#চন্দ্রমলিন_সন্ধ্যায় (শেষ পর্ব)
#কারিমা_দিলশাদ
তাকে প্রথম দেখলাম বাসর রাতে। বেশি রাত হয়ে যাওয়ায় তাকে সে রাতটা আমাদের বাড়িতেই রাখা হলো। আকস্মিক বিয়ে শুধু মনের উপর দিয়ে না, শরীরের উপর দিয়েও ধকল গেছে। শরীরের ধকল বেশি না মনের ধকল বেশি বলতে পারবো না। কিছুই বলতে পারবো না। আমার ইন্দ্রিয়গুলো যেনো অচল হয়ে গেছে। ধকল সইতে না পেরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। যখন ঘুম ভাঙলো ডিমলাইটের আলোয়, মুখের সামনে অচেনা এক পুরুষের মুখ দেখে আমার দেহ থেকে আত্মা বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। ভয়ে চোখ নিশ্চয়ই তার নির্দিষ্ট সাইজের থেকেও বড়ো আকার ধারণ করেছে। চিৎকার দেওয়ার কথা মাথায় আসে নি।
আমার এমন বিহ্বল প্রতিক্রিয়া দেখেই বোধহয় মানুষটা তার স্টকে থাকা সবচেয়ে সুন্দর হাসিটা দিলো। পুরুষ মানুষের হাসি এতো আকর্ষণীয় হয় আমার জানা ছিলো না। আমার সাথে কি হচ্ছে জানা নেই। আমি বিমোহিত হয়ে সেই হাসি দেখলাম। এই লোক তো প্রলয়ঙ্কর! এই হাসি দিয়েই সে শত শত রমণীর হৃদয় নির্মমভাবে হত্যা করতে পারে। কিন্তু আমাকে পারলো না। কারণ আমার হৃদয়কে আগেই কেউ বিভৎসভাবে হত্যা করে ফেলেছে। তবুও কিছু একটা আমাকে চুম্বকের মতো টানলো।
-ভয় পেলে?
পাবো না! মাঝরাতে মুখের সামনে অচেনা একটা পুরুষকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখলে ভয় পাবো না? গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোলো না। আকস্মিক শকটা কাটিয়ে উঠতে পারি নি তখনও। এরমধ্যেই আমার সমস্ত ইন্দ্রিয়কে সচল করে দিলো সেই সুবাস। সারা তনু মন ছেঁয়ে গেলো সুবাসে। লোকটা কি মাখে গায়ে!
-এতো সুন্দর করে ঘুমাচ্ছিলে যে চোখ ফেরাতে পারি নি।
পারবেন কিভাবে লজ্জা আছে আপনার? নেই তো। লজ্জা থাকলে মেয়ে দেখতে এসেই নিশ্চয়ই বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে যেতেন না৷
-ভীষণ ঘুমকাতুরে তুমি! নামের মান রক্ষা করেছো। বরের অপেক্ষা না করেই ঘুমিয়ে পড়লে। বর পছন্দ হয় নি?
– অবশ্য…তুমি তো আমায় দেখোই নি। এতো এতো বাঁধা পেরিয়ে তোমার সামনে এলাম। নিজেকে দেখার সুযোগ করে দিলাম। আর তুমি একটু মাথা উঁচু করে দেখলেও না। এতো অবজ্ঞা! জানো কতো মেয়ে আমার পিছন পিছন ঘুরে?
ঘুরবে না। চেহারা ছবি তো মাশাল্লাহ। মেয়েরা পিছু পিছু তো ঘুরবেই। এতো পিছু পিছু ঘুরা মেয়ে থাকতে আমাকেই লোকটার চোখে পড়লো! আমি তো তাকে কিছুই দিতে পারবো না। নারীর প্রথম ভালোবাসা নাকি তার আত্মার প্রথম স্পর্শ। আর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সেই আত্মার। আমি যে আমার আত্মার প্রথম স্পর্শ তাকে দিতে পারবো না। অপাত্রে দান করে সেই আত্মা নষ্ট করে ফেলেছি যে।
আমার ভাবনার মাঝেই সে লাইট জ্বালিয়ে দুপা ভাজ করে আমার ঠিক সামনে বসে পড়ে। সাথে সেই প্রলয়ঙ্কারী হাসি৷
-যাক বিয়ের আগে যখন বর দেখোনি। এখন দেখো।
দেখতো বরটা চলনসই নাকি। চলনসই না হলেও এখন কিছু করার নেই। তোমাকে একবার সুযোগ দেওয়া হয়েছিলো। তুমি সেই সুযোগ হাতছাড়া করেছো। এখন আর সুযোগ নেই। আমাকেই আজীবনের জন্য বয়ে বেড়াতে হবে। আমার আবার দয়ার শরীর৷ তাই তোমাকে একটা সাজেশন দেই। এই বোঝাটা অন্তর দিয়ে টেনো। আই প্রমিস লোকসান হবে না।
সেই শুরু। নাহ লোকসান হয় নি। বলা যায় আমি জীবনে জিতে গেছি। খুব জেতা জিতেছি। মানুষটা আমায় আমূল বদলে দিয়েছে। এতো যত্ন, আগলে রাখায় আমি বিগড়ে গেছি। কতো যে বাজে অভ্যাস গড়িয়েছে আমার। এই যেমন গোছালো আমিটা এখন অগোছালো হয়ে গেছি। কোনো কাজ এখন গুছিয়ে করতে পারি না। আসলে করতেই চাই না। মানুষটা এতো গোছানো; আমার থেকেও গোছানো। তার কোনোকিছু আমার গুছিয়ে দিতে হয় না। উল্টো আমাকেই সে গুছিয়ে দেয়। আমিও জেনেবুঝে অগোছালো থাকি৷ সে খুব যত্নে আমায় গুছিয়ে নেয়। তার এই যত্নে মাখা ভালোবাসাটার জন্য আমি সারাজীবন অগোছালো থাকতে রাজি। ভাবা যায় একটা সময় আমি অগোছালো কারো জন্য মরিয়া ছিলাম। এখন মনে হয় কি জানেন? কাউকে যত্নে ভালোবাসার থেকে, কারো যত্নের ভালোবাসা নিতেই বেশি ভালো লাগা কাজ করে।
লোকটার উপর আমি পুরোপুরি নির্ভর হয়ে গেছি জানেন। তাকে ছাড়া কিচ্ছু করতে পারি না। দরকারই বা কি বলুন? যার নিজস্ব একজন পারফেকশনিস্ট আছে তার অন্যকিছুর দরকার নেই। লোকে বলে-কারো উপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত নয়, এতে করে তোমার অস্তিত্ব হারিয়ে যাবে। সে লোকে যা বলার বলুক। লোকে তো কতকিছুই বলে। এই মানুষটা আমার অস্তিত্বকে হারিয়ে যেতে দেয় নি। উল্টো যখন আমি আমার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছিলাম; তখন আমার সেই হারানো অস্তিত্বকে ফিরিয়ে দিয়েছে। আমি জীবনে এমন একটা মানুষকে পেয়েছি যার উপর চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়। যার উপর দুনিয়ার সব ঝামেলা চাপিয়ে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারি। যতো খারাপ পরিস্থিতিই আসুক; আমি জানি মানুষটা আমার উপর সেসবের কোনো আঁচ লাগতে দিবে না। এমন মানুষকে মনে জায়গা না দিয়ে উপায় আছে বলুন?
আমি নিজেকে পুরোটাই তার কাছে সঁপে দিয়েছি। আমি এখন নিশ্চিন্ত। আমার কতো কতো ইচ্ছে ছিলো। সব ইচ্ছের দায় এখন তার। এই যেমন হুট করে কোনো বৃষ্টিমুখোর দিনে ফিরতি পথে ফোন দিয়ে বলবে- তন্দ্রা আমি বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছি৷ তুমি একটা শাড়ি পরে জলদি নিচে আসো। আমি অপেক্ষা করছি তোমার জন্য।
আমি পড়িমরি করে গায়ে শাড়ি জড়িয়ে তার ডাকে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি এক শুদ্ধতম সুদর্শন পুরুষ একরাশ শুদ্ধতা নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তারপর আরকি। ঝুম বৃষ্টিতে পিচঢালা রাস্তায় তার হাত ধরে পথ পারি দেওয়া।
আমার সব মন খারাপের দিনে আমার পাশে থাকা। যতক্ষণ না আমার মন ভলো হবে আমার কাছ থেকে সরবে না। মন ভালো করতে একটার পর একটা, কিছু না কিছু করতেই থাকবে। হয় হাতে হাত রেখে গল্প করবে, নাহয় গান গাইবে, নাহয় নিজের হাতে রান্না করে আমাকে খাইয়ে দিবে। গমগমে কন্ঠস্বরে যখন গান গায় শুনতে এত্তো ভালো লাগে। অভিমান করলে হাজার উপায়ে অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা করবে।
আমার সব ইচ্ছে সে পূরণ করছে। আমি কখনো মুখ ফুটে বলি নি। মুখ ফুটে বলার ক্ষমতা যে আমার নেই, জানেনই তো। তার কাছে মুখ ফুটে কিছু বলার প্রয়োজনই পড়ে না। আমার না বলা কথাগুলো কিভাবে কিভাবে যেনো সে বুঝে যায়।
কবে, কখন, কিভাবে জানি না। আমি তার প্রেমে পড়েছি। এই প্রেম ভালোবাসার ব্যাপারগুলো বোধহয় এমনই। কখন, কিভাবে কার ছায়া মনে জাগে; বলা মুশকিল। শুধু জানি এই মানুষটাকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। কিচ্ছু ভালো লাগে না তাকে ছাড়া। মানুষটার দূরত্বে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। তার গমগমে কন্ঠস্বর না শুনলে আমার বড্ডো একা একা লাগে। আর তার সেই অদ্ভুত সুবাস! তার গায়ের সেই অদ্ভুত সুবাস ছাড়া আমার ঘুম আসে না। কেউ যে এতো যত্নের সাথে ভালোবাসতে পারে আমার জানা ছিলো না। এতো যত্নের ভালোবাসাও আমার কপালে ছিলো! আর আমি কিনা শূন্য নীড়ের জন্য হা-হুতাশ করতাম। এখন আর মুনতাজির ভাইকে সেভাবে মনে পড়ে না। পড়ার সুযোগটা কোথায়। মনে যে এখন অন্যকেউ গেড়ে বসে আছে।
“কিন্তু”। তবুও কোথাও একটা কিন্তু থেকে যায়। একজন বলেছিলেন না- নারীর হৃদয়ে প্রথম প্রেম সেই দীপশিখা, যা সময়ের ধাক্কাতেও সহজে নিভে না। আমি তার ব্যতিক্রম নাকি! এতো যত্নের মাঝেও মাঝে মাঝে তাকে মনে হয়।
কেউ যদি আমায় এখন প্রশ্ন করে- জীবন নিয়ে তোমার কোনো আফসোস আছে?
আমি বলবো- হ্যা৷ আফসোস আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে শুদ্ধ মানুষকে আমার শুদ্ধতম ভালোবাসাটা না দিতে পারার আফসোস আছে। আমার প্রথম প্রেমের মালাটা তাকে না দিতে পারার আফসোস আছে। আমার প্রথম অনুভূতিটুকু তার নামে না দিতে পারার আফসোস আছে। আমার এই আফসোস কোনোদিন যাবে না।
***
বহু বছর পর দেশে এলাম। বিয়ের পর পরই বিদেশ বিভূঁইয়ে পাড়ি জমিয়েছিলাম উনার সাথে। মাসখানেক হলো দেশে ফিরেছি। এতদিন শশুর বাড়িতে ছিলাম। আমার শাশুড়ী মারা যাওয়ার পর, শশুর মশাই একা হয়ে গেছেন। সাথে আমার বিধবা ননাশ থাকেন, বাচ্চাকে নিয়ে। অনেক জোর করা হয়েছে উনাদের আমাদের কাছে নেওয়ার জন্য। কিন্তু আমার শশুরের এক কথা। যে কটাদিন বেঁচে আছি এখানেই থাকবো। নিজের বাড়িতে, নিজের দেশেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবো। আমার বাবা-মায়েরও বয়স হয়েছে। খুব চিন্তা হয় তাদের নিয়ে। শশুরকে দেখার জন্য লোক থাকলেও তাদের দেখার জন্য কেউ নেই। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান আমি। এবার ঠিক করেছি তাদেরও সঙ্গে নিয়ে যা। সবঠিক হয়ে গেছে। প্রসেসিং-এ যেটুকু সময় বাকি।
সময় বহমান। সময়ের স্রোতে অনেক কিছুই বদলে গেছে। দেখতে দেখতে আমার বাবা-মা বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমিও কি আগের মতো আছি? নেই তো। আমি এখন পরিপূর্ণ নারী। কারো বিবাহিতা স্ত্রী। দুই সন্তানের মা। যার দিনরাত যায় স্বামী, সংসার আর দুটো বাচ্চার পিছনে ছুটতে ছুটতে।
বহুদিন পর আজ পুরনো মানুষদের কাছাকাছি এসে পুরনো স্মৃতি নাড়া দিচ্ছে। জিনিয়া, নিভাপু আসায় আজকে ওদের বাসায় গিয়েছিলাম। নিভাপুর মাঝে বয়সের ছাপ পড়তে শুরু করেছে। চুলে পাঁক ধরেছে। আমার চিক্কু বেস্টফ্রেন্ড এখন আর চিক্কু নেই। স্বাস্থ্য বেড়ে গেছে। আগের মতো চঞ্চলতার ছিটেফোঁটাও নেই তার মাঝে। কেমন জানি অসহায়ত্ব তার চোখেমুখে। আঙ্কেল মারা গেছেন, আন্টিও বার্ধক্যের ভারে নুয়ে পড়েছে। এদের মাঝে আমার বড়ো হওয়া। এক থালায় খাওয়া। কতো কতো স্মৃতি এদের সাথে জড়িয়ে। সময়ের সাথে সাথে সব বদলে গেছে।
সব বদলে গেলেও উনার প্রতি আমার ভালোবাসা আর আমার প্রতি উনার ভালোবাসা বদলায় নি। আমি আজও উনার যত্ন ভালোবাসার জন্য মুখিয়ে থাকি। বিয়ের পর নাকি ভালোবাসা বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের ভালোবাসা বিলীন হয় নি। বরং সময়ের সাথে সাথে নতুন রুপ নিয়েছে। আমার ভালোবাসার দুটি ফুল আমাদের দুই ছেলে মেয়ে। আগে যেই অনুভূতিগুলোতে সিক্ত থাকতাম। এখন সেসব বিলীন প্রায়।
বহু বছর পর মুনতাজির ভাইকেও দেখলাম। নিজেকে মেইনটেইন করেছে ভালো। চোখে চশমা উঠেছে। এখনও বিয়ে করেন নি। কেনো করেন নি। জানি না। জিনিয়াকে জিগ্যেস করেছিলাম। কিন্তু কোনো জবাব পাই নি। আমিও আর ওকে ঘাটি নি। স্বভাব চরিত্র বোধহয় এখনও বদলায় নি। কিছুই যে বদলায় নি তেমন না। এখন আর উচ্চ শব্দে জ্যাজ সং শোনা যায় না৷ তার পরিবর্তে মৃদু আওয়াজের রবীন্দ্র সংগীত ভেসে এসেছে।
এক বিকেলে তার সাথে কথাও হয়ে গেলো টুকটাক। সবাই উপস্থিত ছিলাম। বাচ্চারা ছুটাছুটি করছিলো। তখন তারসাথে দেখা। জানতাম নিজে থেকে এসে কখনো কথা বলবে না। কথা বললে আমাকেই বলতে হবে। সৌজন্যতার খাতিরে। সবার সামনে আসলে কথা না বললে কেমন দেখাবে না? অথচ আমাকে অবাক করে দিয়ে নিজেই আসলো কথা বলতে।
-কেমন আছো তন্দ্রা?
-মুনতাজির ভাই! ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
বিনিময়ে মলিন হাসি দিয়ে নরম স্বরে খুব সংক্ষেপে জানালো- ভালো।
-বাচ্চা দুটোর বয়স কতো?
– মেয়ের তিন বছর আর ছেলের এক।
-নাম কি?
– সায়রী আর তিহান।
তিহানকে কোলে নিয়ে অনেক আদর করলো। সায়রীকেও আদর করলো। বেশ অবাক হলাম। বেশ বদলে গেছে। মুনতাজির ভাই আর এতো নম্রতা,ভদ্রতা। বিশ্বাস করা যায়! এই কি সেই দাম্ভিক, বেয়াদব, বাউণ্ডুলে মানুষটা! অবশ্য এখন তো আর আগের বয়স নেই। বেলা তো অনেক গড়ালো। পরিবর্তন আসাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একটা কথা সারাক্ষণ আমার মাঝে খচখচ করে, বিয়ে কেনো করেন নি তিনি৷ হয়তো কোনো খেয়ালিপনা থেকে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
***
আজকে জিনিয়া চলে যাচ্ছে। দুদিন পর আমিও চলে যাবো। সব গোছগাছ করা শেষ। বাবা মা’ও সঙ্গে যাচ্ছে। এবার আর কোনো চিন্তা থাকবে না। জিনিয়া যাওয়ার আগে আমাকে একটা ডায়েরি দিয়ে গেছে। খুব অনুরোধ করেছে যেনো পড়ে দেখি।
-তন্দ্রা প্লিজ ডায়েরিটা পড়িস। আমি জানি এটা করা আমার উচিত হচ্ছে না। কিন্তু কথাগুলো তোর জানা উচিত। একটু সময় করে পড়িস। আমাদের ভুল বুঝিস না প্লিজ।
সেই ডায়েরিটা নিয়ে অনেক্ক্ষণ ধরে বসে আছি। জানি না ডায়েরিটা কার, কি আছে এতে। তবে অবচেতন মন কিছু সংকেত দিচ্ছে। মনের সাথে মনের যুদ্ধ চলছে। এক মন বলছে খুলিস না, আরেক মন বলছে খুলেই দেখ না। শেষে খুলেই দেখলাম। আমার অনেক ছবি। ছোটবেলার; বড়বেলার। বিভিন্ন ছোট ছোট চিরকুট, চিঠি, ডায়েরির পাতায় পাতায় লেখা অসংখ্য বাক্য। সব আমায় নিয়ে। হাত কাঁপছে। বুক কাঁপছে। গলা শুকিয়ে আসছে। চোখ থেকে অনবরত পানি ঝড়ছে।
আমার প্রাণপাখি,
অনেক অভিমান আমার প্রতি তোর তাই না। মনে মনে কি আমায় বকাঝকা করিস। কর। যতো ইচ্ছা কর। কি করবি বল। মানুষটা যে আমি খুব খারাপ। আর তোর জন্য আমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ। খুব কষ্ট পেয়েছিস বুঝি? আমারও কষ্ট লাগে। তোকে কষ্ট দিতে আমারও কষ্ট লাগে। তার থেকে বেশি কষ্ট লাগে তোকে অন্যকেউ দেখলে। সহ্য করতে পারি না। ইচ্ছে করে দুনিয়ার সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেই। অন্যকেউ তোকে কেনো দেখবে বল। তুই শুধু আমার। তোকে দেখার অধিকার শুধু আমার। অবশ্য তোর দোষেই তুই কষ্ট পাস। নিজের চুলগুলো অন্যকে কেনো দেখাতে হবে বল? খুব শখ না অন্যকে চুল দেখানোর? তোর সবকিছুতে শুধু আমার অধিকার। অন্যকেউ তোকে দেখবে না। ঠিক করেছি আমি। একদম ঠিক করেছি।
আরেক পৃষ্ঠাতে লেখা-
পরাণপাখি,
আজকে সজীবকে মেরেছি। খুব মেরেছি। কতোবড় সাহস বলতো। বলে কিনা তোকে পছন্দ করে। তোর সাথে যেনো স্যাটিং করে দেই। আমার ভিতরে কি হচ্ছিল বুঝতে পারিস?
এমন অসংখ্য কথা লেখা ডায়েরির পাতায় পাতায়। দমবন্ধ হয়ে আসছে। একটা চিঠিও আছে।
তন্দ্রা,
জানি এই চিঠির আজ কোনো মূল্য নেই। তুই পড়বি কিনা জানি না। তবে একটাবার অনুরোধ করবো পড়ার জন্য। নিজের ভিতরের অস্থিরতা, অপরাধবোধ এমন পর্যায় পৌঁছেছে যেখান থেকে আমি কোনোদিন বের হতে পারবো না।
আমি জানি তোর সঙ্গে অন্যায় করেছি। শুধু তোর সঙ্গে নয়। নিজের সঙ্গেও অন্যায় করেছি। নিজের খামখেয়ালিপনা, নিজের চিন্তাধারায় এতো মগ্ন ছিলাম যে; ঠিক সময়ে তোর মূল্যায়ন করতে পারি নি। তোকে বলতে পারি নি তোকে কতোটা ভালোবাসি।
আর পড়ার ধৈর্য্য হলো না। ভালোবাসতো? মুনতাজির ভাই আমাকে ভালোবাসতো! এখনও বাসে? আমার জন্যই তিনি আজ অবধি বিয়ে করে নি। আমাকে ভালোবাসলে এতো কষ্ট, অবহেলা, অপমান কেনো? যাকে ভালোবাসা যায় তাকে কখনো অপমান করা যায়? প্রতিটা পাতায় আমার প্রতি তার পাগলামো আবেগের কথা।
শীতের সন্ধ্যা। মফস্বলি এলাকা হওয়ায় শীত জেঁকে বসেছে। এই প্রচন্ড শীতেও আমি কুলকুল করে ঘেমে চলছি। কোনো অজানা আবেগে নাকি রাগে আমার জানা নেই। রাগ হ্যা রাগ।
মাঠে কিছু বাচ্চারা আগুন জ্বালিয়েছিল। ডায়েরিটা সেই আগুনে জ্বালিয়ে দিলাম। বৃথা৷ এসব মিথ্যা, দমবন্ধকর আবেগের এখন কোনো দাম নেই। আমার প্রতি তার এসব আবেগের এখন কোনো দামই নেই। একসময় উপযুক্ত সময় ছিলো, তখন তিনি সবটা হেলাফেলায় নষ্ট করেছে। সে যাই বলুক, তার কাজের পিছনে তিনি হয়তো হাজারটা যুক্তি দাঁড় করাতে পারবে। কিন্তু সত্যি তো এটাই; কোনো যুক্তিই আমাকে অপমান করার অধিকার তাকে দেয় না। আমার কিশোরী বয়সের প্রথম অনুভূতিকে গলা টিপে হত্যা করার অধিকার তার ছিলো না। সে তো সবই বুঝতো। জানতো। আমিই বোকা। ভেবেছিলাম তিনি হয়তো কিছুই বুঝতেন না। অথচ তিনি আমার সমস্ত অনুভূতি জানা সত্যেও প্রতি পদে পদে আমাকে অপমান করে গেছে। এ কেমন ভালোবাসা! কেউ চুলের প্রশংসা করেছে বলে, চুল কেটে দেওয়া। কেউ পছন্দ করেছে বলে যাচ্ছে তাই বলে অপমান করা; কেমন ভালোবাসা!
আর যাইহোক। সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষকে কখনো কষ্ট দেওয়া যায় না। অপমান করা যায় না। আমার ভালোবাসা পাওয়ার কোনো যোগ্যতাই তার নেই। তবুও তাকে ভালোবেসেছি। ভালোবাসতে কোনো কারণ লাগে না। আমি ভালোবাসতে জানি তাই তারমতো মানুষকেও খুব যত্ন করে ভালোবেসেছিলাম। তাকে ভালোবাসতে পারাটা আমারই কৃতিত্ব ছিলো। মন থেকে ভালোবেসেছিলাম তাকে আর তিনি তা বড়ো নির্মমভাবে পায়ে ঠেলেছেন। ভালোবাসলে সেই মানুষটাকে সম্মান করতে হয়, আগলে রাখতে হয়, কদর করতে হয়। অপমান, অবহেলা, কষ্ট দেওয়ার মাঝে কোনো ভালোবাসা হতে পারে না। তাই এখন এসবের কোনো মূল্যই আমার কাছে নেই। আমি নিজের জীবনে সুখী। প্রকৃতপক্ষেই সুখী। একটা শুদ্ধতম মানুষ পেয়েছি আমি। যে আমাকে সম্মান করে, মূল্যায়ন করে, আগলে রাখে।
জানি না জীবনে এমন কি পূণ্য করেছি যার জন্য আল্লাহ তায়ালা আমাকে এমন বিষাক্ত একটা সম্পর্কে জড়ানো থেকে বাঁচিয়ে নিয়েছেন। বিষাক্ত সম্পর্ক থেকে বাঁচিয়ে পবিত্র একটা পুরুষকে জীবনে এনে, আমার জীবনটা সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধিতে ভরিয়ে দিয়েছেন। একসময় কাউকে খুব যত্নে ভালোবেসেছিলাম আল্লাহ তায়ালা আমার থেকেও যত্নে ভালোবাসতে পারা মানুষটাকে আমার জন্য পাঠিয়েছে। আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া। ব্যস। আর কিচ্ছু জানতে চাই না আমি। কিচ্ছু না। আমাকে ফিরতে হবে। প্রকৃত এক প্রেমিক পুরুষ অপেক্ষা করছে আমার জন্য। যার সাথে বৃদ্ধ হওয়ার ইচ্ছে। তার বুকে মাথা রেখে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার ইচ্ছে আমার।
***
-তন্দ্রা এই তন্দ্রা..
– উমম..
-ঘুমাচ্ছ?
– কি অদ্ভুত কথা সায়র! ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে বলছো ঘুমচ্ছি কিনা। এই রাতের বেলা মানুষ আর কি করবে।
মুচকি হেসে মাথা চুলকে বলে,
– ছাঁদে এসো। আমি অপেক্ষা করছি তোমার জন্য।
অগত্যা কি আর করার। মশাইয়ের আদেশে চলে গেলাম ছাঁদে। শীতের রাত। ধোঁয়া উঠা দুটো কাপ নিয়ে হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে আছে।
-মাঝে মাঝে যে তোমায় কি ভূতে ধরে। এই মাঝরাত্রিরে কনকনে ঠান্ডায় কেউ ছাঁদে আসে?
-আমি আসি।
বলে এককাপ কফি আমার দিকে দিলো। খুব সন্তপর্ণে নিজের চাদরের মাঝে আমায় ঢেকে নিলো। শুধু কি চাদর। এভাবেই লোকটা তার ভালোবাসার মায়ায় আমাকে ঢেকে নিয়েছে।
– কদিন পর চলে যাবো। ভাবলাম আজকের রাতটা একটু অন্যভাবে কাটায়। আপনার সমস্যা আছে রাণীসাহেবা?
-সমস্যা তো নেই। কিন্তু মাঝরাতে তোমার হুটহাট প্ল্যানিং এ আমার হার্ট অ্যাটাক না হলেই হয়।
সায়র জোরে হেসে উঠে। কি সুন্দর হাসি! এই হাসি এমনই অম্লান থাকুক। অম্লান থাকুক আমাদের ভালোবাসাও।
পুনশ্চ: অন্ধকার ছাঁদের ঠান্ডায় হিম ধরা ফ্লোরে পা মেলে বসে আছে কেউ। বুক্ষুভের মতো সিগারেট টানছে আর হাওয়ায় বিষাক্ত ধোঁয়া ছাড়ছে। শীতের কুয়াশার মাঝে মিশে যাচ্ছে তা। গাশে পাতলা একটা শার্ট ছাড়া কিছু নেই। এই ঠান্ডায় শরীর জমে হিম হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তার ভিতরের ঝড় থামছে না। দৃষ্টি তার সামনের ছাঁদে দাঁড়ানো কপোত-কপোতীর দিকে। তাদের নজর এদিকে পড়ে নি। তারা তো নিজেদের ভালোবাসায় ডুবে আছে। শুধু তারই প্রতিটা রাত এভাবে কাটে। আফসোস আর অনুতাপের সাগরে।
এই আফসোস ভালোবাসার মানুষটাকে না পাওয়ার। এই আফসোস, ভালোবাসার মানুষটাকে ভালোবাসি বলতে না পারার। শুধু কি আফসোস? তার থেকেও অনুতাপে জর্জরিত সে৷ ভালোবাসার মানুষটাকে বুঝতে না পারার অনুতাপ। ভালোবাসার মানুষটাকে কষ্ট দেওয়ার অনুতাপ। ভালোবাসার মানুষটাকে মূল্যায়ন না করার অনুতাপ। বাবা-মায়ের কথায় ঠিকঠাক প্রতিবাদ না করার অনুতাপ। জীবনে কতোই তো বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়েছে। আরও একটাবার অবাধ্য হলে ওই নারীটা আজ তার একান্ত ব্যক্তিগত হতো। সময়কে হেলাফেলা করার অনুতাপ। এতো এতো অনুতাপ আর আফসোসেই দিন কাটে তার। একবুক হাহাকার নিয়ে কাটে প্রতিটা রাত। সময় থাকতে সঠিক সময় এবং সঠিক মানুষের কদর করতে জানতে হয়।
সময় গেলে সাধন হবে না
দিন থাকতে দ্বীনের সাধন কেন জানলে না
তুমি কেন জানলে না
সময় গেলে সাধন হবে না….
সমাপ্ত.