চন্দ্রাণী পর্ব-১০

0
455

#চন্দ্রাণী(১০)
সন্ধ্যা বেলা একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলো। শুভ্র পুকুর ঘাটে বসে ছিলো, শর্মী গিয়েছিলো শুভ্রকে হাত মুখ ধুইয়ে ঘরে আনবে।শ্যাওলা ধরা পিচ্ছিল সিঁড়িতে পা দিতেই পা পিছলে ৫-৬ সিঁড়ি পেরিয়ে শর্মী গিয়ে পানিতে পড়লো।
উপরের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে শুভ্রর অবস্থা খারাপ। শর্মী উঠে এসে ভাইয়ের হাত মুখ ধোয়ানো শেষ করে বাড়ি যায়।

চন্দ্র বোনকে ভিজে যেতে দেখে তাড়াতাড়ি শুকনো তোয়ালে এনে দিলো। জামা কাপড় পালটে শর্মী রুমে গেলো। রাতের দিকে শর্মীর প্রচন্ড ব্লিডিং শুরু হলো।

হতবাক হয়ে গেলো শর্মী। দেহের ভেতর ছোট্ট যে প্রাণ ছিলো, সে কি তবে নেই?
কলিজা কাঁপতে লাগলো শর্মীর।বিড়বিড় করে আল্লাহকে বললো, “আল্লাহ,আমাকে রহম কর। আমার মধ্যে থাকা আরেকটা প্রাণকে তুমি কেড়ে নিও না।নিতে হলে আমাকে সহ নাও,কিন্তু তাকে নিয়ে যেও না। ”

বুক ভাঙা যন্ত্রণা নিয়ে শর্মী বিছানায় গড়াগড়ি করতে লাগলো। চন্দ্র বোনের রুমে এসে দেখে শর্মী কেমন গড়াগড়ি করছে।
ব্যতিব্যস্ত হয়ে চন্দ্র শর্মীকে জড়িয়ে ধরলো। ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে বোন,আমাকে বল?”

আজ আর শর্মী ভয় পেলো না,লজ্জা পেলো না।আজ আর তার কিছু হারানোর নেই।বোনের কোলে মাথা রেখে শর্মী কাঁদতে কাঁদতে বললো, “আমার আর কিছু রইলো না আপা।আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আমার বাবুটা চলে গেছে আমাকে ছেড়ে গো আপা।”

চন্দ্র শর্মীর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, “শান্ত হ তুই বোন।একটু শান্ত হয়ে বস।”

শর্মী কাঁদতে কাঁদতে বললো, “আপা আমি কিভাবে শান্ত হব?আমার তো সব শেষ হয়ে গেলো আপা।নিয়াজ ও চলে গেলো আমাকে ছেড়ে, যাকে রেখে গেলো সে ও তো এখন আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। ”

চন্দ্র ঠান্ডা গলায় বললো, “নিয়াজ?”

শর্মী বললো, “আমি আর নিয়াজ একে অন্যকে ভালোবাসতাম।এমনকি নিয়াজ আর আমি বিয়ে ও করে নিই।কিন্তু তার পর যখন আমি কন্সিভ করে ফেলি নিয়াজ তখন কেমন পালটে গেলো আপা।নিয়াজ বললো, এই বেবি রাখা যাবে না।কিন্তু আমি তাতে রাজি হতে পারলাম না আপা।আমার বেবি তো পাপের ফসল না।আমাদের বিয়ে হয়েছে। নিয়াজকে সে কথা বলতেই নিয়াজ বললো, ও নাকি আমাকে সত্যিকার বিয়ে করে নি,যে বিয়ে করেছে ওটার কোনো ভ্যালু নেই।সরকারি রেজিস্টারে নাম উঠে নি,ওগুলো ভুয়া কাগজ দিয়ে আমাকে নয়ছয় বুঝিয়েছে বিয়ের নাটক করেছে।ওর আসলে লক্ষ্য ছিলো আমার সাথে রাত কাটানোর। যেহেতু আমি রাজি হচ্ছিলাম না তাই আমাকে বুঝিয়েছে এবার বিয়ে হয়ে গেছে। আমি ও বোকার মতো সব বিশ্বাস করেছি আপা।
আর এখন দেখ,আমার বেবিটাও চলে গেলো। ”

চন্দ্র হতাশ স্বরে বললো, “এতো বোকা মানুষ হয়?কাকে ভালোবাসলি?শত্রুর সাথে ভালোবাসা হয়?”

শর্মী মাথা নিচু করে বললো, “তখন তো আমি বা নিয়াজ কেউ-ই জানতাম না আমার বাবা আর ওর বাবা একে অপরের ছায়া ও মাড়ায় না।”

চন্দ্র হেসে বললো, “তুই সত্যি খুব বোকা রে বোন।নিয়াজ জানতো না বলছিস তুই?”

শর্মী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বোনের দিকে।

চন্দ্র মলিন হেসে বললো, “নিয়াজ সব জানতো।ও জেনে শুনেই তোর সাথে এরকম করেছে।কেনো করেছে তুই বুঝতে পারিস নি।
জানিস না ওর বাবা আর আব্বার মধ্যে যে দ্বন্দ্ব। ও চেয়েছিলো তোকে গুঁটি বানিয়ে খেলবে।আব্বাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করার সব পরিকল্পনা নিয়ে ওরা মাঠে নেমেছে এবার।
শুভ্রর ব্যাপারটা মনে করে দেখ,তোর মনে হয় কে করতে পারে এসব কাজ?এটাও নিয়াজের কাজ।নিয়াজই শুভ্রকে ড্রাগ দিয়েছে।

ও চেয়েছিলো তোর প্রেগন্যান্সির খবরটা ছড়িয়ে দিয়ে আব্বার বদনাম ছড়িয়ে দিবে।আর লজ্জায় অপমানে তুই ও হয়তো কোনো স্টেপ নিবি।আব্বা তখন পুরোপুরি ভেঙে পড়বে।সবার কাছে আব্বা ছোট হয়ে যাবে আর ওরা জিতে যাবে।
ওদের দীর্ঘ দিনের প্ল্যান ছিলো এসব।একটু একটু করে এগিয়েছে খাঁনেরা এবার।”

শর্মী হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। আপার সব কথা সত্যি।আপা একটা বর্ণ ও মিথ্যে বলে নি।

চন্দ্র বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, “এই যে যে ছোট্ট প্রাণটা দুনিয়ায় আসলো না বলে তোর এতো কষ্ট হচ্ছে, একবার ভেবে দেখ তো আব্বা মা’র কি তোর জন্য কম কষ্ট হতো যদি তুই ভুল কোনো সিদ্ধান্ত নিতি।অথবা যখন সবাই জেনে যেতো তোর এই ব্যাপারটা। তুই তোর সন্তানের জন্য সবার বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে দুনিয়ায় আনতি,আব্বা মাকে তখন লোকে কেমন থুথু দিতো ভেবে দেখেছিস একবার?
কেউ কি বিশ্বাস করতো তোরা বিয়ে করেছিস?না-কি যে এই কাজ করেছে সে স্বীকার করতো কিছু বল?
দিন শেষে কষ্ট আমরা সবাই পেতাম।

আমার কথা হয়তো তোর কাছে স্বার্থপরের মতো লাগছে,মনে হতে পারে আমি ভীষণ জঘন্য। তবে বাস্তবতা এটাই আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন।ওই ছোট প্রাণটা এই দুনিয়ায় এলে তাকে এই সমাজের মানুষ সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে দিত না।
যা হওয়ার হয়েছে, আব্বা মা কাউকে কখনো ঘুণাক্ষরেও কিছু জানানো যাবে না। আব্বা এই শক নিতে পারবে না শর্মী।”

শর্মী অঝোরে কাঁদতে লাগলো। দেহের ভেতর যে এতো দিন গুটিসুটি মেরে বসে ছিলো সে আজ চির বিদায় নিয়ে চলে গেছে সবাইকে স্বস্তি দিতে।

চন্দ্র বোনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, “বোন আমার, এটা ভেঙে পড়ার দিন নয়।নিজেকে শক্ত করে তোলার দিন।ভেতরে ভেতরে নদীর মতো একূল ওকূল ভেঙে গেলেও উপরে উপরে নিজেকে পাথর করে ফেলতে হবে।
এই সমাজ দুর্বলকে জায়গা দেয় না।যেই কাপুরষ কাপুরুষের মতো তোর শরীরকে নোংরা করতে চেয়েছিলো, নোংরা তুই হস নি।নোংরা হয়েছে সে।

মানুষের জীবনে কতো দুর্ঘটনা ঘটে যায়।ভেবে নিবি এটাও একটা দুর্ঘটনা তেমনই। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নে,এমনভাবে বাঁচবি যে তোকে দেখে সে নিজেই যেনো ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ে। ”

শর্মী মাথা নিচু করে বললো, “আমি যে তাকে এখনো ভালোবাসি আপা।”

চন্দ্র মুচকি হেসে বললো, “তবুও ভুলতে হবে যে বোন।”

শর্মী বললো, “আপা, নিয়াজ কি আমার কাছে আর ফিরে আসবে না?আমি ওকে ভীষণ ভালোবাসি আপা, অনেক বেশি। ওকে বল না একবার ফিরে আসতে।ও একবার সরি বললেই আমি সব ভুলে যাব।”

চন্দ্র অপলক বোনের দিকে তাকিয়ে বললো, “হায়রে বোকা মেয়ে,অন্ধ হয়ে ভালোবাসলি যাকে খবর নিয়েছিস তাকে নিয়ে? ও ফিরতে চাইলেও তুই ফিরিয়ে নিবি না।কারণ নিয়াজ তোকে ঠকিয়েছে।নিয়াজ আরো ৫ বছর আগেই বিয়ে করেছে, ওর ৪ বছরের একটা ছেলে আছে ”

শর্মী চমকে উঠলো শুনে। মাথায় যেনো বাঁজ ভেঙে পড়লো ওর।চন্দ্র একটু জিরিয়ে বললো, “আল্লাহ যা করেন বান্দার মঙ্গলের জন্য করেন।আল্লাহর উপর পূর্ণ বিশ্বাস রেখে পেছনের সব কিছু ভুলে নিজের জীবন গুছানোর চেষ্টা কর।আমি সবসময় তড় পাশে আছি।”

শর্মীর পুরো পৃথিবী যেনো থমকে গেলো।এতো বড় ধোঁকা খাবে সে কখনো ভাবে নি।নিয়াজ এতো জঘন্য মানুষ!

রাতের খাবার টেবিলে শর্মী গেলো না।চন্দ্র ও ডাকাডাকি করলো না খুব একটা। একা থাকুক কিছুক্ষণ। নিজেকে সামলাতে হলে একা একা আগে মনের সাথে যুদ্ধ করতে হবে তার।তবে শর্মীর অনুপস্থিতিতে ওর রুমে গিয়ে একটা পেইন্টিং এর মধ্যে
একটা ক্যামেরা লাগিয়ে দিয়ে এলো চন্দ্র।

রাতে চন্দ্র এসে বললো, “আমি তোর সাথে শুই আজকে?”
শর্মী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, “না আপা।আজ রাতটা আমি একা থাকতে চাই।”

চন্দ্র আর বাড়াবাড়ি করলো না। শর্মী সারারাত গলাকা**টা মুরগির মতো তড়পাতে লাগলো মন ভাঙার যন্ত্রণায়।
পাশের রুমে বোনের ছটফটানি দেখে চন্দ্র কেঁদে বালিশ ভেজাতে লাগলো।
অসহ্য রকমের যন্ত্রণা লাগছে চন্দ্রর।ইচ্ছে করছে গিয়ে খু**ন করে ফেলতে নিয়াজকে।

সারারাত দুই বোনের কেউই ঘুমাতে পারে নি।

সকালে ঘুম থেকে উঠে চন্দ্র বের হয়ে দেখে শর্মী উঠান ঝাড়ু দিচ্ছে।
চন্দ্র বের হলো টগরের বাড়ির উদ্দেশ্যে। বুকের ভেতর রাগ,জিদ,ক্ষোভ।

চলবে……
রাজিয়া রহমান

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে