চন্দ্রাণী পর্ব-৩৬

0
459

#চন্দ্রাণী(৩৬)
একটা রাত কাটলো নির্ঘুম, হতাশা,আক্ষেপের সাথে যুদ্ধ করে। টগরের দুই চোখ দিয়ে নিরবে অশ্রু ঝরছে।
যতবার মনে পড়ছে যাকে ঘরণী করবে সে তার জন্যই বাবাকে হারিয়েছে ততবারই টগরের দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যায়।
এখন মনে হচ্ছে এই সত্যিটা না জানলেই বুঝি ভালো হতো। নিজেকে নিজে অনেক স্ট্রং মান ভাবতো টগর। এখন মনে হচ্ছে সে ভীষণ হালকা মনের মানুষ।

ভাবতে ভাবতেই রাত কাটলো টগরের। অন্ধকার কেটে আস্তে আস্তে আলো ফুটতে শুরু করেছে। সেই সাথে টগরের মনের ও সকল হতাশা কেটে যাচ্ছিলো।

নিজেকে নিজে প্রশ্ন করলো,”এখানে চন্দ্রর দোষ কোথায়?চন্দ্র তো কোনো কিছুর সাথে জড়িত না।কেউ একজন ওকে অতিরিক্ত ভালোবেসে যদি কোনো অপরাধ করে তার দায়ভার কেনো চন্দ্র নিবে?”

সব ভাবনা চিন্তা শেষ করে টগর সিদ্ধান্ত নিলো চন্দ্রর বাবার সাথে কথা বলবে।

শাহজাহান তালুকদার কাচারি ঘরে একা বসে আছেন।ইলেকশন আর বেশি দেরি নেই।কাদের খাঁন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছে।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবার তিনি জয়ী হবেন অতজচ বুকটা কেমন ভার লাগছে তার।
বাহির থেকে সালাম দিয়ে টগর ভেতরে এলো।টগর কে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হলেন শাহজাহান তালুকদার। টগরকে তিনি আশা করেন নি।

মুখোমুখি চেয়ারে বসে টগর বললো, “যেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আমার বাবা মা’কে, এবার তা পূর্ণ করুন চাচা।আমার বউকে আমার হাতে তুলে দিন।আমার শূন্য ঘর পূর্ণতা পাক।”

শাহজাহান তালুকদার জানতেন এরকম একটা দিন নিশ্চয় আসবে।টগর চন্দ্রকে নিতে আসবে।তবে এতো শীঘ্রই টগর সব কিছু মানিয়ে নিতে পারবে বুঝেন নি।কেমন বুকের ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে শাহজাহান তালুকদারের। মেয়েটা চলে যাবে?
তার ঘরটা খালি করে দিবে?

শাহজাহান তালুকদার বললো, “আমি তোমার চাচীর সাথে কথা বলে জানাবো।”

টগর মাথা নাড়িয়ে বললো, “না চাচা,আমার সময় নেই।আমাকে গ্রাম থেকে চলে যেতে হবে যেকোনো মুহূর্তে। হেডঅফিস থেকে যেকোনো মুহূর্তে মেইল আসবে।আমি আমার বউ নিয়ে ফিরতে চাই।আপনি চাচীর সাথে গিয়ে কথা বলে আসুন।আমি অপেক্ষায় আছি।”

এই ছেলেটা সহজে তাকে ছাড়বে না তিনি বুঝতে পেরেছেন।তাই অগত্যা উঠে গেলেন।

রেহানা রান্না ঘরে রান্না বসিয়েছে। চন্দ্র মা’কে তরকারি কেটে দিচ্ছিলো। শাহজাহান তালুকদার গিয়ে একটা মোড়ায় বসে পড়লেন।
রেহানার দিকে তাকিয়ে বললেন, “রেহানা,টগর এসেছে। ”

চন্দ্র চমকে উঠলো বাবার কথা শুনে।

রেহানা উৎকণ্ঠিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি বললো? ”

তালুকদার মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “ওর বউ ও ফিরিয়ে নিতে চায়।দুই এক দিনের ভেতরেই নিয়ে যেতে চায় বউ করে। ”

রেহানার বুকটা কেমন খালি খালি লাগতে লাগলো। আর বুঝি মেয়েকে কাছে রাখতে পারবেন না!
মেয়ে হয়ে জন্মানোর এতো জ্বালা কেনো দুনিয়ায়!
এতো আদর ভালোবাসা দিয়ে লালন করা মেয়েটাকে অন্যের হাতে কিভাবে তুলে দিবেন তিনি?

বুকে পাথর চেপে রেহানা বললো, “মেয়ে যখন হয়েছে তখন আজ হোক আর কাল,পরের ঘরে যাবে-ই। আপনি আয়োজন করুন।”

একদিন পর বিয়ের দিন ঠিক করা হলো।

চন্দ্রর কেমন লাগছে বুঝতে পারছে না। শাহজাহান তালুকদার পুরো গ্রামের সবাইকে দাওয়াত করেছেন, আত্মীয় স্বজন সবাইকে দাওয়াত করেছেন। কানিজকে ও দাওয়াত করেছেন।

চন্দ্র মনে মনে চাইলো কানিজ যাতে বিয়েতে না আসে।একটা মুহূর্তের জন্য ও যদি তার মনটা কানিজকে দেখলে দুর্বল হয়ে যায়, তার দিকে তাকাতে চায়,মায়ায় পড়ে যায় যদি!
কি এক অদ্ভুত দোটানা চন্দ্রর।কাকে দোষ দিবে!
কানিজের দোষ আছে কি নেই চন্দ্রর জানা নেই,তবে এটুকু চন্দ্র জানে যাকে সে মা বলে ডাকে তার কোনো দোষ নেই।তাকে এক চুল পরিমাণ কষ্ট দিতে পারবে না চন্দ্র।
নাই বা পেটে ধরুক, নাই বা জন্ম দিক তবুও ছোট্ট চন্দ্রকে আদর ভালোবাসা দিয়ে তো তিনিই বড় করেছেন। সবার চাইতে বেশি করেছেন সবসময় চন্দ্রর জন্য বিনা স্বার্থে।
শুধু চন্দ্র মা বলে ডাকবে এই টুকু পেতে সারাজীবন কষ্ট করেছেন যিনি তাকে চন্দ্র ঠকাতে চায় না।

কানিজ বিয়েতে এলো না সত্যি।অবশ্য বিয়েতে আসার মতো সেই মনোবল, সাহস কোনোটাই নেই তার।
যেই মেয়েকে সে একবারের জন্য আমার বলে দাবি করতে পারবে না,তার চোখের সামনে মেয়ে অন্য কাউকে মা বলে জড়িয়ে ধরে আকুল হয়ে কান্না করবে কানিজের তখন সহ্য যদি না হয়?
সারাজীবন জীবন তাকে নানাভাবে ঠকিয়েছে,সবসময় তিনি হারিয়ে এসেছেন।
কষ্ট পেতে পেতে এখন সব গা সওয়া হয়ে গেছে। নতুন করে আর কষ্ট পেতে চান না তাই।

চন্দ্রর বিয়েতে এক জোড়া কানের দুল উপহার হিসেবে পাঠালেন কাদের খাঁনের কাছে।
টগর চন্দ্রর নাম্বার আর আনব্লক করে নি।চন্দ্র বিয়ের কথা বার্তা হওয়ার পর থেকে টগরের ফোনে ট্রাই করছে কয়েক বার।টগর যেহেতু ওকে আনব্লক করে নি রাগ করে চন্দ্র ও আর অন্য কোনো নাম্বার থেকে ট্রাই করে নি।

বিয়ের দিন সকাল থেকে চন্দ্রর কেমন ভয় ভয় করতে লাগলো। বারবার মনে হচ্ছিলো বিয়েটা যদি ভেঙে যায় তবে ভালো হবে।
সকাল থেকে অতিথি আগমনে তালুকদার বাড়ি গমগম করছে।শাহজাহান তালুকদার মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে ৪ টা গরু জ/বেহ করেছেন।

চন্দ্র ঘুরে ঘুরে সবকিছু নিরবে দেখছে।কতো আয়োজন তার বিয়ে উপলক্ষে। কতো মেহমান। এদের সবাইকে চন্দ্র চিনে না।
কেউ কেউ ফিসফাস করে বলছে, “পালক নেওয়া মেয়ের জন্য মানুষ এতো আয়োজন করে!বাবা,ভাবা যায় না এগুলো। ”

কেউ আবার বলছে, “পুরনো প্রেমিকার মেয়ে তো তাই মনে হয় একটু আদর বেশি। ”

চন্দ্র ঘুরছে,শুনছে,মুচকি হেসে সরে আসছে।

রেহানা মেয়েকে দেওয়ার জন্য গহনা বের করলো। চন্দ্রর বড় মামী রেহানার হাত ধরে বললো, “রেহানা,তুই এতো বোকার হদ্দ কেনো রে?”

রেহানা বুঝতে না পেরে বললো, “কেনো? কি হয়েছে ভাবী?”

এদিক ওদিক তাকিয়ে তিনি বললেন,”এই মেয়ে তো তোর নিজের না,তার উপর তোর জামাইয়ের পুরনো প্রেমিকার মেয়ে।সেই মেয়েরে কি-না তুই এতো আদর যত্ন করে পালতে গেলি!এই মেয়ে দুই দিন পর তোর থেকে মুখ ফিরাইয়া নিজের মায়ের কাছে যাইবো।পর কোনো দিন আপন হয় না।তুই এরকম বোকামি কেমনে করলি!কেমনে ভুলে গেলি বিয়ের পর চেয়ারম্যান তোরে কতো অবহেলা করছে শুধু এই মেয়ের মায়ের জন্য।
সেই মেয়েরে কি-না তুই এখন এতো গহনা দিতে চাস!আবার না-কি ওই মেয়ের নামে তোরা আলাদা করে সম্পদ ও দিয়ে রেখেছিস আগেই!তোর নিজের পেটের গুলোর কথা ভাবলি না?
এখনও সময় আছে রেহানা,এসব বাদ দে।যা করার করছস,এসব গহনা শর্মীর আর শুভ্রর বউয়ের জন্য রাখ।এই মেয়ে তোর কোনো দিন ও নিজের মেয়ের মতো থাকবে না দেখিস।”

রেহানার মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো। চোয়াল শক্ত করে বললো, “ভাবী,আপনি যদি সসম্মানে এখনই বিয়ে বাড়ি থেকে চলে যান তবে আমি খুশি হবো।আমার মেয়ের বিয়েতে আপনার থাকতে হবে না। চন্দ্র আমার মেয়ে,পুরো দুনিয়ার মানুষ ও যদি আমাকে বলে চন্দ্র আমাকে ছেড়ে চলে যাবে আমি বিশ্বাস করবো না।আর যদি কখনো আমার মেয়ে আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় ও তাতে ও আমার আক্ষেপ থাকবে না।
আমি ওকে আমার জীবনে এনেছি, ও তো নিজে যেচে আমার কাছে আসে নি। আমি আমার সুখের জন্য, শান্তির জন্য ওকে এনেছি।আমার মানসিক বিপর্যয়ের সময় আমার চন্দ্র আমাকে শান্তি দিয়েছিলো।আমি কেনো ওর থেকে প্রতিদান আশা করবো?আমি তো প্রতিদানের জন্য ওকে ভালোবাসি নি।বরং আমারই তো ওকে প্রতিদান দেওয়া উচিত। যেই মেয়েটা আমার মানসিক কষ্ট কমিয়ে দিয়েছে,নিজের আধো আধো বুলি দিয়ে আমাকে মা বলে ডেকে অশান্ত মন শান্ত করেছে। ছোট্ট দুই হাতে আমাকে ঝাপটে ধরেছে।শর্মীকে আমি পেটে ধরেছি,বুকের দুধ খাইয়েছি তাই শর্মীর আমার প্রতি ভালোবাসা হয়েছে। অথচ ওকে তো আমি পেটে ধরি নি,বুকের দুধ ও খাওয়াতে পারি নি অথচ ও আমাকে ভালোবেসেছে কারণ ছাড়া। আমার তো মনে হয় আমার পেটে যাদের ধরেছি তাদের চেয়ে ভালোবাসা বেশি পাওয়ার যোগ্য যাকে আমার চন্দ্রর।শুভ্র,শর্মীকে যদি বলা হয় আমার পেটে ধরা সন্তান তবে আমার চন্দ্র আমার বুকে ধরা সন্তান,আমার কলিজায় ধরা সন্তান। কেনো সবসময় পেটে ধরলেই নিজের সন্তান বলতে হবে,বুকের মধ্যে যাকে ভালোবাসা দিয়ে লালন করা হয় তাকে কেনো পর বলা হবে?
চন্দ্র আমার মেয়ে,সারাজীবন ও আমার মেয়েই থাকবে।তোমাদের কারো যদি মেনে নিতে অসুবিধা হয় এখনই এখান থেকে চলে যাও।আমার মাথা গরম হওয়ার আগেই বিদায় নাও।নয়তো অপমান করে বিদায় করবো।”

রেহানার এই ব্যবহারে চন্দ্রর বড় মামী রাগ করলেন।রেহানার বড় ভাই আব্দুল সাত্তার তখন বাবুর্চিদের কাজ তদারকি করছেন।স্ত্রী গিয়ে কান্নাকাটি করে বললো তার বোন তাকে অপমান করেছে,চলে যেতে বলেছে এখান থেকে। আব্দুল সাত্তার সব শুনে বললো, “রেহানা যা করেছে ভালো করেছে। তোমাকে তো কেউ বলে নি গায়ে পড়ে এতো উপদেশ দিতে আমার বোন কে। এতো বছর যখন কেউ জানতো না চন্দ্রর আসল পরিচয়, তখন তো কেউ বলে নি কেনো চন্দ্রকে এতো বেশি ভালোবাসে ওর বাপ মা।এখন কেনো এতো প্রশ্ন উঠছে তাহলে!
আজকে তো তোমার দরকার ছিল না এসব কথা বলার,ওরা যখন ওদের মেয়েকে সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি দিচ্ছে, সেখানে তুমি বাহিরের মানুষ হয়ে কেনো নাক গলাতে যাও ওদের পারিবারিক কথাতে?নাকটা আরেকটু ছোট করো।আমি রিকশা ডেকে দিচ্ছি বাড়ি চলে যাও।এখানে থেকে এর কাছে প্যাঁচ লাগাবে,ওর কাছে প্যাঁচ লাগাবে এসব আমার সহ্য হবে না।ভাগ্য ভালো রেহানাকে বলেছো,চেয়ারম্যান যদি এসবের সামান্য কিছু শুনে তাহলে আমাদের পুরো গুষ্ঠিকে চলে যেতে বলবে এখান থেকে। ”

স্বামীর কাছে ও পাত্তা না পেয়ে চন্দ্রর বড় মামী চুপসে গেলেন।গুটিগুটি পায়ে আবারও ভেতরের দিকে চলে গেলেন।

বরপক্ষ থেকে মেহমান এসেছে প্রায় ১০০ এর মতো। কোনো শেরওয়ানিতে না,টগর পরেছে একটা আকাশি কালার পাঞ্জাবি। বর পক্ষের আনা লাগেজ থেকে চন্দ্রর জন্য বের হলো বেবি পিংক কালার একটা বেনারসি শাড়ি খুবই সিম্পল কাজের।
বিয়ে মানেই যেখানে লাল শাড়ি সেখানে এরকম শাড়ি দেখে কেউ কেউ দু একটা কথা বলতে বাদ দিলো না।

শর্মী ফিসফিস করে চন্দ্রকে বললো, “আপা,ভাইয়ার পছন্দ কিন্তু বেশ ভালো। ইউনিক হয়েছে তোর বিয়ের শাড়িটি। আমার কি যে ভালো লাগছে।”

চন্দ্র মুচকি হাসলো। বুকের ভেতর ভয়,উৎকন্ঠা। কেমন হবে টগরের সাথে জীবন!
খুব অন্তরঙ্গ মুহূর্তে যদি টগরের মনে পড়ে যায় যাকে সে এতো কাছে টেনে নিয়েছে তার জন্য বাবাকে হারিয়েছে টগর, তখনও কি টগর চন্দ্রকে গ্রহণ করতে পারবে!
এক মুহূর্তের জন্য যদি টগর অবহেলা নিয়ে তাকায় চন্দ্রকে সহ্য করতে পারবে?
টগর তো মুখ ফিরয়েই নিয়েছিলো চন্দ্রর থেকে,এখন মনে হচ্ছে সেটাই বুঝি ভালো হতো।
টগরের সাথে ভবিষ্যৎ কেমন কাটবে এই আশংকা বারবার মনে আসে চন্দ্রর।

চন্দ্রকে শাড়ি পরিয়ে,সাজিয়ে স্টেজে নেওয়া হলো। টগর এক নজর চন্দ্রর দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো। মনে মনে বললো, “এতো সুন্দর লাগতে নেই বউ,আমি যে মাতাল হয়ে যাবো তোমার নেশায় আসক্ত হয়ে।”

রেহানা একটু পেছনে দাঁড়িয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। মনে হচ্ছে কেউ বুঝি তার দেহ থেকে প্রাণটা আলাদা করে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। রেহানার দম বন্ধ হয়ে আসছে।আল্লাহকে বললো, “এতো কঠিন যদি নিয়ম করবে আল্লাহ মেয়েকে বিদায় দিয়ে দেওয়ার মতো, তবে মা বাবার মন পাথর করে দাও নি কেনো?
এই যন্ত্রণা কিভাবে সহ্য করবো গো আল্লাহ! ”

চলবে……
রাজিয়া রহমান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে