চড়ুই নীড়ে বসবাস পর্ব-০৭

0
208

#চড়ুই_নীড়ে_বসবাস
#আলো_রহমান(ফারজানা আলো)
#পর্ব:৭
.
বিকাল গড়িয়েছে। ঘড়িতে পাঁচটা দশ। ঝিরঝির করে এখনো বৃষ্টি পরছে। বর্ণিল ছাতা মাথায় বিন্তুদের বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। আজ সে অন্তুকে প্রতিদিনের চেয়ে বেশ অনেকটা সময় বেশি পড়িয়েছে। কোথাও একটা আশা ছিল বিন্তুকে দেখার। কিন্তু বিন্তু এখনো ফেরে নি। এতক্ষণ বাইরে কি করছে বর্ণিল বুঝতে পারছে না। অবশ্য সময় তো লাগবেই। হবু বরের সাথে বাইরে গেছে বলে কথা। এত জলদি নিশ্চয়ই ফিরবে না। বিন্তুদের বাড়ির সামনে পানি জমেছে। বর্ণিল সাবধানে পা টিপে টিপে কাদা পার হলো। রাস্তার বাঁদিকে একটা সাদা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এটা কি সেদিনের সেই গাড়িই কিনা বর্ণিল বুঝতে পারছে না। তাকে দেখেই গাড়ি থেকে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক নেমে এলেন। ভদ্রলোকের মাথার উপরে কালো রঙের ছাতা। ছাতা তিনি নিজে হাতে ধরেন নি। ছাতা ধরে পিছনে পিছনে আসছে আরেকজন। বর্ণিল তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। এদেশের মানুষের হাতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকাপয়সা এলে তারা আর ছাতাটাও নিজ হাতে ধরতে পারে না। মশা মারতেও কামান আনে। এখানে গরিবের ঘোড়া রোগ হয়, আর বড়লোকের হয় কামান রোগ।
বয়স্ক ভদ্রলোক বর্ণিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। বর্ণিলকে ডেকে কোমল গলায় বললেন,
“বাবা, একটু শুনে যাও।”
বর্ণিল দাঁড়িয়ে পরলো। ভদ্রলোক যথাসম্ভব নিচু আওয়াজে কথা বলছেন। জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি কি এই বাড়ির কেউ?”
বর্ণিল না সূচক মাথা নেড়ে বলল,
“আমি আর এক বাড়ি পরে থাকি।”
“ওহ্! তার মানে খায়রুল সাহেবের প্রতিবেশী?”
“জ্বি। আপনাকে ঠিক চিনলাম না তো।”
ভদ্রলোক মুখ ভোঁতা করে উত্তর দিলেন,
“এবাড়ির সাথে আত্মীয়তা করতে এসেছি। মানে, এই বাড়ির মেয়ের সাথে আমার ভাতিজার বিয়ে ঠিক করেছি।”
উনি কার কথা বলছেন বর্ণিল বুঝতে পারলো না। জানতে চাইলো,
“এবাড়ির মেয়ে? মানে বিন্তুর কথা বলছেন?”
“হ্যাঁ, সেই মেয়েটিই। বড় বিপদে পরেছি এই মেয়েকে পছন্দ করে।”
“বিপদ! কি বিপদ?”
ভদ্রলোকের চোখেমুখে অসন্তুষ্টি। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন,
“মেয়েটির আচার আচরণ প্রচন্ড উগ্র। আজ আমার ভাতিজা তাকে নিয়ে বাইরে গিয়েছিল। মেয়েটির এত বড় সাহস! সে আমার ভাতিজাকে অপমান করে চলে গেছে। ছেলেটা মন খারাপ করে বাড়ি ফিরেছে। বেয়াদব মেয়ে!”
বর্ণিল ভ্রু কুঁচকে ফেললো। অপমান করেছে মানে? বিন্তুর মতো একটা শান্তশিষ্ট মেয়ে কাউকে অপমান কেন করতে যাবে? সে বিভ্রান্তি নিয়ে বলল,
“আমার কাছে কি চাইছেন?”
ভদ্রলোক বিরস মুখে বললেন,
“খোঁজ নিতে চাইছি। বিয়েশাদি তো এক কথায় হয় না। প্রতিবেশীদের কাছে মেয়েটার ব্যাপারে খোঁজ নিবো বলে আমি এখানে এসেছি। এমন উগ্র আচরণ তো মেনে নেওয়া যায় না।”
বর্ণিল শীতল গলায় বলল,
“উগ্র মনে হলে বিয়েটা ভেঙে দিন।”
ভদ্রলোক শুকনো গলায় বললেন,
“বিয়ে ভাঙা যাবে না। এই বিয়ের অনেক সুবিধাও আছে। শুধু কিছু বিষয় জানা জরুরি।”
“কি বিষয়?”
ভদ্রলোক বর্ণিলকে একবার ভালো করে দেখে নিলেন। বললেন,
“তুমি তো ইনাদের প্রতিবেশী। দেখে মনে হচ্ছে বিন্তুর কাছাকাছিই তোমার বয়স। মেয়েটার স্বভাব চরিত্র কেমন?”
বর্ণিল বেশ অনাগ্রহ নিয়ে উত্তর দিলো,
“ও ভালো মেয়ে। শান্ত স্বভাব।”
“কোনো ছেলের সাথে কি ওর সম্পর্ক টম্পর্ক ছিল? আজকালকার মেয়ে। জেনে নেওয়া দরকার।”
বর্ণিল বিরক্ত হলো। তবে কথাবার্তায় বিরক্তি প্রকাশ করলো না। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে উত্তর দিলো,
“এতকিছু আমার জানা নেই। যদি আগে কোনো সম্পর্ক থেকেও থাকে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এখন তো ও এই বিয়েতেই রাজি হয়েছে।”
ভদ্রলোক হেসে উঠে বললেন,
“রাজি সে হয়েছে কিনা তা বোঝার উপায় নেই। বাবা নেই, এতিম মেয়ে। পরগাছার মতো মামাবাড়িতে বড় হয়েছে। ওর নিজের মতামত নেই। থাকাটা গুরুত্বপূর্ণও নয়। যাই হোক, বাবা। তোমাকে ধন্যবাদ।”
ভদ্রলোক বিন্তুদের বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। বর্ণিল বিচলিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। লোকটার কথাবার্তা ঠিক ভালো লাগলো না তার। কেমন পরিবারে বিয়ে হচ্ছে বিন্তুর? আর বিন্তু অপমান করে চলে গেছে কথাটার মানে কি? বিন্তু তো এখনো বাড়ি ফেরে নি! বর্ণিলের কপালে চিন্তার ভাঁজ পরলো। গেল কোথায় মেয়েটা?
____________________________________________
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। বৃষ্টি থামলেও আকাশ এখনো মেঘলা। আকাশে মেঘ থাকায় চারদিক অন্ধকার। চায়ের দোকানটায় টিমটিমে একটা আলো জ্বলছে। দোকান থেকে খানিকটা দূরে রাখা একটা বেঞ্চিতে বসেছে বিন্তু আর পল্লব। বিন্তুর হাতে চায়ের কাপ। সে দুই হাতে কাপটা ধরে ধীরে ধীরে ফু দিচ্ছে। বৃষ্টিতে ভেজায় তার ঠান্ডা লাগছে। শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজেকে ঢেকে রেখেছে সে। তার পাশে পল্লব দাঁড়িয়ে আছে। বিন্তু তার দিকে না তাকিয়েই বলল,
“পল্লব সাহেব, আপনি হুট করে নিজের গল্পটাই আমাকে বললেন কেন?”
পল্লব চায়ে চুমুক দিয়ে উত্তর দিলো,
“মানুষ আত্মকেন্দ্রিক প্রাণী। দুঃখের সময় সবার আগে সে নিজের দুঃখ নিয়ে ভাবে। সুখের সময়ে ভাবে নিজের আনন্দের কথা। অপরের সুখ দুঃখ নিয়ে মানুষ চিন্তিত নয়। গল্প বলার ক্ষেত্রেও মানুষের আগে নিজের গল্পটাই মনে পড়ে।”
বিন্তু মুচকি হাসলো। আধো অন্ধকারে তার সবকিছু রহস্যময় লাগছে। অচেনা একটা মানুষের সাথে সে পুরো দিন কাটিয়ে দিলো! সেই মানুষটাকে সে ভালো করে দেখেও নি। বিন্তুর চোখে স্পষ্ট হওয়ার জন্য যতটুকু কাছে আসা প্রয়োজন, পল্লব ততটুকু কাছে একবারও আসে নি। সারাদিনে বিন্তুর একবারও বাড়ি যাওয়ার কথা মনেও পড়ে নি। পল্লব প্রশ্ন করলো,
“বনরুটি খাবেন, বিন্তু?”
বিন্তুর ক্ষিদে লেগেছিল। সারাদিনে তার খাওয়া হয় নি। কিন্তু সে সংকোচে সে কথা বলল না। মুখে হাসি টেনে বলল,
“জ্বি না। আমি খাব না।”
“খেয়ে দেখুন। ভালো লাগবে। দাঁড়ান, আমি নিয়ে আসছি।”
পল্লব দোকানের দিকে এগিয়ে গেল। দুটো বনরুটি নিয়ে বিন্তুর পাশে দূরত্ব রেখে বসলো। বিন্তুর দিকে এগিয়ে দিতেই বিন্তু এবার সংকোচ ছাড়াই সেটা নিলো। পল্লব প্রশ্ন করলো,
“আপনি বাড়ি ফিরবেন না?”
বিন্তুর হঠাৎ যেন চেতনা ফিরলো। বাড়ি! হ্যাঁ, ফিরতে হবে। কিন্তু তারপর? কে জানে কী অবস্থা এখন বাড়িতে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অস্পষ্ট গলায় বলল,
“না ফিরলেই ভালো হতো।”
পল্লব বুঝতে পারলো না। জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু বললেন?”
বিন্তু মাথা নেড়ে বলল,
“না, কিছু না।”
পল্লব কথা বলল না। বাড়ির কথা মনে পড়তেই বিন্তুর মন খারাপ হয়ে গেছে। অন্ধকার গাঢ় হয়ে এসেছে। বাড়ি ফেরার সময় ঘনিয়ে এসেছে তার। সে আনমনে বলল,
“পল্লব সাহেব, আপনি নিজের গল্পটা আমাকেই কেন বললেন? আপনি তো আমাকে চেনেন না।”
পল্লব মৃদু হেসে উত্তর দিলো,
“মনের ভেতর জমানো দুঃখের গল্প মাঝেমধ্যে কাউকে বলতে হয়। কিন্তু মুশকিল হলো সব দুঃখের কথা সবাইকে বলা যায় না। কিছু দুঃখ থাকে, যেগুলো হয়তো কাছের মানুষরা বুঝতে পারে না। কিংবা কিছু কথা হয়তো কাছের মানুষকে বললে তারা চিন্তায় পরে যায়। সেই সময় কথাগুলো অচেনা কাউকে বলাটা মনের জমানো দুঃখ উগড়ে দেওয়ার একটা কৌশল। মানুষটাও হারিয়ে যাবে, সেই সাথে আপনি যে কাউকে কথাগুলো বলেছেন এই বিষয়টিও হারিয়ে যাবে।”
বিন্তু চমৎকৃত হলো। উৎসাহ নিয়ে বলে ফেললো,
“আপনি কি আমার কথাগুলো শুনবেন?”
পল্লব স্বাভাবিক গলায় বলল,
“নিশ্চয়ই। বলুন”
বিন্তু মাথা নাড়লো। নিচু গলায় বলল,
“আজ নয়। আজ বড় ক্লান্ত লাগছে আমার। আপনি কি আরেকদিন এখানে আসবেন? প্লিজ!”
পল্লবের হঠাৎ মায়া হলো। সে কোমল গলায় বলল,
“হু, আসবো। বলুন কবে?”
বিন্তু হতাশ গলায় বলল,
“কবে? আমি নিজেও তো জানি না।”
তার কথা শেষ হতেই হলুদ হেডলাইট জ্বালিয়ে দোকানের সামনে একটা গাড়ি এসে থামলো। পল্লব উঠে দাঁড়ালো। অস্ফুটে বলল,
“সর্বনাশ!”
বিন্তু বিচলিত হয়ে উঠে দাঁড়ালো। চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করলো,
“কি হলো?”
পল্লব উত্তর দিলো না। গাড়ি থেকে একজন ভদ্রমহিলা নেমে এলেন। উনার পরনে গাঢ় রঙের বোরকা। মাথা কালো চাদরে ঢাকা। মুখ দেখা যাচ্ছে। স্পষ্ট দেখতে না পেলেও বিন্তু বুঝতে পারছে উনি কিছুটা বয়স্কা। উনি সোজা হেঁটে তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। পল্লব মাথা নিচু করে বলল,
“আম্মা, আপনি কষ্ট করে আসতে গেলেন কেন? খবর দিলে চলে আসতাম।”
বিন্তুর কাছে স্পষ্ট হলো ভদ্রমহিলার পরিচয়। সে কিছুটা পেছনে সরে দাঁড়ালো। ভদ্রমহিলা ভারী গলায় বললেন,
“কিভাবে খবর দেবো? না তোমার সাথে মোবাইল ফোন আছে, আর নাইই তোমার যাওয়ার জায়গার ঠিকঠাক ঠিকানা আছে।”
পল্লব কথা বলল না। ভদ্রমহিলা শুকনো গলায় বললেন,
“খবর দিতেই বা হবে কেন? সারাদিন যাযাবরের মতো বাইরে ঘুরছো। বাড়িতে আমি চিন্তা করি, সেটা ভেবেছ? এই বয়সে আর কত চিন্তা করবো?”
পল্লব মৃদু আওয়াজে বলল,
“ভুল হয়ে গেছে, আম্মা।”
ভদ্রমহিলা এবার বিন্তুর দিকে তাকালেন। বিন্তুকে ভালো করে দেখে নিলেন একবার। তারপর পল্লবকে প্রশ্ন করলেন,
“ও কে?”
পল্লব ইতস্তত করে উত্তর দিলো,
“ওর নাম বিন্তু।”
“তুমি কি ওকে পছন্দ করো? বিয়ে করতে চাও?”
বিন্তু হকচকিয়ে গেল। কি বলছেন উনি এসব! পল্লব বিব্রত বোধ করলো। তাড়াহুড়ো করে বলল,
“না, আম্মা। আপনি যেমন ভাবছেন তেমন কিছু নয়। উনার সাথে আমার আজই পরিচয় হয়েছে। নাম ছাড়া আর কিছুই জানা হয় নি এখনো।”
উনি অবাক হলেন না। যেন ছেলের এমন স্বভাবের সাথে তিনি পরিচিত আছেন। উনি এবার কোমল গলায় বিন্তুকে প্রশ্ন করলেন,
“তুমি থাকো কোথায়, মা?”
বিন্তু কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দিলো,
“জ্বি, বাগানবাড়ি।”
“ঠিক আছে, মা। আমাদের সাথে এসো। তোমাকে পৌঁছে দিয়ে তারপর আমরা বাড়ি যাব।”
বিন্তু উত্তর দিতে পারলো না। ভদ্রমহিলা বিন্তুর দিকে এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরলেন।
_________________________________________
রাত আটটা বেজেছে। শিরিন দোতলা থেকে নেমে বাইরের বসার ঘরে ঢুকলো। অমিত সোফায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে গান শুনছে। এই ঘরে শিরিনের দাদাজানের সময়ের একটা পুরানো টেপ রেকর্ডার আছে। অমিত সেটাতে নজরুল গীতির একটা ক্যাসেট চালিয়েছে। শিরিন দ্রুত পায়ে গিয়ে টেপ রেকর্ডার বন্ধ করে দিলো। অমিত চোখ খুলে বলল,
“একি! বন্ধ করলে কেন?”
শিরিন প্রচন্ড রেগে আছে। সে হিসহিসিয়ে বলল,
“তুমি জানো সকাল থেকে কতকিছু সহ্য করতে হচ্ছে আমাকে? আর তুমি মনের আনন্দে গান শুনছো?”
অমিত ঠান্ডা গলায় বলল,
“রেগে যেয়ো না। তুমিও গান শুনতে পারো চাইলে। এতে চিন্তা কমবে।”
শিরিন চিৎকার করে বলল,
“অমিত! আমি মজা করছি না। সকাল শুরু হয়েছে তোমাকে নিয়ে ঝামেলায়। তারপর ওই লোকটা এসে বিন্তুকে নিয়ে যা তা বলে গেছে। মা বাবা দুজনেই ভীষণ রেগে আছে। তার উপর বিন্তু এখনো বাড়ি ফেরে নি। ফুপু ঘরে বসে কাঁদছে। আর তুমি!”
অমিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি বুঝতে পারছি তুমি খুব চিন্তিত। কিন্তু আমার কি কিছু করার আছে?”
শিরিন চোখ বন্ধ করে বড় করে একবার শ্বাস নিলো। তারপর রুক্ষ গলায় বলল,
“অমিত, আমার বাড়িতে এভাবে হুট করে এসে ঝামেলা বাঁধিয়েছ তুমি। এই অপরাধে আমি তোমাকে বিয়ে করবো না।”
অমিত শান্ত গলায় বলল,
“তুমি না করতে চাইলে করবে না। অসুবিধা কি?”
শিরিনের রাগে গা জ্বলে গেল। এ কেমন ছেলের সাথে প্রেমে জড়িয়েছে সে! রেগে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই কলিং বেল বাজলো। সে একবার রাগী চোখে অমিতের দিকে তাকালো। তারপর হনহন করে বেরিয়ে গেল। দরজা খুলে সে বিন্তুকে দেখতে পেলো। শিরিনের যেন প্রাণ ফিরে এলো। সে বিন্তুকে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এলো। আদরের গলায় বলল,
“কোথায় ছিলি, বিন্তু? তুই তো পুরো ভিজে গিয়েছিস। চল, ঘরে চল।”
শিরিন বিন্তুকে নিয়ে ঘরে যেতে পারলো না। উঠানে শর্মিলি আর খায়রুল সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। শর্মিলি হিসহিস করে বললেন,
“নষ্ট মেয়েছেলে! সারাদিন কার সাথে কাটিয়ে এলি?”
শিরিন চাপা গলায় বলল,
“মা! থামো।”
শর্মিলি থামলেন না। চিৎকার করে সায়লাকে ডাকলেন,
“সায়লা, কোথায় গেলে? বেরিয়ে এসো। তোমার গুণবতী মেয়ে আমাদের নাক কেটে ফিরে এসেছে।”
সায়লা প্রায় সাথে সাথেই ছুটে বেরিয়ে এলেন। বিন্তু ভয়ে ভয়ে মায়ের দিকে তাকালো। মায়ের চোখমুখ লাল হয়ে আছে। বোধহয় এতক্ষণ কান্নাকাটি করেছে। বিন্তু অস্ফুটে উচ্চারণ করছিল,
“মা, আ…আমি…. ”
তার কথা শেষ হলো না। সায়লা উর্ধশ্বাসে ছুটে গিয়ে বিন্তুর চুলের মুঠি ধরলেন। বিন্তু যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠলো। সায়লা জ্ঞানশূন্য হয়ে বললেন,
“বেইমান বেহায়া মেয়ে। তোকে আজকে সবার সামনে আমি মারবো। শেষ করে ফেলবো তোকে। আর কত জ্বালাবি আমাকে?”
শিরিনের চোখে পানি এসে গেল। সে অনেক চেষ্টা করেও ফুপুকে আটকাতে পারলো না। শুধু অস্পষ্টভাবে বলতে লাগলো,
“ছেড়ে দাও, ফুপু। ছেড়ে দাও।”
শিরিনের কথা সায়লা শুনলেন না। উনি শুনলেন খায়রুল সাহেবের কথা। খায়রুল সাহেব প্রচন্ড এক ধমক দিয়ে বললেন,
“সায়লা! মেয়েকে ছেড়ে দে।”
সায়লা ছেড়ে দিলেন। তারপর মুখে আঁচল দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে চলে গেলেন উনি। প্রচন্ড অভিমান আর অপমানে বিন্তুর চোখ থেকে পানি পরতে শুরু করেছে। শিরিন তাকে একহাতে ধরে রেখেছে। খায়রুল সাহেব এগিয়ে গেলেন। কঠিন গলায় বললেন,
“এই নিয়ে আমাকে দুইবার অপমানিত হতে হলো তোর জন্য। তুই কি বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছিস, বিন্তু? হাবিবের বড় চাচা নিজে এসেছিলেন আজ। হাবিব তোকে নিয়ে ভালো কোনো রেঁস্তোরায় খেতে চেয়েছে। এটা কি কোনো অপরাধ? কেন তুই তাকে অপমান করে চলে গিয়েছিস?”
বিন্তু উত্তর দিলো না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। শিরিন অস্থির হয়ে বলল,
“বাবা, এসব কথা পরে হবে। ওকে ঘরে নিয়ে যাই।”
“না, শিরিন। ওকে আগে বলতে হবে কেন ও আমাকে অপমান করলো?”
বিন্তু এবারও উত্তর দিলো না। কিন্তু উত্তর এলো দরজার দিক থেকে। শীতল মেয়েলি গলায় কেউ বলল,
“বেশ করেছে।”
সকলে দরজার দিকে ঘুরে তাকালো। উঠোনের মাথায় শাড়ি পরিহিত এক যুবতী দাঁড়িয়ে আছে। শিরিন আচ্ছন্নের মতো বলে উঠলো,
“বড় আপা!”
শর্মিলি ছুটে গেলেন। মেয়েটির হাতে মুখে চুমু খেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কেঁদে ফেলেছেন তিনি। হড়বড় করে বলতে লাগলেন,
“রুনি! আমার রুনি! মা, তুই এসেছিস? আমি জানতাম তুই একদিন আসবিই। মা বাবার উপর কি রাগ করে থাকা যায়? মা আমার! কেমন আছিস, মা? এতদিন পরে আমার কথা তোর মনে পড়েছে?”
রুনি নিজেকে মায়ের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিলো। কঠিন গলায় বলল,
“না, মা। তোমার কথা আমার মনে পড়ে নি। আমি এসেছি বিন্তুর বিয়ের খবর শুনে।”
শর্মিলি আহত চোখে তাকিয়ে রইলেন। রুনি উনার হাত সরিয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে এলো। খায়রুল সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ালো সে। খায়রুল সাহেবের বুক কাঁপছে। উনি নিজের বড় কন্যার মাথায় হাত রেখে জানতে চাইলেন,
“মা, ভালো আছিস?”
রুনি এ প্রশ্নের উত্তর দিলো না। রুক্ষ গলায় বলল,
“বিন্তু যা করেছে ঠিক করেছে, বাবা। তোমাদের সব কথাই এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনেছি। তোমরা বিয়েটা ঠিক করার আগে একবার জানতে চেয়েছিলে ওর মত আছে কিনা? জিজ্ঞেস করেছিলে এই ছেলেটাকে ওর পছন্দ কিনা? ছেলের বড় চাচা কি না কি বলে গেছে সেই কথায় তোমরা ওকে দোষারোপ করছো! একবার ওর থেকে জানতে চেয়েছ কি ঘটেছিল? মেয়েটা সারাদিন পর বাইরে থেকে এসেছে। জানতে চেয়েছ সারাদিনে ও খেয়েছে কিনা? জিজ্ঞেস করেছ একবারও যে ও ঠিক আছে কিনা? তোমরা সবসময়ের মতো নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। ছি, বাবা!”
খায়রুল সাহেব বজ্রাহতের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলেন। রুনি বিন্তুর হাত ধরে বলল,
“যা করেছিস ঠিক করেছিস। একদম কাঁদবি না। চল, ঘরে চল।”
রুনি আর কোনোদিকে না তাকিয়ে বিন্তুকে নিয়ে ঘরে চলে গেল। বাকি সবাই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো উঠোনে। গুড়গুড় করে মেঘ ডাকতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে, এক্ষুনি আবার বৃষ্টি পরতে শুরু করবে। বাতাসে ভেজা গন্ধ।
.
#চলবে…………….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে