#চন্দ্রাণী (৩১)
কারো মায়ায় পড়ে যাওয়ার মতো ভয়ংকর নেশা দ্বিতীয় কিছু নেই।নির্ঝর মুগ্ধ হয়ে শর্মীকে দেখছে। মেয়েটার চোখের নিচে পড়া কালিটাও কেমন আদুরে লাগছে নির্ঝরের কাছে।
এতো মায়া কেনো একটা মানুষের জন্য জন্মাবে হুটহাট?
ভাবতে ভাবতে ঘোর লেগে গেলো নির্ঝরের। আকাশের ওই সাদা মেঘের মতো মন ছুটে চলেছে। ঘোর কাটলো টগরের কথা শুনে। টগর স্পষ্ট সুরে বললো, “যে কারণে এসেছি আজ সেটা বলছি।আপনার বাসার সবাই এখানে উপস্থিত আছে তো চেয়ারম্যান সাহেব?”
টগর সটান হয়ে বসেছে চেয়ারে,কপালের উপর কয়েকটা এলোমেলো চুল অবহেলায় পড়ে আছে।
হাতে একটা ঘড়ি,পরনে একটা আকাশি কালার শার্ট।শাহজাহান তালুকদার তাকিয়ে আছে টগরের দিকে। এই ছেলেটাকে আজকে কেমন অন্য রকম লাগছে। সবসময় যেমন ঘোর লাগা একটা দৃষ্টি ছিলো আজ তেমন মনে হচ্ছে না।
শাহজাহান তালুকদার বললো, “সবাই বলতে আমার কর্মচারী বাবুল দাশ তো নেই আর কাজ করার মহিলা একজন এখনো আসে নি।”
নির্ঝর জিজ্ঞেস করলো, “বাবুল দাশ কোথায়?আর কাজের মহিলা?”
শাহজাহান তালুকদার বললো, “বাবুল কোথায় গিয়েছে আমি জানি না আর কাজের মহিলা এখনো আসে নি।আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে। ”
টগর বললো, “অসুবিধা নেই,মেইন কালপ্রিট যে সে এখানেই আছে।”
চন্দ্র বাবা মা’র দিকে তাকালো। তার বিশ্বাস, ভরসা সব দিন দিন কেমন বিলীন হয়ে যাচ্ছে। রেহানার দুই চোখ ছানাবড়া।
শর্মী প্লেট বাটি গুছিয়ে রাখছিলো রান্নাঘরে। টগরের কথা শুনে সে-ও চমকে উঠলো। কি বলছে টগর!
শাহজাহান তালুকদার নড়েচড়ে বসে বললো, “কে অপরাধী আর কে অপরাধী না,সেটা তুমি জানো কীভাবে? এটা পুলিশের দায়িত্ব, কোনো জাত মাতালের না।যে নিজেই কিনা মাতাল হয়ে থাকে,বাড়িতে মদ দিয়ে ভরিয়ে রাখে।তুমি কি ভেবেছো আমি জানি না তোমার বাড়িতে কোথায় মদের গোপন আস্তানা? ”
নির্ঝর বললো, “কি বলছেন আপনি? ”
শাহজাহান তালুকদার বললো, “ইন্সপেক্টর, যাকে আপনি সাথে করে নিয়ে এসেছেন সে যে একজন মাতাল তা তো আপনি জানেন নিজেই।ওর বাড়িতে মদের কারখানা বলতে পারেন।সে এসেছে অপরাধী খুঁজতে। ”
টগর হেসে বললো, “প্রমাণ করতে পারবেন?”
শাহজাহান তালুকদার বললো, “নিশ্চয়। ”
নির্ঝর দুইজন কনস্টেবলকে শাহজাহান তালুকদারের সাথে পাঠিয়ে বললো, “ওনার সাথে যাও,গিয়ে দেখে আসো ওনার কথা কতটা সত্য।”
শাহজাহান তালুকদার উঠে দাঁড়ালো। রেহানা বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শাহজাহান তালুকদার চলে যাওয়ার পর টগর বললো, “এভাবে তাকাবেন না চাচী আম্মা,এটা তো প্রাচীন যুগ না।প্রাচীন যুগ হলে এতক্ষণে আমি ভস্ম হয়ে যেতাম।”
রেহানা হিসহিসিয়ে বললো, “এখানে কেনো এসেছো তুমি? তোমার উদ্দেশ্য কি?”
টগর বললো, “আমার উদ্দেশ্য একটাই আম্মা,আমি আমার বউকে ফেরত চাই।”
রেহানা চমকে উঠলো। চেহারা মুহূর্তে পাংশুবর্ণ লাভ করলো। নিজেকে সামলে বললো, “কিসের বউ?কার বউ?”
টগর হেসে বললো, “মনে নেই আম্মা?কথা ছিলো আমার পুতুলের ১৮ বছর হলে আমার হাতে তুলে দেওয়া হবে। তারপর কি হলো আম্মা?”
টগর পকেট থেকে একটা ছবি বের করে রেহানার সামনে দিলো।
রেহানার হাত পা কাঁপতে লাগলো। পুরো পৃথিবী যেনো কাঁপছে। চন্দ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে।তাকে জানতে হবে সবটা।
রেহানা শান্ত স্বরে বললো, “কি বলছো এসব?”
টগর হাসতে লাগলো। রেহানার মনে হচ্ছে তার কানে যেনো কেউ বিষ ঢেলে দিচ্ছে। এই ছেলেটা এভাবে হাসছে কেনো?
চন্দ্র এভাবে তাকিয়ে আছে কেনো,এবার কি তাহলে সত্যি সত্যি মেয়েকে হারিয়ে ফেলবে?
নিজেকে নিজে সামলাচ্ছে রেহানা।না তাকে ভেঙে পড়লে চলবে না।কিছুতেই না।
সিতারা বানু রেহানার দিকে তাকিয়ে বললো, “ও রেনু,কি বলছে এই পোলা?কি হইছে রে?”
রেহানা শান্ত স্বরে বললো, “কিছু হয় নি আম্মা।আপনি চিন্তা করবেন না।রুমে গিয়ে বিশ্রাম নেন।”
নির্ঝর বললো, “না দাদী,কোথাও যাবেন না।এখানেই বসুন।আজকে সব নাটকের যবনিকাপাত হবে। সব সত্যি সবাই জানতে পারবে।”
শর্মী এসে টেবিল থেকে কিছুটা দূরে এসে দাঁড়ালো।তার মাথায় ঢুকছে না কোনো কিছু। কিসের কথা বলছে এরা এসব?
রেহানা বললো, “কিসের নাটকের কথা বলছেন?”
নির্ঝর বললো, “নিয়াজের মৃত্যু রহস্য চাচী,গ্রামে ড্রাগের ব্যবসা কে করে সব কিছুই আজ সবাই জানতে পারবে। ”
রেহানা বললো, “নিয়াজের মৃত্যুর সাথে আমাদের কি সম্পর্ক? আর ড্রাগ ব্যবসায়, এসবের সাথে আমাদের কেনো জড়ানো হচ্ছে? এখানে কেনো এসব কথা আসছে?”
টগর মুচকি হেসে বললো, “রক্ষক যখন ভক্ষক হয় তখন এর চাইতে বেশি কি আশা করা যায় বলেন?”
কিছুক্ষণ পর শাহজাহান তালুকদার এলো কনস্টেবলদের সাথে। দুইজন কনস্টেবল হাতে চারটি বোতল নিয়ে এলো।
শাহজাহান তালুকদার বললো, “এগুলো কোথায় পেয়েছে আপনার কনস্টেবলকে জিজ্ঞেস করুন।”
টগর একটা বোতলের ছিপি খুলে একটা গ্লাসে ঢেলে চন্দ্রর সামনে এগিয়ে দিলো। তারপর বললো, “খান এটা।”
শাহজাহান তালুকদার রাগান্বিত হয়ে বললো, “ফাজলামো হচ্ছে না-কি? আমার মেয়ে কেনো এসব হারাম জিনিস মুখে নিবে?এসব কি হচ্ছে ইন্সপেক্টর?
আর ছেলেটা কেনো এতো কথা বলছে?ও কে যে পুলিশ কেসের ব্যাপারে কথা বলবে?কিসের ভিত্তিতে বলছে এসব ও?”
টগর মুচকি হেসে পকেট থেকে নিজের সি আই ডির ব্যাজটা বের করে শাহজাহান তালুকদারের সামনে রাখলো।
এক নজর সেই ব্যাজের দিকে তাকিয়ে শাহজাহান তালুকদার আর রেহানা দুজনেই চমকালো।শর্মী এগিয়ে এসে ব্যাজ হাতে তুলে নিলো।তারপর বিস্মিত হয়ে একবার কার্ডের দিকে আরেকবার টগরের দিকে তাকালো।
এই লোকটা একজন সি আই ডি অফিসার!
শর্মীর বিশ্বাস হচ্ছে না।
টগর বললো, “চন্দ্র,আপনি এটা খান।”
চন্দ্র বিব্রত হয়ে তাকালো টগরের দিকে। এই মানুষটা কি বলছে এসব।
শাহজাহান তালুকদার ক্রুদ্ধ হয়ে বললো, “আমার মেয়ে এসব খাবে না।”
টগর বললো, “চন্দ্র,আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন,আপনি আমার অর্ধাঙ্গিনী, আমার চাইতে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী অন্য কেউ না আপনার। ওনারাও না।”
চন্দ্র বাবার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। এই সেই বাবা চন্দ্রর,অথচ কতো রহস্যময় বাবা।
চন্দ্র ভাবতো বাবা তার কাছে স্বচ্ছ কাঁচের মতো। অথচ এখন মনে হচ্ছে বাবা যেনো গোলকধাঁধা। যেখানের কোনো দিশা খুঁজে পাবে না সে।
ভালোবাসা কি এতোটাই অন্ধ করে তোলে মানুষকে?
শুধু চন্দ্রকে ভালোবাসে বলেই বাবা এরকম করছে?
চলবে…..?
রাজিয়া রহমান
#চন্দ্রাণী (৩২)
স্বচ্ছ কাঁচের গ্লাসে সোনালি তরল পানীয়। শাহজাহান তালুকদারের দুই চোখে উৎকণ্ঠা। রেহানার দুই চোখে ক্রোধ।
চন্দ্র বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে।বাবার উপর যেই রাগ ছিলো সেই রাগটা হঠাৎ করেই মিলিয়ে গেলো।পিতৃ স্নেহের কাছে হেরে গেলো। আস্তে করে গ্লাসটা ঠেলে দিলো টগরের দিকে। টগর অবশ্য জানতো এরকম কিছুই হবে।চন্দ্র বাবার কথার বাহিরে যাবে না।
গ্লাসটা নির্ঝর শাহজাহান তালুকদারের সামনে দিয়ে বললো, “আপনি না হয় খেয়ে দেখুন।”
শাহজাহান তালুকদার হতভম্ব
এদের ব্যবহার কেমন উগ্র মনে হচ্ছে তার কাছে। এদের প্ল্যান কি শাহজাহান তালুকদার কিছুই বুঝতে পারছে না। তার বুক কাঁপছে ভয়ে।এতো বছর পরে এসে ভয় তাকে এভাবে কাবু করে ফেলবে ভাবতে পারেন নি তিনি।
বহুদিন পর নিজেকে ভীষণ ক্লান্ত মনে হচ্ছে তার।বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে নাকে কপালে।
রেহানা স্বামীর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললো, “চন্দ্রর বাপ,আপনি এরকম ভেঙে পড়তেছেন কেনো?”
শাহজাহান তালুকদার ভরসাহীন চোখে মেয়ের দিকে তাকালো। চন্দ্রর মনে হচ্ছে তার কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। এতো যন্ত্রণা কেনো হচ্ছে? আর কতক্ষণ চন্দ্র নিজেকে সামলে রাখতে পারবে চন্দ্র জানে না।
কান্নারা সব দলা পাকিয়ে গলার কাছে এসে জমেছে।
বুক কেমন শূন্য শূন্য লাগছে চন্দ্রর।এই জগৎ সংসার সবই মিথ্যে মায়া শুধু।
চন্দ্র নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো বাবার দিকে।
নির্ঝর বললো, “আপনি চেক করে দেখুন না এটা কি!”
শাহজাহান তালুকদার মানুষ চেনেন।এরা এতো কনফিডেন্স নিয়ে বলছে যখন তখন নিশ্চয় কোনো ঘাপলা আছে।এই বোতলে কিছু থাকলে ওরা এভাবে বলতো না।
গ্লাস তুলে নিয়ে এক চুমুক মুখে দিতেই বুঝতে পারলো শাহজাহান তালুকদার আসল কাহিনি। বোতল ভর্তি সফট ড্রিংকস। এরা এতো নিশ্চন্ত কেনো এবার বুঝতে পারছে।
টগর নিজের কার্ড এগিয়ে দিলো শাহজাহান তালুকদারের দিকে।
নির্ঝর উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “আপনার নামে আমাদের কাছে সার্চ ওয়ারেন্ট আছে চেয়ারম্যান সাহেব। ইউ আন্ডার এরেস্ট। ”
শাহজাহান তালুকদার নিজের অপরাধ কি বুঝতে পারছেন না।
হতবাক হয়ে তাকাতেই টগর বললো, “কুসুমপুরে ড্রাগ বিজনেস, নিয়াজ,নীলির খু//নের জন্য আপনাকে এরেস্ট করা হলো।”
শাহজাহান তালুকদার হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। চন্দ্র মনে মনে বলছে সত্যিটা বলো বাবা।আর চুপ করে থেকো না।
শাহজাহান তালুকদার এক মুহূর্ত কি যেনো ভাবলো।তারপর রেহানার মুখের দিকে তাকালো। রেহানার মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই।যা বুঝার বুঝে নিলো শাহজাহান তালুকদার।
উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “চলুন,যাওয়া যাক।”
চন্দ্র উঠে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। শক্ত করে ধরে বললো, “না আব্বা,আব্বা কোথাও যাবেন না আপনি। আপনি কিছু করেন নি আমি জানি। কেনো অযথা নিজের কাঁধে দোষ নিচ্ছেন?”
শাহজাহান তালুকদার বললো, “আমার মায়ের কাছে আমি নির্দোষ হলেই চলবে গো মা।সারা পৃথিবী আমাকে দোষী ভাবুক।আমার আফসোস নেই আর।”
শর্মী কাঁদতে লাগলো নিরবে।নির্ঝর একবার টগরের দিকে তাকালো। টগরের চোখ হাসছে।নির্ঝর শাহজাহান তালুকদারকে নিয়ে বের হলো।
টগর বের হলো ঘর থেকে। দুই পা গিয়ে আবার পিছিয়ে এলো।চন্দ্রর সামনে এসে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, “এই চোখে আমি কান্না দেখতে চাই না,আমার জন্য ভালোবাসা দেখতে চাই। আপনি যদি কখনো কাঁদেন তাহলে আমাকে পেয়ে খুশিতে কাঁদবেন।”
চন্দ্রর ভীষণ রাগ হলো। কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে নিতেই টগর চন্দ্রর ঠোঁটে আলতো করে আঙ্গুল দিয়ে বললো, “উহু,একটা কথা ও বলবেন না।নাটকের শেষ পর্ব এখনো বাকি আছে। ”
চন্দ্রকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে টগর চলে গেলো।
কাচারি ঘরের সামনে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। ততক্ষণে চারদিকে ছড়িয়ে গেছে চেয়ারম্যানকে পুলিশ ধরেছে নিয়াজের খুনের জন্য।
কাচারি ঘরের সামনে এসে নির্ঝর কিছুক্ষণ দাঁড়ায় চেয়ারম্যানকে নিয়ে। চেয়ারম্যান এদিক ওদিক কিছুক্ষণ দেখলো।তারপর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো, “চলুন।”
নির্ঝর বললো,”আসুন।”
গাড়িতে উঠে নির্ঝর বসলো শাহজাহান তালুকদারকে নিয়ে। গাড়ি অপেক্ষা করছে টগরের জন্য। টগর একটা সিগারেট ধরিয়েছে।সিগারেটে দুই টান দিয়ে টগর ফেলে দিলো সিগারেট।
পেছনে তাকিয়ে দেখে চন্দ্র আর শর্মী দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে।
লোকজন সবাই নানা কথা বলতেছে।সবার কথা টগরের কানে আসছে।টগর গাড়িতে উঠতে যাবে সেই মুহূর্তে বাবুল দাশ ছুটতে ছুটতে এলো।
টগরের হাত চেপে ধরে বললো, “আমি, আসল অপরাধী আমি স্যার। আপনি আমারে এরেস্ট করেন।”
উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। চন্দ্র,শর্মী বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রইলো বাবুল দাশের দিকে।
শাহজাহান তালুকদার কিছু বলার আগে বাবুল দাশ বললো, “আমি আপনার নুন খাইছি স্যার।আপনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা আমজ করতে পারবো না।আমাকে ক্ষমা করে দিন।”
শাহজাহান তালুকদারকে ছেড়ে দেওয়া হলো।কাচারি ঘরের সামনে চেয়ার টেবিলের ব্যবস্থা করা হলো।আশেপাশের মানুষ সবাই এসে হাজির। বাবুল দাশের মতো সহজ সরল বোকাসোকা একটা লোক সব কিছুর মাস্টার মাইন্ড এটা কারো বিশ্বাস হচ্ছে না।
চন্দ্র এক ছুটে গিয়ে মা’কে জড়িয়ে ধরে বললো, “মা,আব্বাকে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। আসল অপরাধী না-কি বাবুল কাকা।আব্বা নির্দোষ। ”
রেহানা ফ্লোরে লেপটে বসে আছে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “তোর বাপ যে নির্দোষ তা আমি জানি গো মা।”
চন্দ্র মায়ের হাত ধরে বললো, “কিসের এতো ভয় তোমাদের মা?আমাকে নিয়ে? ভয় পেও না মা।তোমরা আমার বাবা মা,সারা দুনিয়ার মানুষ এসে যদি বলে তোমরা আমার আপন বাবা মা না আমি তবুও বিশ্বাস করবো না।আমার মা তুমি মা।তুমি আর আব্বা ছাড়া আমার কেউ নেই।আমি সব জানি মা।”
রেহানার দুই চোখ বিস্ফোরিত হয়ে গেলো।মেয়েকে জড়িয়ে ধরে রেহানা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
সিতারা বানু কিছু বুঝতে পারছে না। ছেলেকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেলো এই বউ একটা কথা ও বললো না, একটু চোখের পানি ও ফেললো না।অথচ এখন মেয়ের কথা শুনে কাঁদছে কেনো?
চন্দ্রর কথার মানে তার কাছে পরিস্কার না।
রেহানা চন্দ্রর হাত চেপে ধরে বললো, “তুই আমার মেয়ে,তুই শুধু আমার মেয়ে মা।আমি তোকে কোথাও যেতে দিমু না।তুই আমার শূন্য কোলে আলো নিয়ে এসেছিস।তুই আসার পর আমি জীবনের সব সুখ ফিরে পাইছি।আমি তোরে হারাতে পারমু না।আমার কাউরে লাগবো না মা তুই ছাড়া। ”
শর্মী ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়লো। কি শুনছে এসব সে?
কিছুই বুঝতে পারছে না।
সব কিছুর পেছনে তাহলে কি কারণ ছিলো?
আপা কি বললো এসব?
বাবুল দাশ একেবারে শান্ত হয়ে বসে আছে।কাদের খাঁন ও এসে হাজির হয়েছে।
নির্ঝর বললো, “শুরু করো বাবুল দাশ।”
বাবুল দাশ শাহজাহান তালুকদারের দিকে এক নজর তাকালো। তারপর মাটির দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি বাবুল দাশ। নিচু জাতের মানুষ আমি। হান্নান চৌধুরীর বাড়িতে আমি কাজ করতাম।হান্নান চৌধুরীর বাপ হানিফ চৌধুরীর উদ্যোগে আমি আইএ পাশ করি।এরপর আর পড়ালেখা করতে পারি নাই।”
হান্নান চৌধুরীর নাম শুনে কাদের খাঁন নড়েচড়ে বসলো। কানিজের স্বামী হান্নান চৌধুরী।
বাবুল দাশ বলতে লাগলো, “হান্নান স্যার বিয়ের পর থেকে কানিজ ভাবীর সাথে দুর্ব্যবহার করতো। ওদের বাড়ির সবাই-ই ভাবীর সাথে ভীষণ খারাপ ব্যবহার করতো।
একে একে দুটো কন্যা সন্তানের জন্মের পর কানিজ ভাবী একেবারে ভেঙে পড়ে। ভাবী যখন আবার গর্ভবতী হয় তখন ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে। খেতে পারতো না কিছুতেই।তার উপর ভাইজানের হাত তো কথায় কথায় ভাবীর গায়ে উঠতো। এতো অত্যাচার সহ্য করে ও কেনো পড়ে ছিলেন উনি আমি জানি না।
মাঝেমাঝে আমাকে দিয়ে দোকান থেকে পান সুপারি আনাতেন বমি ভাব হলে খাবেন বলে। তৃতীয় বার ভাবীর অসুস্থতা ভীষণ বেড়ে যায়।ভাবীকে একবারের জন্য ওরা কেউ ডাক্তারের কাছে নেয় নি।
সবাইরে ফাঁকি দিয়ে ভাবী একদিন আমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেছিলো। ফেরার পর খালাম্মা ভাবীকে একটা লাথি দিছিলো কোন সাহসে ডাক্তার দেখিয়েছে এই অপরাধে।
আমি গরীব মানুষ, চাইলেও কিছু করতে পারতাম না।মনে মনে ভাবতাম এইবার ও যদি মেয়ে হয় আমি মেয়েটারে নিয়ে পালাইয়া যামু ওরা কিছু করার আগে।
আবারও একটা মেয়ে হইলো। এতো সুন্দর একটা মেয়ে হইলো আমি ভাবছি সবাই সব ভুলে গেছে বুঝি মেয়ের দিকে তাকিয়ে। অথচ ভুল ভাবছি।বাবুর চার মাস বয়সের সময় একদিন দুপুরে দেখলাম খালাম্মা আর ভাইজান চুপি চুপি বাবুরে কোলে নিয়ে বের হইছে।আমি ও পিছু নিলাম।ওরা একটা হাসপাতালে নিয়ে বাচ্চাটারে বিক্রি করে দিলো।
কষ্টে আমার তখন বুক ফেটে যাচ্ছিলো।
আমি এরপর যারা বাচ্চাটা কিনছে তাদের পিছু নিই।আর পিছু নিয়েই চেয়ারম্যান সাবের বাসা পর্যন্ত যাই।
এরপর থেকে সুযোগ পেলেই ওনাদের বাসার সামনে ঘুরাঘুরি করতাম।ওনারা তখন ঢাকায় থাকতো।
মেয়ের নাম দিলো চন্দ্র।চন্দ্র রাখারই কথা, এতো সুন্দর একটা মেয়ে সে চন্দ্র নয়তো কি?
নিজের উপর খুব রাগ হইতো আমার। যদি আগের দুইটা বাচ্চার উপর নজর রাখতাম তাহলে ওদের ঠিকানা ও জানতাম।
চন্দ্ররে দত্তক নেওয়ার দুই মাস পর আমি চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে যাই বাসায় কাজের জন্য। ততদিনে ছোট্ট পুতুলটার উপরে আমার ভীষণ মায়া জন্মে গেছে। ওরে দেখার লোভেই আমি চেয়ারম্যান সাহেবের বাসায় কাজ নিই।উনি তখনও চেয়ারম্যান হন নাই যদিও। ”
শাহজাহান তালুকদার নিরবে কাঁদছে। এই ভয়টাই পাচ্ছিলেন তিনি।তিনি চান না কেউ জানতে পারুক চন্দ্র তার জন্ম দেওয়া সন্তান না।এই ভয়ে তিনি মেয়েকে নিয়ে বাড়িতেও আসেন নি প্রথমে। কাউকে কিছু জানান নি।আজ সবাই জেনে গেলো,মেয়েটাও জানবে।এরপর কি মেয়ে আর তাকে বাবা বলে ডাকবে?
কিসের একটা অসহ্য চাপা যন্ত্রণা সারা শরীর ছেয়ে গেলো তার।
চন্দ্র,তার কলিজার টুকরো মেয়ে। মেয়ে অভিমান করে হারিয়ে যাবে না তো এবার!
কাদের খাঁন বুক চেপে ধরলেন।ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। এমন লাগছে কেনো?
চন্দ্র,মানে তালুকদারের বড় মেয়ে তার আপন বোনের মেয়ে!
বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি।আশেপাশের সবাই চুপ হয়ে আছে।মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে বাবুল দাশের কথা সবাই।
চলবে……
রাজিয়া রহমান