চলো না হারিয়ে যাই পর্ব-০৪

0
607

চলো_না_হারিয়ে_যাই ❤️ [৪]
লেখকঃ জয়ন্ত_কুমার_জয়

বিষণ্ণ খাম খুললো।দেখলো সেখানে স্পষ্ট লেখা, শিক্ষকের বাড়িতে গিয়ে বেয়াদবি করিবার মতো ধৃষ্টতার শাস্তি স্বরুপ সামনের বছরের ভর্তি কার্যক্রম বাতিল করা হইলো।

নামঃবিষণ্ণ
রোল নম্বর-২০৪

বিষন্ন ভয়ে ভয়ে সামনের কালো ব্লেজার পরিহিত লোকটির দিকে তাকালো।ব্লেজার, কালো ফ্রেমের চশমা পরিহিত লোকটি বিষণ্নর বাবা।বিষণ্ন যে ভয়টা করেছিলো সেটাই হলো।এইটুকু ব্যাপারে শুধু শুধু বাবাকে ডাকার কোনো মানে হয়?শুধু কলেজ কেন,তার ছাত্রত্ব আজীবনের মতো বাতিল করে দিলেও বিষণ্ণর কোনো সমস্যা ছিলো না।সমস্যাটা হয়েছে তার বাবাকে ডেকে এনে।বাবা সব সহ্য করতে পারেন,কিন্তু ছেলের নামে কেউ রিপোর্ট করবে সেটা মেনে নিতে পারেন না।

বিষণ্ণর বাবা চোখ থেকে চশমাটা খুলে হাতে নিলেন।প্রিন্সিপাল বললেন

” বিষণ্নকে এর আগে আমি নিজেই কয়েকবার ওয়ার্নিং দিয়েছি শুধুমাত্র মিষ্টি আর অপুর জন্য ”

বিষণ্ন বুঝতে পারলো খাটাস প্রিন্সিপাল তার এতোদিনের করা কুকর্মের ঝুলি শেষ না করে ছাড়বে না।বাবা বললেন

” অপু কে? ”

” কলেজের রাজনীতি টাজনীতি করে।আমায় খুব শ্রদ্ধা করে।ওর কথায় বিষণ্ণকে লাস্ট বারের মতো ছেড়েছিলাম ”

বাবা ভ্রু কুঁচকে বললো ” লাস্ট বার মানে?এর আগেও কিছু করেছিলো নাকি?

” লাস্টবার তো ও লাইব্রেরি থেকে বই চুরি করেছে ”

বাবা তার ভারী স্বরে বললেন ” আপনার হয়তো ভুল হচ্ছে। বিষণ্ন চুরির মতো নিম্নস্তরের কাজ কখনো করবে না ”

প্রিন্সিপাল প্রচন্ড অবাক হলো।তার থেকেও বেশি অবাক হলাম আমি।কারণ বই চুরির দায়ে প্রিন্সিপাল আমাকে একটা পেপারে সাইন করিয়ে নিয়েছিলেন।যেখানে লেখা ছিলো ভবিষ্যতে এমন কাজ করলে আমায় এক্সপেল্ট করে দেওয়া হবে।সেখানে বাবার সাক্ষর নিতে বলেছিলো।আমি পাকনামি করে বাবার বদলে সেখানে নিজেই সাইন করে দিয়েছিলাম।

তখন বেঁচে গেলেও এখন যে চিপায় পড়ে গেছি বেশ বুঝতে পারছি।প্রিন্সিপাল আমার দিকে তাকালেন।ওনার চোখে চোখ পড়তেই আমি গাধার বাচ্চার মতো একটা হাসি দিলাম।প্রিন্সিপাল বুঝতে পেরেছেন সাইনটা আমার পাকনামিতে করা।বাবা বললেন

” ওকে এক্সপেল্ট করেছেন জেনে খুশি হয়েছি।এখন আসি ”

একথা বলে বাবা প্রিন্সিপালের রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন।আমিও বাবার পিছু পিছু বেড় হলাম।ক্যাম্পাসের বেশিরভাগ ছেলে-মেয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে আমাকে আর বাবাকে দেখছে।

বাবা একটা রিক্সায় উঠে বসলেন,অথচ ক্যাম্পাসে বাবার বাইক দেখলাম দাড় করানো।বাইক ছেড়ে রিক্সায় কেন উঠলেন ঠিক বুঝলাম না।আমিও চুপচাপ তার পাশে গিয়ে বসলাম।মৃদু স্বরে বললাম

” বাবা আমি জানি তুমি খুব রেগে আছো।আমি ইচ্ছে করে এসব করিনি বিশ্বাস করো।সেদিন…. ”

পুরো কথা শেষ না করতেই বাবা আমায় থামিয়ে দিয়ে বললো ” যা বুঝলাম, তুমি এখানে পড়াশোনা বাদে সবকিছুই করছো।প্রিন্সিপাল ডেকে তোমার নামে রুপোর্ট দিচ্ছে।তুমি বুঝতে পারছো আমার অবস্থানটা কোথায় নামিয়েছো? ”

” পারছি ”

” মেসে গিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বাড়িতে চলে আসবে।আর হ্যা, প্রিন্সিপাল মিষ্টি নামের একটা মেয়ের কথা বলছিলো।মিষ্টি কে? ”

আমতা আমতা করে বললাম ” আমার বান্ধবী ”

” শুধুই বান্ধবী? ”

আমি লজ্জা পেয়ে বললাম ” হ্যা ”

” তোমার বয়সে থাকতে কেউ জিগ্যেস করলে আমিও বলতাম তোমার মা আমার বান্ধবী হয় ”

বাবা কি বোঝাতে চাইছে সেটা বুঝতে পেরে বললাম ” বাবা কি যে বলো,ওসব কিছুই না ”

” না হলেই ভালো ”

তারপর অনেক্ক্ষণ কে’টে গেলো দু’জনই চুপ থাকলাম।রিক্সা আমার মেসের সামনে থামলো।রিক্সা থেকে নেমে বাবার দিকে করুন দৃশ্য নিক্ষেপ করে বললাম

” বাবা আমি জানি তুমি হার্ট হইছো।তবুও বলছি,একটু প্রিন্সিপালকে বলবে প্লিজ? ”

যেন কিছুই জানেনা এমন একটা ভাব করে বাবা বললো ” কি বলবো ”

” উনি যেন আমার এক্সপেল্ট লেটারটা উঠিয়ে নেয়,প্লিজ ”

বাবা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন ” জিনিসপত্র গুছিয়ে কাল সকালে চলে আসবে।আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিবো ”

বাবা চলে গেলো।আমি মুখ ভাড় করে মেসে ঢুকলাম।ঢুকতেই দেখলাম মেস মালিক করিম ভাই দাঁড়িয়ে আছে।আমায় দেখে মুখ কালো করে বললো

” এসব কি? তোমরা নাকি ছাঁদে রাতবিরাতে নেং’টু হয়ে নাচটাচ করো?পাশের বাড়ির দুইজন আমাকে রিপোর্ট দিছে ”

মনে মনে বড় একটা হাফ ছাড়লাম।ভাগ্য ভালো বাবা আমার সাথে মেসে আসেননি।এসে এসব শুনলে জানিনা এখন আমার কি অবস্থা হতো।করিম ভাই বললো

” রিয়াদের লুঙ্গি খুলে দিছো কেন? ”

এমনিই মেজাজ খারাপ।তারমধ্যে এসব প্যানপ্যানানি সহ্য হলো না।চেঁচিয়ে বললাম ” আমি এখন রুমে গিয়ে ইম্পরটেন্ট একটা কল করবো।আপনার লুঙ্গি যদি কো’মড়ে রাখতে চান তাইলে চুপ থাকেন।নইলে ওরা কাল রাতে যা দেখছে,সেটা দিনের আলোয় আবার দেখাবো ”

একথা বলে রুমে আসলাম।করিম ভাই এমনি হলে সামান্য ব্যাপারে অনেক সময় ধরে বকবক করেন।কিন্তু আজ চুপ রইলেন।

বিছানায় ধপ করে শুয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে মিষ্টিকে ফোন করলাম।ফোন ওয়েটিং।রাগে বিছানায় উঠে বসলাম।এই ভর দুপুরে মিষ্টি কার সাথে কথা বলছে?

————-

জায়ানের সাথে কথা বলার মুহুর্তে মিষ্টি লক্ষ্য করলো বিষণ্ণ বারবার কল করেই যাচ্ছে।বিরক্ত হয়ে মিষ্টি জায়ানকে বললো

” এখন ফোন রাখি!একজন কল করছে বারবার ”

” কে কল করছে? বিষণ্ন? ”

মিষ্টি একটু অবাক হয়ে বললো ” হ্যা,কিন্তু আপনি জানলেন কিকরে? ”

” হাহাহা,তোমার পিছে তো ও আঠার মতো লেগে থাকে।তাই বললাম ”

” ও আঠার মতো লেগে থাকে না।আমরা অনেক ভালো বন্ধু ”

” আরেহ,তুমি রাগ করছো নাকি? আমি এমনি জাস্ট মজা করে বললাম ”

” এমন মজা আমার পছন্দ না।আমি লক্ষ্য করেছি বিষণ্ণকে আপনি সবসময় অন্যভাবে ট্রিট করে কথা বলেন ”

” আচ্ছা ম্যাডাম আমার ভুল হইছে।এখন ওরে ফোন ব্যাক করো দেখো কি বলে ”

মিষ্টি জায়ানের কল কে’টে বিষণ্ণকে কল করলো।সাথে সাথেই বিষণ্ণ কল রিসিভ করে হুমকির স্বরে বললো

” কার সাথে কথা বলছিলা,কে ফোন করছে? ”

” জায়ান ”

” জায়ানটা আবার কে ? ”

” আমার ক্লাসমেট ”

” ওর সাথে এতোক্ষণ ধরে কিসের কথা? ”

মিষ্টি কিছুটা বিরক্তির স্বরে বললো ” ওর সাথে কিসের কথা সেটা তুই শুনে কি করবি? আর দেখতেছিস আমি ফোনে কথা বলতেছি,তাও এক নাগাড়ে ফোন দিয়েই যাচ্ছিস ”

বিষণ্ন নমনীয় স্বরে বললো ” সরি ”

” তোকে দেখছি আজকাল কিছুই বলা যাবে না।মেয়েদের মতো কথায় কথায় রাগ কেন করিস? ”

” জানোই তো রাগ করি,তবুও রেগে কথা বলো কেন ”

” ওলে বাবালে,আমার পিত্তি বাবুতারে আর রাগ দেখাবো না ”

ওপাশ থেকে বিষণ্ণর হাসির শব্দ ভেসে এলো।মিষ্টি ধমক দিয়ে বললো ” পিচ্চির বাচ্চা হাসি থামা ”

” আচ্ছা থামালাম।এখন জায়ানের সাথে কি নিয়ে কথা হচ্ছিল?”

” এমনিই, ক্লাসে আসিনি কেন সেটা বলতে ফোন দিছে ”

” তুমি ক্লাসে না গেলে ও ফেন দিয়ে খোঁজ নেয়? ”

” হু।আমার একদম বিরক্ত লাগে।ওর মুখের উপর তো আর কে’টে দিতে পারিনা। তুই ফোন দেওয়াতে ভালোই হলো ”

” আর ভালো! আমায় কলেজ থেকে বেড় করে দিছে জানো? ”

মিষ্টি বিস্মিত হয়ে বললো ” বেড় করে দিছে মানে?”

” হ্যা।বাবাকেও ডেকেছে। বাবার সামনে লেটার হাতে ধরিয়ে দিছে ”

” এই দারা তো,জাস্ট এক মিনিট,”

এটা বলেই মিষ্টি গেলো বাবার রুমে।গিয়ে দেখলো বাবা অফিসে চলে গেছে।বাবাকে না পেয়ে মুখ ভোতা করে ফোন কানে দিয়ে বললো

” বিষণ্ন ”

” হু ”

” বাবাকে তো কাল বলছিলাম স্যারের সাথে কথা বলতে!”

” আঙ্কেল বললেই বা কি,ওনার কথায় কি হবে? ”

” আরে ছোট গাধা, প্রিন্সিপাল স্যার বাবার ক্লাসমেট ভুলে গেছিস নাকি ”

” এখন আমার কিছু মনে থাকে না ”

” তুই চিন্তা করিস না।আমি বাবাকে বলে একটা কিছু করিয়ে নিবো। আঙ্কেল যে এসছিলো কিছু বলছে?খুব রাগ করছে তাই না? ”

” একটু একটু করছে।এতক্ষণে বোধহয় ভুলেও গেছে।বাবা রাগ বেশিক্ষণ মনে রাখেন না।বাবার সর্বোচ্চ রাগ করে থাকার রেকর্ড ৪ ঘন্টা ১০ মিনিট ”

” রাগের আবার সময় ও হয়! ”

” রাগটা করেছিলো মায়ের উপর।মা’কে লাল শাড়ি পড়তে বলছিলো,আর মা পড়ছিলো হলুদ শাড়ি।এই নিয়ে ঝগড়া।বাবা রেগে বলছিলো,হলুদ শাড়িতে তোমায় কলা বউয়ের মতো লাগছে।তখন মা রেগে বললো,হ্যা ঠিক বলছো।আর সেই কলার লোভেই তো সাদা বাদরটা গ’লায় ঝুলে পড়লো।বাবাকে সাদা বাদর বলায় বাবা করলো রাগ!চার ঘন্টা কারো সাথে কথা বলেনি ”

এসব ঘটনা শুনে মিষ্টি খিলখিল করে হাসছে।মিষ্টির হাসি বিষণ্ন মুগ্ধ হয়ে শুনছে।মনে মনে ভাবছে,মেয়েটার হাসি এতো সুন্দর কেন?খুব ইচ্ছে করছে ওর সামনে বসে থেকে ওর হাসি দেখি!

মিষ্টি একটা বিষয় খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করেছে যে সে যতক্ষণ বিষণ্ণর সাথে কথা বলে ততক্ষন খুব ভালো একটা সময় কাটে।এই ছেলেটা একটু অন্যরকম।ওর সাথে কথা বলাতেও শান্তি!

বিষণ্ণ বললো ” তুমি কলেজে আসোনি কেন? ”

” পে’টে ব্যাথা ”

বিষণ্ন বিস্মিত হয়ে বললো ” পে’টে ব্যাথা এতোক্ষন বলোনি কেন,খুব ব্যাথা?হঠাৎ করে ব্যাথা কেন করবে। কাল রাতে কি খাইছো ”

” হঠাৎ না।চার পাঁচদিন থেকে ”

” বলোনি তো।ঔষধ খাচ্ছো?ডাক্তার দেখাইছো? ”

” এমনেই ঠিক হবে।কাল পরশুর মধ্যে ”

” এমনে ঠিক হলে এতোদিন হয়ে যেতো।আমি আসবো? ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই? ”

মিষ্টি নিজের কপালে হাত রেখে বললো ” তোরে তো সাধে পিচ্চি গাধা বলি না।বড় হলে বুঝবি ব্যাথা কেমনে ভালো হয়।সব ব্যাথার কারণ বলা যায় না ”

বিষণ্ণ কিছু বললো না।সম্ভবত পিচ্চি বলায় সে রাগ করেছে।সে রাগটাও ঠুমকো।বিষণ্ণ নিজেও চায় মিষ্টির মুখে পিচ্চি ডাক শুনতে।একবার কথায় কথায় মিষ্টি বলেছিলো,যা তোকে আর পিচ্চি ডাকবো না।সত্যি সত্যিই মিষ্টি বিষণ্নকে দুইদিন পিচ্চি বলে সম্বোধন করেনি।তৃতীয় দিনের দিন বিষণ্ণ একটা চুলের খোঁপা বাঁধানো কা’টা নিয়ে বাড়িতে হাজির।কা’টাটা আমার খোপায় রেখে মুখ ভোতা করে বলেছিলো ” এই পচা মেয়ে,তুমি পিচ্চি ডাকো না কেন? তোমার মুখে পিচ্চি ডাকটা না শুনলে ভালোলাগেনা।মুখেই শুধু রাখ দেখাই,কিন্তু মনে মনে ভালোই লাগে।সব কথা তোমায় বলা লাগে কেন?আসল পিচ্চি তো তুমি।না বললে কিছুই বুঝো না ”

মিষ্টি ভুলেই গেছিলো সে বিষণ্ণর সাথে ফোনে কথা বলছে।হুশ ফিরলো ফোনের ওপাশ থেকে বিষণ্ণর রাগি স্বরে।বিষণ্ণ বলছে

” কথা বলো না কেন? হ্যালো,হ্যালো,কথা শোনা যাচ্ছে না? ”

” হু যাচ্ছে। বিষণ্ণ শোন,সন্ধায় দেখা করবি? ”

” কোথায়? ”

” তোর যেখানে পছন্দ।প্রথমে আমার বাড়িতে আসবি।তারপর একসাথে তোর পছন্দের কোথাও যাবো ”

” আচ্ছা ”

” হু,ফোন রাখলাম ”

” আমি তাহলে সন্ধার আগেই চলে আসবো।যেখানে যাবো ভাবছি সেখানে সন্ধায় যেতে হয় ”

” আচ্ছা ”

ফোন কা’টলাম।পে’ট ব্যাথা বাড়তে লাগলো।ওয়াসরুমে গিয়ে প্যাডটা চেঞ্জ করে আসলাম।এখন কিছুটা স্বস্তি লাগছে।

বারান্দায় য়েতেই বিষণ্নর কথা মনে পড়লো।এই ছেলেটার কথা আমার সারাক্ষণ কেন মনে পড়ে বুঝতে পারি না।বাবাকে ফোন করে বলতে হবে প্রিন্সিপালের সাথে দ্রুত যেন কথা বলে।

ঠিক করলাম বিষণ্ণকে আমার মনের বড় সত্যিটা জানাবো।কথাটা বলা মাত্র ওর রিয়েকশনটা কেমন হবে? ও কি খুব অবাক হবে? নাকি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলবে,তুমি প্রেম করবা? প্রেম মানে কি বুঝো?

চলবে?
🥰

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে