চড়ুই নীড়ে বসবাস পর্ব-০৫

0
193

#চড়ুই_নীড়ে_বসবাস
#আলো_রহমান(ফারজানা আলো)
#পর্ব:৫
.
সবকিছু সামলে শিরিন সবেমাত্র নিজের ঘরে গিয়ে বসেছে। ভীষণ ক্লান্তিতে শরীর এলিয়ে পড়েছে তার। বিশাল একটা ঝামেলা সামলানো গেছে ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। সময় বুঝে অমিতকে উচিত শিক্ষা দেবে সে। এভাবে ঝামেলা বাঁধানোর কোনো মানে হয়? এমনিতেই বিন্তুর ব্যাপারটা নিয়ে সে চিন্তিত। আপাতত নিজেকে কিছুক্ষণ স্বস্তি দিতে শিরিন একটা ম্যাগাজিন হাতে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো। প্রথম পাতা খুলতেই শর্মিলি তার ঘরে ঢুকলেন। শিরিন ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল,
“আবার কি হলো, মা?”
শর্মিলির মুখ থমথমে। উনি নিঃশব্দে বিছানার এক কোণায় বসলেন। অসম্ভব রকমের ভারী গলায় বললেন,
“শিরিন, মা বাবাকে কষ্ট দিয়ে কিছু করতে নেই।”
শিরিন ভ্রু কুঁচকে ফেললো। কোনো উত্তর না দিয়ে পুনরায় ম্যাগাজিনের পাতায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। কিছুক্ষণ নীরবতার পরে শর্মিলি আবার বললেন,
“তোর বড় বোন আমাদের সাথে আর যোগাযোগ রাখে নি। আমাদের কথা মনেও পড়ে না তার। কিন্তু এই আমিই ওকে জন্ম দিয়েছি। আমার হাতে ও মানুষ হয়েছে। ওকে লালন পালন করে কি আমি দোষ করেছি?”
শিরিন নির্লিপ্তভাবে জবাব দিলো,
“দোষ করেছ ওর অমতে ওকে বিয়ে দিয়ে।”
শর্মিলি আহত চোখে তাকালেন। শুকনো গলায় বললেন,
“ওর খারাপ করেছি? ও কি সুখে নেই?”
“সে তো আর তুমি আমি ঠিক করতে পারি না, মা। ওর মনে সুখ আছে কিনা, সেটা ওইই বলতে পারবে। আর সুখ থাকলেও হয়তো ওর অভিমান মেটে নি এখনো। কে জানে!”
“তুই আমার সাথে এত কঠিন করে কথা বলছিস কেন, শিরিন?”
“কঠিন করে কথা বলছি না।”
শর্মিলি শিরিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। ওর মনোযোগ ম্যাগাজিনের পাতায়। মায়ের দিকে ভুলেও তাকাচ্ছে না। শর্মিলি এবার ব্যথিত গলায় বললেন,
“তোকে তোর বাবা খুব ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছে। কোনোকিছুর কমতি রাখে নি। আমিও তোর কোনো কাজে বাধা দিই নি। এর প্রতিদানে কষ্ট পাওনা আমাদের?”
শিরিন স্বাভাবিক গলায় বলল,
“না। বিন্তু আর ফুপুকে কষ্ট দেওয়ার প্রতিদানে কষ্ট পাওনা তোমার।”
শর্মিলি বজ্রাহতের ন্যায় তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর চিৎকার করে উঠলেন,
“শিরিন!”
“চিৎকার করো না, মা।”
শর্মিলি উঠে দাঁড়ালেন। রাগী গলায় বললেন,
“ঠিক আছে। তোর আদরের ফুপুকে আমি কষ্ট দিয়েছি। আমার সাথে তোকে কথা বলতে হবে না। তুই তোর বাবার সাথে কথা বল। সে তো আর কাউকে কষ্ট দেয় নি।”
শিরিন চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকালো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তুমি বাবাকে অমিতের বিষয়টা জানিয়ে দিয়েছ?”
“হ্যাঁ, দিয়েছি। চেনা নেই, জানা নেই, একটা ছেলে আমার মেয়েকে বিয়ে করতে আমার বাড়িতে এসে উঠেছে। আর আমি কিছু বলবো না?”
কথা শেষ করে শর্মিলি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। শিরিন বিছানা ছেড়ে নামলো। ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বাবার ঘরের সামনে গিয়ে শিরিন থামলো। তার বাবা পায়চারি করছেন। উনাকে দেখে ভীষণ চিন্তিত এবং বিচলিত মনে হচ্ছে। শিরিন দরজায় দাঁড়িয়েই বলল,
“বাবা, চা এনে দেবো?”
খায়রুল সাহেব তাকালেন। গম্ভীর গলায় বললেন,
“ভেতরে আয়।”
শিরিন ভেতরে গেল। খায়রুল সাহেব কিছুটা চেঁচিয়ে বললেন,
“এসব কি হচ্ছে আমার বাড়িতে?”
শিরিন চমকালো। বাবা সরাসরি একটা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কথা শুরু করেছেন মানে তিনি সত্যিই ভীষণ রেগে আছেন। সে ইতস্তত করে বলল,
“বাবা, মা তোমাকে কতটুকু বলেছে আমি বুঝতে পারছি না।”
খায়রুল সাহেব একইভাবে বললেন,
“আমার বাড়িতে জ্বর নিয়ে একটা ছেলে পরে আছে। অথচ আমাকে কিছুই জানানো হয় নি। কেন?”
শিরিন উত্তর দিলো না। মা জানাতে নিষেধ করেছিল এ কথাটা বলাটাও এখন যুক্তিযুক্ত হবে না। কারণ মা নিজেই সবটা জানিয়ে দিয়েছে। সব অমিতের দোষ। সে অমিতকে ছাড়বে না।
খায়রুল সাহেব বিছানার পাশের আরামকেদারায় বসলেন। হিসহিসিয়ে বললেন,
“ছেলেটাকে ডেকে দে। দেখি তার অসুবিধা কি।”
“জ্বি, বাবা।”
শিরিন ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল। গুটি গুটি পায়ে নিচে নেমে সে অমিতকে সে উপরে পাঠালো। তারপর নিচের বারান্দায় ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে পরলো।

অমিত বেশ সহজভাবে দাঁড়িয়ে আছে। খায়রুল কবির সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে দেখছেন। ছেলেটির চোখেমুখে প্রশান্তি। জীর্ণ জামাকাপড় আর উষ্কখুষ্ক চুল। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর চোখের দৃষ্টি খানিক উদ্ভ্রান্ত। এ বাড়ির মেয়েদের পছন্দ এত অদ্ভুত কেন তিনি ভেবে পেলেন না। শুরুতে সায়লা, তারপর উনার নিজের মেয়েরা। উনি চোখেমুখে গম্ভীর ভাব এনে বললেন,
“কি করা হয়?”
অমিত সাবলীল ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,
“মাস্টার্স করেছি দু’বছর হলো। এখন চাকরি খুঁজছি।”
“তুমি শিরিনের সিনিয়র।”
“জ্বি, তিন বছরের।”
“তবে যে শিরিন বলল তুমি ওর বন্ধু?”
অমিত হালকা কেশে বলল,
“ইয়ে…জ্বি। বিতর্ক ক্লাবে পরিচয় হয়েছিল। তারপর একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে বলতে পারেন।”
খায়রুল সাহেব কিছুটা রূঢ় গলায় বললেন,
“এখানে কি মনে করে? মাঝরাতে বান্ধবীর বাড়িতে আসাটা কি কোনো ভদ্রলোকের ছেলের কাজ?”
অমিত ইতস্তত করে বলল,
“আসলে, আমি একটা চিলেকোঠায় ভাড়া থাকতাম। চার মাস ভাড়া দিতে পারি নি বলে কাল হঠাৎ মাঝরাতে বাড়িওয়ালা আমাকে বের করে দিয়েছেন। আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। তাই সাতপাঁচ না ভেবেই আমি এখানে চলে এসেছি। আমি দুঃখিত।”
খায়রুল সাহেবের কঠিন চোখমুখ স্বাভাবিক হয়ে এলো। উনি প্রশ্ন করলেন,
“যাওয়ার জায়গা নেই মানে? তোমার নিজের বাড়িঘর নেই?”
অমিত মাথা নিচু করে বলল,
“জ্বি না। আমি ছোটবেলায় ফুপুর বাড়িতে কাটিয়েছি। তারপর একটা বয়সের পর থেকে হোস্টেলে হোস্টেলে থেকেছি। মা বাবা নেই। আর এমন কোনো বন্ধুবান্ধবও নেই যে আমাকে থাকতে দিতে রাজি হবে। কিছুটা নিরুপায় হয়েই…..”
খায়রুল সাহেব চেয়ারে হেলান দিলেন। চোখ বুজে বললেন,
“ঠিক আছে। তুমি নিচের ঘরে যাও।”
অমিত মাথা নেড়ে “জ্বি আচ্ছা” বলে নিচে নেমে গেল। ভদ্রলোককে খুব একটা কঠিন মানুষ বলে তার মনে হলো না।
_____________________________________
নদীর বাঁধের চারপাশটা শান্ত। নদীর ধারের এই ক্যাফেতে বিন্তু প্রায়ই আসে। কফিতে চুমুক দিতে দিতে উল্টোদিকের ডাক বাংলোর মাঠে বাচ্চাদের ক্রিকেট খেলা দেখে। মাঝে মাঝে আরেকদিকে তাকিয়ে ঠান্ডা নদীর জলে বয়ে চলা ধীরস্থির ঢেউ গোনে। আজ সে এসেছে হাবিব নামক ব্যক্তিটির সঙ্গে। লোকটাকে এই প্রথম যে ভালো করে দেখলো। ভদ্রলোকের বয়স সত্যিই কিছুটা বেশি। কে জানে বিন্তুর সাথে চিন্তাভাবনায় মিল হবে কিনা। বিন্তুই প্রথম কথা বলল।
“জায়গাটা সুন্দর না?”
হাবিব বিরস মুখে উত্তর দিলো,
“আমার ফাইভ স্টার ছাড়া অন্য কোনো জায়গা পছন্দ নয়। নদীর ধার থেকে ধুলো উড়ে আসছে। আমার বিশেষ ভালো লাগছে না।”
বিন্তু হেসে ফেললো। নদীর দিকে তাকিয়ে বলল,
“ধুলো উড়ছে না। সুন্দর হাওয়া আসছে। যাই হোক, আপনি কি ধরণের কফি খেতে পছন্দ করেন?”
হাবিব অনাগ্রহের সঙ্গে জবাব দিলো,
“আমি এরকম একটা দোকানের কফি খেতে চাইছি না।” তোমাকে জায়গা পছন্দ করার দায়িত্ব দিয়ে ভুল করেছি। সেই ভুলের খেসারত হিসেবে এখন এখানে বসে আছি।”
বিন্তুর কপাল কুঁচকে গেল। এই জায়গায় খারাপ কি আছে? তার এখন বিরক্ত লাগছে লোকটাকে। সে তবুও মুখে হাসি টেনে বলল,
“খেয়ে দেখুন। খারাপ লাগবে না। আমি অর্ডার দিয়ে আসছি। আপনার জন্য কোল্ড কফি বলছি।”
বিন্তু উঠে গেল টেবিল থেকে। মিনিট পাঁচেকের ভেতরে ফিরে এলো। চেয়ারে বসতে বসতে বলল,
“এখানকার কফি খারাপ নয়। আপনি খেয়ে দেখুন। এই এলাকার মেয়েকে যখন বিয়ে করছেন, তখন এখানকার খাবারও তো পছন্দ করতে হবে। আর যাকে বিয়ে করছেন, তার পছন্দের জায়গা হলে তো আরও আগে পছন্দ করতে হবে।”
হাবিব ভ্রু কুঁচকে বলল,
“পছন্দ করার কিছু নেই। বিয়ের পরে মেয়েদের পছন্দ অপছন্দ বদলাতে হয়। তোমাকেও বদলাতে হবে, বিন্তু। আমাদের আদব কায়দার সাথে মানিয়ে নিতে হবে।”
বিন্তু দমে গেল। তার পছন্দ অপছন্দের কোনো দাম নেই নাকি? সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“আপনার তাহলে কি পরিকল্পনা ছিল?”
“আমার পরিকল্পনা ছিল তোমাকে নিয়ে কোনো ফাইভ স্টারে গিয়ে লাঞ্চ করা।”
“তাহলে শুরুতেই বললেন না কেন? শুধু শুধু আমাকে পছন্দ করতে বললেন।”
“ভদ্রতা করে বলেছি। তোমার রুচি এত খারাপ, তা তো বুঝি নি। অবশ্য তোমার দোষ নেই। যেভাবে বড় হয়েছ, রুচিও তেমন হয়েছে। তবে এখন বদলাতে হবে।”
বিন্তু এবার রাগী গলায় বলল,
“আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন!”
হাবিব হেসে উঠে বলল,
“তুমি দেখি রেগে যাচ্ছ। কথাগুলো সহজভাবে নাও।”
বিন্তু কথা বলল না। তাদের কফি চলে এসেছে। বিন্তু হাতে নিয়ে চুমুক দিলো। সম্পূর্ণ মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো কফির কাপ আর নদীর পানিতে। হাবিব কফিটা খেলো না। বিন্তুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“সেদিন বৃষ্টির মধ্যে তুমি সারাদিন ছিলে কোথায়?”
বিন্তু সহজভাবে উত্তর দিলো,
“আশেপাশেই হাঁটাহাঁটি করেছি। তারপর বৃষ্টিতে ভিজেছি।”
হাবিব ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কেন?”
“কারণ আমার বৃষ্টি পছন্দ। আবহাওয়ার খবরে দেখেছিলাম আজ বৃষ্টি হতে পারে। চাইলে আপনি ভিজতে পারেন। নদীর ধারের ঘাসে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজা খুবই রোমাঞ্চকর ব্যাপার।”
হাবিব ব্যাঙ্গাত্মক হেসে বলল,
“টিনেজারদের মতো কথা বলছো কেন? তোমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে, বিন্তু। ম্যাচিউর চিন্তাভাবনা করো। কাদায় পা মাখামাখি করে বৃষ্টিতে ভেজার বয়স কি আর আছে তোমার?”
বিন্তু এবার প্রচন্ড বিরক্ত হলো। চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি চলে যাচ্ছি।”
হাবিবও উঠে দাঁড়ালো। বলল,
“হ্যাঁ, চলো। এখানে আর ভালো লাগছে না।”
বিন্তু কঠিন গলায় বলল,
“আপনি আমার সাথে যাচ্ছেন না।”
হাবিব হকচকিয়ে গিয়ে বলল,
“মানে?”
“মানে, আমি আপনার সাথে যাব না। দুপুরে আপনার সাথে খাবও না। আমি যাব আমার মতো।”
হাবিব হতভম্ব হয়ে বলল,
“কোথায় যাবে?”
“যেখানে আমার ইচ্ছা। আর আপনি আমার সাথে আসার চেষ্টাও করবেন না। নইলে আমি চিৎকার করবো।”
হাবিব অস্ফুটে বলল,
“বিন্তু, দাঁড়াও। আমি কিন্তু বিয়েটা ভেঙে দেবো। তোমার মামার সাথে কথা বলবো।”
বিন্তু শুনলো কিনা বোঝা গেল না। সে বেরিয়ে চলে গেল। হাবিব দাঁড়িয়ে দেখছে বিন্তু হাইস্কুলের পাশের রাস্তাটা ধরে এগিয়ে চলেছে।
.
#চলবে………….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে