চাঁদের বাড়ি বহুদূর পর্ব-০১

0
658

গল্পঃ #চাঁদের_বাড়ি_বহুদূর(১ম পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda .

পাঁচ বছর পর বিদেশ থেকে দেশে এসেছি ছুটিতে। উদ্দেশ্য হলো বিয়ে করা। যদিও আমি এই সময়টাতে দেশে আসতে চাইনি,কিন্তু পরিবারের রিকোয়েস্টে তিন মাসের ছুটিতে দেশে ফিরেছি।

যে মেয়েটি এই পাঁচ বছর আমার অপেক্ষায় ছিলো, দেশে আসার পরে সেই মেয়েকে আমার পরিবার মানতে নারাজ। আমিও আসার আগে ভাবছিলাম, আমার পরিবার খুব সহজেই মেনে নিবে।

মায়া! আমরা একই গ্রামে বড় হয়েছি। পড়াশোনায় দুজনে একই ক্লাসে ছিলাম। মায়া এবং আমার সম্পর্কের কথা এলাকার সবাই জানতো। ইন্টার ফাইনাল ইয়ারে আমাদের সম্পর্ক হয়।

বছর দেড়েক পরে পারিবারিক আর্থিক সমস্যার কারণে বিদেশ যেতে বাধ্য হই। আমি পরিবারের বড় সন্তান। তাই আমার দ্বায়িত্ব পরিবারে বেশি। তাই আমার সিদ্ধান্তেই আমি দেশের বাহিরে চলে যাই।

আমি বিদেশে যাওয়ার পরে অনেকেই মায়াকে বলেছে, বিদেশ গেলে আমি মায়াকে ভুলে যাবো। আমার জন্য আর অপেক্ষা না করতে। মায়ার পরিবার অনেক চেষ্টা করেছে বিয়ে দিয়ে দিতে। কিন্তু মায়াকে কেউ কথা শোনাতে পারেনি। সেই থেকে এখন পর্যন্ত মায়া আমার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে।

আমি বিদেশ থাকতে মায়া আমাকে বলেছিলো,এয়ারপোর্টে আমাকে রিসিভ করতে মায়া যাবে। আমিও ভেবেছিলো হয়তো মায়া আসবে। কিন্তু আমার পরিবার এক পর্যায়ে মায়ার পরিবারের সাথে ঝামেলা পাকিয়ে বসে।

মায়া দেখতে অতটা সুন্দরী না হলেও আমার চোখে মায়া পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী। লেখকেরা বলে থাকেন,”প্রেমিক, প্রেমিকার চোখে ভালোবাসার মানুষটি পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন/ সুন্দরী মানুষ। আমার কাছেও ব্যাতিক্রম নয়।

বাড়িতে আসার পরে বিকেলে মায়ার সাথে দেখা করতে গেলাম। এত বছর পরে আমাকে দেখে মায়া কান্নার সূরে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমিও নিজের অজান্তে মায়াকে বুকে জড়িয়ে নিলাম। আশপাশের মানুষ কে কি দেখলো, বুললো তাতে আমার কিছুই যায় আসে না। মায়া আমার ভালোবাসার মানুষ।

মায়ার সাথে দেখা করা শেষ হলে বাসায় যাই। ডাইনিং টেবিলে বসে বাবা বললেন..

– ‘আবিদ শোনো! আমরা তোমার বাবা মা। তোমার ভালো-মন্দ আমরা বুঝি। মায়ার সাথে যোগাযোগ অফ করে দাও। তোমার জন্য আমরা মেয়ে পছন্দ করে রেখেছি।’

আমি চুপচাপ খাবার খাচ্ছি। বাবার কথায় আমি কোনো জবাব দেইনি। মা পাশ থেকে বাবাকে চুপ করতে বললেন। কিন্তু বাবা আবারো বলে উঠলেন…

-‘আজকে মায়ার সাথে দেখা করেছো ভালো কথা। পরবর্তীতে এমনটা যেনো না হয়। এই সমাজে আমার একটা মানসম্মান আছে। ওর পরিবার আর আমার পরিবারের দিকে তাকিয়ে একবার দেখো। ওর যদি কোনো পাওনা থাকে তাহলে সেটা তুমি পরিশোধ করে দাও৷ প্রয়োজনে কিছু টাকা দিয়ে দাও।

– বাবা টাকা দিয়ে কি হবে?

– যদি সে চায় আরকি।

– আপনার কথা আমি কিছুই বুঝলাম না। ওর পরিবারের দিকে আমি তাকাতে কেনো যাবো। একবার আমাদের আগেরকার সময়ের পরিবারের দিকে তাকান। আমি যখন বিদেশ গিয়েছিলাম,পরিবারের দেনার দ্বায় মাথায় নিয়েই গিয়েছিলাম। দেখুন বাবা আমি বেশি কথা বলে আপনাকে অসম্মান কিংবা কষ্ট দিতে চাই না।

পরেরদিন সকালে বাবা ঘুম থেকে ডাকলেন। আমি ফ্রেশ হওয়ার পরে বাবা আমাকে বললেন..

– একটু পরে মেয়ে দেখতে যাবো,খাওয়া শেষ করে রেডি হয়ে নাও।

– মেয়ে দেখতে যাবেন আমাকে একবারো বলেছেন? আর তাছাড়া আমি যেতে পারবো না।

– আমি তাদের কথা দিয়েছি, ওয়াদার বরখেলাপ করা যাবে না।

– এই করার জন্য আমাকে দেশে এনেছেন? আমি তো দেখছি দেশে আশার পরে রীতিমতো আমাকে বাধ্য করেছেন।

– আমি তোমার বাবা, ভুলে যেও না।

– তাই বলে সবটাই আপনাদের ইচ্ছায় হবে?

– হ্যাঁ। আমরা সকলেই তোমার ভালো চাই।

বাবার সাথে আর কথা বাড়াতে গেলাম না। তার কথা মত মেয়ে দেখতে গেলাম। মেয়ে দেখে বাবার পছন্দ হয়েছে। অবশ্য আমি দেশে আসার আগেই বাবা এই মেয়ে দেখে রেখেছে এমনকি পছন্দও করেছে৷ শুধু আমার দেশে আসার অপেক্ষায় ছিলো। এখন আমি রাজী হলেই বাবা বিয়ের তারিখ ঠিকঠাক করে আসবেন। সবার সামনে আমি তাদের কাছে সময় নিলাম। মেয়ের পরিবার সময় দিতে পারলেও বাবা যেনো সময় দিতে নারাজ। আমি জোর করেই সময় নিয়ে বের হয়ে চলে আসলাম।

বাসায় আসার পরে বাবা আমার সাথে অনেক রাগারাগি করলেন। নিজের কাছে নিজেকে অসহায় মনে হলো। আমি কোনো জবাব দিতে পারলাম না। আমি সাফ জানিয়ে দিলাম আমি বিয়ে করতে পারবো না। আমি যদি আমার পছন্দের মানুষকে বিয়ে করতে না পারি তাহলে কাউকেই বিয়ে করতে পারব না। যে মানুষটা আমার জন্য এতবছর অপেক্ষায় ছিলো সেই মানুষকে আমি কষ্ট দিতে পারবো না। আর তাছাড়া দুজন দুজনাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন বুনেছি। খুব সহজেই আমি হার মানবো না।

রাতের দিকে মায়া আমাকে ফোন করে দেখা করতে বলে। আনুমানিক রাত এগারোটা হবে। আমি মায়ার সাথে দেখা করি। দেখার করার পরে, আমি যে গিফট গুলো দিয়েছিলাম মায়াকে সেগুলা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে…

– আবিদ আমি এগুলো রাখতে পারবো না। তার চেয়ে তুমি নিয়ে নাও।

– পাগল হয়ে গেছো তুমি? কত শখ করে তোমার জন্য নিয়ে আসছি জানো?

– দেখো এই দামী ফোন, গোল্ডের চেইন,ব্রেসলেট আমার সাথে মানায় না। আমি এর ওজন সইতে পারছি না। প্লিজ এগুলো ধরো। আমার বাবা দেখে ফেললে ঝামেলা হয়ে যাবে।

– কি হয়েছে আমাকে বলো না। মায়া প্লিজ।

– এখন বলার মত সময় আমার হাতে নেই,প্লিজ এগুলা নিয়ে তুমি চলে যাও।

আমাকে কিছু না বলতে দিয়ে, সব কিছু আমার হাতে রেখে মায়া এক দৌড়ে চলে গেলো। আমি রাতের অন্ধকারে স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি মায়ার চোখে জল। চোখের জল চিকচিক করছে। আমার বুকের মধ্যে কেমন জেনো একটা ধাক্কা লাগলো। বুকটার ভেতর ব্যথাও করছে কিছুনা। আমি সেখানে অনেক সময় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভেবেছিলাম মায়া আবারো আসবে। কিন্তু আসেনি। কয়েকবার ফোনও দিয়েছিলাম ফোনটাও বন্ধ। হঠাৎ করে কি হলো কিছুই বুঝলাম না। মায়া আমাকে এত ভালোবাসে, অথচ আজ প্রথমবার মায়ার ভেতর চেঞ্জ দেখতে পেলাম।

আমি দেশে আসার সময় মায়া আমাকে বলেছিলো পায়েল আনতে। এবং আমার নিজ হাতে ওর পায়ে পায়েল পড়িয়ে দিতে বলেছিলো। আমিও মায়ার জন্য,চেইন,ব্রেসলেট, পায়েল এবং ফোন এনেছিলাম কারণ মায়া তো আমারই বউ হবে। কিন্তু এখনকার মায়াকে দেখে আমার ভয় লাগলো।

এমনও হতে পারে আমার পরিবার থেকে মায়াকে কিছু বলেছে। তাই এমনটা করছে মায়া। কিন্তু মায়ার কাছে তো আমি কিছুই জানতে পারলাম না।

অনেক রাত করে বাসায় ফিরলাম। বাবা চৌকিতে বসে আছেন। বাড়িতে ঢুকতেই বাবা জিজ্ঞেস করলেন…

– এত রাতে কোথায় গিয়েছিলে?

– বাইরে। একটু কাজ ছিলো।

– তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েও পড়ো।

আমি চুপচাপ সেখান থেকে চলে আসলাম। বাবার শাসন, হুকুম দেখে নিজেকে দশ বছরের শিশু মনে হলো। আমার কাছে মনে হচ্ছে আমার হাত পা শিকলে বাঁধা। তারা আমাকে যেভাবে যা বলবে সেভাবেই তা করতে হবে।

পরেরদিন শুনতে পেলাম মায়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে। কথাটা শুনে আমার বিশ্বা হলো না। কারণ যে আমার জন্য এতবছর অপেক্ষায় ছিলো, তার অন্য কোথাও বিয়ে ঠিক হতে পারে না। আমি আর দেরি না করে মায়াদের বাসায় গেলাম। গিয়ে মায়াকে ডাকলাম। মায়া এসে আমাকে বললো…

– আবিদ তুমি এখন আর কোনো সিনক্রিয়েট করতে এসো না। আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমার ইচ্ছাতেই বিয়েতে হচ্ছে। আমি যেমন আমাকে নিয়ে ভাবছি তুমিও তোমাকে নিয়ে ভাবো এবং বিয়ে করে নাও বাবা মায়ের পছন্দ মত। প্লিজ তুমি আর বাঁধা হয়ে এসো না। প্রত্যেকটা বাবা মায়ের স্বপ্ন থাকে তাদের সন্তানদের নিয়ে। তাই আমি আমার বাবা মায়ের দিয়ে তাকাচ্ছি। তুমিও তাই করো।

– তোমার মাথা ঠিক আছে? এসব কি বলছো?

– আমার মাথা ঠিক আছে,এবং স্ব জ্ঞানে বিয়েটা মানিয়ে নিচ্ছি।

– তোমার বিয়ে আমি হতে দিবো না।

– তুমি যদি কিছু করো তাহলে আমি সুইসাইড করতে বাধ্য হবো। তুমি কি চাও এমনটা হোক।

আমার মুখ থেকে আর একটাও কথা বের হলো না। শেষ পর্যন্ত আমি মায়া মুখে কি শুনলাম। এত আশা আকাঙ্খা নিমিষেই শেষ হয়ে যাবে?

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে