চড়ুই নীড়ে বসবাস পর্ব-০৯

0
196

#চড়ুই_নীড়ে_বসবাস
#আলো_রহমান(ফারজানা আলো)
#পর্ব:৯
.
রাত আটটার মতো বেজেছে। খায়রুল সাহেব দোতলার বৈঠকখানায় বসে আছেন। উনার হাতে কাগজ কলম। বিন্তুর বিয়েতে কাকে কাকে দাওয়াত দেওয়া হবে, তার একটা তালিকা করা হচ্ছে। তালিকা ছোট রাখতে গিয়েও রাখা যাচ্ছে না। কাকে বলা হবে, কাকে বাদ দেওয়া হবে, সব মিলিয়ে দারুণ বিভ্রান্তি। শিরিন বাবার পাশে বসে আছে। সে বুঝতে পারছে না এক সপ্তাহে কিভাবে আয়োজন করা সম্ভব হবে। সে এ পর্যন্ত এগারোটা নাম্বারে ফোন করেছে। খায়রুল সাহেব আরও কিছু নাম লিখছেন। শিরিন অস্থির হয়ে বলল,
“বাবা! তাড়াতাড়ি করো। এরপর আরও অনেক কাজ আছে।”
খায়রুল সাহেব লেখা বন্ধ করলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আবার কি কাজ?”
শিরিন হতাশ ভঙ্গিতে বলল,
“কি কাজ মানে? বিয়েতে, গায়ে হলুদে খাবার কি কি হবে সেটা ঠিক করতে হবে তো। তারপর সেই অনুযায়ী বাজারের লিস্ট বানাতে হবে, বাবা।”
খায়রুল সাহেব হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললেন,
“হ্যাঁ, তাই তো! ভালো কথা মনে করেছিস। রান্নার জন্য বাবুর্চি আনতে হবে। আর কি কি করতে হবে, শিরিন? একটু বল তো।”
“বাড়িঘর সাজাতে হবে, বাবা। সেই আয়োজন আছে। তারপর বিয়ের কেনাকাটাও তো করতে হবে।”
খায়রুল সাহেবের কপালে চিন্তার ভাঁজ পরলো। উনি মৃদু গলায় বললেন,
“একা একা কি করে সব করবো বল তো?”
শিরিন ইতস্তত করে বলল,
“ইয়ে…একা করবে কেন, বাবা? কিছু কাজের দায়িত্ব অমিতকে দিয়ে দাও না। না মানে, তুমি যদি ঠিক মনে করো…। তাছাড়া আমি আর বড় আপা আছি তো সাহায্য করার জন্য।”
খায়রুল সাহেব গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন। তারপর চিন্তিত গলায় বললেন,
“খারাপ বলিস নি। শিরিন, যা তো মা। আমার জন্য এক কাপ চা পাঠিয়ে দে। আর তারপর একটু সায়লাকে ডেকে দে।”
শিরিন ভ্রু কুঁচকে বলল,
“এখন ফুপুকে কেন ডাকবে? অন্তু আর বিন্তু বাইরে গেছে বলে কি তুমি ফুপুকে বকবে? বাবা, ওরা একটু পরেই ফিরে আসবে। তুমি রাগারাগি করো না।”
খায়রুল সাহেব মৃদু হাসলেন। চশমা খুলে হাতে নিয়ে ব্যথিত গলায় বললেন,
“তোর কি ধারণা রে? আমি সবসময় শুধু বকাবকি করি? সায়লার শ্বশুর বাড়ির কাউকে দাওয়াত দিতে হবে কিনা, জানতে হবে তো। যা, মা, তোর ফুপুকে ডেকে দে।”
শিরিন অপরাধীর ভঙ্গিতে বলল,
“সরি, বাবা। চিন্তা করছিলাম বেশি, সেজন্য বলে ফেলেছি। আমি চা পাঠিয়ে দিচ্ছি। ফুপুকেও বলছি।”
শিরিন বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। খায়রুল সাহেব পুনরায় চোখে চশমা পরলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কপালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করলেন। উনি শিরিনকে বলতে চেয়েছিলেন চা নিয়ে রুনিকে পাঠিয়ে দিতে। বলতে পারেন নি। কোথায় যেন একটা সংকোচ! কিন্তু বড় কন্যার সাথে কিছু কথাবার্তা বলতে উনি ভেতরে ভেতরে ঠিকই ছটফট করছেন। আর পাঁচটা সাধারণ বাবার মতো উনারও ইচ্ছা করছে মেয়ে, জামাই, নাতনি, সবাইকে একসাথে বাড়িতে আনতে। বাড়িতে একটা উৎসব হতে চলেছে। অথচ একমাত্র নাতনি সেখানে নেই। নাতনিকে এ জীবনে কোলে পর্যন্ত নেওয়া হলো না। কোনোকিছুই কি আর স্বাভাবিক হবে না?
দরজায় টোকা পরলো। ঠকঠক শব্দে খায়রুল সাহেবের চিন্তা ভঙ্গ হলো। উনি মাথা তুলে তাকালেন। রুনি এসেছে। তার হাতে এক কাপ চা। খায়রুল সাহেব ভীষণ খুশি হলেন। মুখে হাসি টেনে বললেন,
“আয়, মা। ভেতরে আয়।”
রুনি ভেতরে গেল। টেবিলে চায়ের কাপ রেখে হাসিমুখে বলল,
“কি এত চিন্তা করছো, বাবা?”
খায়রুল সাহেব হেসে উত্তর দিলেন,
“বাড়িতে বিয়ে। চিন্তা কি আর একটা রে, মা?”
“তুমি একটুও বদলাও নি, বাবা। টেনশনের সময় চা খেয়ে সেটা কমাতে চাইছো। কিন্তু এই অসময় চা খাওয়া কি ভালো? বয়স হয়েছে তোমার।”
খায়রুল সাহেব হাসলেন। চায়ে চুমুক দিয়ে মলিন গলায় বললেন,
“ঠিকই বলেছিস। বয়স হয়েছে। এই বয়সে এসে আর মান অভিমানের ধাক্কাটা নিতে পারি না রে, মা। বুড়ো বাপের উপর আর তুই রাগ করে থাকিস না। তোর খারাপ আমি কখনো চাই নি। তুই কি সেটা বিশ্বাস করিস না?”
রুনি মলিন গলায় উত্তর দিলো,
“ভালো খারাপ আপেক্ষিক ব্যাপার, বাবা। তোমাদের যা খারাপ মনে হয়েছিল, সেটা আমার জন্য ভালোও হতে পারতো। আমার তোমার প্রতি অভিযোগ নেই, বাবা। যার সাথে বিয়ে দিয়েছ, সে ভালো মানুষ। আমাকে সম্মান করে। সম্মান করে বলেই এত বছর ধরে তোমাদের সাথে যোগাযোগ না রাখার সিদ্ধান্তকে সে সম্মান করেছে। আমার মেয়ের জন্মের পরে যখন তোমরা হাসপাতালে গেলে তখন আমি তোমাদেরকে মেয়ের মুখ দেখতে দিলাম না। তখনো কিন্তু সে আমার পাশে থেকেছে। কোনো জোরজবরদস্তি করে নি। কিন্তু ওর জায়গায় যদি সেই ছেলেটা থাকতো যাকে আমি পছন্দ করেছিলাম, তাহলে কি হতো জানো? তাহলে সে নিজ দায়িত্বে তোমাদের সাথে আমার মনোমালিন্য মিটিয়ে দিতো। এটাই তফাত, বাবা। দুজনেই ভালো, কিন্তু দু’রকমভাবে।”
খায়রুল সাহেব কথা বললেন না। মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন এক দৃষ্টিতে। রুনি হালকা কেশে ভারী হয়ে আসা গলা পরিষ্কার করে নিলো। তারপর স্বাভাবিক গলায় বলল,
“তোমাদের জোর করে বিয়ে দেওয়াতে আমার হয়তো শেষ পর্যন্ত কোনো ক্ষতি হয় নি। এই বিয়ে হয়ে আমি সুখীই হয়েছি। কিন্তু ক্ষতি হয়েছে সেই মানুষটার যাকে আমি পছন্দ করেছিলাম, আশ্বাস দিয়েছিলাম। সে কোনো অপরাধ না করেই কষ্ট পেয়েছে। তোমাদের সিদ্ধান্তের কারণে সে বহুবছর এলোমেলো জীবনযাপন করেছে। আমি তাকে বিয়ে করলে সুখে থাকতাম, এখনো সুখেই আছি। শুধু আমার জীবন থেকে একটা মানুষ হারিয়ে গেছে। তোমরা মেনে নিলে, তাকে হারাতে হতো না। তার জীবনের কয়েকটা বছর অগোছালো কাটতো না। আমারও নতুন মানুষকে মেনে নিতে নিজের সাথে লড়াই করতে হতো না। আজ হয়তো সব শান্ত হয়ে গেছে, যে যার মতো ভালো আছি। কিন্তু একটা সময় যেই ঝড়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছি আমরা, সেটা আমাদের প্রাপ্য ছিল না। এইসবই তোমাদের প্রতি আমার অভিমানের কারণ। আর সবচেয়ে বড় কারণ, সেই সময় আমার সাথে তোমার আর মায়ের করা দুর্ব্যবহার যা আমি এখনো ভুলি নি।”
রুনি থামলো। খায়রুল সাহেব বজ্রাহতের ন্যায় বসে রইলেন। উনার পলক পরছে না। সত্যিই কি এটা এত বড় অপরাধ? রুনি মৃদু গলায় বলল,
“চা খাও, বাবা। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
খায়রুল সাহেব চায়ে চুমুক দিলেন। চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। খেতে ভালো লাগছে না। উনি চায়ের কাপ টেবিলে রাখলেন। কিছুটা বিভ্রান্তি নিয়েই বললেন,
“তোর কথা হয়তো বুঝেছি, আবার হয়তো বুঝি নি। কিন্তু তোকে যে কষ্ট দিয়েছি, তা বুঝতে পেরেছি। তুই এবার আমাদের সাথে সম্পর্কটা স্বাভাবিক করে নে, রুনি মা। জামাইকে, আমাদের নাতনিকে এবার এই বাড়িতে নিয়ে আয়। আমি বাবা হয়ে ক্ষমা চাইছি তোর কাছে।”
রুনি তাড়াহুড়ো করে বলল,
“না না, বাবা। ক্ষমা চাইতে হবে না। তুমি শুধু আমার একটা কথা রাখো। রাখবে?”
“কি কথা? বল।”
রুনি বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে শীতল গলায় বলল,
“বিন্তুর এই বিয়েটা দিও না, বাবা। প্লিজ!”
খায়রুল সাহেব হকচকিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলেন। ধীরে ধীরে বিস্ময় নিয়ে বললেন,
“কিসব বলছিস, রুনি? সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। এখন কিভাবে আমি পিছিয়ে আসবো?”
রুনি একইভাবে বলল,
“বুঝতে চেষ্টা করো, বাবা। আমার ভাগ্য ভালো বলতে হয়। আমার স্বামী খুব ভালো মানুষ। কিন্তু এই ছেলেটা! এই ছেলেটা কথায় কথায় বিন্তুকে অপমান করে, ছোট করে কথা বলে। তার বাড়ির লোকের কথা নাহয় বাদই দিলাম। সেও যদি বিন্তুর পাশে না থাকে, তাহলে বিন্তু কি করে এখানে সংসার করবে?”
“সে কি? হাবিবকে তো আমি ভদ্রলোক বলেই জানি। ও যদি বিন্তুকে অপমান করে থাকে তাহলে বিন্তু আমায় এতদিন বলে নি কেন?”
“বলার সুযোগ পায় নি, বাবা। আমি তো বলছি এখন। তুমি বিয়েটা ভেঙে দাও।”
খায়রুল সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“এখন তো আর সম্ভব নয়, রুনি। পাড়া প্রতিবেশীরা জেনে গেছে। আর তাছাড়া এই বিয়ে ভাঙলে বিন্তুকে নিয়ে আমার চিন্তা বাড়বে। তোর মাও ঝামেলা করবে।”
“মাকে আমি সামলাবো।”
খায়রুল সাহেব ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
“পারবি না, রুনি। দুবছর আগে বিন্তুকে নিয়ে বেশ বড় একটা ঝামেলা হয়েছিল। পাড়া প্রতিবেশীর গঞ্জনা থেকে বহু কষ্টে বাঁচিয়েছি। তোর মা সেসব জানে। তখনই তোর মা বিন্তুদের এ বাড়ি থেকে বের করে দিতে চেয়েছিল। আমি সামলেছি অনেক কষ্টে। এখন শর্মিলি চায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিন্তুর বিয়েটা হয়ে যাক। বিয়ে ভাঙলে যদি কোনোভাবে আগের কথাগুলোও প্রকাশ হয়ে যায়? তখন তো বিন্তুর বদনাম হবে। ও বিপদে পরবে।”
রুনি ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি হয়েছিল দু’বছর আগে?”
“আমি এসব কথা আর তুলতে চাই না। আমি যা করছি তাতেই বিন্তুর ভালো হবে।”
রুনি হতাশ হয়ে উঠে দাঁড়ালো। বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
“বিন্তুকে নিয়ে কি হয়েছিল তা আমি জেনে নেবো, বাবা। কিন্তু তুমি জেনে রাখো যে এই বিয়েটা আমি হতে দেবো না।”
কথা শেষ করে রুনি ক্লান্ত ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। খায়রুল সাহেব চিন্তিত হয়ে বসে রইলেন। সব জেনেশুনেই হাবিব রাজি হয়েছিল বিয়েতে। সব বললে ভুল হবে, অর্ধেকটা জেনে। কিন্তু এই অর্ধেকটা জেনেই বা আর কোন ছেলে বিন্তুকে বিয়ে করতে চাইবে?
__________________________________________
অন্তুকে তার বান্ধবীর বাসায় পৌঁছে দিয়ে বিন্তু বাইরে বেরিয়ে এসেছে। হাঁটতে হাঁটতে ডাকবাংলোর পাশের চায়ের দোকানটায় এসেছে সে। চায়ের দোকানে এখনো বেশ ভিড়। কতগুলো লোক চা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছে। সবার কথাবার্তার আওয়াজে ভীষণ হট্টগোল হচ্ছে। বিন্তু কাছে এগিয়ে যেতে পারছে না। সে ভেবেছিল এগিয়ে গিয়ে দোকানদারকে পল্লবের খবর জিজ্ঞেস করবে। পল্লবের ফোন নাম্বার আছে কিনা তাও জানতে চাইবে। কিন্তু এতগুলো পুরুষ মানুষের ভিড়ের মধ্যে গিয়ে সে কি করে কথাটা জিজ্ঞেস করবে? বলা যায় না, এখানে হয়তো তার মামার চেনা কোনো ব্যক্তিও আছে। বিন্তু উপায় খুঁজে পেলো না। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। লম্বামতো এক যুবক বিন্তুর দিকে এগিয়ে আসছে। যুবকের মুখে হাসি। বিন্তু অস্বস্তি বোধ করছে। এই লোকটা তার দিকে এগিয়ে আসছে কেন? বিন্তু ভেবে পেলো না। লোকটাকে সে চেনে বলে মনে হলো না। বিন্তু আর দাঁড়িয়ে থাকলো না। উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করলো। পিছন থেকে আওয়াজ এলো,
“বিন্তু, দাঁড়ান।”
বিন্তু থম মেরে দাঁড়িয়ে গেল। গলাটা তার পরিচিত। যুবক দৌড়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালো। প্রশ্ন করলো,
“আমাকে দেখে চলে যাচ্ছিলেন কেন?”
বিন্তু হাসলো। বলল,
“আপনিই পল্লব সাহেব?”
পল্লব এবার ভ্রু কুঁচকে উত্তর দিলো,
“জ্বি। আপনি আমায় চিনতে পারেন নি?”
বিন্তু এবার শব্দ করে হাসলো। হাসতে হাসতেই বলল,
“গলা শুনে চিনলাম এবারে। চেহারা তো এর আগে স্পষ্ট দেখতে পাই নি।”
পল্লব হাসলো। জানতে চাইলো,
“আপনি এখানে?”
বিন্তু মাথা নাড়িয়ে বলল,
“হ্যাঁ, একটু দূরে আমার বোনের বান্ধবীর বাসা। ওকে সেখানে পৌঁছে দিয়ে একটু হাঁটতে বেরিয়েছি। কিন্তু আপনি? আজ তো বৃষ্টি নেই।”
“বৃষ্টি না হলেও আমি সন্ধ্যার পরে একবার এই চায়ের দোকানে আসি। একপাশে বসে মানুষ দেখি।”
বিন্তু মৃদু হাসলো। কথা বলল না। পল্লব নিজে থেকেই বলল,
“দেখা যখন হয়েই গেছে, চলুন না কোথাও বসি। আপনার হাতে সময় আছে তো?”
বিন্তু মৃদু হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। বলল,
“নদীর পাড়ে বসবেন? আজ আকাশে চাঁদ আছে।”
পল্লব রাজি হলো। সানন্দে বলল,
“চলুন।”
.
বিন্তু আর পল্লব নদীর ধারের ঘাসের উপর মুখোমুখি বসেছে। নদীর জলে হালকা ঢেউ। চাঁদের আলো পরে নদীর পানি রূপার থালার মতো চকচক করছে। চারপাশে ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ। মৃদুমন্দ বাতাসে বিন্তুর চুল উড়ছে। সে চোখ বন্ধ করে মুখমণ্ডল ছুঁয়ে যাওয়া হাওয়া উপভোগ করছে। এমন সুন্দর প্রকৃতির অভিজ্ঞতা আগে তার হয় নি। সে অস্ফুটে বলে ফেললো,
“কী অসাধারণ!”
পল্লব মৃদু হাসলো। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
“চাঁদনী রাত আমার ভীষণ প্রিয়। আমি প্রায়ই এখানে আসি জ্যোৎস্না দেখতে।”
বিন্তু মলিন হাসলো। ক্লান্ত গলায় বলল,
“আমার জীবনে এমন সুন্দর মুহূর্ত আসে না। তবে এক সময় আসতো। নিজের ভুলে সেটা হারিয়েছি।”
পল্লব কৌতুহলী গলায় বলল,
“মানে?”
বিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর দিলো না। মলিন গলায় বলল,
“নদীর ধারে বসে এই প্রথমবারের মতো জ্যোৎস্না দেখছি আমি। হয়তো এটাই শেষ বার।”
“শেষবার? কেন?”
বিন্তু মুখে হাসি টানলো। চাঁদের আলোয় তার হাসি রহস্যময় লাগছে। ভারী গলায় সে বলল,
“আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, পল্লব সাহেব। যার সাথে বিয়ে হচ্ছে সে বউকে নিয়ে রাত-বিরাতে জ্যোৎস্না বিলাস করার মানুষ নয়।”
পল্লব বজ্রাহতের ন্যায় বসে রইলো কিছুক্ষণ। তার মনে হলো কেউ তাকে বিষম এক ধাক্কা দিয়েছে। বিন্তুর মুখে তখনো হাসি। পল্লব প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলল,
“আপনার বিয়ে ঠিক হয়েছে?”
বিন্তু হঠাৎ হাহা করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতেই বলল,
“মজার ব্যাপার কি জানেন? এটা আমার প্রথম বিয়ে নয়। দ্বিতীয় বিয়ে।”
পল্লব কিছু বুঝতে পারলো না। পৃথিবী সমান বিস্ময় আর একগুচ্ছ প্রশ্ন মনে নিয়ে সে বিন্তুর দিকে চেয়ে রইলো। বিন্তুর মুখে হাসি। কিন্তু তার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। পরিপূর্ণ জ্যোৎস্নাতলে মেয়েটাকে বড় রহস্যময় লাগছে। ভারী এক নিস্তব্ধতার পরে বিন্তুই মুখ খুললো। গাল বেয়ে নেমে আসা অশ্রু মুছতে মুছতে বলল,
“জীবনে নিজের শখ, নিজের ইচ্ছা পূরণের অনেক সুযোগই আমি পেয়েছিলাম। সুযোগের সদ্ব্যবহারও করেছি অনেক। কিন্তু একবার এর অপব্যবহার করে ফেললাম। আমার মামাকে কষ্ট দিলাম। আমার মায়ের উপর মামার রাগ থাকলেও আমাকে মামা খুব ভালোবাসতেন।”
পল্লব এবারও কথা বলল না। বিন্তু হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলো। তারপর বলল,
“আমার বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন, আমাকে খুব আদর আহ্লাদে রেখেছিলেন। তারপর একদিন হুট করেই বাবা চলে গেলেন। বাবা চলে যাওয়ার পরে আমার মাকে তার স্বামীর বাড়ি ছাড়তে হলো। কারণ সেই বাড়ির কেউই তাকে রাখতে চায় নি আর। তখন আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, এতবছরেও মাকে কেউই ঠিক মন থেকে মেনে নিতে পারে নি। বাবা ছিল বলে কেউ কিছু বলতে পারে নি এতদিন। কিন্তু বাবা চলে যেতেই সব প্রকাশ হয়ে পরলো। আমার দাদীজান মায়ের মুখের উপরে বলে দিলেন, যে মেয়ে বাপ ভাইকে লুকিয়ে আমার ছেলের হাত ধরে পালিয়েছে তার এই বাড়িতে কোনো জায়গা হবে না। মাকে চলে যেতে বলা হলো। কিন্তু আমাদের দুই বোনকে মায়ের সাথে যেতে দেওয়া হবে না বলে ঠিক করা হলো। আমাদের ছেড়ে থাকার কথা মা ভাবতে পারলেন না। সেদিন রাতে মা আমাদের নিয়ে পালিয়ে এলেন। পনেরো বছর পরে নিজের বাপের বাড়িতে গিয়ে দাঁড়ালেন। কিন্তু ততদিনে সেখানেও আর মায়ের জায়গা নেই।”
বিন্তু থামলো। পল্লব নিচু আওয়াজে বলল,
“সেদিন আপনাকে যেখানে পৌঁছে দিয়ে এলাম, সেই বাড়িটা আপনার মামাবাড়ি?”
বিন্তু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। বড় করে একবার শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলো,
“আমার নানাজান মায়ের উপর রাগ করে সব সম্পত্তি মামার নামে লিখে দিয়েছিলেন। যেদিন আমরা এই বাড়িতে এলাম সেদিন আমার নানাজান মারা গিয়েছেন। বাড়িতে ঢুকে দেখি নানাজানের লাশ। মাকে দেখে সবাই যেন আকাশ থেকে পরলো। মা আমার বাবার হাত ধরে পালিয়ে যাবার পরে এই বাড়ির মানসম্মান যতটুকু হারিয়েছিল, পনেরো বছরে তা একটু একটু করে ফিরিয়ে এনেছিলেন নানাজান। মা দুই সন্তানের হাত ধরে এই বাড়ির উঠোনে দাঁড়ানোর পরে আবারও যেন সেসব অসম্মান, অপমান মাথা চাড়া দিলো। আমার মামী ভীষণ ক্ষিপ্ত হলেন। একে তো সদ্য মৃতের বাড়ি। তার উপর আমরা যেন একটা উটকো ঝামেলা। নানাজানের দাফন হলো। আমরা কয়েকদিন অস্পৃশ্যের মতো বাড়িটাতে ঘুরে বেড়ালাম। কেউ আমাদের দেখেও দেখলো না। সপ্তাখানেক পরে মামা আর মামী আমাদের নিয়ে বসলেন। মামা চেয়েছিলেন সম্পত্তির একটা অংশ মাকে ফিরিয়ে দিতে। মামী কিছুতেই তা হতে দিলেন না। শেষে ঠিক হলো, আমরা বাড়ির নিচতলায় থাকবো। কিন্তু তার বদলে আমাদের ভাড়া দিতে হবে। মাকে তাইই মেনে নিতে হলো। যে বাড়িতে আমার মায়ের জন্ম, যে বাড়িতে আমার মায়ের বড় হয়ে ওঠা, সেই বাড়িতেই আমার মা হয়ে গেলেন ভাড়াটে।”
বিন্তুর গলা জড়িয়ে এসেছে। পল্লব স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। তার স্থির দৃষ্টি বিন্তুর মুখের দিকে। প্রথমবারের মতো বিন্তুর চোখেমুখে বাস্তবতার রূঢ়তা দেখতে পেলো পল্লব। সে মৃদু গলায় প্রশ্ন করলো,
“আপনার দাদা বা দাদী কেউ আর পরে আপনাদের খোঁজ করলো না?”
“উঁহু, কোনোদিন না।”
পল্লব ব্যথিত হলো। কিছু বলবে না বলবে না করেও বলল। কৌতুহল বড় সংক্রামক। প্রশ্ন করে ফেললো,
“এরপর কি হলো?”
বিন্তু মুচকি হেসে বলল,
“এরপর ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হয়ে এলো। আমরা ওই জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। বাবার অফিস থেকে প্রতিমাসে কিছু টাকা পান আমার মা। বাবা মাকে নমিনি করেছিলেন। সেটা দিয়েই মাসের খরচ চালান আমার মা। মামা মাঝেমধ্যে সাহায্য করেছেন। টাকাপয়সা নিয়ে টানাটানি থাকলেও আমার দুঃখ ছিল না। মা আমাকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। মামাও খুব ভালোবাসতেন। মামী সবসময় দুর্ব্যবহার করলেও মামার কাছে আমার আবদার করার সুযোগ ছিল। মামার কাছে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে এটাসেটা চাইতাম। মামা কখনো না করতেন না। কিন্তু কয়েক বছর পরে আমি এমন একটা ভুল করে ফেললাম যে মামার সামনে কথা বলার মুখ রইলো না আমার। তাই আজও আমি মামাকে বলতে পারি নি যে এই ছেলেটাকে আমার পছন্দ হয় নি। আমি এই বিয়েটা করতে চাই না। বলার উপায় নিজেই রাখি নি।”
পল্লব কৌতুহল নিয়ে বলল,
“কি করেছিলেন আপনি?”
বিন্তু ভেতরের দীর্ঘশ্বাস চাপা দিলো। সামনের নদীর পানিতে দৃষ্টি দিলো। চাঁদের আলো ম্লান হয়ে আসছে। হয়তো মেঘ করছে। একটু সময় নিয়ে সে বলল,
“বর্ণ। সেই কিশোরী বয়স থেকেই ওকে দেখেছি একই পাড়ায় থাকার সুবাদে। কিন্তু কলেজে পড়ার সময়ে বর্ণিলকে আমার ভালো লেগে গেল। ওর সাথে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো। ধীরে ধীরে না চাইতেও আমি ওর সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পরলাম। এখানে বলে রাখা ভালো যে বর্ণিলের মা আমাদের কখনোই পছন্দ করতেন না।”
বিন্তু থামলো। বড় নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলল,
“সেই বয়সে যেমন উত্তাল অনুভূতি থাকে, আমারও তাই ছিল। আমি এড়িয়ে যেতে পারলাম না সেই অনুভূতি। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমরা কথা বলতাম। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঘুরতে যেতাম। এভাবেই চলছিল। এরপর আমাদের কলেজ শেষ হলো। বর্ণকে ওর মা বাবা অনার্স করতে দেশের বাইরে পাঠাতে চাইলো। ও রাজি হলো না। কারণটা অবশ্যই আমি। আমাকে ভর্তি হতে হলো এলাকার ডিগ্রী কলেজে। ও আমাকে ছেড়ে যেতে চাইলো না। শেষ পর্যন্ত দেশের বাইরে না গেলেও এই মফস্বল ছেড়ে অন্য শহরে ঠিকই যেতে হলো। কিন্তু ও যাওয়ার আগেই আমরা একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিলাম।”
পল্লব থমথমে গলায় বলল,
“লুকিয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত?”
বিন্তু হেসে উঠলো। চাপা গলায় বলল,
“আপনি বুদ্ধিমান।”
পল্লব কথা বলল না। বিন্তু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর মাথা নিচু করে বলল,
“তখন বয়স অল্প ছিল। বুঝতে পারি নি। ভেবেছি বিয়ে তো হয়ে গেছে। আর কেউ আলাদা করতে পারবে না আমাদের। কয়েক মাস গোপনে সংসার করেছি। মাকে মিথ্যা বলে বর্ণর কাছে যেতাম। ওর সাথে থাকতাম। যখন ওর বাড়িতে কেউ থাকতো না, ও লুকিয়ে ওর বাড়িতে আমাকে নিয়ে যেতো। আমরা ভেবেছিলাম, বর্ণিল নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পরে সবাইকে জানাবো বিয়ের কথা। কিন্তু উল্টোদিকে যে বর্ণর মায়ের এত ঘোরতর আপত্তি, তা ও কখনোই আমাকে জানায় নি। উনাকে যে বর্ণ রাজি করাতে পারবে না, আর উনার রাজি না হওয়াটাই যে শেষ অব্দি বর্ণ মেনে নেবে তাও আমি জানতাম না।”
“উনার মা কবে জানতে পেরেছিলেন?”
বিন্তু উদাসীন হয়ে উত্তর দিলো,
“বছর দুয়েক পরে।”
পল্লব হতভম্ব হয়ে বলল,
“দুই বছর আপনারা গোপন রেখেছিলেন সবটা?”
“জ্বি। দুই বছর যে খুব ভালো ছিলাম, তা নয়। বর্ণ অন্য শহরে যাওয়ার পর থেকেই কেমন যেন বদলে গেল। আগে ও হাজার কাজের মাঝেও আমার জন্য সময় বের করতো। কিন্তু ধীরে ধীরে ওর সময় কমতে লাগলো। আমাকে একটাবার ফোন করার সময়ও হতো না ওর। মাঝেমধ্যে বন্ধুদের আড্ডায় বসে আমাকে বলতো, ব্যস্ত আছি। বিরক্ত করিস না। আমি এসব মেনে নিতে পারতাম না। এসব নিয়ে ঝগড়াঝাটি করতাম। ঝামেলা হতো। ঝগড়ার পরে রাগ করে আমি কথা বন্ধ করে দিতাম। বর্ণর কিচ্ছু যায় আসতো না। ও যেন আরও স্বস্তি পেতো। কিন্তু আমি ভীষণ অস্থির হয়ে পড়তাম। একটা সময় পরে নিজে থেকেই আবার কথা বলতাম। অনুরোধ করতাম যাতে সব স্বাভাবিক করে নেয়। একদিন ওকে বলেছিলাম, আজ রাতে আমার সাথে কথা বল। আমার শরীর ভীষণ খারাপ। তোকে খুব মনে পড়ছে। ও নিষ্ঠুরের মতো বলে দিয়েছিল ও পারবে না। আমার শরীর খারাপ বলে কি ও আমাকে নিয়ে বসে থাকবে? ওর অন্য জরুরি কাজ আছে। আর তাছাড়া ও তো ডাক্তার নয়। পরে ওর এক বন্ধুর থেকে জানতে পেরেছিলাম যে ওর জরুরি কাজটা ছিল একটা কনসার্টে যাওয়া। আমি প্রচন্ড আঘাত পেলাম। আমার মনে হলো, বর্ণর কাছে আমার আর কোনো গুরুত্ব নেই। আমি এক বাড়ি লোকের মধ্যে থেকেও ওর সাথে কথা বলার সুযোগ করে নিতাম। অথচ ও কি করলো? আমি অভিমানে টানা সাতদিন ওর সাথে যোগাযোগ করলাম না। ভেবেছিলাম ও আমার অভিমান ভাঙাতে চাইবে। কিন্তু তেমন কিছু ঘটে নি। বরং অষ্টম দিনে আমিই ওকে ফোন করলাম। জানতে চাইলাম, এই ক’টাদিন একবারও কি আমার সাথে কথা বলতে ওর ইচ্ছা করলো না? ও উত্তর দিয়েছিল, ইচ্ছা করেছে। কিন্তু সময় দরকার ছিল বলে যোগাযোগ করে নি। আমার ওর কথা বিশ্বাস হলো না। কিন্তু তবুও মেনে নিলাম। কারণ আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারতাম না। অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল কিনা!”
বিন্তু মুচকি হেসে থেমে গেল। পল্লব ধীরে ধীরে বলল,
“দুটো বছর কি এভাবেই কেটেছে?”
বিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“না, ভালো স্মৃতিও আছে অনেক। কিন্তু অধিকাংশ সময় এভাবেই কেটেছে। এক পর্যায়ে ও বলতে শুরু করলো, আমি নাকি ওকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই। ওর সব কাজে বাধা দিই। ওকে আমার কথা অনুযায়ী চলতে বলি। ও নিজের মতো কিছু করতে চাইলে আমি তা মানতে পারি না। সেজন্যই নাকি আমাদের মাঝে ঝগড়া বিবাদ হয়। আমার অভিমানটা বুঝতে পারলো না ও। আমাকে সময় না দেওয়াটা ওর ভুল ছিল, সেটাও মানলো না। কিন্তু আমি ওর কথা মেনে নিলাম। কারণ আমার একমাত্র চিন্তা ছিল সম্পর্কটা বাঁচানো। ওর মনমতো চলতে শুরু করলাম ধীরে ধীরে। ঝগড়া করা বন্ধ করে দিলাম, সময় চাইতে তো ভুলেই গেলাম। সপ্তাহে মাত্র দু তিনদিন যোগাযোগ হতো, তাও আবার আমি ফোন করলে তবেই। ওর এসব পরিবর্তন ভেতরে ভেতরে আমাকে তীরের মতো বিঁধতো। কিন্তু তবুও আমি সব মেনে নিলাম। আর আগের বর্ণকে মিস করতে থাকলাম। শেষ যে বছর আমাদের বিয়েটা টিকেছিল সে বছর বর্ণ দশদিনের ছুটি পেলো। বাড়িতে এলো। আমার সাথে সুন্দর কিছু মুহূর্ত কাটালো। আমি ভাবলাম সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু এরপর আমি পরলাম এক ভয়ংকর দোটানায়। বর্ণ চলে যাওয়ার মাসখানেক পরে জানতে পারলাম আমি অন্তঃসত্ত্বা।”
পল্লব বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। তার শরীরে শীতল একটা স্রোত বয়ে গেল। হতভম্ব হয়ে বিন্তুর দিকে তাকিয়ে রইলো সে। কথা বলতে চেয়েও পারলো না। কেবল অস্ফুটে উচ্চারণ করলো,
“কি?”
বিন্তু স্পষ্ট গলায় বলল,
“ঠিকই বলছি। এসব কথা আমি কখনো কাউকে বলি নি আগে। বলার কথাও নয়। আপনাকেও বলতাম না। কিন্তু আপনিই সেদিন বললেন, মনের ভেতর চাপা দিয়ে রাখা কথাগুলো অচেনা কাউকে বলাটাই নিজেকে হালকা করার সবচেয়ে ভালো উপায়। তাই বলছি। যদিও আপনি এখন আমার অচেনা নন, তা সত্ত্বেও আপনাকেই বলা যায় বলে মনে হয়েছে।”
পল্লব নিজেকে স্বাভাবিক করলো। থমথমে মুখে বলল,
“বলুন। এরপর কি হলো?”
বিন্তু ক্লান্ত গলায় বলতে লাগলো,
“বর্ণকে জানানোর পরে ও প্রথমে খুব রাগারাগি করলো। বলল, আমি নাকি পরিকল্পনা করে ওকে আটকে রাখতে কাজটা করেছি। আমারও রাগ হলো। যা মনে এলো বলে দিলাম। বললাম, বিয়ের পরে সব মেয়েই স্বামীকে আটকে রাখতে চায়। এটা অপরাধ হলে হয়েছে। আমার তাতে আফসোস নেই। এক কথা দুই কথা থেকে একটা বিশ্রী কথা কাটাকাটি হলো। আমি দুশ্চিন্তায় শেষ হয়ে যেতে লাগলাম। ধীরে ধীরে অনিদ্রার রোগী হয়ে গেলাম। রাতের পর রাত কাটাতে লাগলাম বারান্দায় বসে। কয়েকদিন কাটার পরে বর্ণিলের দয়া হলো। ও বাড়িতে এলো। আমাকে নিয়ে ওর মায়ের কাছে গেল। ওর মা সব জানার পরে বর্ণকে কি বলেছিলেন জানি না। কিন্তু আমাকে ভীষণ বাজেভাবে অপমান করলেন। হুমকি দিলেন যেন আমি এই বাচ্চাটাকে না রাখি। আর তারপর যেন তার ছেলেকে তালাক দিয়ে দিই। যদি উনার কথা না শুনি তাহলে আমার পরিবারকে সব জানাবেন। আমি অবাক হয়ে দেখলাম বর্ণ তার মায়ের প্রতিটা কথা মেনে নিচ্ছে।”
“আপনি উনাদের কথা মেনে নিলেন?”
বিন্তু জোরের সাথে বলল,
“প্রশ্নই ওঠে না। আমি রাজি হই নি। পরবর্তীতে ওরা আমার মামা মামীকে ডাকলেন। সব জেনে উনারা আকাশ থেকে পরলেন। মামা চেষ্টা করেছিলেন যাতে সামাজিকভাবে আমাদের সম্পর্কটা স্বীকৃতি পায়। কিন্তু বর্ণর মা রাজি হোন নি। মামা আর মামীকে খুব অপমান করেছিলেন। মামী আমার উপর রাগে ফেটে পরলেন। আমাকে বিদ্রূপ করে বললেন আমি নাকি আমার মায়ের যোগ্য কন্যা হয়ে উঠেছি। তবে একটা কথা আমাকে স্বীকার করতেই হবে। মামী মুখে আমাকে গঞ্জনা দিলেও আমার ভালো চেয়েছিলেন। বারবার বর্ণর মাকে অনুরোধ করেছিলেন আমাদের বিয়েটা মেনে নিতে। উনি মানেন নি। হুমকি দিয়েছিলেন, এক মাসের মধ্যে তালাক না দিলে উনি মামার মান সম্মান মাটিতে মিশিয়ে ছাড়বেন। আমাকে বদনাম করবেন। আমি অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম বলে বর্ণিলের দিক থেকে তালাক দেওয়াটা সম্ভব হচ্ছিলো না। মামা মামী চিন্তায় পরলেন। মামী আমার মাকে কিছুই জানতে দিলেন না। আমাকে উনি সেই সময়টায় আগলে রেখেছিলেন।”
বিন্তু থামলো। তার চোখ ভর্তি জল মুছে ফেলে ধীরে ধীরে আবার বলল,
“একদিন হুট করে বর্ণর মা আমাকে ফোন করলেন। খুব আদর করে আমাকে বাড়িতে ডাকলেন। উনার মিষ্টি কথায় ভুলে আমি সেখানে গেলাম। আর সেদিনই করলাম সবচেয়ে বড় ভুল। সেদিন উনি আমাকে কি খাইয়েছিলেন জানি না। কিন্তু খাবারের সাথে নিশ্চয়ই কিছু মেশানো ছিল, হয়তো কোনো ওষুধ। যার ফলে আমি আমার বাচ্চাটাকে হারালাম। নিজেও অসুস্থ হয়ে পরলাম। সেদিন আমার শিরিন আপা না থাকলে আমি হয়তো মরেই যেতাম। এই ঘটনার মাসখানেক পরে আমার কাছে ডিভোর্স নোটিশ এলো। আমি মরিয়া হয়ে বর্ণর কাছে গেলাম। জানতে চাইলাম, সেও কি এই বিচ্ছেদ চায়? তার মায়ের করা অন্যায় নিয়ে সে কি কিচ্ছু বলবে না? ও উত্তর দিয়েছিল, তার মা কিছু করে নি। বাচ্চাটা আমি হারিয়েছি নিজের দোষে। সেজন্যই ও ডিভোর্স চায়। এইদিন, ঠিক এইদিন থেকেই আমি বর্ণকে প্রচন্ড ঘৃণা করতে শুরু করলাম।”
বিন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করলো। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক কমে এসেছে। চারদিক এখন প্রায় নিস্তব্ধ। টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। পল্লব ইতস্তত করে প্রশ্ন করলো,
“আপনার মা এখনো কিছু জানেন না?”
“সবটা জানেন না। মামী শুধু বলেছিল, আমি লুকিয়ে বিয়ে করতে গিয়েছিলাম আর মামা আমাকে সেখান থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। ছেলেটা কে সে বিষয়ে মা জানেন না। এটুকু জানার পর থেকেই মা আর কখনো আমার সাথে ভালো করে কথা বলেন নি।”
“বর্ণিলের সাথে আর কখনো দেখা বা কথা হয়েছে আপনার?”
বিন্তু তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। বলল,
“বছর দুয়েক পরে বর্ণ বাড়িতে ফিরে আসে। এখন এই এলাকার কলেজেই মাস্টার্স করছে। ওর মা ওকে আর দৃষ্টি সীমার বাইরে যেতে দেয় নি। আর আমি টেনেটুনে ডিগ্রী পাশ করেছি। তারপর বিয়ে করতে চলেছি। কিন্তু আমি সবসময় চেয়েছি আমার বোন পড়ালেখা করুক। তাই যখন আমি জানলাম ওর জন্য টিউশন টিচার প্রয়োজন, তখন খানিকটা নিরুপায় হয়ে বর্ণর কাছে গিয়েছিলাম। ততদিনে যদিও দুই বছর কেটে গেছে, তবুও আমার ভেতরের আঘাত তখনো তাজা। তবুও গিয়ে অনুরোধ করেছিলাম অন্তুকে যেন পড়ায়। শুরুতে রাজি হয় নি। পরে অবশ্য হয়েছে। আমার মা জানেন না বলেই ও রোজ এসে অন্তুকে পড়াচ্ছে।”
“আপনি কি এসবকিছুর জন্যই বিয়েতে মন থেকে রাজি হতে পারছেন না?”
“হ্যাঁ। মনে হচ্ছে, যাকে বিয়ে করছি তাকে ঠকাচ্ছি। যদিও আমার অতীত আমি বর্তমানে আনবো না। তবুও দ্বিধা হয়। আর তাছাড়া যার সাথে আমার বিয়ে হতে চলেছে, তাকে আমার পছন্দ হয় নি।”
পল্লব আর কথা বলল না। বিন্তু আকাশের দিকে তাকালো। মেঘে ঢেকে যাচ্ছে চাঁদ। সেদিকে তাকিয়েই বিন্তু মৃদু গলায় বলল,
“জানেন, পল্লব সাহেব? আমার সম্পর্কে খুব ভয়। যদি আবার বদলে যাওয়া দেখতে হয়? মানুষের হুট করে বদলে যাওয়া বড় ভয়ংকর। এরচেয়ে একা থাকা ভালো।”
পল্লব এবারেও কথা বলল না। বিন্তু উঠে দাঁড়ালো। মুখে হাসি টেনে বলল,
“অনেক রাত হয়ে গেল। আমি আসি। আমার বোনকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে।”
বিন্তু কথা শেষ করে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। আধো অন্ধকারে পল্লবের কেমন ঘোর লাগা অনুভূতি হলো। মনে হলো, এতক্ষণ যা হলো সবটাই স্বপ্ন। সে উঠে দাঁড়ালো। বিন্তুর চলে যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তার ইচ্ছা করলো দৌড়ে গিয়ে বিন্তুকে আটকাতে। তারপর বলতে, “আপনি যাবেন না, বিন্তু। আমাকে বিশ্বাস করুন। আমি কখনো বদলে যাব না।” সে দু’পা এগিয়ে গেল। পরক্ষণেই আবার পিছিয়ে এলো। যদি কথা রাখতে না পারে?
.
#চলবে……………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে