন্য করিনি। আমার কাছে কোনো টাকাই রাখিনি কিংবা কোনো ব্যাংক ব্যালেন্সও করিনি। মাস শেষে আপনার কাছে টাকা গুলো পাঠিয়ে দিয়েছি। নিজের চিন্তা না করে আপনাদের কথা আমি চিন্তা করেছি। সেই আপনারা কেনো আমার দিকে তাকাচ্ছেন না? বাবা কষ্ট পাবেন না। আর ভাববেন না আপনাকে আমি খোঁটা দিচ্ছি। আসলে আমার মনের কথা আমি কখনো প্রকাশ করতে পারিনি। আপনি সুযোগ দেননি। আমি শেষবারের মত বলছি। মায়াকে আমি ভালোবাসি,এই মায়াকেই আমার জীবনে লাগবে।
– মায়াকে আমি মেনে নিতে পারব না, এটাই আমার ফাইনাল কথা।
বাবার কথা শুনে প্রচন্ড ভাবে রাগ হচ্ছে এবং ঘৃণা হচ্ছে নিজের প্রতি। নিজেকে মেরুদণ্ডহীন একজন মানুষ মনে হচ্ছে এখন। যেখানে আমার কোনো সিদ্ধান্ত নেই,আমার সব কিছু যেনো শিকলে বাঁধা। আমি তো একজন মেরুদণ্ডহীন মানুষ। ইচ্ছা করছে আমিই নিজেকে শেষ করি। কিন্তু শেষ করলে তো আমার মায়াকে পাওয়া হবে না,কিংবা মায়াকে পাওয়ার জন্য যুদ্ধ করা হবে না। প্রকৃত প্রেমিকরা তো পরিস্থিতির স্বীকার হয়েও পিঁছু হটে না কিংবা নিজেকে শেষ করে হার মেনে নেয় না। যে করেই হোক মায়ার বিয়ে আটকাতে হবে এবং মায়াকে আমার করে নিতে হবে।
আমার মনে আছে, মায়া এবং আমার যখন সম্পর্ক হয় তখন ওর বাবা যেনে যাওয়ার সময় অনেক মেরেছিলো। তবুও কখনো বলেনি আমাকে ভূলে যাবে। গ্রামের মেয়েরা ভালোবাসার অপরাধে মার খেলে কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকে না। কারণ সবাই সেই মেয়েকে দেখে হাসাহাসি করে কিংবা ভালো চোখে দেখে না। সবার কাছে মনেহয় মেয়েটা ভালো না। যেসব মেয়েরা প্রেম করে তারা সমাজের কাছে খারাপ। এমনটাই মনে করে সব সময়। তাই ভালোবেসে মার বা পিটানি খাওয়ার পরেও বাসার কোণে মুখ লুকিয়ে চোখের জল ফেলতে হয়। এমনকি দিনেরপর দিন না খেয়েও কাটাতে হয়। মায়ার বেলাও সেরকমটা হয়ে ছিলো। আমি বিদেশ চলে আসার পরে ওর পরিবার ভেবেছিলো এই সম্পর্ক থাকবে না। কিন্তু আমাদের ভালোবাসায় কখনো কমতি হয়নি।
কোনো একজনের মাধ্যমে আমি মায়ার সাথে দেখা করার সুযোগটা পেলাম। মায়াকে কাছে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম…
– মায়া কি হয়েছে? হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত কেনো নিলে?
– দেখো তোমার সাথে আমার কথা বলাটা এখন অন্যায় হবে। কারণ তোমার সাথে কথা বললে আমার বাবা অপমানিত হবে। তোমার জন্য ছয়টা বছর আমি অপেক্ষায় ছিলাম। এই ছয় বছরে আমার বাবা কম চেষ্টা করেনি বিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু কোনো ভাবেই আমার বাবা আমাকে বিয়ে দিতে পারেনি। তোমার জন্য আমি অপেক্ষায় ছিলাম। যেকোনো ভাবে আমি আমার পরিবারকে মানিয়ে রেখেছিলাম। তার মানে এই নয় যে তোমার পরিবারের সবার কথা আমার শুনতে হবে। এবং আমার বাবা-মাকে অপমানিত করতে হবে।
– কি হয়েছে সেটা তো বলবে।
– তুমি জানো গতকাল তোমার বাবা কি বলে গিয়েছে? আমি নাকি তোমার টাকার জন্য এখনো তোমার জীবনে পড়ে আছি? তুমি বলতে পারবে এই পাঁচ বছরে তোমার কাছে কখনো কোন কিছু চেয়েছি কিনা? কিংবা তোমার কাছে কখনো টাকা চেয়েছি কিনা ? অথচ তোমার বাবা গতকাল আমাদের পরিবারে এসে বেশ কিছু টাকার অফার করে, যাতে আমাদের এই সম্পর্ক কখনো না আগাই। অবশ্য আমার বাবা আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিল যে তোমরা আমাদের সাথে ঝামেলা করবে । তাই তুমি আসার পরপরই আমার জন্য বাবা ছেলে দেখে। তোমার পরিবার থেকে যদি আমার পরিবারে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতো তখন হয়তো আমার বাবা রাজি হত। আমি সেটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু ভালোবাসার বিনিময় যে অপমানিত হতে হবে সেটা কখনো ভাবতে পারিনি।
– আমি খুবই লজ্জিত আমার বাবার কারণে। আমিও কখনো ভাবতে পারিনি বাবা এমনটা করে বসবে।
– দেখো যা হওয়ার হয়েছে। আমি আর চাইনা নতুন করে কোন ঝামেলা হোক। সব ভালবাসার সমাপ্তি সুখের হয় না, কিছু কিছু ভালোবাসার সমাপ্তি কষ্টেরও হয়। আমি এটাই মেনে নিয়েছি। বিধাতা আমাদের এক হতে দিতে চায়নি তাই আমরা এক হতে পারছি না।
তোমার কাছে আমার একটাই রিকুয়েস্ট প্লিজ কখনো তুমি আমার সাথে আর যোগাযোগ করতে এসো না।
– মায়া তুমি এসব কি বলছো?
– আমি ঠিকই বলেছি। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না। তবে আমি এটাই বুঝতে পারছি না। তোমার আমার সম্পর্কে তোমার বাবার এত সমস্যা কোথায়? কি নিয়ে তার এত আপত্তি?
– আমিও সেটা বুঝতে পারছি না।
মায়া বেশি সময় এখানে দাঁড়ালো না। আমার কাছ থেকে মায়া চলে গেলো। আমি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছি। কি করব বুঝতে পারছি না। যদি আমার বাবা বেশি ঝামেলা করে বসে, তাহলে আমি খুব তাড়াতাড়ি টিকিট কেটে দেশের বাইরে চলে যাব। আমি যদি মায়াকে না পাই তাহলে অন্য কাউকে কখনো বিয়ে করতে পারব না।
অনেক স্বপ্ন নিয়ে দেশে এসেছিলাম। কিন্তু কষ্ট নিয়ে এভাবে ফিরে যেতে হবে কখনো কল্পনাও করতে পারিনি। মায়া এমন মেয়েও নয় যে আমার সাথে পালিয়ে যাবে।
তবে আমি এমন কিছু করে বসব…….
#চলবে….