চন্দ্রাণী পর্ব-৩৭ এবং শেষ পর্ব

0
644

#চন্দ্রাণী (৩৭-শেষ পর্ব)
চন্দ্র ভেবেছিলো যতো কষ্টই হোক সে কিছুতেই কান্না করবে না।সে কান্না করলে মা বাবা সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়বে। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো তাকে যখন কবুল বলতে বলা হলো তখন চন্দ্র খেয়াল করলো সে নিরবে কেঁদে চলেছে। দু চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ে শাড়ি ভিজে যাচ্ছে।
চন্দ্রর মনে হলো কেউ বুঝি তার গলা টিপে ধরে শ্বাস রোধ করে রেখেছে। কিছুতেই গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না তার।
চন্দ্র আকুল নয়নে মায়ের দিকে তাকালো। রেহানা সবাইকে সরিয়ে মেয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে মেয়ের হাতে আলতো চাপ দিয়ে বললো, “বল মা কবুল।”

চন্দ্র নিজেকে সামলাতে পারলো না। মা’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো, “আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”

পরবর্তী পুরোটা সময় চন্দ্র মা’কে জড়িয়ে ধরে রাখলো।রেহানার কেমন পাগল পাগল লাগছে।মনে হচ্ছে আজরাইল বুঝি তার জানটা নিয়ে নিচ্ছে। মৃত্যু যন্ত্রণা কেমন হয় রেহানা জানে না কিন্তু এই মুহূর্তে যেই যন্ত্রণা পাচ্ছে তা কোনো অংশে কম না।
এ যেনো জেনেশুনেই কষ্ট পাওয়া।

শাহজাহান তালুকদার দূর থেকে মেয়েকে দেখে যাচ্ছেন। মেয়ে ভেঙে পড়েছে, তিনি সামনে এলে আরো ভেঙে পড়বেন।
পুরুষ মানুষ বলে কথা, চাইলেও সবসময় কান্না আসে না।অথচ আজকে কেমন অবলীলায় দুই চোখ বারবার ভিজে উঠছে।কন্যা সম্প্রদানের সময় শাহজাহান তালুকদার বুকফাটা আর্তনাদ করতে লাগলেন।সারা পৃথিবী বুঝি অন্ধকার হয়ে আসছে তার।তার ঘরের আলোর প্রদীপ অন্য ঘরকে আলোকিত করতে চলে যাবে।
আহারে,এই বুঝি শেষ হয়ে গেলো মেয়ের উপর বাবা মায়ের সব অধিকার, সব দায়িত্ব।
এরপর আর অভিভাবক হিসেবে শাহজাহান তালুকদারের নামটা বসবে না।এরপরে আর কখনো মেয়েকে আগের মতো করে কাছে পাবেন না।
চিৎকার করে তিনি বললেন,”ও আল্লাহ,এতো যন্ত্রণা কেমনে সহ্য করবো গো মাবুদ। আমার কলিজে ছিড়ে যাচ্ছে গো আল্লাহ।আমার মা’কে আমি বিদায় দিয়ে দিচ্ছি নিজের হাতে!
বাবারে,আমি মানুষ হয়তো খুব খারাপ। চেয়ারম্যান হিসেবে সবার প্রিয় না হয়তো, ভাই হিসেবে খারাপ, স্বামী হিসেবে খারাপ, বন্ধু হিসেবেও খারাপ হতে পারি।
আমি বাবা হিসেবে সবসময় ভালো হতে চাইছি।নিজের সবটা দিয়ে বাবার দায়িত্ব পালন করতে চাইছি।এই পৃথিবীতে আমার বড় মেয়ের চাইতে অধিক প্রিয় কোনো জিনিস নাই,কোনো মানুষ নাই।
আমি বেহেশত কেমন হবে জানি না, তবে সবসময় মনে হতো আমার চন্দ্র আমারে বাবা বলে ডাকলে আমার কলিজা যেমন শান্ত হয়ে যায় বেহেশত ও এরকমই। আমার মেয়ে ছাড়া আমি নিঃস্ব একেবারে। আমার উপর তোমার অনেক রাগ,জেদ থাকতে পারে। আমার কোনো অপরাধের জন্য আমার মেয়েরে এক ফোঁটা কষ্ট দিও না।আমার মেয়ের চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়ালে তা আমি মাটিতে পড়তে দিই নি।আমি বুকে পেতে নিয়েছি।কোনো সময় যদি মনে হয় আমার মেয়ের সাথে তোমার চলছে না আমার মেয়েকে একটা ফুলের টোকা ও দিও না আমাকে বলো আমি আমার মেয়েকে আমার কাছে নিয়ে আসবো।আজ তোমাকে আমি শুধু আমার কন্যা সম্প্রদান করছি না সেই সাথে সম্প্রদান করছি আমার কলিজা, আমার শান্তি,আমার সুখ,আমার পুরো জীবন। ওই চোখে জল গড়ালে আমার বুকে রক্তক্ষরণ হবে। আমার মেয়েকে ভালো রেখো বাবা।”

শর্মী, শুভ্র দুজনেই কাঁদছে বোনকে ধরে। পুরো বাড়িতে যেনো শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
রেহানা বিছানায় বিলাপ করে কাঁদছেন।চন্দ্রর পুরো পৃথিবী অন্ধকার লাগছে।দৃষ্টি ঘোলা হয়ে আসছে।ভীষণ চক্রাকারে মাথা ঘুরছে।টগর শক্ত করে চন্দ্রকে ধরে রাখলো।চন্দ্রকে ধরাধরি করে গাড়িতে তুলে দিলো সবাই।শাহজাহান তালুকদার জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। চন্দ্র বেহুশ হয়ে আছে।টগর সযত্নে চন্দ্রর মাথা নিজের কাঁধে নিয়ে বললো, “আমরা আসি আব্বা।”

গাড়ি চলছে।শাহজাহান তালুকদার বুক চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়েছেন।চিৎকার করে বলছেন,”ও গাড়ি থাম,আমার কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে রে আল্লাহ।আমার মা’কে তোরা নিয়ে যাচ্ছিস রে।আমার মা ছাড়া আমার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যাবে।আমি কিভাবে বাঁচবো গো মাবুদ।”

জগতের নিষ্ঠুর নিয়ম মেনে গাড়ি চলে গেলো নব দম্পতিকে নিয়ে। পেছনে রেখে গেলো একজন ভগ্নহৃদয় বাবাকে।

নির্ঝর পকেট থেকে টিস্যু বের করে শর্মীকে দিয়ে বললো, “আজকেই কি চোখের পানি সব শেষ করে ফেলবে?আমাদের বিয়ের দিন ও তো কাঁদতে হবে।তখনকার জন্য ও তো রাখতে হবে চোখের জল বাঁচিয়ে। ”

শর্মী কান্নার মধ্যে ও ফিক করে হেসে বললো, “গাছে কাঁঠাল,গোঁফে তেল।”

নির্ঝর আলতো করে শর্মীর হাতে চাপ দিয়ে বললো, “গাছের কাঁঠাল পাকলে ঘরে ও তুলে নিতে জানি।সে নিয়ে তুমি ভেবো না।”

টগরদের পুরো বাড়ি খালি।যেহেতু বাবা মা কেউ নেই টগরের,আত্মীয় স্বজনের সাথে সম্পর্ক নেই বললেই চলে। তবুও যাদের বলেছে বিয়েতে তারা সবাই যার যার বাড়িতে ফিরে গেছে।
গাড়ি থেকে নেমে টগর চন্দ্রকে কোলে তুলে নিলো।

চন্দ্রর যখন হুশ এলো দেখলো একটা বিছানায় শুয়ে আছে। খুব সিম্পলভাবে রুমটা সাজানো। চন্দ্র বুঝতে পারলো সে এখন টগরের বাড়ি।
হুট করে চন্দ্রর বুকের ভেতরে একটা শূন্যতা চেপে বসলো।মনে হচ্ছে নিজেকে ফেলে এসেছে বাবার বাড়িতে।
পুরো বাড়ি কেমন শূন্য, জনমানবহীন।
টগরকেও দেখা যাচ্ছে না।

কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো চন্দ্র।বুকে কেমন তীব্র একটা ব্যথা হচ্ছে।

টগর এলো মিনিট দশেক পর। চন্দ্রকে বসে থাকতে দেখে মুচকি হেসে বললো, “আমার মহারানী তাহলে উঠলো এতক্ষণে। ”

চন্দ্র কথা বললো না। বলার মতো তার কোনো কথা নএই যেনো।টগর চন্দ্রর হাত ধরে বললো, “আজ থেকে তুমি সম্পূর্ণ আমার। কতো দিন পর আমার নিজের একটা মানুষ হলো জানো!
আমার ছন্নছাড়া জীবনে গুছানোর মতো একজন এলো।
আমাকে ভালোবাসার একজন এলো।
তুমি শুধু আমাকে একটু ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখো,আমি পৃথিবীর সব সুখ তোমার পায়ের কাছে এনে দিবো।
তুমি শুধু সারাজীবন আমার থেকো,আমি জনমে জনমে তোমার সাধনা করে যাবো।”

চন্দ্রর কেমন অস্থির লাগছে। টগরের উপর রাগ ও হচ্ছে। তাকে ব্লক করে রেখে এখন কেমন প্রেম দেখাচ্ছে। মুখ ভোঁতা করে চন্দ্র বললো, “আপনি কোনো কথা বলবেন না।আমাকে ব্লক দিয়ে রেখে এখন আবার ভালোবাসা দেখানো হচ্ছে। ”

টগর হেসে চন্দ্রকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, “মাঝেমাঝে খুব কাছে আসার জন্য একটু দূরত্ব করতে হয়।এই যে দুইদিন কথা বলি নি,এখন ইচ্ছে করছে বাকি জীবনটা শুধু ননস্টপ তোমার সাথে কথা বলে এই দুই দিন কথা না বলার প্রায়শ্চিত্ত করবো।”

চন্দ্র মুচকি হাসলো। টগর হাত ধরে বললো, “চলো আমার সাথে এবার,তোমার সংসার তোমাকে বুঝিয়ে দিই।”

চন্দ্র উঠলো। উঠে এসে দেখে টগর চুলায় কফি বসিয়েছে। দুইটা কাপে কফি নিয়ে টগর বললো, “চলো আমরা ছাদে গিয়ে বসি।”

চন্দ্র টগরের পিছুপিছু ছাদে গেলো।ছাদে গিয়ে একটা ছোট ধাক্কা খেলো চন্দ্র।পুরো ছাদে অসংখ্য ফুল ফল গাছ।একটা দোলনা আছে ফুল দিয়ে সাজানো।

দুজন গিয়ে দোলনায় বসলো।টগর চন্দ্রর মাথা নিজের কাঁধে টেনে নিয়ে বললো, “এই ছাদে তুমি ছাড়া কেউ আসে নি আর।এটা আমার ভীষণ স্পেশাল একটা জায়গা।তোমাকে ভেবে এই জায়গাটা আমি সাজিয়েছি। আমাদের যখন মান অভিমান হবে তখন এই দোলনায় এসে তুমি বসে থাকবে।আমি কফি নিয়ে এসে তোমার মান ভাঙাবো।
আমি সব হারানো মানুষ চন্দ্র।সর্বহারা মানুষ খড়কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়।আমি তো তোমাকে পেয়েছি। তোমাকে ঘিরে আমার অনেক স্বপ্ন চন্দ্র।তোমাকে নিয়ে আমি বাঁচতে চাই পুরোটা জীবন। তুমি আমার হয়ে থেকো শুধু। ”

চন্দ্র চুপ করে তাকিয়ে রইলো টগরের দিকে। কি অদ্ভুত না!
একটা সময় এই মানুষটাকে বিরক্তিকর মনে হতো অথচ এখন মনে হচ্ছে এই মানুষটাই তার সবচেয়ে আপন মানুষ।
চন্দ্র টগরের হাত শক্ত করে ধরলো। টগর মুচকি হেসে গান ধরলো,
“এইভাবে যদি কেটে যায় চিরদিন
রঙে রঙে যদি হয় মনটা রঙিন
স্বপ্নের দিন যখন আসে আপনজনের ছোঁয়ায়
ভরে যায় খুশিতে তখন এ হৃদয়”

(সমাপ্ত)
রাজিয়া রহমান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে