চন্দ্রমলিন সন্ধ্যায় পর্ব-০২

0
19

#চন্দ্রমলিন_সন্ধ্যায় (২)
#কারিমা_দিলশাদ

আজকে আমাকে দেখতে আসবে। হুট করে জানতে পারলাম; এমন না। কালকে রাতে বাবা এসে জানিয়েছে। বাবা বিদেশে থাকায় আমি যেমন বাবাকে কাছে পাই নি। বাবাও তেমন আমাকে কাছে পায় নি। আর দশটা বাবাদের মতো আমার বাবা আমার বড় হওয়া দেখে নি। আর দশটা বাবা-মেয়ের মতো আমাদের সম্পর্ক নয়। একটা নিরব দূরত্ব বিরাজ করে আমাদের মাঝে। দেশে আসার পর বাবা একটা নিয়ম তৈরি করেছে। প্রতিদিনের চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে এক ঘন্টা কেবল আমাদের বাবা-মেয়ের জন্য বরাদ্দ। এতো বছরের কাছে না পাওয়া মিটিয়ে নেওয়ার ছোট্ট একটা চেষ্টা। এই এক ঘন্টা আমরা কথা বলি। যেকোনো বিষয় নিয়ে। এই এক ঘন্টা আমাদের বাবা-মেয়ের মাঝে দুনিয়ার অন্য সব কিছুর প্রবেশ নিষিদ্ধ। এমনকি মা’ও। মায়ের প্রবেশ নিষিদ্ধ হলেও আমাদের আলাপের বেশিরভাগই থাকে মাকে নিয়ে। অন্য কোনো বিষয় নিয়ে কথা শুরু করলেও বিষয়গুলোতে কিভাবে যেনো মা ঢুকে পড়ে। আলাপের সময় সীমা এক ঘন্টা হলেও; কথায় কথায় ঘন্টার পর ঘন্টা পার হয়ে যায়। বাবা যে কিভাবে এতো মজার মজার কথা বলে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে বাবার সাথে ওই সময় আমিও কিভাবে যেনো বকবক করে চলি। মায়ের গজর গজরে আমাদের সেই আলোচনা পর্ব শেষ হয়।

রোজকার মতো কালকেও বাবা আসে। এদিক ওদিকের কথা বলতে বলতেই জিগ্যেস করে আমার পছন্দের কেউ আছে কিনা। মুহুর্তেই ভেসে উঠে অগোছালো, দাম্ভিক একটা চেহারা। কিছু টুকরো স্মৃতি। কিছু টুকরো ইচ্ছে। বাবার সাথে সব বলা হলেও এটা বলা হয় নি। আজও বলা হলো না যে,

-হ্যা বাবা। পছন্দ করি। একটা বাউন্ডুলে, অগোছালো,দাম্ভিক ছেলেকে পছন্দ করি। খুব পছন্দ করি। খুবববব।

কিন্তু বলা হলো না। তারপর জানলাম আমাকে আজ দেখতে আসবে। আমার আপত্তি আছে কিনা। নাহ নেই। কোনো আপত্তি নেই। সত্যিই নেই। সে আমার জন্য না এটা আমি বহু আগেই মেনে নিয়েছি। তাই কোনো কিছু নিয়েই আমার কোনো আপত্তি নেই। ওই পরিবারের সাথে আমাদের আন্তরিকতা আগের মতোই আছে। জিনিয়া এখনও আমার প্রাণের সখী। নিভাপুর বিয়ে হয়ে গিয়েছে। মুনতাজির ভাইয়ের সাথে সামনাসামনি দেখা হয় না বহুদিন। তার সাথে সামনাসামনি দেখা না হলেও; আমার লুকিয়ে দেখা এখনো জারি আছে। যদিও আগের মতো এখন আর তার দেখা পাওয়া যায় না। ছুটিছাটায় আর অফিসে যাওয়া আসার সময় দেখা পাওয়া যায়। বাউন্ডুলেটা চাকরি পেয়েছে কিছুদিন হলো। চাকরি পেলেও বাউন্ডুলেপনা এখনও কমে নি। পাশাপাশি রুম হওয়ায় এখনও তার রুম থেকে জ্যাজ সং শুনতে পাই। হ্যাড়ে গলার গান শুনতে পাই। এখন আর আগের মতো ছটফটে ইচ্ছেগুলো মাথাচাড়া দেয় না ঠিক। তবে এখনও প্রতিদিন নিয়ম করে তাকে ভেবে ঘুমোতে যাওয়া হয়। অফিসে যাওয়ার পথে “আম্মু যাই” বলে যখন ‘ধাঙঙঙ’ করে গেট লাগায়। পর্দার আড়াল থেকে তাকে দেখে সকাল শুরু করা হয়। টিপটপ হয়ে অফিসে যায়। কি যে এক পারফিউম লাগায়। না সে পারফিউম লাগায় না। গোসল করে। পুরনো অভ্যাস। সাতদিনে একবার গোসল করুক আর না করুক; পারফিউম দিয়ে গোসল চলবেই। ঘ্রাণটা নাক দিয়ে ঢুকে সোজা মস্তিষ্কে গিয়ে টং করে উঠে। এখনও নিয়ম করে তাকে নিয়ে ভাবা হয়। তবে কোনো কিছুতেই আমার কোনো আপত্তি নেই।

***

বিয়েটা আমার হয়েই গেলো শেষমেষ। বড়োই নাটকীয় ভাবে। দেখতে এসে বিয়ে হয়ে যাওয়া শুনেছি অনেক। আজকে নিজের সাথেই হলো। আজকেই বিয়ে হবে কথাটা জানলাম বিয়ের ঠিক দশ মিনিট আগে। উনারা আসবে বলে মা একটা জামরঙা জামদানী শাড়ি দিয়ে গিয়েছিলো। জিনিয়া এসে পরিয়ে দিতেও নিয়েছিলো; বাবা এসে না করলো। আমার মেয়ে যেমন থাকে সেভাবেই সামনে যাবে। আমার অবশ্য কোনো আপত্তি ছিলো না। শাড়ি পড়ে সং সেজে তাদের সামনে যেতে হবে। হেঁটে দেখাও, চুল দেখাও, নখ দেখাও, দাঁত দেখাও এসব দেখানোর জন্য ম্যান্টাল প্রিপারেশন নেওয়াই ছিলো। তবে ঘটনা সেরকম ঘটলো না। ঘরভর্তি মানুষের সামনে গিয়ে আমায় দাঁড়াতে হলো না। কয়েকজন মহিলা এসে আমাকে দেখে গেছে। সুন্দর করে বলতে গেলে বলতে হয় কোশল বিনিময় করে গেছে।

আশেপাশের পরিবেশ তখন রমরমা। কিন্তু যার বিয়ে তারই কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ভোতা এক অনুভূতি ছাড়া কোনো কিছুই অনুভব করতে পারছিলাম না। কিচ্ছু না। বিয়ে হবে শোনার পরেও না। যেনো এটা হওয়ারই ছিলো। আজ এবং এভাবেই হওয়ার কথা ছিলো। আমি যেনো অপেক্ষায় ছিলাম এমন ঘটনার। বাবা-মাকে ছেড়ে যাওয়া নিয়ে কষ্ট ছিলো না। ভালোবাসাকে না পাওয়া নিয়ে কষ্ট ছিলো না। কারো কথাই ভাবছিলাম না। কোন জগতে ছিলাম জানি না।

বাবা-মা প্রথমে কিছুতেই এভাবে বিয়ে দিতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু ছেলের বাবা আর মামার কথায় বাবা নিমরাজি হলেও। মা কিছুতেই রাজি না। কোনোভাবেই একমাত্র মেয়ের বিয়ে এভাবে দিবেন না। তার মেয়ে তার কাছে ভারী হয় নি। কলিজা ছেঁড়া ধন তার। বড়ো আদরের সন্তান। একা এক হাতে মানুষ করেছে। এখনই এভাবে বিয়ে হয়ে যাবে মা কিছুতেই মেনে নিবে না। কিন্তু জানি না ছেলের সাথে আলাদা কি কথা হলো। কথা বলার পর বাবা সানন্দে রাজি আর মা’ও নিমরাজি! আমার অমতে বিয়ে হয় নি। আমি সজ্ঞানে মত দিয়েছি। সজ্ঞান বললেও তখন জ্ঞান ছিলো কি ছিলো না; জানি না। বাবা-মা এসে মাঝখানে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বুলিয়ে জিগ্যেস করলো-আম্মু ছেলে পছন্দ হয়েছে?

আমি ছেলে তখনো দেখি নি। সেটা বললাম না। আমার তো কোনো কিছুতেই আপত্তি নেই। তাই মাথা নাড়ালাম। ছেলে ভালো। আমাদের পছন্দ হয়েছে। এভাবে আমাকে বিয়ে দিতে চায় না। এমন অনেক কিছুই বললো। আমি শুধু মাথা নাড়ালাম। আমার তো কোনো কিছুতেই আপত্তি নেই। রাজি না হওয়ার কোনো কারণ নেই। মুনতাজির ভাইকে দেখলাম বড়ভাইয়ের মতো বোনের হঠাৎ বিয়েতে খাটাখাটুনি করছে। অফিস থেকে ফিরে কাপড় বদলানোর সময়টাও পায় নি। ইশশ বেচারা। আমার কোনো কিছুতেই আপত্তি নেই।

একটুপর সেই ছেলে আসলো। ঘরে ঢুকে নি। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো। দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই মৃদুমন্দ বাতাসে একটা সুন্দর সুবাস নাকে এসে ধাক্কা খেলো। আমি দরজা বরাবর খাটে দুই পা ভাঁজ করে বসা। মাথায় সাদা-গোলাপি মিশেলে উড়না। সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে পাশে জিনিয়া বসা। লোকটাকে আসতে দেখেই সে উঠে বারান্দায় চলে গেলো। ছেলে এসে গলা খাঁকারি দিয়ে বললো- আসসলামু আলাইকুম। আমি জুনায়েদ সারোয়ার সায়র।
-এই বিয়েতে আপনার আপত্তি আছে?

সুবাসটা এবার শুধু নাকে না সারা রুমে ছড়িয়ে গেলো যেনো। কি অদ্ভুত সুন্দর একটা সুবাস। একদম কড়া না আবার খুব হালকাও না। মেয়েদের সুগন্ধির মতো মিষ্টিও না। অদ্ভুত সুন্দর। এমন সুন্দর ঘ্রাণ এজীবনে আমি আগে কখনো অনুভব করি নি। কাল থেকে আজ পর্যন্ত ওই প্রথম কিছু করতে ইচ্ছে হলো। জিগ্যেস করতে ইচ্ছে হলো- আপনার পারফিউমটার নাম কি মশাই। কি সুন্দর সুবাস। নামটা বলুন তো। মুনতাজির ভাইকে কিনে দিবো একটা। ইশশ আবার মুনতাজির।

আমি লোকটার পলিশ করা চকচকে কালো জুতা, কালো প্যান্ট আর সাদা শার্ট দেখলাম। লোমে ভরা দুটো সুঠাম হাত দেখলাম পকেটে গুজা। ভুড়ি নেই। মাথা নিচু করা অবস্থায় শুধু চোখ তুলে যতটুকু দেখা গিয়েছে তটুকুই দেখেছি। মাথা একটু উঁচু করলেই মুখ দেখা যেতো। ইচ্ছে করলো না। গমগমে গলার আওয়াজ শুনলাম। কথা বলার ঢং-টা সুন্দর। যেনো স্কেলে মেপে মেপে কথা বলে। শুনতে ভালো লাগে। নামের পরে একটু সময় নিয়ে প্রশ্ন করেছে। আপত্তি আছে? নাহ। আমার কোনো কিছুতেই আপত্তি নেই। ব্যস হয়ে গেলো বিয়ে।

এখন আমার জীবনে মুনতাজির ভাইয়ের কোনো জায়গা নেই। এখন আর রোজ নিয়ম করে তাকে নিয়ে ভাবতে বসা হবে না। তাকে দেখা হবে না। লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে দেখা হবে না। আমার জীবনে তার আর কোনো অধিকার নেই। এতে যে স্বামী নামক মানুষটাকে। ঠকানো হবে।
তবে আফসোস রয়ে গেলো। ভালোবাসার মানুষটাকে না পাওয়ার। বলতে না পারার। আমি ভালোবেসেছিলাম তাকে। সে তো বাসে নি। বাসে নি বলেই আমার বিয়েতে বত্রিশ দাঁত কেলিয়ে ঘুরতে পারছে। থাক। কিছু না পাওয়া, না পাওয়াই থাক। আপনাকে নিয়ে আর লেখবো না মুনতাজির ভাই। আপনাকে নিয়ে লেখা ডায়েরিটা যাওয়ার সময় ফেলে রেখে যাবো। কবুল বলার সাথে সাথেই আমার নতুন জীবন শুরু হয়েছে। সেখানে আপনার কোনো স্থান নেই। ভালো থাকবেন মুনতাজির ভাই। খুব ভালো থাকবেন।

#ক্রমশ…

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কেমন লাগলো জানাবেন।]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে