চন্দ্ররঙা প্রেম ২ পর্ব-১৬+১৭

0
1195

#চন্দ্ররঙা_প্রেম_২
#পর্বঃ১৬
#আর্শিয়া_সেহের

সেদিনের পর ছয়দিন কেটে গেছে। আজ পুনমের গায়ে হলুদ। রুশান সকাল থেকেই দরজা বন্ধ করে বসে আছে। এই ছয়দিনে সে অনেক চেষ্টা করেছে পুনমের বিয়ে ভাঙার কিন্তু বিবেকে সায় দেয় নি। পুনমের উডবির ব্যাপারেও কোনো তথ্য পায় নি রুশান। ভেবেছিলো ছেলেটার সাথে কথা বলে বিয়েটা আটকাবে কিন্তু ছেলের ব্যাপারে কিছুই জানতে পারেনি। শুধু ছেলের ছবিটাই দেখেছে । এতো দিনে কেসটাও ক্লোজ হয়ে যেতো কিন্তু রুশানের কোনো কিছুতেই মন বসছে না। সে পুনম ছাড়া কিছু ভাবতে পারছে না।

পুনম সেদিন রাতে রুশানকে কল করেছিলো কিন্তু রুশান‌ রিসিভ করে নি। পরে তনিমের থেকে শুনেছে যে রুশান সবটা নিজ কানে শুনে গেছে । অঝোরে কেঁদেছিলো পুনম তখন। সেই রাতেই পুনম তনিমের বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলো। তারপর থেকে পুরোপুরি ঘরবন্দি করে রেখেছে নিজেকে পুনম। সারাক্ষণ ফোনে তার আর রুশানের কাপল পিক দেখেই তার দিন কাটে।

তনিম ভোরেই চলে এসেছে শানদের বাড়িতে। এই কয়দিনে সেও‌ রুশানের সাথে চেষ্টা করেছে পুনমের হবু বরের সাথে কথা বলার কিন্তু ফলাফল শূন্য। ছেলের পরিবারের সবার সাথে শুধু ফোনেই কথা হয়েছে। তারা একবারে বিয়ের দিনে আসবে এমনটাই কথা হয়েছে। তাদের ভাবসাব দেখে মনে হয় যেন আন্ডারওয়ার্ল্ড ফ্যামিলি।
তনিম অয়েকবার রুশানকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে এসে সোফায় বসেছে। পুনমের গায়ে হলুদ বা বিয়ে কোনোটাতেই থাকার ইচ্ছে নেই তার। যদিও রুশান তাকে বলেছে থাকতে।

সোফায় তনিমের অপজিটে রুমঝুম আর বিথী বসে আছে। শান্ত তনিমের পাশে বসে আছে। রুশানের এই দৈন্য দশা দেখে সবচেয়ে বেশি কেঁদেছে শান্ত। সকাল দুপুর রাতে, যখনই রুশানকে দেখে তখনই কাঁদে শান্ত। শান্তর কান্না দেখে রুশান যখন হেঁসে ফেলে তখন শান্ত চেঁচিয়ে কান্না করে‌। রুশানকে নিজের ভাইয়ের মতো ভালোবাসে শান্ত। রুশানের কষ্টটা যেন ওকেই বেশি কষ্ট দিচ্ছে।

শান খানিকটা পরে নিচে এলো । তনিমকে দেখে বললো,
-“তোমার শালির বিয়ে আর তুমি এখানে কি করছো? যাও যাও বিয়ের কাজ করো।”
তনিম মুখ অন্ধকার করে বললো,
-“এভাবে বলবেন না ভাইয়া। আমার কাছে পুরো দুনিয়া এক দিকে আর আমার স্যার একদিকে। আমি স্যারকে এভাবে রেখে শালির বিয়েতে কখনই যাবো না।”

শাফিয়া আক্তার শানের খাবার টেবিলে রেখে এগিয়ে এসে বললেন,
-“রুশানের মতো সোনার টুকরো ছেলে রেখে কার সাথে বিয়ে দিচ্ছে ওই মেয়ের ?”
তনিম কিছু বললো না। বলবেই বা কি? ছেলের ব্যাপারে কিছু জানেই তো না।
রুমঝুম তনিমের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আচ্ছা তনিম, পুনমের উডবির ছবি আছে তোমার কাছে?”

তনিম কিছুক্ষণ ভেবে বললো,
-“হ্যাঁ হোয়াটসঅ্যাপে আছে মনে হয়। পিহুর মামা পাঠিয়েছিলো দেখার জন্য।”
-“আমাকেও দেখাও তো।”
তনিম ছবিটা বের করে রুমঝুমের হাতে দিলো। ছেলেটা বেশ হ্যান্ডসাম। এমন ছেলেকে যে কোনো পরিবার তাদের মেয়ের জন্য পছন্দ করবে।
রুমঝুম হালকা হেঁসে বললো,
-“ভালোই তো।”
রুমঝুমের পাশ থেকে বিথী উঁকি মারলো স্ক্রিনে। সঙ্গে সঙ্গেই শরীরের মধ্যে ঝিমঝিম করে উঠলো তার। খানিকটা চেঁচিয়ে বললো,
-“রায়হান। এটা তো রায়হান। রাশেদ এর ভাই। এই ছেলেটার সাথে বিয়ে হবে পুনম মেয়েটার? ওর জীবনটা শেষ হয়ে যাবে। এই ছেলে অনেক খারাপ। বাজে চরিত্র। এই বিয়ে আটকাও। দরকার হলে মেয়েটাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলো তবুও নরকে পাঠিও না।”

বিথীর চিৎকার শুনে শান উঠে এলো। শাফিয়া আক্তার,রুমঝুম আর তনিম তিনজনই হতভম্ব হয়ে গেছে। তনিম মিনমিন করে বললো,
-“তাহলে আমি ঠিকই ভেবেছিলাম। আন্ডারওয়ার্ল্ড পরিবার বলেই হয়তো সামনে আসে না।”
শান রুমঝুমের হাত থেকে ফোন নিয়ে ছেলেটাকে দেখলো। বেশ কিছুক্ষণ পরখ করে বললো,
-“ছেলেটা যেন তেন ছেলে না। বুদ্ধিমান ছেলে মনে হচ্ছে। তনিম তুমি সবটা রুশানকে বুঝিয়ে বলো। আজকের দিনটা এভাবে যাক। কাল বিয়ের আসরেই ড্রামা স্টার্ট করা যাবে।
আর রুশানকে একা ছেড়ো না। এমনিতেই ওর মাথা খারাপ হয়ে আছে। কখন কি করে ফেলবে টের পাবো না। সবকিছু ঠিকঠাক সামলে রেখো।”

শানও এখন কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো। আর যাই হোক পুনমের বিয়েটা নিশ্চিত ভাঙবে আর রুশানটাও আগের মতো স্বাভাবিক হবে এটা ভেবে।
বিথী অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। প্রায় এক সপ্তাহ পর আবার একটা পশুর ছবি দেখে ওর অতীতটা একে একে ঘুরছে মাথায়। শাফিয়া আক্তার বিথীকে সোফায় বসিয়ে পানি খাইয়ে দিলো। শান্ত তনিমের আগেই লাফাতে লাফাতে রুশানের ঘরের সামনে চলে গেছে সবকিছু বলতে। তার রুশান ভাইয়ের ক্লান্তিমাখা মুখটাতে হাঁসি দেখেনি যেন কতকাল হয়ে গেছে। নিশ্চয়ই খবরটা পেয়ে হাসবে সে।

শান অফিসের জন্য বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
-“সবাই তৈরি হয়ে পুনমের হলুদে যাও। বেচারি এমনিতেই অনেক কষ্টে আছে।
আর আগামী পরশু তিহান আসছে দেশে। আগেই জানিয়ে রাখলাম।”

তিহানের নামটা শুনে বিথীর বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো। এই একটা মানুষ বিথীর আগাগোড়া অস্তিত্ব দখল করে আজও আছে। রাশেদের দেওয়া কষ্টগুলো তিহানের কথা আরো বেশি মনে করিয়ে দিতো বিথীকে। বারবার মনে হতো তিহানের উপর রাগ করে সে নিজেই নিজের এতো বড় সর্বনাশ করেছে।
সেদিনের পর কতগুলো বছর কেটে গেছে। সে তিহানকে দেখেনি,তার কথা শোনে নি, তার নামটাও উচ্চারন করেনি কেউ তবুও মানুষটা তার হৃদয়ে গেঁথে আছে। ‘ভালোবাসা, ভালোবাসা’ – বিথী দুই তিন বার মনে মনে আওড়ালো শব্দটা। আবার নিজ মনেই ব্যর্থতার হাঁসি হেঁসে বললো, ‘ভালোবাসা না একতরফা ভালোবাসা।’

শান্তর চেঁচামেচি শুনে তনিম পেছন দিকে তাকালো। রুশান হাতে একটা টিশার্ট নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। পেছন পেছন শান্ত চিল্লাতে চিল্লাতে বলছে,
-“দাঁড়াও রুশান ভাইয়া, দাঁড়াও। এতো তড়িঘড়ি করে কিছু করো না। হিতে বিপরীত হবে নইলে।”
তনিম এক লাফে সোফা থেকে উঠে এসে রুশানকে ধরলো। রুমঝুমও রুশানের কাছে এগিয়ে গিয়ে তাকে থামানোর চেষ্টা করলো। শাফিয়া আক্তার শান্তর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“এই ছেলেটা বেশি পাকা। তোকে কে বলেছে এখনই ওকে সবটা জানাতে? ছোট মানুষ, ছোট মানুষের মতো থাকতে পারিস না?”

শান্ত মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে পড়লো। সে তো শুধু রুশান ভাইয়ের হাঁসি মুখটাই দেখতে চেয়েছিলো।
রুশান শান্তর মুখের দিকে তাকিয়ে হতাশ নিঃশ্বাস ফেললো। তনিমের হাত ছাড়িয়ে শান্তর কাছে এসে দাঁড়ালো। সবার দিকে একপলক তাকিয়ে শান্তকে নিয়ে সোফায় বসে পড়লো।
সবাই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুশানের দিকে। চুলের উপর দিয়ে যেন ঝড় বয়ে গেছে তার। চোখ দুটো ফুলে লাল হয়ে আছে। কত রাত ঘুম বিসর্জন দিয়েছে কে জানে? মুখটাও ফুলে আছে।

রুমঝুম রুশানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তনিম এসে দাঁড়ালো রুশানের পেছনে। রুশান ধীরে ধীরে মাথা তুলে রুমঝুমের দিকে তাকালো। বোনের দু’চোখ যেন উত্তাল যমুনা। যেকোনো সময় বাঁধ ভাঙবে।
রুশান হেঁসে ফেললো রুমঝুমকে দেখে। মেয়েটা এত্তো কেন কাঁদে তা বুঝতে পারে না রুশান।
রুশানের হাঁসি দেখে রুমঝুম মুখ ফিরিয়ে নিলো। সাথে সাথেই দু’চোখ বেয়ে টুপ করে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। রুমঝুম অভিমানী কন্ঠে বললো,
-“আমাদের কথা তো ভুলেই গেছিস তুই। তোর এমন অবস্থা দেখে বাকিদের কেমন লাগছে সেটা তো দেখতে বা জানতে ইচ্ছে করে না তোর। আজকে পুনমের উডবির ব্যাপারে না জানলে তো‌ আজও দেখতে পেতাম না তোকে। স্বার্থপর কোথাকার। কারো কথা ভাবিস না।”

রুশান আলগোছে রুমঝুমের হাত ধরলো। সোফা থেকে উঠে নিজের জায়গায় বসালো রুমঝুমকে। রুমঝুমের দুই হাত নিজের গালে রেখে বললো,
-“আমার দুনিয়ার সবচেয়ে মূল্যবান মানুষটি তুমি,আপু। আমি এখন স্বার্থপরের মতো আচরণ করেছি আমি জানি। কিন্তু একটা কথা কি তুমি জানো? ”
রুমঝুম রুশানের দিকে তাকিয়ে আছে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে। রুশান হেঁসে বললো,
-“আমি সবচেয়ে বড় স্বার্থপর হই আমার আপুর বেলায়।”

রুমঝুম মুচকি হাসলো। রুশানের গাল থেকে বাম হাতটা সরিয়ে চোখ মুছলো। সোফা থেকে উঠে বললো,
-“এখন এতো মিষ্টি কথা বলতে হবে না। তনিমের সাথে কালকের সব প্ল্যান গুছিয়ে নে। আমি তোদের খাবার রেডি করি।”
রুমঝুম যেতেই বিথীও উঠে পড়লো। সাথে সাথে রুশান বললো,
-“আপু আপনি যাবেন না প্লিজ। আপনাকেও প্রয়োজন এই প্ল্যানে। আমাদের কাছে আপনার স্বামী রাশেদের ব্যাপারে প্রমান থাকলেও আপনার দেবরের ব্যাপারে কোনো প্রমান নেই যার প্রেক্ষিতে তাকে আমরা কিডন্যাপ করবো। তাই আপনার সাহায্য আমাদের প্রয়োজন।”

বিথী হালকা হেঁসে বসে পড়লো। ব্যথিত কন্ঠে বললো,
-“আমি তোমাদের সব রকমের সাহায্য করবো। বলো কি করতে হবে?”

রুশান,তনিম বিথীকে সাথে করে নিয়ে পুরো প্ল্যান করে ফেললো। শান্তর জোরাজুরিতে তাকেও প্ল্যানে শামিল করতে হলো। সে কোনো কথাই শুনলো না।
তনিম রুশানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“স্যার, আমাদের প্ল্যান যদি সফল না হয় তাহলে কিন্তু সব শেষ হয়ে যাবে। পুনমের জীবনটাও শেষ হয়ে যাবে। ”

বিথীও তনিমের কথায় সায় জানালো। চিন্তিত গলায় বললো,
-“সত্যিই অনেক বড় সমস্যা হবে যদি রায়হান আমাদের ফাঁদে পা না দেয়। ও কিন্তু গভীর জলের মাছ। খুবই সতর্ক।”

রুশান আনমনে বললো,
-“আমি জানি না কি হবে। সবটাই ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিলাম। চেষ্টা তো করতে হবে। বাকিটা আল্লাহ ভরসা।”

তাদের কথার মধ্যেই রুমঝুম খাবার খাওয়ার জন্য ডাক দিলো। রুশান আর তনিম উঠে গেলো খেতে। বিথী উঠে মেয়ের কাছে গেলো।
রুশান আর তনিমকে খেতে দিয়ে রুমঝুম বললো,
-“আমি পুনমের গায়ে হলুদে যাবো। দাওয়াত যেহেতু আছেও তো মিস করবো কেন?”

রুশান পরোটা চিবুতে চিবুতে আড়চোখে তাকালো রুমঝুমের দিকে। রুমঝুম ঠোঁট চেপে হাসছে। তনিম খেতে খেতে বললো,
-“আমি যাবো আপু। আপনি রেডি হয়ে নিন। একমাত্র শালিকার গায়ে হলুদ মিস করা যায় নাকি?”

রুশান চুপচাপ খাচ্ছে। সে ভালোই বুঝতে পারছে এরা দুজন ওকে রাগাচ্ছে। রুশান একমনে খেয়েই চলেছে। অনেকদিন হলো ঠিক মতো খেতে পারে না সে। আজ মনটা বেশ শান্তি পাচ্ছে। তবে কোথাও ভয় রয়েই যাচ্ছে। যদি প্ল্যান সফল না হয় তাহলে পুনমকে হারিয়ে ফেলবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত সে। যতবার এমনটা ভাবছে ততবারই মেরুদন্ড বেয়ে নেমে যাচ্ছে এক শীতল স্রোত।

শান্ত চুপচাপ বসে আছে। মনে মনে ভেবে ফেলেছে কাল একটা ছুড়ি নিয়ে যাবে লুকিয়ে। তাদের প্ল্যানিং সফল না হলে সবার সামনেই ছুড়ি দিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলবে ওই লোকটাকে। পুলিশে ধরলে ধরুক। তারপর খবরের চ্যানেল, পেপারের হেডলাইনে উঠে আসবে তার ছবি আর নাম। তার জন্য সবাই ফেমাস হয়ে যাবে।
উর্বিন্তাও নিশ্চয়ই দেখবে তাকে। কাল একটু বেশিই স্টাইলিশ হয়ে যেতে হবে। ছবি খারাপ আসলে চলবে না। উর্বিন্তার চোখে তাকেই সবচেয়ে বেশি হ্যান্ডসাম হতে হবে। উর্বিন্তা তাকে টিভিতে দেখে অবশ্যই আবেগাপ্লুত হয়ে ছুটে আসবে পুলিশ স্টেশনে তার সাথে দেখা করতে।

‘পুলিশ স্টেশন’ কথাটা মাথায় আসতেই শান্তর সমস্ত ভাবনা উধাও হয়ে গেলো। মানে সে ফেমাস হওয়ার সাথে সাথে একজন আসামিও হয়ে যাবে সেই ব্যাপারটা তার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো। একজন আসামিকে উর্বিন্তা ভালোবাসবে না আর উর্বিন্তার বাবাও মেনে নিবে না জামাই হিসেবে, তা শান্ত জানে। তাই খুন করার প্ল্যান বাদ দিয়ে অন্য কিছু করার চিন্তায় ডুব দিলো‌ শান্ত।

চলবে……

#চন্দ্ররঙা_প্রেম_২
#পর্বঃ১৭
#আর্শিয়া_সেহের

সকাল থেকেই রুশানের বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছে।‌ প্রেয়সীকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠছে বারবার। হাত-পা ও কেমন যেন অসাড় হয়ে আসছে।
এরই মধ্যে শান্ত হাজির হলো একগাদা জামাকাপড় নিয়ে। কোনটা রেখে কোনটা পড়বে বুঝতে পারছে না সে। সবগুলো কাপড় এনে বিছানায় ছড়িয়ে রাখলো।‌ রুশানকে ডেকে বললো,
-“রুশান ভাই দেখো তো এখানে কোনটা পড়লে আমাকে ভালো মানাবে।”

রুশান নিজের ভাবনা ফেলে বাইরে এলো। ভ্রু কুঁচকে শান্তর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“তোর যেটা ভালো লাগে তুই সেটাই পড়।‌ তোকে সব কাপড়ে ভালো লাগে।”
শান্ত কোমরে হাত রেখে বললো,
-“ওহ রুশান ভাইয়া,তুমি প্লিজ বাঙালি মায়েদের মতো কথা বইলো না। কোনটা পড়বো বলো না প্লিজ।”
রুশান সব কাপড়ে একবার চোখ বুলিয়ে বললো,
-“ওখানে তো উর্বিন্তা আসবে না, তুই কাকে দেখাতে যাবি এতো ফিটফাট হয়ে?”

শান্ত মুখ বাঁকিয়ে বললো,
-“আমি কোনো মেয়েকে দেখাতে যাবো না বুঝছো? বিয়ে বাড়িতে এদিক ওদিক সবদিক দিয়ে ফটোশুট চলে সারাক্ষণ। কোথায় কার ক্যামেরায় বন্দী হয়ে যাবো টেরই পাবো না। সেই ছবি হয়তো তারা স্যোশাল মিডিয়াতে আপলোড করবে। কোনোভাবে সেই ছবি উর্বিন্তা দেখবে হয় তো। এজন্যই এতো পরিপাটি হয়ে যাবো বুঝেছো?”

রুশান একহাতে কপাল চাপড়ালো। এই ছেলের সবখানেই উর্বিন্তা থাকে। ওকে চাঁদে পাঠালে সেখানেও কোনোভাবে উর্বিন্তাকে জড়িয়ে ফেলবে। এই ছেলের মাথায় উদ্ভট চিন্তা ঘোরে সারাক্ষণ।
রুশান সব জামাকাপড়ের মধ্যে থেকে বেছে একটা অ্যাশ কালারের পাঞ্জাবি বের করে আনলো। দু’হাতে পাঞ্জাবিটা ধরে বললো,
-“তোর পুনম আপুর অ্যাশ কালার ভীষণ পছন্দ।”

শান্ত কিছুক্ষণ রুশানের দিকে তাকিয়ে থেকে সমস্ত জামাকাপড় দলা পাকিয়ে কোলে তুলে নিলো।‌ রুশানের হাত থেকে পাঞ্জাবিটা নিয়ে বললো,
-“এই ঘরে বসেই পুনম পুনম করো। আমি বিয়ে সাদি খেয়ে এসে গল্প শুনাবো তোমাকে।হুহ।”
শান্ত হনহন করে বেরিয়ে গেলো। রুশান মুচকি হাসলো শান্তর‌ যাওয়ার দিকে তাকিয়ে। ছেলেটা আসলেই পাগল।

সকাল প্রায় দশটা বেজে গেছে । রুশান ফ্রেশ হয়ে বেডে বসে তনিমের সাথে টুকটাক কথা বলছিলো। বিয়ে বাড়ির অলমোস্ট সব কাজ শেষ করে ফেলেছে তনিম। প্লানমাফিক বাড়ির পেছন দিকটা পুরোপুরি আঁটকে ফেলেছে। এখন রায়হান যাই করতে চায় সবটা বাড়ির সামনে থেকে করতে হবে। তনিম ফিসফিস করে বললো,
-“আমাদের পুরো প্ল্যানটা বিথী আপুর ড্রামার উপর নির্ভর করছে।‌ সে যত নিখুঁত ড্রামা করবে ততই প্ল্যান সাকসেসফুল হবার সম্ভাবনা বাড়বে।”

রুশান অনেকটা দম আটকানো কন্ঠে বললো,
-“আই উইশ সবটা ঠিকঠাক হোক। আমার সব..”
রুশানের কথা শেষ হওয়ার আগেই ফোনে ম্যাসেজ আসার মতো টুংটাং শব্দ হলো।‌ রুশান স্ক্রিনে দেখলো রুমঝুম হোয়াটসঅ্যাপ এ একটা ছবি পাঠিয়েছে। তনিমকে ফোন রাখতে বলে রুশান রুমঝুমের ইনবক্স সীন করলো। রুমঝুম বেশ সুন্দর একটা ডায়মন্ডের রিং এর ছবি পাঠিয়েছে। রুশান ছবিটা দেখার পরপরই রুমঝুম একটা টেক্সট পাঠালো,
-“আংটিটা পছন্দ হয়েছে তোর?”

রুশানের ভ্রু কুঁচকে গেলো। রুমঝুমকে টেক্সট করে লিখলো,
-“এটা তো মেয়েদের আংটি। আমি পছন্দ করে কি করবো।”
রুমঝুম সাথে সাথে হোয়াটসঅ্যাপ এ কল‌ করলো। রুশান রিসিভ করতেই বোনের বজ্রকণ্ঠ শুনতে পেলো,
-“তোকে জিজ্ঞেস করেছি পছন্দ হয়েছে কি না? তুই ওটা কেমন রিপ্লাই দিলি? সোজা উত্তর দিতে পারিস না?”

রুশান রুমঝুমের কথায় খানিকটা ভড়কে গেলো।‌ আমতাআমতা করে বললো,
-“আংটি টা খুব সুন্দর হয়েছে আপু। আমি তো চোখই ফেরাতে পারছি না।”
রুমঝুম ভাব নিয়ে বললো,
-“দেখতে হবে না পছন্দ টা কার? সেই নয়টা থেকে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে এটা পছন্দ হলো।”
রুশান হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারছে না। একটা আংটির জন্য এক ঘন্টা সময় ,বাপ রে।
ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
-“হ্যাঁ আপু, সময় নিয়ে কিনলে ভালো জিনিস পাওয়া যায়।”
-“হুম ঠিক ধরেছিস।‌ তোর দুলাভাই বোঝে না এই ব্যাপারটা।
যাই হোক শোন ,আমি,শান্ত আর বিথী আপু এখান থেকেই বিয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছি‌। তোর দুলাভাই পরে আসবে বলছে। তুই সাবধানে আসিস। আর চিন্তা করবি না একদম। রাখছি এখন।”

রুমঝুম ফোন রাখার পর রুশান নিচে নেমে এলো। সাঁঝ আর ইমতিয়াজ মাহমুদ ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখছে।‌ বিন্দুকে বিথী নিয়ে গেলেও সাঁঝকে নিয়ে যায় নি। কখন পরিস্থিতি কেমন হয়ে যাবে কেউ জানে না। এখানে বাচ্চাদের না নিয়ে যাওয়াই ভালো।

..

পুনমকে সাজিয়ে গুছিয়ে বসিয়ে রেখেছে ঘরে। একদম পুতুলের মতো লাগছে তাকে। পুনমের দৃষ্টি জানালার বাইরে। এই মূহুর্তে তার অনেক নিষিদ্ধ ইচ্ছা জাগছে মনে। পুনম খুব কষ্টে দমিয়ে রাখছে নিজেকে।
রুমঝুম বিথীকে নিয়ে পুনমের রুমে ঢুকলো। কারো আসার শব্দ পেয়ে পুনম মাথা ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালো। রুমঝুমকে দেখে বিষ্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো পুনমের । সে কোনোভাবেই রুমঝুমকে আশা করেনি এখানে। কাঠ পুতুলের মতো বসে থাকা পুনম নড়েচড়ে উঠলো রুমঝুমকে দেখে।

রুমঝুম হেঁসে পুনমের পাশে গিয়ে বসলো। বিথীও বিন্দুকে কোলে নিয়ে খাটের এক কোণে গিয়ে বসলো। শান্ত দাঁত বের করে হাসতে হাসতে ভেতরে এলো। পুনম অবাকের পর অবাক হচ্ছে। এদের এতো খুশি হওয়ার কারন খুঁজে পাচ্ছে না সে।
শান্ত পুনমের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
-“ওয়াহ আপু,কি জোস লাগছে তোমাকে। আমার রুশান ভাই তো ফিদা হয়ে যেতো দেখলে।”
শান্তর কথা কানে পৌঁছাতেই পুনমের বুকের ভেতরটা জ্বালা করে উঠলো। কেঁপে উঠলো পুরো শরীর। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামলো।
রুমঝুম চোখ পাকিয়ে তাকালো শান্তর দিকে। শান্তও বুঝতে পারলো সে ভুল‌ যায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে। সেকেন্ডের মাঝেই প্রায় ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেলো সে।

রুমঝুম পুনমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। মুচকি হেঁসে বললো,
-“তুমি একদম মেঘার মতো পুনম। নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসো সবাইকে। সবাইকে ভালো রাখার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করো। তোমার সাথে খারাপ কিচ্ছু হবে না দেখো। অনেক সুখী হবা তুমি।”
পুনম অশ্রুসিক্ত চোখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। আর কিছুক্ষণ বাকি। তারপর তার ভালো থাকার কারন থেকে পুরোপুরি ছিন্ন হয়ে যাবে সে।

রুমঝুম পুনমকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে গেছে ইতোমধ্যে। ছেলেপক্ষ একটার মধ্যে চলে আসবে এমনটাই শুনেছে রুমঝুম। পুনমকে ছেড়ে বেরিয়ে এলো বাইরে। বিথীও রুমঝুমকে অনুসরণ করে বেরিয়ে এলো। দরজা অবধি এসে আবার পেছনে তাকালো। ফুলের মতো মেয়েটার প্রতি মায়া লাগছে তার। বিথী ভেবে নিয়েছে,যে করে হোক বাঁচাবে পুনমকে।

শান্ত বিন্দুর হাত ধরে পুরো বিয়ে বাড়িতে ঘুরে বেরাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই বরযাত্রী এসেছে। বিথী আড়াল থেকে প্রত্যেকটা মানুষকে দেখেছে। চোখমুখে কাঠিন্য ধরে রেখে রুশানকে কল করে বললো,
-“শিকার দু’জনই এখানে আছে। বিন্দুকে নিয়ে ওদের সামনে ঘোরাফেরা করছে শান্ত। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো।”

প্ল্যানমাফিক বিন্দুর হাত ধরে বরযাত্রীদের সামনে নিয়ে গেলো শান্ত। আঙুলের ইশারায় রায়হানকে দেখিয়ে বিন্দুর কানে কানে বললো,
-“ওই দেখো তোমার চাচ্চু।”
বিন্দু মাথা ঘুরিয়ে তাকালো। রায়হানকে দেখেই চোখেমুখে ভয় ভর করলো বিন্দুর। এতো টুকু বাচ্চা মেয়েও ওদের রুপ সম্পর্কে জানে। শান্ত বিন্দুর কানে কানে আবার বললো,
-“তুমি চাচ্চুর কোলে উঠে কান্না করবা আর বলবা আম্মুর কাছে যাবো। ঠিক আছে?”
বিন্দু কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
-“তাত্তু বালো না। আমাকে মাববে।”
(চাচ্চু ভালো না। আমাকে মারবে।)

শান্ত আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বললো,
-“এই দেখো কত্ত মানুষ এখানে। চাচ্চু মারতে সাহসই পাবে না। আর আমি আছি তো এখানে। তোমাকে অনেক গুলো চকোলেট দিবো, চাচ্চুর কাছে যাও।”
চকোলেটের কথা শুনে বিন্দু হেঁসে উঠলো। সে আগে কখনোই চকোলেট খায়নি। শান্তদের বাড়িতে আসার পর সাঁঝের সাথে থেকে থেকে চকোলেট প্রিয় হয়ে উঠেছে তার। বিন্দু দৌড়ে চলে গেলো রায়হানের কাছে। সাথে সাথেই আড়ালে চলে গেলো শান্ত। তনিম সহ বাকি ছদ্মবেশী পুলিশেরা নজর রাখা শুরু করলো রায়হানের উপর।

-“তাত্তু,তাত্তু আম্মুল কাতে দাবো। নিয়ে তলো আমাকে।”
(চাচ্চু, চাচ্চু আম্মুর কাছে যাবো। নিয়ে চলো আমাকে।)
পরিচিত কন্ঠ শুনে রাশেদ-রায়হান দু’জনই চমকে তাকালো নিচের দিকে। বিন্দু রায়হানের পা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রাশেদের চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। এই মেয়ে এখানে তার মানে বিথীও এখানে। রাশেদ মুখ লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কেউ চিনতে পারলেই সর্বনাশ।

বিন্দু পেছন দিকে তাকিয়ে শান্তকে দেখতে পেলো না। তার আম্মুকেও দেখতে পাচ্ছে না । সাথে সাথেই কেঁদে উঠলো বিন্দু। রায়হান এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখছে, বিথীকে দেখা যায় কি না। কয়েকজন তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে কেউই জানেনা বিন্দু রাশেদের মেয়ে আর বিথী জীবিত আছে। রাশেদের চাচি এগিয়ে এসে রায়হানকে বললো,
-“বাচ্চাটা কে? তোকে চাচ্চু ডাকছে কেন?”

রায়হান ইতিমধ্যে ঘেমে উঠেছে। চাচির দিকে তাকিয়ে মেকি হাঁসি দিয়ে বললো,
-“এটা তো বাচ্চা মেয়ে চাচি। হয়তো মা’কে খুঁজে পাচ্ছে না তাই কাঁদছে। দাঁড়াও আমি দেখছি।”
রায়হান বিন্দুকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। রাশেদের মুখের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,
-“ভাবি এখানেই কোথাও আছে। যাও খুঁজো তাকে। আমাদেরকে দেখার আগেই মুখ বন্ধ করে দাও। কুইক ।”

রাশেদ রায়হানের কাঁধে হাত রেখে কিছু বলতে যাবে তখনই দেখলো সামনে বিথী হন্তদন্ত হয়ে কিছু খুঁজছে। সেকেন্ড ত্রিশের মাথায় বিথীর সাথে রাশেদের চোখাচোখি হয়ে গেলো।‌ বিথী চোখ বড় বড় করে ফেললো। এমন ভাব করলো যেন রাশেদকে এইমাত্রই দেখেছে আর দেখা মাত্রই তার পিলে চমকে উঠেছে। বিথী ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে উল্টো দিকে ছুট লাগালো। রায়হান রাশেদের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“তাড়াতাড়ি যাও আর ওকে ধরো। কোনো গড়বড় যেন না হয়। আমি আমার কাঙ্ক্ষিত নারীকে পেতে এসেছি এখানে। কোনো ঝামেলা যেন না হয়। পুনমকে না পেলে আমি কিন্তু সব শেষ করে দিবো ভাইয়া।”

রাশেদ রায়হানের কোল‌ থেকে ছো মেরে বিন্দুকে নিয়ে নিলো। দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
-“যা তুই গিয়ে ধর ওকে। এদিকটা আমি দেখতেছি। লুকিয়ে যা। আমি সামলে নিবো।”

রায়হান আশেপাশে পরখ করে দ্রুত পায়ে হেঁটে গেলো বিথীকে ধরার উদ্দেশ্যে। উত্তেজনায় সে আশেপাশে তাকে ধরার জন্য ওঁৎ পেতে থাকা লোকগুলোকে খেয়াল করতে পারলো না।
রায়হানকে ছুটতে দেখেই হাঁসি ফুটলো তনিমের মুখে। উল্টোদিকে ফিরে খুশিতে লাফিয়ে উঠে বললো,
-“ইয়েসসস… শিকার ফাঁদে পা দিয়েছে। এবার তোমারে বাঁচাবে কে,চান্দু?”

রায়হান লোকজনের আড়ালে চলে যেতেই পুলিশের লোকেরা ঘিরে ফেললো রাশেদকে। শান্ত কোত্থেকে যেন তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে এলো। রাশেদের কোল থেকে‌ বিন্দুকে নিয়ে নিলো। বিন্দুর হাতে কয়েকটা চকোলেট দিয়ে বললো,
-“ওয়েল ডান পিচ্চি। নে খা , চকোলেট খা। যত পারিস খা। লাগলে দোকান খাইয়ে দিবো তোরে।”

চলবে…….

(রি-চেক দেইনি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে