#চন্দ্রাণী (২১)
চন্দ্র অস্থির হয়ে বসে রইলো নিয়াজের মেসেজের আশায়।কিন্তু মেসেজ এলো না।অপেক্ষা করতে করতে শর্মী ঘুমিয়ে গেলো।ঘুম এলো না চন্দ্রর চোখে। দুই চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু কিন্তু মস্তিষ্ক বারবার জানান দিচ্ছে কিছুতেই ঘুমানো যাবে না।
ঘুমন্ত শর্মীর মুখের দিকে তাকিয়ে চন্দ্রর মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। আহা বেচারি!
কতো স্বপ্ন দেখেছিলো নিয়াজকে নিয়ে। বুঝতে পারে নি অপাত্রে ভালোবাসা দান করছে।আর যখন বুঝলো তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
এই মুখোশের দুনিয়ায় ভালোবাসা যেনো স্বপ্ন।চাইলেই পাওয়া যায় না।
ফজরের আজান হচ্ছে চারদিকে,চন্দ্র ঘুমাচ্ছে না।আরো একটা মানুষ ও ঘুমাচ্ছে না। টগর সে।সে ব্যস্ত তার হিসেব মেলাতে।
ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি তার।সামনে ল্যাপটপে একটা ভিডিও প্লে করে রেখেছে।
শর্মীর ঘুম ভেঙে গেলো হঠাৎ করে। ধড়ফড়িয়ে উঠে দেঝে চন্দ্র সেই আগের মতো বসে আছে। লজ্জা পেলো শর্মী।আপা বসে আছে তার কাজে অথচ সে কি-না ঘুমিয়ে গেছে।
চন্দ্র হেসে বললো, “কোনো ছবি আসে নি।মনে হচ্ছে না ছবি পাঠাবে,তোকে সম্ভবত ভয় দেখাতে চাইছে।তবে ও যেই ছেলে ওকে বিশ্বাস নেই।”
শর্মীর বুকের ভেতরে হাতুড়ি পেটা হচ্ছে যেনো।কেমন একটা অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে বুকজুড়ে।আব্বা যদি একবার এসব কিছু জানতে পারে আব্বার সামনে শর্মী দাঁড়াবে কিভাবে?
আব্বা কি সহ্য করতে পারবে মেয়ের এই বেহায়াপনা?
আব্বা ম//রেই যাবে লজ্জায় অপমানে।সারা গ্রাম জেনে যাবে এরপর।
শর্মীর কেমন দমবন্ধ অনুভূতি হচ্ছে। চন্দ্র উঠে এসে বোনকে জড়িয়ে ধরে। বোনের বুকে পিঠে মালিশ করতে করতে বলে,” তুই একদম চিন্তা করবি না।তোর আপা বেঁচে আছে। আমি থাকতে তোর কোনো ভয় নেই।আমি যা করার করবো।”
শর্মীর বুক ফেটে কান্না আসছে।বুক উজাড় করে ভালোবাসার পরেও কেনো ভাগ্য তাকে এভাবে ঠকালো।সে তো ছলনা করে নি,ধোঁকা দেয় নি।নিজেদের শত্রু জেনেও ছেড়ে দেয় নি।মন থেকে ভালোবেসেছিলো।অথচ বিনিময়ে কি পাচ্ছে সে!
শর্মীর আর সহ্য হচ্ছিলো না এতো কিছু। চন্দ্র সময় নিয়ে বোনকে সামলায়।এই সময়টা ভীষণ নাজুক সময়। শর্মীকে ভালো করে কাউন্সেলিং করতে হবে। তা না হলে শর্মী আবারও ভুল পদক্ষেপ নিতে পারে।
চন্দ্র নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, “দেখ,আগে তোকে শক্ত হতে হবে।এই পরিস্থিতি এতটা সেনসেটিভ আমি জানি।কিন্তু যাই হয়ে যাক,নিয়াজ যা-ই করুক তোকে সাহস রাখতে হবে মনে। আব্বার কাছে যদি ছবি পাঠায় নিয়াজ তখন কি হবে?
আব্বা খুব মানসিক আঘাত পাবে।ধর তোর সাথে অভিমান করবে,নিয়াজ ট্র্যাপে ফেলে চাইবে আব্বাকে ইলেকশন থেকে বিরত রাখতে।
তুই যদি ভবিষ্যতে এসব হবে ভেবে মনে মনে কোনো ভুল স্টেপ নেওয়ার চিন্তা করিস তবে মনে রাখিস,তোর এসব ছবি দেখলে আব্বা হয়তো কষ্ট পাবে কিন্তু তোর ভুল পদক্ষেপে আব্বা দুনিয়া থেকে চলে যেতে পারে। আব্বা কতটা নরম মনের মানুষ তোর নিশ্চয় অজানা না?তোর মনে আছে কখনো আমার তোর কোথাও আঘাত লাগলে,রক্ত বের হলে আব্বা পাগলের মতো কান্না করতো?
সেই কয়দিন বাড়ি থেকে কবুতরের মাংস ফুরাতো না।কবুতর খেতে রক্ত হয় এই ভেবে আব্বা সবসময় কবুতর আনতো আমাদের খাওয়াতে।
তোর মনে আছে, তোর একবার ওজন অনেকটা বেড়ে যাওয়ায় তুই সিদ্ধান্ত নিলি ডায়েট করার।৪ মাস তুই ডায়েট করলি,ভাত খেলি না।সেই ৪ মাস আব্বা ও ভাত খায় নি তোর মনে আছে?
সেই তুই যদি ঘুণাক্ষরেও ভাবিস যে এই লজ্জা নিয়ে আব্বার সামনে যেতে পারবি না এরচেয়ে পৃথিবী ছেড়ে যাবি তো আব্বা কি করবে তখন?
আর মেইন কথা নিয়াজ এটাই চায় বুঝলি?
নিয়াজ চায় তুই একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেল।তাতে আব্বা ভেঙে পড়ুক আর ওরা জিতে যাক।পরিস্থিতি যাই হোক নিজেকে শান্ত কর।এটাও মনে রাখবি আব্বার ইলেকশনে জিতে যাওয়ার একটা ধাপ।তুই যদি হেরে যাস আব্বা ও হেরে যাবে।তুই যদি সাহস রাখিস মনে বিপদ মোকাবিলা করার তো আব্বা জয়ের পথে এক ধাপ এগিয়ে যাবে।”
শর্মীর কেমন মন হালকা হয়ে গেলো বোনের কথা শুনে।সে সত্যিই আবারও একটা ভুল ভাবনা ভেবে ফেলেছিলো।আপার কথা ম্যাজিকের মতো কাজ করলো।
শর্মী বোনকে ছেড়ে দিয়ে বললো, “এখন আমরা কি করবো? ”
চন্দ্র বললো, “ইন্সপেক্টরের সাথে কথা বলতে হবে।নিয়াজকে পুলিশ খুঁজছে জানিস তো।ইন্সপেক্টরের জানা উচিত নিয়াজের এই কান্ড। ”
চন্দ্র নির্ঝর কে কল দিলো।নির্ঝর তখনও বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। ফোন বাজতেই উঠে বসে রিসিভ করে হ্যালো বলতেই শুনলো ওপাশ থেকে মেয়েলী একটা কণ্ঠ। চেনা চেনা লাগছে নির্ঝরের।
চন্দ্র পরিচয় দিয়ে বললো নিয়াজের কথা। রাতে শর্মীকে যা যা বলেছে সেসব বললো।
নির্ঝর অবাক হয়ে বললো, “নিয়াজ কল করেছে? কোন নাম্বার থেকে? ওর ফোনটা অফ,ওর সিম কার্ড ও ব্যবহার করছে না।ওর নতুন নাম্বার আমাকে এক্ষুনি সেন্ড করুন।ওর লোকেশন বের করতে হবে এক্ষুনি। ”
চন্দ্র সাথে সাথে নিয়াজের ফোন নাম্বার পাঠিয়ে দিলো।
দ্রুত তৈরি হয়ে নির্ঝর বের হয়ে গেলো বাসা থেকে।নাম্বারটা পাঠিয়ে দিলো লোকেশন জানার জন্য। ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসছে সে।শর্মী কে এভাবে থ্রেট করছে নিয়াজ!এতো বড় স্পর্ধা ওর!
নিয়াজকে একবার ধরতে পেলে নির্ঝর কি কি মামলা দিবে ওর নামে সেসব ভাবছে।
চোখের সামনে শর্মীর বিরক্তি নিয়ে তাকানো মুখখানা ভেসে উঠছে।নির্ঝরের বুকের ভেতরে কেমন ঝড় উঠলো হঠাৎ করে। কোমল,নির্মল মুখখানা বুঝি এখন আষাঢ়ের আকাশের রূপ নিয়েছে!
নিশ্চয় খুব কান্না করছে।কখনো কি নির্ঝরের ভাগ্য হবে শর্মীর চোখের জল মুছে দেওয়ার?
জানে না নির্ঝর। থানায় গিয়ে জানতে পারলো নিয়াজের লাস্ট লোকেশন কুশি নদী দেখাচ্ছে। নির্ঝর আবারও কল দিলো,রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ করছে না কেউ।
নির্ঝর আবারও কল দিলো নিয়াজের নাম্বারে যত ইনকামিং এবং আউটগোয়িং কল হয়েছে, ডিটেইলস আনার জন্য।
মাথায় রাগ চেপে বসেছে নির্ঝরের। কিছুতেই আর নিয়াজকে ছাড়বে না সে।
চলবে……
রাজিয়া রহমান
#চন্দ্রাণী (২২)
নির্ঝরের সামনে কয়েকটা কাগজ ছড়িয়ে রাখা।গভীর মনোযোগ দিয়ে নির্ঝর দেখছে।নিয়াজের ফোনে একটা নাম্বার থেকেই কল এসেছে সবসময়।
কিছুক্ষণ ভাবলো নির্ঝর। এরপর নিয়াজের আগের নাম্বারের কল লিস্ট নিয়ে বসলো। ওখানেও এই নাম্বারটা আছে।কিন্তু কল ডিউরেশন খুবই কম বলে নির্ঝর এই নাম্বার তখন স্কিপ করে গেছে।
নির্ঝর নাম্বারটায় কল দিলো।রিং হলো কিন্তু রিসিভ করলো না কেউ।
কিছুক্ষণ ভেবে নির্ঝর সেই নাম্বারের ডিটেইলস আনার জন্য বললো।
মিছেমিছি এক সময় টগরকে সন্দেহ করেছে সে।নীলির মৃ/ত্যুর কোনো সমাধান ও করতে পারলো না।নির্ঝরের নিজের উপর নিজের রাগ হচ্ছে। কেনো কোনো ক্লু পাচ্ছে না সে?
তার উপর নীলির মৃত্যুর আগের রাতে যেই খু/ন হলো তার ও সমাধান হয় নি।নিজেকে কেমন লুজার মনে হচ্ছে নির্ঝরের।
চোখে যখন আঁধার দেখছে নির্ঝর সেই সময় থানায় ফোন এলো নদীতে এক জেলের জালে একটা লাশ উঠেছে। আর লাশটা নিয়াজের।নির্ঝর ভয়ানকভাবে চমকালো।নিয়াজের লাশ মানে!
এক মুহূর্ত দেরি না করে নির্ঝর বের হয়ে গেলো।যেতে যেতে চন্দ্রকে কল দিয়ে সবটা জানালো।
শর্মী তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্রর ভেজা কাপড় শুকাতে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইন্সপেক্টরের কল এসেছে শুনে শর্মী আর ভেতরে এলো না।মন কেমন করছে।কে জানে নিয়াজ হয়তো সবাইকে সব দেখিয়েছে সেটাই বলছে ইন্সপেক্টর।
শর্মী বাহিরের দিকে তাকিয়ে রইলো। মা উঠানে বসে ইলিশ মাছ কা/টছে।দাদী বসে বসে মরিচের বোঁটা ছাড়াচ্ছে।মনার মা উঠান ঝাড়ু দিচ্ছে। কতো ব্যস্ত সবাই সবার কাজে অথচ কেউ জানে না তাদের মধ্যে থেকেও একটা মেয়ের বুকের ভেতরে বিষাদের বন্যা বয়ে যাচ্ছে।
নিজেকে বড় অসহায় লাগছে।
মানুষ এরকম ছলনা কিভাবে করতে পারে? ভালোবাসা নামক অভিনয় করে কিভাবে?
বাবুল দাশ এসে শর্মীকে ডেকে বললো, “জননী, এক কাপ কড়া লিকারের চা দিতে পারো?”
শর্মী বাবুল দাশের দিকে তাকালো।বাবুল দাশ শর্মীর শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলো। তারপর নরম স্বরে বললো, “আইচ্ছা থাক লাগবে না।”
শর্মী মলিন হেসে বললো, “কেনো কাকু?আপনি একটু বসেন আমি চা করে দিচ্ছি। ”
বাবুল দাশ নরম স্বরে বললো, “আমার জননীর কি মনটা খারাপ, এরকম মুখ কালো করে তো থাকে না আমার মা।”
শর্মীর কেমন মায়া হলো।না সব মানুষ এক রকম হয় না,কেউ কেউ সত্যি সত্যি ভালোবাসে।এই যে বাবুল কাকা,বুঝ জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বাবার সাথে আছেন।বাপ মা নেই,বিয়ে থা করে নি।সেই কোন কালে শাহজাহান তালুকদার তার মা’য়ের চিকিৎসার সময় সাহায্য করেছেন,তারপর মা মরে যাওয়ার পর থেকে চেয়ারম্যানের কাছে পড়ে আছে।
ওই যে জমিলা আজ কতো বছর ধরে পড়ে আছে এই বাড়িতে।কোনো প্রতিদান চায় না এখন আর।প্রতিদিন নিজে থেকেই শর্মীর চুলে তেল লাগিয়ে দেয়।
এরাও তো ভালোবাসে।
এদের ভালোবাসা কি সুন্দর, কোনো ছলনা নেই,অভিনয় নেই।
ভাবতে ভাবতে শর্মী বের হলো। ভেতরে তখনও চন্দ্র ফোনে কথা বলছে।শর্মী বের হয়ে এলো। বাহিরে এসে দাঁড়াতেই চন্দ্রর চিৎকার শুনতে পেলো।আব্বা আব্বা করে চন্দ্র চিৎকার করতে করতে বের হলো ঘর থেকে। বাবুল দাশ বললো, “স্যার তো কাচারি ঘরে গো মা।কি হইছে?”
হাঁপাতে হাঁপাতে চন্দ্র বললো, “কাকু,নিয়াজ আছে না,ওর নাকি খুন হইছে। ওর লাশ আজ সকালে পাইছে পুলিশ। ”
শর্মীর হাত থেকে চায়ের পাতিল পড়ে গেলো মাটিতে। বাবুল দাশ তার জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো। সবাই সবার জায়গায় স্থির শুধু হতভম্ব হয়ে গেলো শর্মী।
চন্দ্র দাঁড়ালো না আর,ফোন হাতে নিয়ে এক ছুটে গেলো বাবা কে খবর দিতে।
শাহজাহান তালুকদার কিছু কাগজপত্র দেখছে বসে বসে। চন্দ্র হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললো, “আব্বা,নিয়াজের মা///র্ডার হয়েছে। ”
শাহজাহান তালুকদার চমকে গেলেন।নিয়াজ!
নিয়াজ নেই মানে!শাহজাহান তালুকদার কাশতে লাগলো। চন্দ্র ছুটে গিয়ে বাবার জন্য পানি আনে।
চন্দ্র পানি আনতে গিয়ে চন্দ্র এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ায়।
তারপর পানি এনে দেয় বাবাকে। শাহজাহান তালুকদার নিজের সামনে রাখা কাগজপত্র সব কিছু তাড়াহুড়ো করে গুছিয়ে রাখতে গিয়ে একটা ছবি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে চন্দ্রর সামনে পড়ে যায়।
পাসপোর্ট সাইজের একটা ছবি।
চন্দ্র ছবিতে চোখ বুলায়।ছোট্ট একটা মুখ দেখা যাচ্ছে।
হেসে উঠে চন্দ্র,এটা তার ছবি।চন্দ্র বললো, “আমি গুছিয়ে রাখতেছি,আপনি বসেন আব্বা।”
শাহজাহান তালুকদার উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “না লাগবে,তুই যা বাড়িতে। আমি সব রাখতেছি।আর বাবুলরে বল আসতে।খাঁনের সাথে দেখা করতে যাবো।”
চন্দ্র অবাক হয়ে বললো, “খানের সাথে! ”
শাহজাহান তালুকদার হেসে বলে, “তার এতো বড় শোকের দিন এখন,যতই শত্রুতা থাকুক তবুও মানুষ তো আমরা! তুই ও আয় না আমার সাথে। বাবা মেয়ের একটু ঘুরাঘুরি ও হয়ে যাবে।”
চন্দ্র এক মুহূর্ত ভাবতে লাগলো। মন বলছে যাওয়া উচিত, একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে সে।কিন্তু শর্মীর কাছে ও থাকা উচিত এখন।শর্মীকে রেখে যেতেও ইচ্ছে করছে না।
পরমুহূর্তে মনে হলো বাড়িতে সবাই আছে এখন,শর্মীকে একটা কাজে ব্যস্ত রাখলেই হবে।চন্দ্র জানালো সে ও যাবে।
চন্দ্র চলে গেলো বাড়ির দিকে। শাহজাহান তালুকদার সব ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে গায়ের পাঞ্জাবি বদলে নিলেন।
বাবুল দাশ ২ মিনিটের মধ্যে ফিরে এলো। তার মনটা খারাপ। শর্মীকে কেমন বিষণ্ণ হয়ে বসে থাকতে দেখেছেন।এই মেয়ে দুটো তার বড় আদরের। একজনকে ঘাড়ে আর একজনকে কোলে নিয়ে পুরো গ্রাম ঘুরে বেড়াতেন।এদের জন্য ঘোড়া হতেন।দুজনকে সাঁতার ও শিখিয়েছেন তিনি।লম্বাচওড়া এই বাবুল দাশ এই দুইটা পরীর ছানার সামনে এলে একটুখানি হয়ে যেতেন নুয়ে। তার কাছে এরাই তার প্রতিমা। তিনি হিন্দু ওরা মুসলমান হতে পারে কিন্তু তার প্রতি মেয়ে দুটোর অথবা মেয়েদের জন্য তার ভালোবাসার বিন্দুমাত্র কমতি নেই।
শাহজাহান তালুকদার জিজ্ঞেস করলেন,”মন খারাপ কেনো তোর?”
বাবুল দাশ হেসে বললো, “কিছু না, এমনেই।চলেন।”
চন্দ্র ও তৈরি হয়ে এলো। এক ছুটে গিয়ে একটা থ্রিপিস পরে এসেছে গায়ের টপস পালটে।
কেমন একটা অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে চন্দ্রর।
বাবার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে কাদের খানের বাড়িতে হাজির হলো। এই বাড়িতে কখনো আসা হয় নি চন্দ্রর।সবসময় বাহিরে থেকে দেখেছে।কখনো ইচ্ছে হয় নি ভেতরে এসে দেখার।বুঝদার হওয়ার পর থেকেই দেখছে বাবার সাথে লড়াই এদের সাথে।
ড্রয়িং রুমে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে কাদের খাঁন।কাদের খাঁনের এই বাড়িটি বাহির থেকে বুঝা যায় না কতটা জৌলুশপূর্ণ। ভেতরে এসে চন্দ্রর চক্ষু কপালে। পুরো বাড়ি ইইন্টেরিয়র দিয়ে ডিজাইন করা।
বিশাল বড় এই বাড়িটিতে নানান রকম শোপিস,লাইটিং দিয়ে সাজানো।
দেখেই মনে হয় ভীষণ রুচিশীল মানুষ। চন্দ্রর কেমন ভালো লাগতে শুরু করলো। শাহজাহান তালুকদারকে দেখেই কাদের খাঁন উঠে দাঁড়ালো। দুজন হ্যান্ড শেক করে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। কারো মুখে কোনো কথা নেই।নিরবতা ভেঙে কাদের খাঁন বললো, “বস তালুকদার।”
শাহজাহান তালুকদার সোফায় বসতে বসতে বললো, “কিভাবে এসব হলো?”
কাদের খাঁন বিমর্ষ সুরে বললো, “এ তো হওয়ারই ছিলো, আমি ছেলেকে মানুষ করতে পারি নি তালুকদার। অমানুষ হয়ে গেছে আমার ছেলে।শাস্তি পেয়েছে। তালুকদার, তবুও কেনো আমার বুকটা এরকম খাঁখাঁ করছে বল তো?বেঁচে থাকতে আমি কখনো ওকে প্রশ্রয় দিই নি,কখনো কোনো সাহায্য করি নি।কখনো ভালো করে কথা বলি নি অথচ আজ ইচ্ছে করছে ছেলেটার সাথে একটু কথা বলি।
আমাকে গতকাল খবর পাঠিয়েছে টগরকে দিয়ে একজন ভালো ল’ইয়্যার দেখার জন্য। আমি সোজা নিষেধ করে দিয়েছি।যেই ছেলে অসৎসঙ্গে পড়ে খারাপ কাজে যুক্ত হয় সেই ছেলের জন্য আমি একটা কাজ ও করতে রাজি না।এতো দিন তো মন দুর্বল হয় নি আজ কেনো এমন লাগছে বলো তো?মনে হচ্ছে আমি যদি এতটা কঠোর না হতাম ছেলেটা বেঁচে থাকতো।
আবার বিবেক বলছে যা হয়েছে ঠিক হয়েছে, পাপের শাস্তি পেতেই হয় এভাবে।একটা অপরাধী কমেছে সমাজ থেকে এটাও তো আনন্দের ব্যাপার। ”
চন্দ্র অবাক হলো নিয়াজের বাবার কথা শুনে। এই মানুষটাকে সে সবসময় খারাপ জেনে এসেছে। অথচ তার চিন্তা ভাবনা কতো উন্নত। এরকম একটা মানুষের ছেলে হয়ে নিয়াজ এতটা বখে গেলো!
শাহজাহান তালুকদার বললো, “তুমি সেই আগের মতোই আছো নীতিবান।”
কাদের খাঁন মৃদু হেসে বললো, “নীতিবান হয়ে লাভ কি হলো তালুকদার, ছেলেকে তো মানুষ করতে পারলাম না।”
চন্দ্রর হঠাৎ করে মনে হলো তার বাবা আর কাদের খাঁন একে অন্যকে যেনো খুব ভালো করে চেনে।কিন্তু কিভাবে?যদি ভালো করে চিনেই থাকে তবে এতো শত্রুতা কেনো?
চন্দ্র এসব ভাবছে সেই মুহূর্তে টগর এসে চন্দ্রর পিছনে দাঁড়িয়ে বললো, “কি ভাবছেন?”
চমকে উঠে চন্দ্র তাকিয়ে দেখে টগর দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। টগরকে দেখতেই বুকের ভেতরে কেমন একটা কাঁপুনি শুরু হলো চন্দ্রর।কেমন লজ্জা এসে ভর করলো তার মধ্যে। আশ্চর্য তো,চন্দ্র বুঝতে পারছে না এরকম বুকের ভেতরে ধুকপুক করছে কেনো।
টগর চন্দ্রর খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। টগরের বডি স্প্রের মৃদু ঘ্রাণ পাচ্ছে চন্দ্র।কেমন জানি লাগছে চন্দ্রর।
নিজেকে নিজে ধমক দিলো চন্দ্র।সে তো টিনএজ মেয়ে না,তবুও কেনো এমন হচ্ছে তার।
টগর হেসে বললো, “কথা বলবেন না বলে ঠিক করেছেন নাকি?”
চন্দ্র মুচকি হেসে বললো, “না তা না,আপনি এখানে?কখন এলেন?”
টগর হেসে বললো, “আপনি এসেছেন, আমি আসবো না তা কি হয়?”
চন্দ্র ভ্রুকুটি করতেই হেসে বললো, “আচ্ছা রাগবেন না প্লিজ, আমি অনেক আগেই এসেছি। গেইট দিয়ে আপনি ঢুকার সময় এক নজর দেখে ছুটে এলাম আপনার সাথে দেখা করতে। ”
চন্দ্রর নিজেকে কেমন লাজুকলতা মনে হচ্ছে। এরকম তো সে ছিলো না। টগর তার সাথে দেখা করতে এসেছে শুনে এমন লজ্জায় লাল হওয়ার কি আছে!
টগর হেসে বললো, “আপনার দুই গাল পাকা টমেটোর মতো হয়ে গেলো যে হঠাৎ করে, কোনো কারণে কি আপনি লজ্জা পাচ্ছেন?”
চন্দ্র নিজেকে সামলে বললো, “না ওসব কিছু না,রোদের মধ্যে হেটে এসেছি তাই আরকি।”
টগর হেসে বললো, “আপনাকে একেবারে লজ্জাবতী লতার মতো লাগছে।ভীষণ সুন্দর। ”
চন্দ্র হেসে সরে গেলো সেখান থেকে। সে খেয়াল করেছে আব্বা তিন চারবার তার দিকে তাকিয়েছে। বাবুল কাকা আব্বার পেছনে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এর আগে কারো সাথে চন্দ্রকে কথা বলতে দেখে নি, তাই দুজনেই অবাক হচ্ছে।
দুজনেই কি মনে করবে ভেবে চন্দ্র সরে গেলো ভেতরের দিকে।শাহজাহান তালুকদার বিরক্তি নিয়ে টগরকে দেখছে।টগর হাসিমুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।সে শাহজাহান তালুকদারের সাথে তাকিয়ে থাকার এই খেলাটা খেলতে চায়।কতক্ষণ তিনি তাকিয়ে থাকতে পারে তার দিকে।
শাহজাহান তালুকদার চমকে গেলেন কিছুক্ষণ পর।একটু আগে এই ছেলেটার চোখে যেই সারল্য ছিলো মুহুর্তেই সেই চোখে রাজ্যের কঠোরতা ফুটে উঠলো কিভাবে!
এ যেনো অন্য মানুষ!
এই মাতালের সাথে চন্দ্রর এরকম হাসিমুখে কিসের কথা,কিভাবে চেনে সে চন্দ্রকে?
টগরের সাথে কথা বলতে গিয়ে লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া শাহজাহান তালুকদার, বাবুল দাশ কারোর নজর এড়ায় নি।
শর্মীকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে ছোট মাছ কাটতে।বুকের ভেতর ক্ষণে ক্ষণে ঝড় উঠছে শর্মীর।নিয়াজ নেই,নিয়াজ আর কোনো দিন ফিরে আসবে না।কি আশ্চর্য, শর্মীর তো খুশি হওয়ার কথা।তবুও কেনো বুকটা এমন কেঁপে উঠছে।যেই মানুষ তার ভালোবাসাকে অপমান করেছে, তাকে সবার চোখে খারাপ বানাতে চেয়েছে তার জন্য মনের ভেতর কোথায় এখনো কিছুটা ভালোবাসা লুকোনো ছিলো?
কোথায় ছিলো?
কেনো ছিলো?
কেনো শর্মীর এতো কষ্ট হচ্ছে?
একটা মিথ্যে বিয়ে বিয়ে খেলা খেলেছে নিয়াজ তার সাথে। অথচ শর্মী কি অবলীলায় তাকে স্বামী বলে জেনেছে।
সেই প্রতারককে কেনো মনে পড়ছে!
কেনো চোখে জল আসতে চাইছে?ভালোবাসা এতো অদ্ভুত কেনো?
চলবে……
রাজিয়া রহমান।