#চন্দ্ররঙা_প্রেম_২
#পর্বঃ১২
#আর্শিয়া_সেহের
উর্বিন্তা স্কুলের মধ্যে একটা চক্কর মেরে বেরিয়ে এলো। শান্ত ফোন করে বলেছে সাঁঝকে একটু দেখে রাখতে। শানের আসতে এখনো দশ মিনিটের মতো লাগবে। উর্বিন্তা বাইরে এসে সাঁঝ আর সিনিমের কাছে দাঁড়ালো। মাহিম বেলুন উড়াতে উড়াতে খানিকটা দূরে চলে গেছে।
সাঁঝ উর্বিন্তার দিকে মলিন মুখে তাকিয়ে বললো,
-“আমার খুব খিদে পেয়েছে উর্বি আন্টি।”
উর্বিন্তা হেঁসে বললো,
-“দাঁড়া এখানে। আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
উর্বিন্তা পেছনে তাকিয়ে মাহিমকে ডাক দিলো সে খাবে কিনা সেটা জিজ্ঞেস করার জন্য। ঠিক তখনি মাহিমের একদম পাশ ঘেঁষে একটা মাইক্রোবাস দাঁড়িয়ে পড়লো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছোঁ মেরে গাড়িতে তুলে নিলো মাহিমকে। মাহিমের হাতে থাকা গোলাপী রঙের বেলুনটা ফুটপাতে পড়ে গেলো।
চোখের সামনে কি হয়ে গেলো সেটা বুঝতে উর্বিন্তার কিছুক্ষণ সময় লেগে গেলো। হুঁশ ফিরলো দারোয়ানের চিৎকারে। ততক্ষণে মাইক্রোবাস ছেড়ে দিয়েছে। উর্বিন্তা সাঁঝ আর সিনিমকে দারোয়ানের কাছে দিয়ে নিজের গাড়িতে উঠে পড়লো । দারোয়ানকে চিৎকার করে বললো,
-“ওদের দু’জনের থেকে নাম্বার নিয়ে ওদের বাড়িতে ফোন দিন আর্জেন্টলি। আর ওদের খেয়াল রাখুন।”
উর্বিন্তা তার ড্রাইভারকে বললো মাইক্রোবাসটা ফলো করতে। নিজেও শান্তকে কল করলো। ফোনের লোকেশনও অন করে রাখলো উর্বিন্তা।
বিশ বারের মতো কল করেও শান্তর কোনো রেসপন্স পেলো না উর্বিন্তা। হয়তো গোসল করছে বা খাচ্ছে। উত্তেজনায় হাত-পা কাঁপছে তার। মাইক্রোবাসটা তাদের থেকে অনেকটা দূরে। উর্বিন্তা বুঝতে পারছে না কি করবে। ওর কাছে সাহায্য চাওয়ার মতো তার বাবা ছাড়া আর কারো নাম্বার নেই। উর্বিন্তা অনেক ভেবে তার বাবাকে ফোন করলো। ততক্ষণে গাড়ি মেইন রাস্তা ছেড়ে একটা শুনশান রাস্তায় ঢুকে পড়েছে। উর্বিন্তা আশেপাশে তাকিয়ে ঢোক গিললো। ড্রাইভারটাও এখন ভয় পাচ্ছে।
বাবার থেকেও কোনো রেসপন্স পেলোনা উর্বিন্তা। বিপদে পড়লে চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসে । হঠাৎ ড্রাইভার বলে উঠলো,
-“ছোট ম্যাডাম, ওদের গাড়ির গতি কমায় দিছে।”
উর্বিন্তা বড় বড় চোখ করে সামনের দিকে তাকালো। আশেপাশের কয়েকটা ছবি উঠিয়ে শান্তর ইনবক্সে পাঠিয়ে দিলো যেন ও বিপদে পড়লেও ওরা জায়গাটা চিনে কাছাকাছি আসতে পারে।
উর্বিন্তা ফোনের দিকে নজর রাখা অবস্থাতেই কাঁচ ভাঙার আওয়াজ হলো। সাথে সাথেই ব্রেক কষে থেমে গেলো মৃদু গতিতে চলতে থাকা গাড়িটি। ব্যাকসিট থেকে উঁকি মেরে দেখলো চারজন লোক তার গাড়ির দিকেই এগিয়ে আসছে।
উর্বিন্তা মনে মনে দোয়া দুরুদ পড়া শুরু করে দিয়েছে। ফোনটা সাইলেন্ট করে স্কুল ব্যাগে পুরে পিঠে নিয়ে নিলো। ব্যাগের বেল্টটা পেছন থেকে এনে পেটের সাথে লক করে দিলো। তাকে যেখানেই নিয়ে যাক সাথে যেন ব্যাগটা থাকে এটাই মূল উদ্দেশ্য তার।
দুই সাইড দিয়ে দু’জন করে লোক এসে গাড়ির দরজা খুলে উর্বিন্তাকে বের হতে বললো। উর্বিন্তা কাঁপতে কাঁপতে গাড়ি থেকে নামলো। এই বিশালদেহী লোকগুলোর সামনে সে এক ছোট্ট পুঁটি মাছের মতো।
উর্বিন্তা একবার পেছনে তাকালো। ড্রাইভারের হাতে গুলি লেগেছে বোধহয়। রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। সাইলেন্সার লাগানো ছিলো বলে শব্দ পায়নি। এসবে উর্বিন্তা ভয় পায়না। ছোট থেকেই এসব দেখে অভ্যস্ত কিন্তু তাকে এভাবে নিয়ে যাচ্ছে কেন এই লোকগুলো?
উর্বিন্তা করুন স্বরে বললো,
-“আমাকে কেন নিয়ে যাচ্ছেন? আমি কি দোষ করেছি? আমি তো বাড়ি যাচ্ছি।”
একটা লোক গম্ভীর কন্ঠে বললো,
-“এদিকে আর কোনো বাড়ি নেই।”
উর্বিন্তা চোখ তুলে আশেপাশে তাকালো। আসলেই এখানে বাড়িঘর নেই। জঙ্গল আর ফাঁকা মাঠ চারিদিকে।
উর্বিন্তার শরীর শিউরে উঠলো। ভয়ার্ত চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে বারবার।
গাড়ির কাছে আসতেই ভেতর থেকে একজন হেঁসে বললো,
-“শিকার এভাবেই নিজে থেকে জালে আটকে যায়। ওরে তোল গাড়িতে।”
উর্বিন্তা লোকটাকে ঠিকমতো না চিনলেও ওর কেমন জেনো চেনা চেনা লাগলো। গাড়ির মধ্যেই অচেতন হয়ে পড়ে আছে মাহিম। মাহিমের কাছে বসা লোকটা সামনের লোকটির দিকে তাকিয়ে বললো,
-“বাচ্চাটার পালস রেট কমে গেছে অনেক। ক্লোরোফর্ম বেশি স্প্রে করা হয়ে গেছে মনে হয়।”
লোকটা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,
-“মাছ ধরার টোপটা কি জীবিত থাকে? ওগুলো মরাই হয় বা মরে যায়। এই ছেলেও টোপ ছিলো। বাঁচলে বাঁচুক,মরলে মরুক।”
উর্বিন্তা হাওয়ার বেগে গাড়িতে উঠে মাহিমের পাশে বসলো। মাহিমকে তুলে তার কোলে নিলো। হাতের পালস খুবই কম। উর্বিন্তা কেঁদে উঠলো এবার। আল্লাহ ছাড়া এই বিপদ থেকে কেউ উদ্ধার করতে পারবে না তাদের।
..
রুশান আর জিহাদ সেই পুরোনো বাড়িটাতে ভালোভাবে তল্লাশি চালিয়েও কিছু পায়নি। বাড়িটা দেখে মনে হচ্ছে বহুদিন যাবৎ এখানে কারো আসাযাওয়া নেই। ধুলোবালিতে ডুবে আছে প্রতিটা রুম।
রুশানের ধারনা জিহাদের সেদিনের ব্যাপারটার পর থেকেই এই জায়গা ছেড়ে দিছে ওরা। পাছে জিহাদ কাউকে কিছু বলে দেয়। রুশান অনেক চেষ্টা করেও এখানে কোনো ধরনের সহিংসতার চিহ্ন পায়নি। ওরা জায়গাটা পুরোপুরি পরিষ্কার করে রেখে গেছে।
হতাশ হয়ে রুশান আর জিহাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। গেট পেরোতেই রুশানের ফোনে রাফিনের কল এলো। রিসিভ করতেই রাফিন উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো,
-“ডিআইজি স্যার ফোন করেছিলো। উনার মেয়ে অপহরণ হয়েছে।”
রুশান চেঁচিয়ে বললো,
-“হোয়াট? উদয় স্যারের মেয়ে মানে উর্বিন্তা ? কখন, কিভাবে?”
-“জানি না আমি। শুধু স্যারের কাছে ফোন এসেছে যেন তুমি এই মিশন থামিয়ে দাও। নাহলে উনার মেয়েকে দু’খন্ড করে ফেলবে।”
রুশানের হঠাৎ করে শান্তর কথা মাথায় এলো। রুশান তড়িঘড়ি করে বললো,
-“স্যার আপনি ভাববেন না। আমি দেখছি। আই উইল হ্যান্ডেল ইট।”
-“ডিআইজি স্যারের মেয়ের ব্যাপার। একটু সাবধানে করো যা করবা।”
-“ওকে স্যার।”
রুশান কল কেটে শান্তর নাম্বারে কল করলো। শান্ত ফোন হাতে নিয়েই বসে ছিলো। উর্বিন্তার পাঠানো মেসেজ আর ছবি দেখে সে হ্যাং হয়ে গেছে। রুশান কল করার সাথে সাথেই শান্ত রিসিভ করে কেঁদে উঠলো। কেঁদে কেঁদে বললো,
-“রুশান ভাইয়া, উর্বিন্তা আমাকে অনেক মেসেজ দিয়েছে। অনেক ছবি দিয়েছে। ওকে অনেকবার কল করেছি আমি। ফোন বাজছে কিন্তু ও রিসিভ করছে না। ওই লোকগুলো মাহিমকে নিয়ে গেছে। ওদের পিছু পিছু উর্বি গিয়েছিলো। তারপর ,তারপর আর উর্বিকে পাচ্ছি না ভাইয়া।”
‘মাহিমকে নিয়ে গেছে’ কথাটা রুশানের কানে ধাক্কা খেলো। ওরা পাঁচ বছরের উপরে কোনো বাচ্চাকে তুলে নেয় না। মাহিমের সেখানে ছয়ের কাছাকাছি। আবার মাহিমকে এমনভাবে নিয়েছে যেন সেটা উর্বিন্তার চোখে পড়ে। তার মানে ওদের টার্গেট উর্বিন্তা ছিলো যাকে পাওয়ার জন্য মাহিমকে ব্যবহার করেছে। মাহিমকে ওদের কোনো প্রয়োজন নেই। তাহলে ওকে বাঁচিয়ে রাখার বা ওদের কাছে রাখার পসিবিলিটি কতটুকু?
রুশান কেঁপে উঠলো। মাহিম ছেলেটা সবার আদরের। ছোট থেকেই দেখে আসছে ওকে রুশান। এই ছেলের কিছু হলে ওদের পরিবারটা শেষ হয়ে যাবে।
রুশান জিহাদকে বাড়ি যেতে বলে নিজেও শানদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। মাথায় একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘ডিআইজি স্যার এই কেসের জন্য তাকে সাহায্য করেছে এটা কিভাবে জানাজানি হলো? কে জানালো এই কথা?’
-“আমার ভাই ব্রেভ। খুব সাহসী ও। সবাইকে ঢিসুম ঢিসুম করে মেরে ঠিক চলে আসবে দেখিস,সাঁঝ। আমাকে যেভাবে মারে ওদেরও মারবে।”
মেইন দরজা দিয়ে ঢুকতেই সিনিমের কথাগুলো কানে এলো রুশানের। সোফায় সিনিম,সাঁঝ আর তাহমিদ বসে আছে। সিনিমের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে আছে। তার বিশ্বাস তার ভাই খারাপ লোকদেরকে মেরে চলে আসবে। রুশানের বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। সাঁঝ একবার রুশানের দিকে তাকালো। দৌড়ে এসে রুশানের হাত ধরে শুকনো মুখে বললো,
-“মাহিম ভাইয়াকে এনে দাও না, মামা। উর্বিন্তা আন্টিও গেছে মাহিম ভাইয়াকে আনতে। তুমিও যাও মামা। ওদের সাথে উর্বিন্তা আন্টি একা পারবে নাকি বলো?”
রুশান হাঁটু গেড়ে সাঁঝের সামনে বসলো। মাথা নিচু করে বললো,
-“আমাকে দোয়া কর মা,আমি যেন মাহিম আর উর্বিন্তাকে নিয়ে আসতে পারি।”
সাঁঝ হেঁসে বললো,
-“পারবে পারবে। তুমি আমার সাহসী মামা না?”
রুশান ঝিম মেরে বসে রইলো। হুট করেই কানে এলো সিন্থিয়ার চিৎকার । রুশান উঠে সেদিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই উপর থেকে শান্ত নেমে এলো। রুশানের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
-“সিন্থিয়া আপু মাহিম হারানোর খবর শোনার পর থেকেই ওভাবে কাঁদছে। ভাইয়া, রাফিন ভাইয়া আর মেহেদী ভাইয়া পুলিশের কাছে গেছে। তুমি আমার সাথে এসো।”
শান্ত রুশানকে টেনে নিয়ে গেস্ট রুমে ঢুকলো। তারপর ফোন বের করে উর্বিন্তার ইনবক্স দেখালো। রুশান মনোযোগ সহকারে সব টেক্সট দেখলো। তারপর মুচকি হেঁসে বললো,
-“বাপ কা বেটি। মেয়েটা সাহসী বটে।”
রুশান উর্বিন্তার সব টেক্সট আর মেসেজ নিজের ফোনে ফরোয়ার্ড করে নিলো। তনিমকে কল করতে গিয়েও থেমে গেলো। ছেলেটার নতুন বিয়ে হয়েছে। ওকে নাহয় এই ডেঞ্জারাস মিশন থেকে দূরেই রাখা হোক।
রুশান ধীর পায়ে হেঁটে রুমঝুমের রুমের সামনে দাঁড়ালো। সিন্থিয়া রুমঝুমের বুকে হেলে পড়ে আছে। একটু সময়ের মধ্যেই কি অবস্থা হয়ে গেছে। মেহেদী ভাইয়ার আকাশপরীটা এখন তার সামনে বিদ্ধস্ত হয়ে পড়ে আছে। সন্তানের কিছু হয়ে যাবে এই ভয়ে ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে সে।
রুশান সরে এলো। সে মনে মনে ছক কষে ফেলেছে। রাফিন আর শানকে কল করে সবকিছু বলে দিলো। রাফিনকে উর্বিন্তার নাম্বার সেন্ড করে লোকেশন জানতে বললো। উর্বিন্তা শান্তকে টেক্সটে স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে সে ফোনে লোকেশন অন করে রেখেছে।
রুশান ডিআইজি স্যারের সাথেও কিছু কথা বললো। তার একটা কথায় রুশান ভীষণ মুগ্ধ হলো। তিনি নিজের মেয়ের জীবনের চেয়েও ওই কুচক্রী দলের বিনাশটাকেই বড় করে দেখছেন।
রুশান ফোন রেখে বের হয়ে এলো বাড়ি থেকে। পেছনে রয়ে গেলো শান্ত। এখন মনে হচ্ছে আজ উর্বিন্তার সাথে না গিয়ে সে জীবনের অনেক বড় একটা ভুল করেছে। শান্তর মন আজ অশান্ত হয়ে উঠেছে। ভালোবাসার মানুষটিকে না দেখা অবধি মনের এই অশান্তি হয়তো কমবে না।
চলবে……
#চন্দ্ররঙা_প্রেম_২
#পর্বঃ১৩
#আর্শিয়া_সেহের
রুশান বাড়ি থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরই তনিম কল করলো। রুশান বাইক স্টার্ট দিয়েছে মাত্র। তনিমের কল পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো রুশান। এই সময়ে তনিম কেন কল করেছে?
রুশান কল রিসিভ করতেই তনিম বললো,
-“হ্যালো স্যার, আপনি কোথায় আছেন ?”
তনিমের প্রশ্নে রুশানের কপালে ভাঁজ পড়লো। তীক্ষ্ণ কন্ঠে জবাব দিলো,
-“এইতো একটু বাইরে আছি। কেন?”
-“স্যার আপনার সাথে আমার প্রয়োজনীয় কথা আছে। একটু দেখা করবেন প্লিজ?”
-“এখন সম্ভব না তনিম। আমি দরকারি কাজে যাচ্ছি। পরে কথা বলবো।”
তনিম তড়িঘড়ি করে বললো,
-“স্যার আমার কথাটাও দরকারি, ভীষণ দরকারি। এটা আগেই বলা উচিৎ ছিলো কিন্তু আমার মনে ছিলো না বিয়ের টেনশনে।এখন না বললে হয়তো ঝামেলা হয়ে যেতে পারে।”
রুশান তাড়া দিয়ে বললো,
-“অলরেডি একটা ঝামেলায় আছি আমি। আর কোনো ঝামেলার কথা বলো না এখন। আমি পরে কথা বলবো। এখন রাখছি।”
তনিমের আর কোনো কথা না শুনেই কল কেটে দিলো রুশান। তনিমের এতো কি দরকারি কথা আছে তা সে ভেবে পেলো না। আপাতত ভাবতে চাইছেও না। এখন উর্বিন্তা আর মাহিমকে বাঁচাতে হবে আর সেদিকেই ফোকাস তার।
…
রুশান উর্বিন্তার গাড়ির কাছে চলে এসেছে। গাড়ির পেছনে বাইক দাঁড় করিয়ে সামনে এলো। পুলিশের গাড়িও পেছনে আছে। রুশান গাড়ির সামনে এসে দেখলো ড্রাইভার ড্রাইভিং সিটে হেলে আছে। হাত দিয়ে এখনো রক্ত পড়ছে। রুশান লোকটার হাতের পালস চেক করলো। এখনো বেঁচে আছে। দু’জন পুলিশকে সেখানে রেখে হসপিটালে কল করলো রুশান। ইমার্জেন্সি দু’টো অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে বলে আবার বাইকে বসলো।
শান,রাফিন আর মেহেদীও রুশানের সাথে এসেছে। তারা পুলিশের গাড়ির মধ্যে আছে।
উর্বিন্তার ফোনের লোকেশন এখান থেকেও প্রায় মাইল দুয়েক দূরে দেখাচ্ছে। রুশান এগিয়ে চলছে। পেছনে বাকিরা আসছে। লোকেশনের কাছাকাছি আসতেই রুশান বুঝলো জায়গাটা লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন। এখানে মানুষের পদচারণা নেই বললেই চলে। বেশ নিরাপদ জায়গা বেছে নিয়েছে নিজেদের কাজের জন্য এরা।
দূর থেকেই রুশানের চোখে পড়লো কয়েকটা মাইক্রোবাস। রুশান গাড়ি থামিয়ে দিলো। উর্বিন্তা টেক্সটে মাইক্রোবাসের নাম্বারও পাঠিয়েছিলো। সেই টেক্সটা বের করলো রুশান। সবাইকে ঘাড়ি থেকে নামতে বলে ধীর পায়ে সামনের দিকে এগোতে শুরু করলো। কিছুটা সামনে যাওয়ার পর পরই রুশানের কানে দুইজন লোকের চিৎকার এলো। তারা দু’জন রুশান এবং বাকিদের দেখে চিৎকার করেই সামনের বিধ্বস্ত একটা বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লো। তাদের পিছু পিছু রুশানও দৌড় দিলো সেদিকে। রুশানকে ফলো করে বাকিরাও দৌড় লাগালো।
লোক দু’টো বাড়ির মধ্যে ঢুকেই চিৎকার করে বললো,
-“পুলিশ এসে পড়েছে,পালান।”
বলেই বাড়ির পেছনের দিকে দৌড় দিলো।
দলের নেতা উঠে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। রুশানকে দৌড়ে আসতে দেখে একটা বাজে গালি দিয়ে বললো,
-“এখানে পৌঁছালো কিভাবে এটা? আমাদের সব প্ল্যান বানচাল করে দিলো।”
রাগে হাত মুঠো করে ফেললো লোকটি। উর্বিন্তা হাত-পা মুখ বাধা অবস্থায় বসে বসে হাসছে। লোকটি দ্রুত গতিতে প্রস্থান করলো জায়গা থেকে ।
হঠাৎ করে এমন হওয়ায় পুলিশেরা পজিশন নেওয়ারও সময় পেলো না। তার আগেই দলের সবাই যে যেখান থেকে পারলো বেরিয়ে গেলো।
রুশান ভেতরে ঢুকে দেখলো তারা পেছনের দিকের একটা ভাঙা দেয়াল টপকে বেরিয়ে গেছে। বিশাল বড় ঘরটার মেঝের এক পাশে মাহিম পড়ে আছে। মাহিমের ডান পাশে একটা চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় বসে আছে উর্বিন্তা। রুশান পুলিশ ফোর্স কে ওই লোকগুলোর পেছনে পাঠালো। রাফিনও গেলো তাদের পেছনে। মেহেদী ঘরে ঢুকেই দৌড়ে গেলো মাহিমের কাছে। ফ্লোর থেকে নিজের কোলে তুলে নিলো ছেলেকে। জড়িয়ে নিলো বুকের সাথে। শান মেহেদীকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। মাহিমের পালস একদম ধীরে চলছে। বোঝার উপায় নেই বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে। শান মেহেদীকে অভয় দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিলো। বাড়িতে ফোন করে রুমঝুমকে বলে দিলো হসপিটালে আসার কথা।
রুশান উর্বিন্তার বাঁধা হাত-পা খুলে দিলো। মুখের বাঁধন ও খুলে দিলো। সাথে সাথেই উর্বিন্তা ফোঁস করে দম ফেললো। মাহিমকে হসপিটালে নেওয়া হয়েছে দেখে তার দুশ্চিন্তা দূর হলো। রুশানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আপনার সহকারী কে ভাইয়া?”
রুশান ভ্রু কুঁচকে উর্বিন্তার দিকে তাকালো। এতক্ষণ সে আশপাশ দেখতে ব্যাস্ত ছিলো। উর্বিন্তার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“কেন? আমার সহকারীর কথা জেনে কি করবা?”
উর্বিন্তা একটু সময় চোখ বন্ধ করে থেকে বললো,
-“তার নাম কি তনিম?”
-“হ্যাঁ তনিম।”
উর্বিন্তা বিনা ভনিতায় বললো,
-“আপনাকে এই কেসে আমার বাবা সাহায্য করছে সেটা তনিম নামের লোকটাই এদেরকে বলেছে।”
রুশান অবিশ্বাস্য চোখে উর্বিন্তার দিকে তাকালো। উর্বিন্তা রুশানের চোখের চাহনি দেখেই বুঝতে পারলো সে তার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। হয়তো খুব বিশ্বস্ত কেউ।
-“তুমি কিভাবে জেনেছো যে তনিম ওদেরকে বলেছে এটা?”
উর্বিন্তা হাত দিয়ে কাপড় ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,
-“ওরাই বলেছে এখানে বসে। আপনার সহকারী তনিম ওদেরকে এই কথা বলেছে।”
রুশান কোনো ভাবেই বিশ্বাস করতে পারছে না তনিম এই কাজ করেছে। আবার তনিমের ফোন করে দরকারি কথা বলা নিয়েও রুশান এখন ভাবছে। যাই হোক সেটা পরে দেখা যাবে। আপাতত এখানকার অবস্থা দেখতে হবে।
রুশান উর্বিন্তার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“তুমি ঠিক আছো? কোনো সমস্যা হয়নি তো ?”
উর্বিন্তা হেঁসে বললো,
-“না ভাইয়া,কোনো সমস্যা হয়নি।”
রুশান সামনে এগোতে এগোতে বললো,
-“তুমি খুব বুদ্ধিমতি উর্বিন্তা। ঠিক তোমার..”
-“ঠিক আমার বাবার মতো।”
রুশানের কথা কেড়ে নিয়ে উর্বিন্তাই জবাব দিলো।”
রুশান হেঁসে আশেপাশে দেখতে লাগলো। ওরা যেহেতু আগে থেকে প্রস্তুত ছিলো না সেহেতু অনেক কিছু পাওয়া যেতে পারে এখানে। রুশান একটু এগিয়ে গিয়ে দু’টো রুম দেখতে পেলো। উর্বিন্তার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“এই দু’টো রুম কিসের জানো?”
উর্বিন্তা মাথা নাড়িয়ে বললো,
-“নাহ।”
রুশান দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। গরু কাটার জন্য যেসব অস্ত্র ব্যবহার করা হয় সেগুলো সহ নানা রকম অস্ত্র সাজানো এখানে।
রুশান চারপাশ ভালো করে দেখে বেরিয়ে এলো। পাশের রুমটা খুলেই কেশে উঠলো। নাকে বিশ্রী গন্ধ এলো। উর্বিন্তা বেশ দূরে থাকা সত্ত্বেও তার নাকে পৌঁছে গেলো গন্ধ। উর্বিন্তা এগিয়ে আসতে চাইলে রুশান হাতের ইশারায় বারন করলো ওকে আসতে। খুব কষ্টে মুখ খুলে বললো,
-“দুলাভাইকে পাঠাও।”
উর্বিন্তা এদিক ওদিক তাকিয়ে শানকে খুঁজতে লাগলো।
পকেট থেকে রুমাল বের করে রুশান নাক ঢেকে নিলো। এক পা এক পা করে ভেতরে গেলো। পুরো রুমটা অন্ধকার। দরজা খোলা থাকায় মৃদু আলো আসছে ভেতরে। সেই আলোতে জানালা দেখা যাচ্ছে । রুশান এগিয়ে গিয়ে জানালা খুলে দিলো। পেছনের জঙ্গলটা খুব ভালো ভাবে দেখা যাচ্ছে। হাড় কাঁপানো শীতল বাতাস আসছে।
রুশান ঘুরে তাকালো রুমের মধ্যে। পেছনে ফিরেই আঁতকে উঠলো সে। দরজার পেছনে চার পাঁচটা বাচ্চার লাশ ফেলে রেখেছে। লাশগুলো একদম অক্ষত। হয়তো গতকাল বা গতপরশু রেখেছে। এই লাশ থেকে এই গন্ধ আসছে না। রুশান গন্ধের উৎস খোঁজা শুরু করলো।
মিনিট দুয়েকের ব্যবধানে শান এলো । উর্বিন্তা ভেতরে এলো না। সে আশপাশ দেখতে ব্যাস্ত। শান ভেতরে এসে হঠাৎ চোখের সামনে চার পাঁচটা বাচ্চার লাশ দেখে মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো। অসহায় আর করুন দৃষ্টিতে তাকালো রুশানের দিকে। রুশানের চোখে ইতিমধ্যে পানি জমে গেছে। কোনো সুস্থ মানুষ হয়তো চোখের সামনে বাচ্চাদের লাশ দেখে স্বাভাবিক থাকতে পারে না। শান ধরা গলায় বললো,
-“এদের শরীরে কোনো দাগ নেই, আঁচড় নেই,আঘাত নেই। এরা কিভাবে মারা গেলো?”
-“হয়তো ক্লোরোফর্মের পরিমান বেশি হয়েছিলো বা ভয় পেয়েছিলো অথবা উল্টাপাল্টা ভাবে আঘাত লেগেছে কোথাও।”
শান বাচ্চাগুলোর দিকে এগিয়ে গেলো। বাচ্চাগুলোকে যেখানে ফেলে রাখা হয়েছে সেখানকার ফ্লোরে গোলাকার একটা ম্যানহোলের ঢাকনা টাইপ দেখা যাচ্ছে। শান সেটা দেখে রুশানকে ডাক দিলো। রুশান এগিয়ে গেলো সেদিকে। একটা বাচ্চাকে ডিঙিয়ে ঢাকনাটার সামনে দাঁড়ালো। ঢাকনা তুলতেই বিশ্রী রকমের গন্ধ বের হলো যেটা আগের চেয়েও জঘন্য। রুশানের নাক জ্বলে উঠলো। দেহের ভেতর থেকে সব বেরিয়ে আসতে চাইছে যেন। রুশান ঢাকনা তুলেই সরে গেলো। ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কি আছে তা বোঝা যাচ্ছে না। শান ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে এগিয়ে এলো। ছোট্ট একটা গর্তের মতো জায়গা। অসংখ্য হাড়গোড়,পচাগলা আর অর্ধগলিত লাশ সেখানে। বড় ছোট সব আছে। রুশান নাক চেপে এগিয়ে এলো। যেসব বাচ্চা মারা যায় তাদেরকে এখানেই ফেলে রাখে এখানে।
বেশিক্ষণ সেই গভীরে তাকিয়ে থাকতে পারলো না ওরা দু’জন। সাহসী রুশানেরও হাত-পা কাঁপছে এটা দেখে। কতটা নির্দয়, নির্মম এরা। বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোকেও ছাড় দেয়না। কষ্ট হয় না এদের? মোটেই হয় না? -রুশান নিজেকে প্রশ্ন করলো কিন্তু জবাব পেলোনা।
বিরবির করে বললো,
-“এসবের জন্য ভয়ংকর শাস্তি পেতে হবে ওদের,খুব ভয়ংকর। মৃত্যুযন্ত্রণা কি তা এবার টের পাবে ওরা।”
-“রুশান ভাইয়াআআ…..”
উর্বিন্তার চিৎকার কানে পৌঁছাতেই রুশান ঝট করে দাঁড়িয়ে পড়লো। শানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“বাইরে আসুন দুলাভাই।”
বলেই বেরিয়ে গেলো। শান নড়াচড়ার শক্তি হরিয়ে ফেলেছে। বারবার এই বাচ্চাগুলোর মধ্যে সাঁঝের চেহারা ভেসে উঠছে। দম আটকে আসছে শানের। মানুষ এমনও হয়? নিরপরাধ বাচ্চাদের উপর নিজেদের মৃত্যুক্ষুধা কিভাবে চাপায় ওরা?
-“চেঁচালে কেন উর্বিন্তা? কি হয়েছে?”
উর্বিন্তা ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে সামনের রুমটায়। একটু আগেই এই রুমের দরজার নিচ থেকে কারো আঙুল দেখেছে ও। রুশানকে কাঁপা কন্ঠে এগুলো বললো উর্বিন্তা। রুশান ভ্রু কুঁচকে তাকালো দরজাটার দিকে। তালা দেওয়া রুম। এখানে কেউ কিভাবে থাকবে?
তারপরও উর্বিন্তার কথাটা ফেলে দিতো পারলোনা রুশান। পাশ থেকে একটা লোহার হাতল এনে তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়লো।সাথে সাথেই একটা ছায়ামূর্তি দৌড়ে খাটের কোনায় গিয়ে বসে পড়লো।
রুশান প্রথমে ভয় পেলেও নিজেকে সামলে নিলো। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো মানুষটির দিকে। পিছনে উর্বিন্তা আর শানও আসছে। রুশান কিছুটা এগিয়ে এসে বুঝলো এটি একটি মেয়ে। চুলগুলো জট পাকিয়ে আছে। বহুদিন যত্ন করা হয়নি। গায়ের কাপড়টাও নোংরা। মেয়েটি যে এখানে অযত্ন, অবহেলা আর নির্যাতনের মধ্যে দিন অতিবাহিত করেছে তা ভালোই বোঝা যাচ্ছে।
মেয়েটির বুকের মধ্যে বোধহয় একটা বাচ্চাও আছে যার পা মেয়েটার পায়ের কাছে দেখা যাচ্ছে। রুশান আরো কাছে এগিয়ে গেলো। মেয়েটি ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে একদম। শান আর উর্বিন্তাও রুশানের পাশে এসে দাঁড়ালো।
রুশান একটু নিচু হয়ে বললো,
-“এই যে শুনছেন? এদিকে একটু তাকান। কে আপনি আমাদের বলুন।”
মেয়েটা নড়াচড়া করছে না। রুশান এবার মেয়েটার পাশে বসে পড়লো। নরম কন্ঠে বললো,
-“আমরা আপনার কোনো ক্ষতি করবো না। তাকান আমাদের দিকে।”
মেয়েটার তবুও কোনো হেলদোল নেই। শান উর্বিন্তার দিকে তাকিয়ে ইশারায় বললো,
-“তুমি চেষ্টা করো একবার।”
উর্বিন্তা আস্তে আস্তে মেয়েটার কাছে এগিয়ে গেলো। মেয়েটার কাঁধে হাত রেখে বললো,
-“আপু ,আমরা আপনাকে সাহায্য করতে চাই। আমাদের সাথে কথা বলুন প্লিজ। আমরা আপনার ক্ষতি করবো না।”
এবার মেয়েটা নড়ে উঠলো। ধীর গতিতে মাথা ঘুরিয়ে ওদের তিনজনের দিকে তাকালো।
মেয়েটার মুখ দেখেই শান ছিটকে দু-তিন পা পেছনে চলে গেলো। চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকম বড় হয়ে গেলো শানের। কাঁপা গলায় বললো,
-“বিথী ,তুই?”
চলবে……..
(রি-চেক দেইনি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)