চড়ুই নীড়ে বসবাস পর্ব-১০ এবং শেষ পর্ব

0
334

#চড়ুই_নীড়ে_বসবাস
#আলো_রহমান(ফারজানা আলো)
#শেষ_পর্ব
.
আজ বিন্তুর গায়ে হলুদ। গোটা বাড়ি সেজেছে লাল নীল বাতিতে। সন্ধ্যা হলেই বাতিগুলো জ্বালানো হবে। উঠোনের মাঝে একটা স্টেজের মতো সাজানো হয়েছে। তার চারদিকে ফুল লাগানো হয়েছে স্বয়ং শর্মিলির তদারকিতে। পুরো উঠোনে তিরপল দিয়ে সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে। হুট করে বৃষ্টি এলে যাতে কোনো বিপদ না হয়। অমিত কোথা থেকে যেন একটা ক্যামেরা এনেছে। সেটা দিয়ে দুপুর থেকেই ছবি তুলতে আরম্ভ করেছে সে। শিরিন ব্যস্ত বিন্তুর পোশাক আর অলংকার গোছানোর কাজে। ফুলের গহনা আনতে একজনকে পাঠানো হয়েছিল। সেগুলো এখনো এসে পৌঁছায় নি। শিরিন চোখমুখ কুঁচকে উঠোনে গেল। কতগুলো বাচ্চা ছোটাছুটি করছে চারদিকে। শিরিন চারপাশে চোখ বুলালো। অমিতকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। সে ধীরে ধীরে রান্নাঘরের দিকে গেল। অন্তু একটা ফুলের মালা নিয়ে দৌড়ে দোতলায় উঠছিল। শিরিন খপ করে ওকে ধরে বলল,
“এই অন্তু। তোর অমিত ভাইকে দেখেছিস?”
অন্তু অনাগ্রহ নিয়ে উত্তর দিলো,
“আমি কি জানি? রান্নাঘরে গিয়ে দেখো।”
“ও রান্নাঘরে কি করছে?”
“আমি জানি না। তুমি গিয়ে দেখো, আপা। আমি নিজের জন্য ফুলের গয়না বানাচ্ছি।”
অন্তু কথা শেষ করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। শিরিন বিরক্ত হলো। বিয়ের কনের গয়না এখনো আসে নি, সে নিয়ে কারোর মাথাব্যথা নেই। আর এদিকে সবাই ব্যস্ত নিজেদের সাজগোজ নিয়ে। যত্তসব! শিরিন রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকলো। সেখানে এখন পুরি ভাজা হচ্ছে। সায়লা আর শর্মিলি দুজনেই সেখানে আছেন। শর্মিলি চেঁচিয়ে বলছেন, “মিষ্টি কোথায়? এখনো মিষ্টি কেন আসে নি? কে গেছে মিষ্টি আনতে?”
রান্নাঘরের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে অমিত। শুধু শুধু দাঁড়িয়ে নেই, ছবি তুলছে। তার হাতে ক্যামেরা। শিরিনের বিরক্তি দ্বিগুণ হলো। সে কপাল কুঁচকে সেদিকে এগিয়ে গেল। অমিতকে নিচু আওয়াজে বলল,
“বাইরে এসো।”
তারপর অমিতকে এক প্রকার টেনেই নিয়ে এলো বাইরে। অমিত উৎসাহ নিয়ে বলল,
“কী সুন্দর সুন্দর ছবি যে তুলেছি, শিরিন! তুমি ভাবতে পারবে না।”
শিরিন ধমকের সুরে বলল,
“চুপ করো। আছাড় মেরে তোমার ক্যামেরা ভেঙে ফেলবো আমি। যত্তসব! বিয়েবাড়িতে এত কাজ! আর তুমি পরে আছ ছবি তোলা নিয়ে। কবে আক্কেল হবে তোমার? এরকম করলে বাবা কখনো তোমাকে ভরসা করবেন?”
অমিত থতমত খেয়ে বলল,
“রাগ করছো কেন? ভুলটা কি করেছি?”
শিরিন চোখ বুজে বড় করে শ্বাস নিলো। যথাসম্ভব নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলল,
“বিন্তুর জন্য যে ফুলের গয়নাগুলো অর্ডার করা হয়েছিল, সেগুলো এখনো আসে নি। তুমি কি দোকানটা চেনো?”
অমিত হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বলল,
“হু। আনবো?”
“হ্যাঁ, দ্রুত যাও। আধঘন্টার মধ্যে ফিরবে।”
অমিত হেসে বলল,
“কোনো চিন্তা করো না। আমি এই যাব, আর এই আসবো।”
অমিত বেরিয়ে গেল। শিরিন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সকাল থেকে রুনিকে কোথাও দেখে নি শিরিন। সে ঘরে একা একা বসে আছে। বলে দিয়েছে যাতে তার ঘরে কেউ না যায়। শিরিনের কপালে চিন্তার ভাঁজ পরলো। গতকাল রাতে বিন্তুর ব্যাপারে আপাকে সবটা জানানো কি ভুল হয়েছে? কি চলছে রুনির মনে? কি করতে চাইছে ও?
________________________________
বিন্তু ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। আজ বৃষ্টি নেই, আকাশে মেঘও নেই। আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। সূর্য প্রায় ডুবুডুবু। একটু পরেই তাকে সাজানো হবে। যদিও তার সাজার ইচ্ছা নেই। তার খুব ইচ্ছা করছে ছাদে আরাম করে বসে এক কাপ চা খেতে। কিন্তু এখন চা পাওয়া সম্ভব নয়। রান্নাঘরে ভীষণ ব্যস্ততা। অবশ্য চাইলে দোতলায় মামীর রান্নাঘরে ঢুকে এক কাপ চা বানিয়ে নেওয়া যায়। আজকের দিনে মামী নিশ্চয়ই তাকে বকবে না। বিন্তু একবার ভাবলো, যাবে। পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত বদল করলো। তার চা বানিয়ে নিতে ইচ্ছা করছে না। বিন্তু ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে ছাদের একপাশে গিয়ে পা ছড়িয়ে বসলো। হুট করেই ছাদের দরজা খোলার শব্দ হলো। দরজা দিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকলো বর্ণিল। বিন্তু হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বর্ণিলের চোখমুখ বিধ্বস্ত। সে ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে গেল বিন্তুর দিকে। কাতর গলায় বলল,
“আমার সাথে একটু কথা বল, বিন্তু। শুধু দুটো মিনিট।”
বিন্তু শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বর্ণিলের চোখেমুখে আকুলতা। বিন্তু শীতল গলায় প্রশ্ন করলো,
“কিসের কথা? আর তুই এখানে কেন? তোকে কে বলল আমি ছাদে?”
বর্ণিল তাড়াহুড়ো করে উত্তর দিলো,
“কে বলবে? তুই জানিস না আমার ঘর থেকে এই বাড়ির ছাদ স্পষ্ট দেখা যায়? তোকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি ছুটে এসেছি, বিন্তু।”
বিন্তু তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। বিদ্রূপ করে বলল,
“হঠাৎ ছুটে আসতে হলো কেন?”
বর্ণিল ব্যথিত গলায় বলল,
“বিন্তু, তুই আমাকে ক্ষমা করে দে। আমি নিজের ভুলগুলো বুঝতে পেরেছি।”
বিন্তু নির্লিপ্তভাবে জবাব দিলো,
“ক্ষমা করেছি। এবার তুই আসতে পারিস।”
বর্ণিল দিশেহারা বোধ করলো। বিন্তুর নির্লিপ্ততা তাকে আঘাত করলো। সে নিঃশব্দে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরে ধীরে ধীরে বলল,
“বিন্তু, এই বিয়েটা ভেঙে দে। আমি নিজে তোর বাড়ির সবার সাথে কথা বলবো। আমার মা আমাকে আর আটকাতে পারবে না। আমি তোকে এখনো ভালোবাসি।”
আচমকা এমন কথায় বিন্তু বুকের ভেতর কেমন একটা চাপ অনুভব করলো। এক মুহুর্ত অপলক তাকিয়ে রইলো বর্ণিলের দিকে। তারপরই অট্টহাসিতে ফেটে পরলো। বর্ণিল কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বিন্তুর হাসি থামছে না। বিন্তুর হাসির শব্দ যতই কানে আসছে, ততই বর্ণিলের চোখে জল জমছে। সে অস্ফুটে বলল,
“প্লিজ! থাম!”
বিন্তু কোনোমতে হাসি থামালো। তারপর কঠিন গলায় বলল,
“আমি তোকে ঘৃণা করি, বর্ণ। প্রচন্ড ঘৃণা করি। তুই এই মুহূর্তে আমার সামনে থেকে চলে যা। আর কখনো নিজের মুখ আমাকে দেখাবি না।”
বর্ণিল হতবিহ্বল হয়ে বলল,
“ক্ষমা কর, বিন্তু। ক্ষমা কর। আমি ভুল শুধরে নিতে চাই। আর একটা সুযোগ দে আমাকে। একটা সুযোগ! প্লিজ!”
বিন্তু কাঠ কাঠ গলায় বলল,
“লালন শাহ্ এর একটা কথা আছে না? সময় গেলে সাধন হয় না। সত্যিই হয় না, বর্ণ। কিসের সুযোগ চাইছিস তুই? সুযোগ পেলে কি তুই আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দিতে পারবি? সুযোগ চাইতে লজ্জা করছে না তোর?”
বর্ণিল মাথা নিচু করে ফেললো। মৃদু গলায় বলল,
“করছে, বিন্তু, খুব লজ্জা করছে। কিন্তু…. কিন্তু আর উপায় নেই আমার। আমি কিছুতেই তোর এই বিয়ে মানতে পারবো না। তোকে যে আমি বিয়ে করেছিলাম!”
বিন্তু তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। বলল,
“তালাকও দিয়েছিস।”
বর্ণিলের মনে হলো অপমান আর লজ্জায় তার মাথাটা কাটা পরেছে। সে আহত গলায় বলল,
“আমি মাকে ভয় পেতাম, বিন্তু। আমি….আমি তখন চেয়েও পারি নি….।”
বর্ণিল কথা শেষ করতে পারলো না। সে কেঁদে ফেলেছে। বিন্তু বিরক্ত গলায় বলল,
“প্লিজ! তোর এসব কান্নাকাটির নাটক আমার ভালো লাগছে না। তোরা মা ছেলে কি চাস? আমার জীবনটা একেবারে শেষ করে দিতে? আমি বিয়ে করছি, নতুন করে জীবন গোছাতে চলেছি, সেটা সহ্য হচ্ছে না, এই তো?”
বর্ণিল কান্নাভেজা গলায় বলল,
“তেমনটা নয়, বিশ্বাস কর। আমি……।”
তার কথা শেষ হতে দিলো না বিন্তু। তার আগেই অস্ফুটে বলল, “উফ! অসহ্য!” তারপর হনহন করে বর্ণিলকে পাশ কাটিয়ে ছাদ থেকে নেমে গেল সে। বর্ণিল মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো ছাদের কোণায়। তার দৃষ্টিতে শূন্যতা, চোখেমুখে ক্লান্তি, পুরো শরীরে ব্যর্থতার ভার। চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো বর্ণিল। তার দৃষ্টিসীমা জুড়ে শুধুই শূন্যতার অস্তিত্ব।
_______________________________________
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। রুনি ঘর অন্ধকার করে বসে আছে। বাইরে রঙিন বাতি জ্বলছে। নানা রঙের আলো জানালা দিয়ে তার ঘরে ঢুকছে। সে মনে মনে পরিকল্পনা করছে বিন্তুকে এই বিয়ে থেকে বাঁচানোর। বিন্তুকে কি সাজাতে শুরু করা হয়েছে? তার একবার নিচে যাওয়া উচিত। রুনি চোখ বন্ধ করে ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললো। তার বড় ক্লান্ত লাগছে। ঝনাৎ করে দরজা খোলার আওয়াজ হলো। রুনি চোখ খুলে তাকালো। বাইরে থেকে আসা রঙিন আলোয় বিন্তুকে চেনা যাচ্ছে। বিন্তু ছোট ছোট পা ফেলে পুতুলের মতো হেঁটে রুনির সামনে গিয়ে বসলো। বিন্তুকে সাজানো হয়েছে। ওর গায়ে হলুদ রঙের শাড়ি, শাড়িতে বেগুনি রঙের পাড়। গা ভর্তি গোলাপ ফুলের গয়না। রুনি মৃদু হাসলো। বিন্তুর গালে হাত রেখে বলল,
“খুব সুন্দর লাগছে রে তোকে, বিন্তু।”
বিন্তু মুচকি হাসলো। জানতে চাইলো,
“ঘর অন্ধকার করে বসে আছ কেন, বড় আপা?”
“এমনি রে। মাথাটা ধরেছে তো। তাই।”
বিন্তু এবারে রুনির হাত চেপে ধরলো। আবদারের সুরে বলল,
“নিচে চলো, আপা। সকাল থেকে ঘরে বসে আছ। আমার গায়ে হলুদে থাকবে না? এসো না!”
রুনি শান্ত হয়ে বসে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর বিন্তুর দিকে আরও কিছুটা এগিয়ে এলো। শীতল গলায় বলল,
“পালিয়ে যা, বিন্তু।”
বিন্তু স্তব্ধ হয়ে গেল। কথা বলতে পারলো না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো রুনির মুখের দিকে। রুনি অস্থিরতা নিয়ে বলল,
“হা করে চেয়ে থাকিস না। তুই তো বলেছিলি, এই লোকটাকে দেখলেই তোর দম বন্ধ হয়ে আসে। কি করে সংসার করবি? বিন্তু, সারাজীবনের জন্য এই কষ্টটা তুই মাথা পেতে নিস না, বোন। ওই বাড়ির লোকগুলোকে তো আমি দেখেছি। তোকে ওরা শান্তিতে থাকতে দেবে না। তুই চলে যা। আমি তো আছি। এদিকে সব সামলে নেবো।”
বিন্তু অস্ফুটে বলল,
“কোথায় যাব?”
“যেখানে খুশি যা। শুধু দুটো দিন কাটিয়ে আয়। তারপর সব ঠিক করে দেবো আমি। আমার উপর ভরসা রাখ।”
বিন্তু নীরবে বসে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর মৃদু হেসে বলল,
“আমার ব্যাপারে সবকিছু তুমি শুনেছ, আপা?”
রুনি শক্ত গলায় বলল,
“হ্যাঁ, শুনেছি। তাতে কি হয়েছে? অতীতে কিছু ভুল হয়েছে তোর। সেজন্য কি এখন তোর পছন্দ অপছন্দ বলে কিছু থাকবে না? নিজের অপছন্দের একটা ছেলেকে বিয়ে করতে হবে? তোর কি ভালোভাবে বাঁচার অধিকার হারিয়ে গেছে?”
বিন্তু জানতে চাইলো,
“কার থেকে জেনেছ?”
রুনি ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে উত্তর দিলো,
“শিরিন বলেছে। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। তুই আমার কথা শোন। দেরি করিস না। কোনো বান্ধবীর বাসায় চলে যা। অথবা আমার বাড়িতে যা। আমি তোর দুলাভাইয়ের সাথে কথা বলে সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। যা, বিন্তু।”
বিন্তু নিচু গলায় বলল,
“মামাকে সবাই অপমান করবে, আপা।”
রুনি প্রায় চিৎকার করে বলল,
“বিন্তু! তুই কেন বুঝতে পারছিস না? তোর সারাজীবনের ব্যাপার! আর তোর হবু শ্বশুর বাড়ির লোকজন কি বাবাকে খুব সম্মান করে? তোকে বউ করে নিয়ে গিয়ে বাবাকে উদ্ধার করছে, এমন কথা তো সারাক্ষণই শুনিয়ে চলেছে।”
বিন্তু নিঃশব্দে হাসলো। বড় বোনের গায়ে হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বলল,
“তুমি কিছু ভুল বলছো না। কিন্তু আমার কথাটা একবার শোন তুমি।”
রুনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“বল তোর কথা।”
“আপা, দুই বছর আগে যখন সব জানাজানি হলো তখন বর্ণর মা খুব অপমান করেছিল মামাকে। মামা মামী আমার জন্য অনেক সয়েছেন। সেই ঘটনার পরেও আমাকে ফেলে দেন নি। বরং তারপরেও আমার জীবনটা গুছিয়ে দিতে চেয়েছেন। হ্যাঁ, হয়তো নিজের মতো করে চেয়েছেন। কিন্তু চেয়েছে তো, আপা! মামী তো আমার মাকেও কিছু জানতে দেন নি। এতকিছুর পরেও আমাকে যেদিন দেখতে আসার কথা, সেদিন আমি নির্বোধের মতো বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। মামাকে অপমানিত হতে হলো। যদি আজও আবার আমি এই বিয়েটা থেকে পালিয়ে যাই, তাহলে তো আবার মামা মামীর অসম্মান হবে। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, সবাই ছি ছি করবে। তাছাড়া এই সবকিছু আয়োজনে অনেক খরচাপাতি করেছেন মামা। আমি কি করে পালিয়ে যাই? এটা অকৃতজ্ঞতা হবে না, বড় আপা? তুমিই বলো।”
রুনি অপলক তাকিয়ে ছিল এতক্ষণ। তার চোখ হঠাৎ ঝাপসা হয়ে এলো। সে হুট করে বিন্তুকে বুকে টেনে নিয়ে বলল,
“তোর খুব ভালো হবে, বিন্তু। খুব ভালো হবে।”
বিন্তু ফিসফিস করে বলল,
“কাঁদিয়ে দিলে তো। আমার চোখের কাজল লেপ্টে গেল সব।”
রুনি হেসে ফেললো। মনে মনে প্রার্থনা বাক্য উচ্চারণ করলো। “হে আল্লাহ! এই মেয়েটাকে তুমি রক্ষা করো।”
হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন খায়রুল সাহেব। আচ্ছন্নের মতো বললেন,
“রুনি, ঘরে একটু আলো জ্বালিয়ে দে তো মা। আলো জ্বালিয়ে দে।”
রুনি তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়ালো। ঘরে আলো জ্বালিয়ে দিয়ে চিন্তিত মুখে বাবার দিকে তাকালো। খায়রুল সাহেব অস্থির হয়ে পায়চারি শুরু করলেন। বিরবির করে বলতে লাগলেন,
“বিন্তুও তো এখানেই আছে। মা রে, একটা ঘটনা ঘটে গেছে।”
রুনি এগিয়ে গেল। বাবার হাত ধরে বসিয়ে দিলো চেয়ারে। বলল,
“শান্ত হও, বাবা। কি হয়েছে? ঠান্ডা মাথায় বলো।”
খায়রুল সাহেব হতবিহ্বল হয়ে বললেন,
“মা, রুনি। যা, তোর ফুপু আর মাকে ডেকে আন। শিরিনকেও আসতে বল। যা, মা। জলদি যা।”
রুনি কিঞ্চিৎ ভয় পেলো। শীতল গলায় বলল,
“বাবা, কি হয়েছে?”
খায়রুল সাহেব ধমকের সুরে বললেন,
“আহ্! কেন কথা বাড়াচ্ছিস? যা বলছি কর, মা।”
রুনি দ্রুত বাইরে বেরিয়ে গেল। বিন্তু মূর্তির মতো বসে আছে। তার চোখেমুখে ভয়। খায়রুল সাহেব ভাগ্নির দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলেন। ভরসা দিয়ে বললেন,
“চিন্তা করিস না। আমি আছি।”
.
দশ মিনিটের মাথায় সবাই রুনির ঘরে একত্রিত হলো। অন্তুও ঘরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। ইতোমধ্যে বাইরে আত্মীয় স্বজনরা কানাকানি শুরু করেছে। অনুষ্ঠান বাড়িতে পরিবারের সবাই দরজা বন্ধ করে দিয়ে কি এমন কথা বলছে? সায়লা অস্থির হয়ে পড়েছেন। ভয়ে আর দুশ্চিন্তায় উনার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। শর্মিলি অধৈর্য হয়ে বললেন,
“থম মেরে কেন বসে আছ, রুনির বাবা? কেন ডেকেছ বলবে তো।”
খায়রুল সাহেব কথা বললেন না। পকেট থেকে নিজের মোবাইল ফোন বের করে সেটা স্ত্রীর দিকে এগিয়ে দিলেন। শর্মিলি ভ্রু কুঁচকে ফোনটা হাতে নিলেন। ফোনের স্ক্রিনে ছোট্ট একটা এসএমএস। সেখানে লেখা,
“খায়রুল সাহেব, আপনি আমাদের জানিয়েছেন আপনার ভাগ্নির আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। অল্প বয়সে ভুল করে একটা বিয়ে করেছে, তারপর আপনারা তাকে ফিরিয়ে এনেছেন। এসব আমরা মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি যে আপনাদের মেয়েটির আগের ঘরে দুই বছরের সংসার ছিল। সে সন্তান সম্ভবাও হয়েছিল। এতকিছু জানার পরে আমাদের ছেলের সাথে এরকম একটি মেয়ের বিয়ে দেওয়া আর সম্ভব নয়। আমরা এই বিয়েটা দিচ্ছি না। ক্ষমা করবেন।”
শর্মিলি থমথমে মুখে বললেন,
“সত্যিই কি ওদের বাড়ি থেকে এটা পাঠিয়েছে?”
খায়রুল সাহেব শান্ত গলায় বললেন,
“হ্যাঁ। এসএমএস পাওয়ার পরে আমি ফোন করেছিলাম ওদের বাড়িতে। একই কথাই বলা হয়েছে। কথাটা হাবিবের বড় চাচা নিজে বলেছেন।”
সায়লা অস্থির হয়ে বললেন,
“কি বলেছেন, ভাইজান? উনারা কি বলেছেন? কি পাঠিয়েছেন? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”
শর্মিলি শীতল গলায় বললেন,
“শান্ত হও, সায়লা। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায় নি। তোমার মেয়ের বিয়ে ভেঙে গেছে।”
সায়লা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। শর্মিলি এত সহজে কথাটা কি করে বলে ফেললো? রুনি মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। শর্মিলি ফোনটা সায়লার দিকে এগিয়ে দিলেন। একে একে সবাই এসএমএসটা পড়লো। সায়লা ধীরে ধীরে বিন্তুর দিকে এগিয়ে গেলেন। সজোরে বিন্তুর গালে চড় বসিয়ে দিলেন। চড়ের আঘাতে বিন্তুর চশমা ছিটকে দূরে গিয়ে পরলো। রুনি দ্রুত এগিয়ে গিয়ে বিন্তুকে নিজের কাছে টেনে নিলো। তাড়াহুড়ো করে বলল,
“ফুপু, ওকে তুমি মারবে না।”
সায়লা হিসহিসিয়ে বললেন,
“মারবো না! মারবো না তো কি করবো? এসব কি লিখেছে ওরা? কি করে এসেছে ও?”
বিন্তুর চোখে পানি এসে গেছে। সায়লা মুখে আঁচল দিয়ে কাঁদছেন। খায়রুল সাহেব ঠান্ডা গলায় বললেন,
“এসব কিছু তো কেউই জানতো না, রুনির মা। উনাদের কে জানালো এসব?”
শর্মিলি ক্লান্ত গলায় বললেন,
“বলেছে কেউ না কেউ। সেটা জেনে আর কি হবে?”
শিরিন বলে উঠলো,
“আমরা ছাড়া বর্ণিল আর ওর মা বাবা জানে। ওরাই হয়তো বলেছে। বিন্তুর বিয়ে হোক, সেটা হয়তো চায় নি। বিন্তুর ভালো সহ্য হয় নি ওদের।”
শর্মিলি অস্বাভাবিক শান্ত আছেন। চেঁচামেচি করছেন না, রাগও করছেন না। উনি শান্তভাবেই বললেন,
“বিন্তুর খারাপের জন্যই কেউ করেছে, এমন কেন ভাবছিস, শিরিন? ওর ভালোর জন্যও তো কেউ করতে পারে।”
শিরিন ভ্রু কুঁচকালো। সায়লা আঁতকে উঠে বললেন,
“বর্ণিল! মানে কি? আমি বুঝতে পারছি না। কেউ আমাকে কিছু বলছো না কেন?”
শিরিন এগিয়ে এসে ফুপুর হাত ধরলো। কোমল গলায় বলল,
“ফুপু, তুমি শান্ত হও। আমি বুঝিয়ে বলবো।”
শর্মিলি পাশের চেয়ারে বসলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“হ্যাঁ, সায়লা। শান্ত হও। যা হয়েছে ভালো হয়েছে। ওদের বাড়ির লোকজন আমারও পছন্দ ছিল না।”
সায়লা উতলে আসা কান্নাটাকে কোনোমতে চাপা দিয়ে বললেন,
“লোকজন আজেবাজে কথা বলবে, ভাবি। বাড়ি ভর্তি আত্মীয় স্বজন! আমার মেয়েটার আর বিয়ে হবে না।”
রুনি এগিয়ে গেল। বাবার হাত ধরে বলল,
“বাবা, সবাইকে আমি সামলাবো। কেউ কোনো বাজে কথা বলবে না। তুমি আমার সাথে এসো। মা, তুমিও এসো।”
শর্মিলি মাথা নাড়িয়ে বললেন,
“তোরা যা। আমি আসছি।”
রুনি বাবাকে নিয়ে এগিয়ে গেল। শর্মিলি বিন্তুর কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন,
“মন খারাপ করিস না, বিন্তু। শোক পালন করার মতো কিছু হয় নি। আল্লাহ যা করেছেন, ভালো করেছেন। তুই খুশি থাক। চাইলে বাইরে থেকে বেড়িয়ে আয়।”
বিন্তু থতমত খেয়ে বলল,
“বাইরে যাব?”
“চাইলে যাবি। কিন্তু জলদি ফিরে আসবি।”
ভেজা চোখেও বিন্তুর মুখে হাসি ফুটলো। সে মামীকে খপ করে জড়িয়ে ধরলো। আনন্দিত হয়ে বলল,
“থ্যাংক ইউ, মামী। তুমি আমাকে বাঁচালে!”
শর্মিলি বিরক্তি দেখিয়ে বললেন,
“ঢং করবি না তো। একদম জড়িয়ে ধরে আহ্লাদ করবি না, বিন্তু। যা তো, যা।”
বিন্তু হেসে ফেললো। চোখ মুছে সে ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেল। অন্তু পিছনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে,
“আপা, দাঁড়াও। আমাকে নিয়ে যাও।”
বিন্তু কথাটা শুনতে পেলো কিনা বোঝা গেল না। সে কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখের আড়াল হয়ে গেল। সায়লা অস্ফুটে বললেন,
“ও যে সত্যি চলে গেল রে, শিরিন!”
শিরিন হেসে বলল,
“যেতে দাও, ফুপু। তোমাকে আমি সব বুঝিয়ে বলছি। কিন্তু তুমি ওকে বকতে পারবে না। এমনিতেই মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছে। এসো, তুমি বসবে এসো।”
.
বিন্তু যখন উঠোন পেরিয়ে বেরিয়ে গেল তখন উঠোনে দাঁড়িয়ে রুনি সবাইকে বলছে, ছেলের আচরণ ভালো নয় তাই বিয়েটা হচ্ছে না। বিয়ের আগেই ছেলের স্বভাব চরিত্র জানা গেছে, এ তো ভালো কথা। তাদের মেয়ের জীবনটা নষ্ট হলো না। এমন পরিবারে বিয়ে হওয়ার চেয়ে বিয়ে ভেঙে যাওয়াই তো ভালো। সকলেই রুনির কথায় সায় দিলো। রুনি হাসিমুখে সকলকে খেয়ে যেতে বলল। সব কথা বিন্তুর কানে আসে নি। সে দ্রুত পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। রাস্তায় বেরিয়েই সে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করলো। আকাশে স্পষ্ট চাঁদ। কেন সে ছুটছে, সে জানে না। কোথায় যেতে চায়, তাও জানে না। তার কেবলই মনে হচ্ছে তাকে ছুটে যেতে হবে। সে নদীর বাঁধ ধরে ডাকবাংলোর দিকে এগিয়ে চলেছে। মুক্তি! বহুদিন পরে যেন সে মুক্তি পেয়েছে! হঠাৎ কারোর সাথে সজোরে ধাক্কা লাগলো বিন্তুর। দ্রুতবেগে ছুটছিল বলে হঠাৎ ধাক্কায় সে পরে যাচ্ছিলো। কিন্তু পরে যাওয়ার আগেই কেউ তাকে ধরে ফেললো। বিন্তু হাঁপাতে হাঁপাতে চোখ তুলে তাকালো। চোখের পানিতে তার দৃষ্টি ঝাপসা। বিন্তু খেয়াল করলো তার চশমাও নেই। যে বলিষ্ঠ হাত জোড়া তার দুই বাহু ধরে ছিল, সেই হাতের অধিকারী এবার কথা বলল। বিস্মিত স্বরে বলল,
“বিন্তু! আপনি? আপনি এই সময় এখানে? আজ তো…আজ তো আপনার গায়ে হলুদ!”
কন্ঠস্বর কানে যেতেই বিন্তু তাকে চিনলো। এ গলা পল্লবের। তার মুখে হাসি ফুটলো। সে অস্ফুটে বলল, “পল্লব সাহেব! আপনি এসেছেন?” পল্লব মৃদু গলায় বলল, “হ্যাঁ। কিন্তু আপনি এখানে?” বিন্তু উত্তর দিলো না। অনুভূতির আতিশয্যে এক মুখ বিস্তৃত হাসি নিয়েই সে ডুকরে কেঁদে উঠলো। হুট করে পল্লবের বুক স্পর্শ করলো বিন্তুর কপাল। পল্লব তাকে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। চাঁদের আলোয় পৃথিবী ভেসে যেতে শুরু করলো।
.
#সমাপ্ত।
[কিছু মানুষের জীবন চড়ুই পাখির মতো। অন্যের বাড়িতে তাকে বাসা বাঁধতে হয়। সেই বাসা চিরস্থায়ী হয় না। ক্ষণে ক্ষণে তাকে বাসা বদলাতে হয়।]
________________________

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে