#চন্দ্রাণী(১৭)
নির্ঝর হেসে জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছেন মিস শর্মীলা তালুকদার? ”
শর্মী মুখ ভোঁতা করে, “ভালো। ”
নির্ঝর বললো, “মুড অফ মনে হচ্ছে? ”
শর্মী অগ্নিশর্মা হয়ে বললো, “আপনার কি তাতে?আপনার কাজ যা,তা করুন।অন্যের মুড নিয়ে ভাবতে নিশ্চয় আসেন নি।”
নির্ঝর মাথা নাড়িয়ে বললো, “তা ঠিক।আচ্ছা আমরা কাজের কথায় আসি।নীলির সাথে আপনার কেমন সম্পর্ক ছিলো? মানে আপনাদের বন্ধুত্ব কেমন ছিলো?”
শর্মী মন খারাপ করে বললো, “নীলি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো না হয়তো কিন্তু আমাদের সম্পর্ক খুব ভালো ছিলো। একইসাথে কলেজে আসা যাওয়া করতাম আমরা দুজনেই। একইসাথে আসা যাওয়া করতে করতে একে অন্যর ভালো বন্ধু হয়ে যাই।নীলি প্রায় সময় আমাদের বাড়ি আসতো ছুটির দিন হলে।সকাল থেকে গল্প,আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যায় চলে যেতো। ”
নির্ঝর জিজ্ঞেস করলো, “আপনার ফ্যামিলি মেম্বাররা নীলিকে কিভাবে নিতো?তার আসা যাওয়া এসব।যা সত্যি তা বলবেন।”
শর্মী অবাক হয়ে বললো, “আপনি কি আমার পরিবারের মানুষদের সন্দেহ করছেন নাকি? দেখুন আমার মা নীলিকে অনেক পছন্দ করতো। নীলি এলে মা ধরে ওর চুলে তেল লাগিয়ে দিতো।
আমরা একইসাথে দুপুরে খেতাম আব্বাসহ।এমনকি আমার আব্বা তো নীলিকে কখনো একা বাড়িতে যেতেও দিতো না।বাবুল কাকাকে দিয়ে ওকে বাড়ি পাঠাতো। ”
নির্ঝর বললো, “বুঝতে পেরেছি,এজন্যই নীলির লাশ দেখে আপনার বাবা এমন ভেঙে পড়েছে।”
শর্মীর চোখ ছলছল করতে লাগলো।
নির্ঝর বললো, “নীলির কারো সাথে রিলেশন ছিলো? ”
শর্মী এক মুহূর্ত থেমে বললো, “হ্যাঁ ছিলো শফিক নামে একজনের সাথে। তবে শফিক ভাই আর যা হোক এই কাজ করতে পারে না।”
নির্ঝর বললো, “এতো কনফিডেন্স? ”
শর্মী বললো, “নীলি যেদিন হারিয়ে যায় পরদিন সকালে আপা আর আমি শফিক ভাইয়ের দোকানে যাই।আমাকে দেখে শফিক ভাই মিষ্টি করে হাসলো। উনি নিজেই বলেছেন আগের রাত থেকে নীলিকে ফোনে পাচ্ছেন না।নীলির বাড়িতে বিয়ের কথা চলছিলো।শফিক ভাই ওকে পালিয়ে যেতে ও বলেছিলো।নীলি যদি ওনার সাথে পালাতো রাতে উনি নিশ্চয় পর দিন দোকানে আসতেন না কাজে।”
নির্ঝর বললো, “আপনার আপার মনে হচ্ছে এসব ব্যাপারে বেশ ইন্টারেস্ট? ”
শর্মী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “আপনি নিশ্চয় আমার আপাকে সন্দেহ করছেন না?”
নির্ঝর হেসে বললো, “সত্যি বলতে আমি আপনাকেও সন্দেহ করছি।আমার কাজই সন্দেহ করা।তবে তাই বলে ভাববেন না ব্যক্তিগত জীবনে ও আমি এরকম।সেখানে আমি অন্য মানুষ। ”
শর্মী বিরক্তি নিয়ে তাকাতেই হেসে বললো, “আপনি এতো শিওর হচ্ছেন কিভাবে শফিকের ব্যাপারে? হতে ও তো পারে ও নিজেকে সন্দেহ মুক্ত রাখতে আপনার সাথে অভিনয় করেছে?”
শর্মী ইতস্তত করে বললো, “হতে পারে হয়তো তবে আমার মনে হচ্ছে না এরকম কিছু হয়েছে। সব মানুষ তো এক না,কেউ কেউ সত্যি সত্যি ভালোবাসে।নীলির মৃত্যুর খবর শোনার পর শফিক ভাই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন,উনি হাসপাতালে আছেন।”
নির্ঝর জিজ্ঞেস করলো, “আপনি কিভাবে জানলেন?”
শর্মী বললো, “আপা খবর নিয়েছে।”
নির্ঝর বললো, “আপনি যেতে পারেন,দরকার হলে আবারও জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসবো।”
শর্মী যেতে নিতেই নির্ঝর পেছন থেকে বললো, “কেউ কেউ কিন্তু সত্যি ভালোবাসতে পারে, আমি ও তাদের দলে।”
শর্মী পেছনে তাকিয়ে বললো, “আমাকে এসব বয়ার মানে কি?”
নির্ঝর হেসে বললো, “এমনি,জানিয়ে রাখলাম।আপনি জানেন না তো তাই।”
শর্মী আর দাঁড়ালো না।
চ্যানেল স্বদেশে বেলা বারোটায় একটা বিশেষ ভিডিও প্রচার করা হলো।কুসুমপুর নামক এক সীমান্তবর্তী গ্রামে অবাধে কেমন ড্রাগ বিক্রি হচ্ছে।
পুরো দেশের মানুষ হতবাক হয়ে দেখছে।আর এর ক্রেতারা সবাই ১৫ বছর বয়সী কিশোর থেকে শুরু। কেউ দোকানদারির আড়ালে ড্রাগ বিক্রি করছে,কেউ বা স্টেশনে কুলির কাজে আড়ালে ড্রাগ বিক্রি করছে।কেউ রিকশাচালক, কেউ ভিক্ষুক। একজন এক ছদ্মবেশে আছে।
নির্ঝর হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে টিভির দিকে। যাদের সন্ধানে সে লোক লাগিয়ে রেখেছে, আজ টিভিতে তাদের সন্ধান দিচ্ছে তাকে।অনুষ্ঠান চলাকালীন নির্ঝরের কেবিনের টেলিফোন বাজতে শুরু করলো। একের পর এক উপর মহল থেকে ফোন আসছে।
নির্ঝরের কান ব্যথা হয়ে গেলো শুনতে শুনতে। সবার এক কথআ,আজকে দিনের ভেতরেই এদের সবাইকে থানায় পুরতে হবে বলে অর্ডার দিচ্ছে।
নির্ঝর ভাবতে লাগলো, এই ভিডিও রেকর্ড করেছে কে?
চ্যানেল স্বদেশ বলছে তাদের নিজস্ব ক্রাইম রিপোর্টার এই ব্যাপারে নিজে অনুসন্ধান চালাচ্ছে।
বিড়বিড় করে নির্ঝর বললো, “এই কুসুমপুর জায়গাটার সব মানুষ কেমন মুখোশধারী বলে মনে হয়। কে ভালো আর কে অপরাধী কিছুই বুঝতে পারছি না।একে তো উপর মহলের চাপ ছিলো এতো দিন এখন আবার এই চ্যানেলের জার্নালিস্ট। এভাবে টিভিতে এসব প্রচার হলে তো জনগন পুলিশকে ভরসা করবে না।অথচ এসব চ্যানেল তাদের টিআরপির জন্য সব কিছু করতে পারে। ”
নিয়াজ টিভিতে এই অনুষ্ঠান দেখে ভূত দেখার মতো চমকে গেলো। মুহুর্তেই তার পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো যেনো। টিভিতে যাদের গোপনে ভিডিও করে দেখানো হচ্ছে এরা সবাই তো নিয়াজের লোক।
নিয়াজের মনে হলো তার প্রাণ বুঝি এখনই চলে যাবে।পুলিশ ওদের ধরতে পারলে নিয়াজের নাম জেনে যাবে পুলিশ। এরপর?
নিয়াজ আর ভাবতে পারছে না।সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে।
গতকাল রাতে টগরকে নিয়ে এদের সবার কাছে গিয়েছিলো নিয়াজ,আর আজকেই এই নিউজ।কে গতকাল রাতে তাদের পিছু নিয়েছিলো?
না-কি টগর এই কাজ করেছে?কিন্তু টগর কেনো করবে?ওর ও তো রোজকার করার পথ এটা।
নিয়াজের ফোন বাজছে।ভয়ে নিয়াজ রিসিভ করছে না।চেক না করে ও নিয়াজ বুঝতে পারছে কে কল দিয়েছে।বসকে কিভাবে সামলাবে নিয়াজ?
চলবে….
#চন্দ্রাণী(১৮)
চন্দ্র দুপুরে খেতে বসে বললো, “আব্বা,কাদের খানের ছেলেটারে তো পুলিশ খুঁজতেছে শুনছেন? ”
শাহজাহান তালুকদার চিন্তিত হয়ে বললেন,”হ্যাঁ, শুনছি রে মা।কি যে হচ্ছে এলাকায় এসব কিছুই বুঝি না।সামনে নির্বাচন এরই মধ্যে দেখ কতো ভেজাল। একের পর এক ঝামেলা লেগেই আছে। কি হবে কে জানে!”
শর্মী বললো, “আপনি এতো চিন্তা কইরেন না আব্বা।গ্রামের সব মানুষ জানে আপনি কেমন মানুষ। আপনি চেয়ারম্যান হইলে সবার কতো সুবিধা তা কি মানুষের অজানা না-কি!
আপনার মতো কয়জন আছে যে গ্রামের মানুষের কথা এতো চিন্তা করে। রাতে হইলে আপনি বাবুল কাকাকে নিয়ে গ্রামে পরিদর্শনে যান।কোনো দিন তো দেখি নি সরকারি কোনো জিনিস বাড়িতে আমাদের জন্য রাখতে।সবই তো মানুষের জন্য করেন।”
শাহজাহান তালুকদার মুচকি হেসে বললো, “আমার ছোট মেয়েটা বড় বেশি সহজ সরল। মা রে,এখন যুগটাই এরকম যে কারো হাতে যদি ১হাজার টাকার একটা নোট ধরিয়ে দেয় কেউ,মানুষ তাকেই ভোট দিবে যে টাকা দিয়েছে। ১৫ বছর ধরে আমি কি করেছি একটা ১হাজার টাকার নোটের কাছে আমার সব পরিশ্রম বিক্রি হয়ে যাবে।মানুষ এটা ভাববে না এরপর কি হবে,আজকের ১হাজার টাকাই সবকিছুর উর্ধ্বে চলে যাবে। ”
চন্দ্র বললো, “আব্বা,এতো চিন্তার কি আছে আপনার? ”
শাহজাহান তালুকদার শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বললেন,”আল্লাহ আমারে একটা ছেলে দিছে অথচ তার খেয়াল রাখা লাগে অন্যদের।এই যে আমার নির্বাচন, ও যদি সুস্থ থাকতো ও নিজেই তো আমার নির্বাচনের কাজে সাহায্য করতো। নিজের মানুষ বাহিরের মানুষ দিয়ে কাজ করানোর অনেক ফারাক রে মা।”
চন্দ্রর মুখ মলিন হয়ে গেলো বাবার কথা শুনে। শুভ্র আপনমনে খেয়ে যেতে লাগলো।
নরম সুরে চন্দ্র বললো, “আপনি চিন্তা কইরেন না আব্বা।আপনার ছেলে হতে পারি নি হয়তো কিন্তু মেয়ে বলে যে হাতে চুড়ি পরে ঘরে বসে থাকবো তেমন মেয়ে হই নি।
এই হাতে যেমন ১০০ মানুষের জন্য রাঁধতে পারি তেমনি এই হাতেই ১০০ মানুষকে কন্ট্রোল করতে পারি।
এই মুখ দিয়ে যেমন মানুষের সাথে মিষ্টি করে কথা বলতে পারি তেমনি এই মুখেই আবার প্রতিবাদ করতে পারি আব্বা।”
শাহজাহান তালুকদার অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।এই মেয়েটাকে কেমন অচেনা লাগছে তার আজ।কেমন শান্ত কণ্ঠ, দৃঢ়তা, আত্মবিশ্বাসে ভরপুর।
এই মেয়ের মধ্যে কার ছায়া দেখতে পাচ্ছেন যেনো তিনি!
বহু বছর ধরে যাকে ভুলে থাকতে চেয়েছেন তাকেই কেনো বারবার মনে পড়ছে!
চন্দ্র খাওয়া শেষ করে নিজের রুমে গেলো। শুভ্র কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো বোনের চলে যাওয়ার দিকে।রেহানা আড়চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলো।
দুপুরের খাবারের বেশ খানিক পরে চন্দ্র,শর্মী,শুভ্র বের হলো গ্রামের রাস্তায়। ঠিক করলো গ্রামের শেষ প্রান্ত থেকে শুরু করবে।হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের শেষ মাথায় গেলো। এক বাড়ি এক বাড়ি করে তিন ভাই বোন ঢুকছে আর লিফলেট বিতরণ করছে।
চন্দ্র মিষ্টি মুখে সবার সাথে হেসে কথা বলছে।বৃদ্ধাদের সাথে বসে পান সুপারি খাচ্ছে।
শর্মী তাকিয়ে ভাবতে লাগলো ও কখনো আপার মতো এরকম সাহসী হতে পারবে কি-না! ওর মনের বল কখনো এরকম হবে কি-না! আপা কি সুন্দর করে সব ম্যানেজ করতে পারে।
এক দিনেই ওরা ১০ বাড়িতে যাবে বলে ঠিক করলো। ১০ টা বাড়িতে যাওয়ার পর ক্লান্ত হয়ে আবার বাড়ির দিকে পা বাড়ালো তিন জন।এক এক বাড়িতে প্রায়৭-৮ টা,১০-১২ টা করে ঘর আছে।এতো মানুষের সাথে কথা বলতে অনেক এনার্জি লাগে।শর্মী কথা না বলেও ক্লান্ত হয়ে গেলো অথচ চন্দ্র কেমন ফিট এখনো। কোনো ক্লান্তির ছাপ নেই তার মধ্যে।
শর্মী বললো, “আপা আজকে আর না।আবার আগামীকাল। ”
চন্দ্র হেসে বললো, “আচ্ছা অসুবিধা নেই।শোন,আমি একটা প্ল্যান করেছি কিন্তু।”
শর্মী জিজ্ঞেস করার আগেই চন্দ্র বললো, “গ্রামে একটা খেলাধুলার প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করবো ।নির্বাচন তো চলে এলো।”
শর্মী জিজ্ঞেস করলো, “কেমন প্রতিযোগিতা? ”
চন্দ্র বললো, “আরে,ইউটিউবে, ফেসবুকে দেখিস না গ্রামের মানুষদের নিয়ে নানা ধরনের খেলার ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের টার্গেট হবে ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সী মহিলাদের আর অপশনাল হিসাবে হবে বাচ্চাদের। ”
শর্মী জিজ্ঞেস করলো, “পুরুষরা বাদ যাবে কেনো?”
চন্দ্র হেসে বললো, “পুরুষ মানুষ যেকোনো মুহূর্তে রঙ বদলে ফেলতে পারে তাই।তাছাড়া, পুরুষেরা মোটামুটি মাথায় সেট করেই রাখে কাকে ভোট দিবে তারা।মহিলারা যেহেতু এসব পলিটিক্স কম বুঝে তাই ওরা যেখানে আনন্দ পায়,ভালো কোনো উপহার পায়,তাদের বাচ্চাদের মুখে হাসি দেখতে পায় সেদিকে ঝুঁকে যায়।
আমরা এদের টার্গেট করে প্ল্যান করবো বসে কেমন ধরনের খেলার ব্যবস্থা করা যায় আর উপহার কি হবে।”
শর্মী হেসে বললো, “আপা,তুই আসলেই জিনিয়াস। আমার গোবর মাথায় এতো বুদ্ধি নেই।”
চন্দ্র হাসলো।টগরের সাথে দেখা করতে হবে একবার তার।
টগর চিন্তিত হয়ে নিয়াজের সাথে কথা বলছে।নিয়াজের নামে সার্চ ওয়ারেন্ট বের হয়েছে। নিয়াজ আছে আপাতত টগরের সাথে এক গোপন আস্তানায়।
টগর টেবিলে আলতো করে চাপড় দিয়ে বললো, “এটা ঠিক কিভাবে হলো আমি এখনো বুঝতে পারছি না। আমরা ঠিক যেখানে যেখানে গিয়েছি ঠিক সেখানে সেখানেই গেলো ওই সাংবাদিক।
অন্য কোনো কাউকে কিন্ত দেখায় নি, আবার আমাদের লিস্টের কেউ বাদ ও যায় নি।
কেউ কি আমাদের পিছু নিয়েছিলো তাহলে?
নিয়াজ চমকে উঠে। আসলেই তো!
তার তো শত্রুর অভাব নেই।হতেও তো পারে।
চলবে…..
রাজিয়া রহমান