ছোটগল্প~#চন্দ্রমলিন_সন্ধ্যায় (সূচনা পর্ব)
কলমে~#কারিমা_দিলশাদ
মুনতাজির ভাই…আমার বুকে কাঁপন ধরানো প্রথম পুরুষ। আমার কিশোরী বয়সের প্রথম প্রেম। কিশোরী বয়সের প্রথম প্রেম হয় বসন্তের প্রথম কুঁড়ির মতো। যাকে নিয়ে কিশোরী মনে প্রথম প্রেমের মাল্য গাঁথা হয়। আমিও প্রথম প্রেমের মালা গেঁথেছিলাম; মুনতাজির ভাইকে নিয়ে। খুবই নিরবে নিভৃতে। তাকে ভেবে ভেবে যে কতো রাত নির্ঘুম কাটিয়েছি। তার কোনো হিসেব নেই। প্রথম প্রেমের অনুভূতি হয় অনন্য। অথচ তার প্রেমে পড়ে আমি প্রতিবার মরমে মরেছি। মুনতাজির ভাই আমার সেই আবেগ যার থেকে পাওয়া আঘাতে জর্জরিত হয়ে দুঃখের মহাসাগরে তলিয়ে গেছি। আসলে এ-তো হওয়ারই ছিল। বলা হয় প্রেম যদি সুখের হয়,তবে তা স্বপ্ন। আর যদি কষ্টের হয়,তবে তা বাস্তবতা। আর বাস্তবতা বলেই কষ্ট পেয়েছি। গল্প হলে হয়তো কাহিনিটা অন্যরকম হতো।
বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান আমি। মা হাইস্কুলের শিক্ষিকা; বাবা প্রবাসী। মা-বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ায় খুব আদরে-আহ্লাদে বড় হয়েছি। যদিও বাবা প্রবাসে থাকার দরুণ বাবার আদর খুব একটা পাই নি। মুনতাজির ভাই আমাদের বাড়িওয়ালার ছেলে। ফর্সা,লম্বা, এলোচুলের সুদর্শন এক পুরুষ। আমার স্বপ্ন পুরুষ। তারা তিন ভাই-বোন। নিভা আপু,মুনতাজির ভাই আর জিনিয়া। মুনতাজির ভাইয়ের মা মমতা আন্টি,নামের মতোই মমতাময়ী। আমাকে খুব আদর করেন। ওই পরিবারের সবাই আমাকে খুব পছন্দ করে। স্নেহ করে। একমাত্র আসল মানুষটা ছাড়া। মুনতাজির ভাইয়ের ছোটবোন জিনিয়া আর আমি বেস্টফ্রেন্ড। দুজন দুজনের সব পেটের খবর জানি। ওকে একটা মশা কামড়ালেও এসে আমাকে বলবে- দোস্ত আজ একটা দানব আকৃতির মশা তোর বেস্টুর শরীর থেকে ১লিটার রক্ত খেয়ে নিয়েছে। কি করি বলতো?
-মাত্র ১লিটার! কমই তো জিনি। মশাদেরও তো ক্ষিধে পায় বল। ওদেরও বেঁচে থাকার অধিকার আছে।
-হুমম…ঠিকই তো। কিন্তু তোর চিক্কু বেস্টুর শরীর থেকে ১লিটার রক্ত খেয়ে নিলো তা নিয়ে তোর কোনো আফসোস নেই?
-থাকবে না কেনো। অবশ্যই আছে। তুই হলি আমার বুজম ফ্রেন্ড। তোর কষ্টে অবশ্যই আমি কষ্টিতবোধ করছি। তাই আমার শরীর থেকে ১লিটার রক্ত আমি তোকে দিয়ে দিলাম। হুশ.হুশ.ফুশ ল্যামেন জুশ…ছুহ…নে দিয়ে দিলাম।
-আয় তো এবার বুকাবুকি করি।
স্বভাবতই আমি চুপচাপ, শান্তশিষ্ট, লাজুক প্রকৃতির আমি। তবে একমাত্র জিনিয়ার সাথেই আমার ভিন্নরুপ প্রকাশ পায়। দুজন দুজনের পেটের কথা জানলেও মুনতাজির ভাইয়ের প্রতি আমার অনুভূতির কথা জিনিয়া জানে না। কাউকেই জানানো হয় নি। মুনতাজির ভাইয়ের প্রতি আমার অনুভূতি সেভাবে কখনো প্রকাশও করা হয় নি। তার প্রতি আমার ভালোলাগা, ভালোবাসা সবটাই ছিলো মনে মনে। কবে কখন কিভাবে মুনতাজির ভাইয়ের প্রতি আমার ভালো লাগা সৃষ্টি হয়েছে জানি না। খালি একসময় খেয়াল করলাম তারজন্য ভাই ভাই ফিলটা আর আসছে না। ‘মুনতাজির ভাই’ না শুধু মুনতাজির বলে ডাকতে ইচ্ছে হয়। কেউ বিশ্বাস করবেন না, একসময় তাকে আমি দু-চোখে সহ্য করতে পারতাম না। সে ছিলো আমার দুশমন। কিন্তু কি হলো জানি না। হঠাৎ খেয়াল করলাম বদের হাড্ডি, খামখেয়ালি, এলোমেলো মানুষটাকে আমার ভালো লাগছে। একসময়কার তার সব বিরক্তিকর কাজগুলো ভালো লাগছে। এই যে অযথা ছাগলের মতো ম্যা ম্যা করে চিল্লাচিল্লি করছে এসব আমার ভালো লাগছে। আগে বিরক্ত লাগতো। গোসল করতে গিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা হেঁড়ে গলায় চিৎকার করে গান গাইছে, আমার ভালো লাগছে। ধুমধাম করে হাঁটা আমার ভালো লাগছে। যাওয়া আসার সময় লোহার গেটটা “ধাঙঙঙ” শব্দ করে আটকানোও আমার ভালো লাগছে। অথচ এসব আমার একসময় বিরক্ত লাগতো। ভালো লাগার মতো কিছু না,যে ভালো লাগবে। এগুলোর জন্য কতবার মাকে বলেছি বাসা পাল্টাতে। মা পাল্টায় নি। বাসাটা সেফ আর মমতা আন্টির ভরসায় আমাকে রেখে মা নিশ্চিন্তে স্কুল যেতে পারছে। এখন এই বিরক্তিকর বিষয়গুলোই আমার ভালো লাগা। একরাশ ভালো লাগা।
আমি কান পেতে থাকি মুনতাজির ভাইয়ের অনর্থক চিল্লাচিল্লি শোনার জন্য। ম্যা ম্যা ম্যা ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো চিল্লানিতে বিরক্ত হয়ে আন্টি দুরুম-দারুম করে দামড়া ছেলের গায়ে কিল বসিয়ে গজগজ করতে করতে কাজ করছে। এগুলো দেখে ফিক করে হেসে ফেলছি। মানুষটা লোহার প্যাঁচানো সিঁড়ি বেঁয়ে ধক-ধক করে যখন ছাঁদে উঠে, আমার বুকের ভিতরেও তখন ধক-ধক করে উঠে। সে বাইরে গেলে চাতক পাখির মতো তার ফেরার অপেক্ষা করি। “ধাঙঙ” করে গেটের উপর দিয়ে যখন তুফান বয়ে যায় তখন বুঝি সে এসেছে।
বলে না Opposites attract. মানুষটার সবকিছু তুফানের মতো। শান্ত হয়ে কিছু করতেই পারে না। আমি যতটা শান্তশিষ্ট। সে ততোটাই অশান্ত। আমি যতোটা গোছালো,সে ততটাই অগোছালো। আমি নিরব থাকতে পছন্দ করি। তিনি সবসময় লাউড। সুন্দর করে গুছিয়ে সবকাজ করার বেশ সুনাম আছে আমার।
সে যাইহোক। মুনতাজির ভাইকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা। তার অনুপস্থিতিতে সবার অগোচরে তার ঘরে গিয়ে তার জিনিস ছুয়ে দেখা। তার পড়নের টি-শার্টের ঘ্রাণ নেওয়া আমার অভ্যেস হয়ে গেছে। তার ঘর থেকে তার একটা টি-শার্ট চুরিও করেছি। কাউকে বলবেন না যেনো। মুনতাজির ভাই জানলে চুন্নি বলে গালাগালি করবে। চুরি করাটা একটু বেশি হয়ে গেছে কি? হলে হোক। মুনতাজির ভাইয়ের প্রতি আমার ভালোবাসাটাও তো বেশি বেশি।
তুমুল এক বৃষ্টিমুখোর দিনে। মানুষটার পছন্দের ল্যাটকা খিচুড়ি আর কষা মাংস নিজের হাতে রান্না করলাম। বাউন্ডুলে নিষ্ঠুরটা বৃষ্টির দিনে এসব খেতে খুব পছন্দ করে। এই যে আমি তার এই ছোট ছোট বিষয়গুলোও নজরে রাখি নিষ্ঠুরটা তাও জানে না। বাউণ্ডুলে নিষ্ঠুরটার সবকিছু আমার নখ দর্পনে। এই যে তার বৃষ্টির ধাঁচ সহ্য হয় না। আমি জানি। জানা তো তারও আছে। কিন্তু সে মানলে তো। দাম্ভিক গোছের রামছাগল বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে হয়ে বাসায় ফিরলো। আমি সবে রান্না শেষে ঘরে ঢুকছি। ঠিক এই মুহূর্তে তার আগমন। সেই মুহূর্তে একটা ইচ্ছে জাগলো। কি জানেন? ইচ্ছে হলো বিয়ের পর এমনই কোনো বৃষ্টিমুখোর দিনে সদ্য বর্ষায় ভেজা একগুচ্ছ কদম নিয়ে ভিজে ভিজে আসবে। আমি তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবো। সে আসতেই শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথা মুছিয়ে শাসন করবো। কেনো সে আমার কথা শুনে না। জ্বর এলে তার সেবাযত্ন আমি করতে পারবো না। বিনিময়ে সে হাসবে। আমি তার হাসি দেখে ভিতরে ভিতরে মুগ্ধ হবো। কিন্তু বাইরে কপট অভিমান নিয়ে ঘুরে বেড়াবো। তখন শুধু একগুচ্ছ কদমে হবে না। বেলিফুলের মালা খোঁপায় গুজে যতক্ষণ না আমার রাগ ভাঙাবে; ততক্ষণ অভিমানীর অভিমান ভাঙবে না৷ কিছু প্রণয়সমর মুহূর্তের পর কিছু ভালোবাসাময় সময় কাটবে দুজনের। আগাগোড়া প্রেমাবৃত একটা সংসার হবে দুজনের। মানুষ আসলে কল্পনাতেই সুখী।
তার ভিজে চুল নিজের আঁচল দিয়ে মোছার অভিলাষ নিজের মাঝে গ্রাস করে নিই। মানুষটাকে নিয়ে এমন অনেক ইচ্ছেই আমার আছে। এই যেমন বৃষ্টিতে ভিজলে উনার জ্বর আসবেই। তবুও উনি জ্বরে ভিজবেই। আমি চাই সে ভিজুক। জ্বর আসুক। আমি নিজের ভালোবাসা দিয়ে সেবা শুশ্রূষা করে তাকে সারাতে চাই। জ্বরের দিনগুলোতে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে চাই “ভালোবাসি মুনতাজির। খুব ভালোবাসি।” তার জন্য কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে রান্না করতে চাই। অগোছালো মানুষ সে। তার অগোছালো রুমটা একরাশ বিরক্তি নিয়ে গোছাতে চাই। শুধু যে তার জন্যেই ইচ্ছে হয় তা না। তার পরিবারকে নিয়েও আমার অনেক ইচ্ছে আছে। এই যেমন আন্টির খুব চিন্তা তার বাউন্ডুলে ঘাড়ত্যাড়া ছেলেকে নিয়ে। আমি তার চিন্তা কমাতে চাই। ছেলের চিন্তায় অতিষ্ঠ হয়ে যখন চেঁচামিচি করে তখন ইচ্ছে করে গিয়ে জিগ্যেস করি- আন্টি তোমার অগোছালো ছেলেকে গোছানোর দায়িত্ব আমাকে দিবে?
আগেই বলেছি মুনতাজির ভাইয়ের প্রতি আমার অনুভূতি কখনো সেভাবে প্রকাশ করি নি। তবুও অবচেতন মনে আশা করতাম কোনোভাবে সে আমার অনুভূতিটুকু বুঝোক। কোনো না কোনোভাবে কেউ আমার অনুভূতিটুকু তাকে বলে দিক। কিন্তু তেমন কিছুই হয় নি। কেউ বুঝে নি। এই না বোঝাটা আমাকে কষ্ট দেয়। তাকে বলতে না পারাটাও আমায় কষ্ট দেয়। মাঝে মাঝে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে-এই নিষ্ঠুর মানুষ এতো কষ্ট দেন কেনো বলুন তো? কি হয় আমাকে একটু বুঝলে। আমার সাথে একটু ভালো ব্যবহার করলে কি আপনি পঁচে যাবেন? আপনার বুঝতে না পারাটা আমায় কষ্ট দেয়। আমার কষ্ট আপনি দেখতে পান না? আপনার এই অবুঝপনার নীরব বিষে ধীরে ধীরে আমার ভালোবাসা মরে যাবে।
জানি না অবুঝপনা আমার ছিলো নাকি তার। কিন্তু কথাগুলো খুব করে বলতে চাইতাম। বলতে তো অনেক কিছুই চাইতাম। চোখে চোখ রেখে ভালোবাসার কথা বলতে চাইতাম। বলতে চাইতাম- “মুনতাজির ভাই…আপনার হাতটা একটু ধরতে দেবেন? আমি হাত ধরলে আপনি পঁচে যাবেন না। বিশ্বাস করুন একটুও পঁচে যাবেন না। এই একটুখানি আপনার হাত ধরবো। এক চিমটি।” এহেন অসংখ্য কথা বলতে চাইতাম। কিন্তু কিছুই বলতে পারি নি। সব কথা আমার ভিতরেই রয়ে গেছে।
মুনতাজির ভাইকে আমি যতোটা পছন্দ করি। তিনি আমাকে ততোটাই অপছন্দ করেন। আমাকে দেখলেই তার চোখমুখ কুঁচকে যায়। যেনো কোনো অশুচি দেখে ফেলেছে। তাকে আমি যতোটা যত্নে ভালোবেসেছি। তিনি আমাকে ততোটা যত্নেই অবহেলা করেছেন।
– এই ছকিনা তুই আমার সামনে আসবি না। তোকে দেখলেই আমার বমি পায়।
এটা কোনো কথা হলো বলুন তো! আমাকে দেখলেই বমি এসে যাবে এতোটা কুৎসিত আমি মোটেই নই। ভালোবাসার মানুষের মুখ থেকে এমন কথা শুনলে কষ্ট হয় না বলুন! মাঝে মাঝে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবি। আমি কি সত্যিই এতোটা কুৎসিত? আমি অসুন্দর হলে কি পাড়ার ছেলেরা আমার পিছে ঘুরঘুর করতো! অসুন্দর হলে এতো এতো প্রপোজাল কেনো পাই! মুনতাজির ভাই বাদে সবাই বলে আমি সুন্দর। সবাই আমার বড়ো বড়ো টানা টানা চোখ আর কোমড় ছাড়ানো ঝরঝরে চুলের প্রশংসা করে। এগুলো কি মানুষটা দেখতে পায় না? আমার মুখে নাকি আল্লাহ তায়ালা অনেক মায়া দিয়েছেন। তাহলে সেই মায়া মুনতাজির ভাইকে কেনো ছুঁতে পারে না?
মাঝে মাঝে রাগ করে মনে মনে বলি যাহ বেয়াদব। বাসলাম না তোকে ভালো। কিন্তু হায়রে মন! মন কি আর কথা শুনে। ঘরে এসে বিছানায় মুখ গুঁজে সেই অসভ্যটার জন্যেই চোখের পানি ফেলি।
-কেনো এতো কষ্ট দেন মুনতাজির ভাই। আপনি কি কিছুই বুঝেন না?
মুনতাজির ভাই এপর্যন্ত আমাকে কতোভাবে যে কষ্ট দিয়েছে; তার ইয়ত্তা নেই। কিছু কিছু সময় তো অতিরিক্ত করে ফেলেন। চুল মেয়েদের খুব শখের। চুলেই মেয়েদের অর্ধেক সৌন্দর্য। আমার চুল মাশাল্লাহ অনেক লম্বা, ঘন আর সুন্দরও বটে। চুল নিয়ে দূর্বলতা আমারও আছে। লম্বা, ঘন চুল সামলানো প্যারাদায়ক হলেও; শখ। আর শখের দাম ষোলআনা। বেশিরভাগ সময় বেণি করে রাখতাম। সেই বেণি ধরে টান দেওয়া মুনতাজির ভাইয়ের অভ্যাস। আগে বিরক্ত হলেও পরবর্তীতে তিনি বেণি ধরে টান দিলেই একরাশ লজ্জা এসে ভর করতো আমার মাঝে। মনে হতো এই বুঝি আমার হৃদপিন্ড লাফিয়ে বের হয়ে এলো।
একদিন ভেজা চুল ছেড়ে ছাঁদের রেলিং-এ বসে আচার খাচ্ছিলাম। আমার সাথে নিভাপু আর জিনিয়াও ছিল। কোত্থেকে নিষ্ঠুরটা এসে কথা নেই বার্তা নেই, কেঁচি দিয়ে ঘ্যাচ করে একমুঠ চুল কেটে দিলো। কাঁটা চুল নিয়ে সেদিন পাগলের মতো কেঁদেছিলাম। অথচ পাষাণটা এসে একটাবার সরিও বলে নি। ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম সেদিন ভীষণ।
তবুও তার প্রতি আমার ভালোবাসা কমে নি। জানি না কখন কিভাবে তার প্রতি অনুভূতি জন্মেছে। ওই যে বলে না, ভালোবাসতে কোনো কারণ প্রয়োজন হয় না। আমিও মানুষটাকে অকারণেই ভালোবেসেছি। কোনো প্রতিদানের আশায় ভালোবাসি নি ঠিকই। তবে চেয়েছি সেও আমায় ভালোবাসুক। ভালো না বাসতে পারুক অন্তত আমাকে সম্মান করুক। ভালোবাসার বিনিময়ে তার কাছে অসম্মান আমার কখনোই প্রাপ্য নয়।
কিন্তু মানুষটা আমাকে তাইই দিয়েছে। প্রেমের এক নির্মম অবশ্যম্ভাবী নিয়ম আছে। যাকে ভালোবাসা হয় তার কাছ থেকেই সবচেয়ে বেশি দুঃখ পাওয়া হয়। আর আমার ভালোবাসা তো ছিল একতরফা। আমাকে তো পেতেই হতো।
একদিন বাসায় তার কিছু বন্ধু আসে। আমি জানতাম না। কাউকে দেখি নি। মা মরিচ আনতে বলায় আন্টির কাছে গিয়েছিলাম মরিচ আনতে। টানা বেলকনি। বেলকনি দিয়েই তাদের কিচেনে যাওয়া যায়। কিছুক্ষণ পর শুনতে পেলাম আন্টির সাথে তর্কাতর্কি করছে। কেনো আমি যখন তখন তাদের বাসায় যাই। ভাড়াটিয়া ভাড়াটিয়ার মতো কেনো থাকি না। সৌভাগ্য বলবো না দূর্ভাগ্য বলবো জানি না। গ্যাস না থাকায় সেদিন মা বাসার পিছনের মাটির চুলায় রান্না করছিলো। শুনলে কি হতো জানি না। মুনতাজির ভাইয়ের কাছ থেকে অপমান-অবহেলা, কষ্ট অনেক পেয়েছি। কিন্তু সেদিনের কষ্টের পরিমাণ যেনো একটু বেশিই ছিলো। ভাড়াটিয়া! তিনি একটু অহংকারী জানতাম। তার সবকিছু আমার নখ দর্পনে হলেও তার দাম্ভিকতা এই পর্যায়ের জানা ছিলো না। আমরা তার কাছে কেবল ভাড়াটিয়া সেদিনই প্রথম জানলাম। ভাড়াটিয়া বলেই এমন ব্যবহার; সেই কারণ সেদিনই উদ্ধার করলাম। আর এইরকম একটা শিক্ষা আমার পাওনা ছিলো।
তার সব ভালো খারাপ মেনে নিয়েই তাকে ভালো বেসেছিলাম। তার এতো এতো খারাপ ব্যবহারে আমি কষ্ট তো অনেক পেয়েছি। কিন্তু শিক্ষা হয় নি। এবার হয়েছে। আমার লজ্জা-আত্মসম্মানবোধ কম ছিলো বোধহয়। বোধহয় না। সত্যিই কম ছিলো। নাহলে এতকিছু হতোই না। একতরফা ভালোবাসা ধীরে ধীরে আত্মসম্মান কেঁড়ে নেয়। বলা হয় ভালোবাসা কখনো শেষ হয় না। কিন্তু তার অবহেলা আমার ভালোবাসাকে ধীরে ধীরে মেরে ফেলেছে। তার অপমান, অবহেলার ঝড় আমার ভালোবাসার ছোট্ট নৌকাটা একেবারে ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে।
ওই ঘটনার পর থেকে নিজেকে একেবারে গুটিয়ে নিলাম। চুপচাপ স্বভাবের হওয়ায় কেউ আমলে নেয় নি। মুনতাজির ভাইকে নিয়ে আমার সমস্ত জল্পনা-কল্পনাও নিজের মাঝেই ছিলো। তাই কেউ কিচ্ছুটি বুঝতেও পারে নি। মুখচোরা, আহ্লাদি, ভীতু হওয়ার পাশাপাশি আমি বড্ডো অভিমানী।
সেই ঘটনার পর অনেকদিন চলে গেছে। মুনতাজির ভাই আর আমি দুই মেরুর মানুষ। ভুলে কখনো কাছাকাছি এলেও এক হওয়া অসম্ভব। ভবিতব্য আমি মেনে নিয়েছি। পড়ার অযুহাতে ওদের বাসায় যাওয়া একেবারেই কমিয়ে দিয়েছি। জিনিয়ার সাথেও আগ বাড়িয়ে মিশতে যেতাম না। তবে ওকে কিছু বুঝতে দিতেও নারাজ ছিলাম। আপাত দৃষ্টিতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও। আমার আমিটা সেদিনের পর থেকে স্বাভাবিক রইলাম না। সেই আমার আমিটাকে হয়তো আরও গুঁড়ো করা বাকি ছিলো তার।
সেদিন মুনতাজির ভাইয়ের জন্মদিন ছিলো। ততদিনে আমরা মুনতাজির ভাইদের ভাড়াটিয়া থেকে প্রতিবেশী হয়ে গেছি। বাবা বিদেশ থেকে একেবারের জন্য চলে এসেছে। বাবা ফিরে আসার পর আমাদের নিজস্ব বাড়ি হয়েছে। এখন মুনতাজির ভাইয়ের ঠিক পাশের বাড়িটাই আমাদের। আমার। মাঝে মাঝে বাবার সাথে একতলা ছাঁদে গিয়ে যখন সদ্য কাঁচা দালানে পানি দিতাম; নিজের ভিতরেই পৈশাচিক এক আনন্দ অনুভব করতাম। আর ছাঁদে যেদিন মুনতাজির ভাইকে দেখতাম সেদিন তো কথাই নেই। এখন আর আমরা তাদের ভাড়াটিয়া নই।
তো সেদিন জন্মদিন ছিলো তার। আগের আমি হলে লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে তাকে একনজর দেখার জন্য, একবার উইশ করার জন্য ভিতরে ভিতরে ছটফট করতাম। হাজারটা অযুহাত দাঁড় করাতাম। তবে ওই যে ভবিতব্য আমি মেনে নিয়েছি। ততদিনে নিজের আবেগকেও কন্ট্রোল করা শিখে গেছি। তাই তাকে না দেখেও দিনের পর দিন থাকতে পারতাম। জন্মদিনের দিন নিভাপু, জিনিয়া, তার সব বন্ধু-বান্ধবীরা মিলে ছাঁদে তারজন্য সারপ্রাইজ প্ল্যান করে। ওরা দুবোন জোর করে আমাকেও নিয়ে যায়। অনেকদিন পর আমাদের সামনাসামনি দেখা হয়। আমাকে দেখে কেনো জানি কিছুক্ষণ শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন। অনেকদিন পর দেখেছে বলেই হয়তো। মনে মনে নিশ্চয় আমাকে অপমান করার পায়তারা করছে। সবশেষে সবাই যখন গিফট খুলে দেখছিলো তখন মুনতাজির ভাই টিটকারী দিয়ে বলে বসে,
– কিরে ছকিনা ফ্রী ফ্রী খেতে এসেছিস। এখন তো খুব বড়লোক হয়ে গেছিস। কিপ্টেমি করে করে রাজপ্রাসাদ তৈরি করে ফেলেছিস। এবার তো থাম।
– মুন একদম বাজে কথা বলবি না। জন্মদিনে কানমলা খাস না।
নিভাপুর কথা তিনি হেসেই উড়িয়ে দিলেন। রাগে আমার শরীর কিড়মিড়িয়ে উঠলো। সবার সামনে এভাবে বলায় কষ্টও পেলাম। শখ করে মায়ের থেকে হাতের কাজ শিখেছিলাম। মায়ের অগোচরে একটু একটু করে যত্ন করে পাঞ্জাবিতে হাতের কাজ করেছিলাম। তার জন্মদিনেই দিবো বলে। পাঞ্জাবিটা নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু এই কথার পর তা দিলে সস্তা বলে অপমান করবে বলে দেওয়ার সাহস হচ্ছে না। সবার দামী দামী গিফটের ভীরে আমার এতো যত্ন ভালোবাসার জিনিসের মূল্য এই নাকউঁচু মানুষ কোনদিনই দিবে না। একবার ভাবলাম থাক দিবো না। কিন্তু ওই যে সুখে থাকতে ভূতে কিলাচ্ছিলো। তাই দিয়ে দিলাম। সবার নজর তখন আমার গিফটের উপর। নিভাপু অতি উৎসাহী হয়ে পেপারে মোড়ানো গিফট খুলতেই আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। এক্ষুণি নিশ্চয়ই গা জ্বালানো কথা বলে আমাকে জ্বালিয়ে ছাড়খাড় করে দিবে। কিন্তু সবার প্রশংসা শুনে জানে পানি আসে।
কিন্তু মানুষটা যে নিষ্ঠুর, অহংকারী, শুধু ভালোবাসারই অযোগ্য নয় মানুষ হিসেবেও কুৎসিত। সেদিন তারও প্রমাণ দিলো।
-সত্যিই দারুণ হয়েছে। মোড়ের মাথার পাগলা মামার গায়ে দারুণ মানাবে। এগুলো কি আর আমাকে মানায়?
-সত্যিই মুনতাজির ভাই মানায় না। কারো যত্নে গড়া জিনিস আপনার মতো কুৎসিত মানুষের গায়ে মানায় না।
সেদিন প্রথমবারের মতো তার অপমানের এটুকু জবাব দিয়েছিলাম। কতোই আর চুপ থাকা যায় বলুন তো! আর পারি নি। আমার কিশোরী বয়সের আবেগ কিংবা ভালোবাসা যাই বলুন। আমার এতোগুলো বছরের আবেগ-ভালোবাসার এতো নির্মম হত্যা আর মেনে নিতে পারি নি। দরজা বন্ধ করে সেদিন নিরবে কেঁদেছি। পাশাপাশি আমার মনের দরজাও তার জন্য চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দিয়েছি।
চলবে।