#চড়ুই_নীড়ে_বসবাস
#আলো_রহমান(ফারজানা আলো)
#পর্ব:৪
.
মধ্যরাতটা শুরু হয়েছে অন্যভাবে। টিপটিপ বৃষ্টি আর হালকা বাতাসে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর পরিবর্তে বিন্তু বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছে। তার ঘুম আসছে না। বহুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে সে বিছানা ছেড়ে উঠে এসেছে। এই মুহূর্তে তার ভয়ংকর একটা ইচ্ছে করছে। ইচ্ছা করছে হুট করে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে। কিন্তু এই ঘটনা এখনই পুনরাবৃত্তি করা সম্ভব নয়। শিরিন আপাকে বলে দেখা যেতে পারে। তার কাছে সব সমস্যার সমাধান থাকে। বিন্তু একবার ভাবলো শিরিনের ঘরে যাবে। পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত বদল করলো। শিরিন আপা হয়তো ঘুমিয়ে পরেছে। অথবা হয়তো প্রেমিকের সাথে ফোনালাপে ব্যস্ত। বিরক্ত করা একেবারেই ঠিক হবে না। কেউ একজন যতই কাছের হোক না কেন, তার ব্যক্তিগত গন্ডিতে ঢুকে পরা উচিত নয়। বিন্তু বারান্দার গ্রিল ঘেঁষে দাঁড়ালো। বাতাসের ধাক্কায় কিছু পানি বারান্দায় এসে পরেছে। বিন্তু পানিটুকু পাশ কাটিয়ে সামনের উঠোনের দিকে তাকালো। কংক্রিটের উঠোনে বারান্দার এক কোণে জ্বলতে থাকা হলুদ আলোটা ছড়িয়ে আছে। টিমটিমে আলোয় উঠোনের বৃষ্টি ফোঁটাগুলো চকচক করছে। চারদিকে মাটির টবে লাগানো পাতাবাহার গাছগুলো মৃদু বাতাসে নাচছে। বিন্তুর এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে গাছ হয়ে জন্মালে ভালো হতো। না থাকতো মন, না থাকতো দুঃখ। সে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
কাঁধে ঠান্ডা হাত পরতেই বিন্তু চমকে পিছনে ফিরলো। দোতলা থেকে শিরিন নেমে এসেছে। তার মুখ থমথমে। বিন্তু হাফ ছেড়ে বলল,
“উফ, আপা! ভয় পাইয়ে দিয়েছ। এভাবে ভূতের মতো কেউ হাঁটাচলা করে? পা ফেলার কোনো আওয়াজ নেই পর্যন্ত!”
শিরিন শুকনো মুখে বলল,
“একটা ঝামেলা হয়ে গেছে, বিন্তু।”
বিন্তু অস্থির হয়ে বলল,
“সে কী! আবার কি হলো?”
শিরিন থমথমে মুখে উত্তর দিলো,
“অমিত আমাদের বড়ির সামনে চলে এসেছে।”
বিন্তু কিছু বুঝতে পারলো না। অস্ফুটে বললো,
“কে?”
অমিতকে বাইরের বসার ঘরে এনে বসানো হয়েছে। ছেলেটাকে বিন্তুর বেশ ভালো লাগছে। প্রেমিকাকে দেখতে বাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে। এটা কি কম বড় ব্যাপার? শিরিন রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এসব খামখেয়ালিপনার মানে হয় না। এখন যদি বাড়ির কেউ উঠে পরে তাহলে কী ঝামেলাটাই না হবে!
অমিতের হাতে একটা তোয়ালে দিয়েছে বিন্তু। সে মাথা মুছছে। বিন্তু জিজ্ঞেস করলো,
“পানি খাবেন?”
অমিত মৃদু হেসে বলল,
“পানি লাগবে না। কিন্তু এক কাপ চা খেতে পারি। অনেকক্ষণ ঠান্ডা বাতাসে থেকেছি তো। খুব ঠান্ডা লাগছে।”
বিন্তু বিস্মিত হলো। একটা অল্পবয়সী যুবক লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেমিকাকে দেখতে এসেছে। তাকে বাড়ির ভেতরে আনা হয়েছে চোরের মতো। অথচ এমন অনায়াসে চা চাইলো যেন সে নিমন্ত্রিত কোনো অতিথি। শিরিন কঠিন গলায় বলল,
“এত রাতে এই বাড়িতে চা হবে না।”
বিন্তু উঠে দাঁড়ালো। কোমল গলায় বলল,
“এভাবে বলো না, আপা। আমি নিয়ে আসছি।”
শিরিন বিচলিত হয়ে বলল,
“সাবধানে, বিন্তু! কেউ টের পেয়ে গেলে ঝামেলা হবে।”
বিন্তু মৃদু হেসে মাথা নাড়লো। পা টিপে টিপে রান্নাঘরের দিকে রওনা হলো। শিরিন তাকালো অমিতের দিকে। অমিত হাত পা ছড়িয়ে আরাম করে বসেছে। সে বিরক্ত গলায় বলল,
“এসবের মানে কি? বাড়িতে এমনিতেই হাজার ঝামেলা। বাবা জানতে পারলে আমাকে আস্ত রাখবে না।”
অমিত স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিলো,
“আমি দুটো দরকারে এসেছি। প্রথম দরকার, তোমার সাথে দেখা করা। আর দ্বিতীয়, আমার কিছু টাকার প্রয়োজন। তুমি ছাড়া আমাকে ধার দেওয়ার কেউ নেই।”
শিরিন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হতাশ চোখে তাকিয়ে বলল,
“এই যুগে টাকা ধার করতে তিন ঘন্টা বাসে বসে সামনে এসে দাঁড়াতে হয়? তুমি চাইলে আমাকে ফোনে বলতে পারতে। আমি টাকা পাঠিয়ে দিতাম। এটা কোনো দরকারি কারণ হতে পারে না, অমিত। এসব ছেলেমানুষির মানে কি?”
অমিত হাসলো। শিরিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি কেন এসেছি, আমি আসলে জানি না।”
শিরিন ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তোমার কান্ডকারখানা আমি এখনো বুঝি না। বিন্তু চা নিয়ে এলে খেয়ে চলে যাবে। যন্ত্রণা!”
অমিত বিনা দ্বিধায় বলল,
“শুধু চা খেয়ে যেতে পারবো না। আমার খুব ক্ষিদে লেগেছে। এক প্লেট গরম ভাত আর ডিম ভাজি খেয়ে তারপর উঠবো।”
শিরিন রাগ করতে গিয়েও পারলো না। মমতার চোখে অমিতের দিকে তাকালো। এই ছেলেটার উপর কেন যে তার এত মায়া, সে বুঝতে পারে না। হয়তো অমিতের কেউ নেই বলেই এত মায়া হয় তার। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। কোমল গলায় বলল,
“তুমি বসো। আমি ব্যবস্থা করছি।”
শিরিন ভেতরে গেল। অমিত সোফায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পরলো এবং কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পরলো।
___________________________________________
বিন্তু ঘুমিয়েছিল অনেক রাতে। তার ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে গেল। বেলা এগারোটায় অন্তুর ডাকে সে উঠলো। কোনোমতে চোখ টেনে খুলতেই অন্তু হড়বড় করে বলল,
“দুঃসংবাদ, আপা। দুলাভাই এসেছে তোমাকে নিয়ে বাইরে যাবে বলে। কিন্তু তাকে বসার ঘরে নিয়ে যেতেই এক বিপত্তি। সেখানে এক অচেনা ছেলে শুয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। মা তো ভয়ে কথা বলতে পারছে না।”
ঘুমের রেশ কাটেনি বলে অন্তুর কথাগুলো তার বোধগম্য হলো না। বিন্তু উঠে বসলো। আড়মোড়া ভেঙে জড়ানো গলায় বলল,
“হড়বড় করে কীসব বলছিস? দুলাভাই কে? কার দুলাভাই?”
অন্তু উত্তর দিলো,
“আমার দুলাভাই, আপা। যার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হচ্ছে।”
বিন্তু দমে গেল। লোকটা এখানে কি চায়? বিরক্তি নিয়ে বলল,
“এসেছে তো আমি কি করবো? আমি উনার সাথে কোথাও যেতে পারবো না। শিরিন আপা কি করছে দেখে আয়। আপার সাথে বাইরে যাব আমি।”
অন্তু বিরস মুখে বলল,
“শিরিন আপা আসতে পারবে না। সে মামীকে সামলাচ্ছে। অচেনা সেই ছেলে নাকি আপার বন্ধু।”
বিন্তু চমকে উঠলো। সর্বনাশ! অমিত নামক ছেলেটি কি তবে রাতে এখানেই থেকে গেছে? বিন্তু বিছানা ছেড়ে নামলো। দৌড়ে মায়ের ঘরে যেতেই সেখানে শিরিন আর তার মামীকে আবিষ্কার করলো। শর্মিলি মুখভার করে আছেন। শিরিন বলছে,
“মা, ও বিপদে পরে এসেছে। ওর খুব জ্বর বলে আমি ওকে চলে যেতে বলতে পারি নি।”
শর্মিলি মুখ ভোঁতা করে বললেন,
“তোকে আমি কোনোকিছুতে না করি না বলে তো তুই যা খুশি করতে পারিস না। বন্ধুবান্ধব কি অন্য কারোর থাকে না? তারা কি এভাবে রাত বিরাতে বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়?”
“মা, ওর জ্বর কমলে চলে যাবে। তুমি একটু শান্ত হও।”
শর্মিলি সায়লার দিকে তাকালেন। চাপা গলায় বললেন,
“সায়লা, সারারাত একটা বাইরের লোক বাড়ির ভেতরে। অথচ তুমি আমাকে সকালবেলা জানাচ্ছো?”
সায়লা থতমত খেয়ে বললেন,
“আমি তো বাইরের বসার ঘরে যাই নি, ভাবি। তাই জানতে পারি নি।”
শিরিন মাথা নিচু করে বলল,
“মা, আমি খুব লজ্জিত। তুমি প্লিজ একটু বুঝতে চেষ্টা করো। ও সত্যিই অসুস্থ। তবে হ্যাঁ, এভাবে না বলেকয়ে এসেছে বলে তুমি একশবার রাগ করতে পারো। চলে যেতেও বলতে পারো। আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি ওকে বলছি এখনই বেরিয়ে যেতে।”
শিরিন বাইরে যাচ্ছিলো। শর্মিলি গম্ভীর গলায় বললেন,
“থাক। চলে যেতে বলতে হবে না। আজকের দিনটা থাকুক। কিন্তু তোর বাবা যেন জানতে না পারে। ছেলেটাকে বলে দিস যেন ওই ঘর থেকে বাইরে না বেরোয়।”
শিরিন আনন্দিত হলো। ভেতরের উচ্ছ্বাসকে চাপা দিয়ে বলল,
“বলে দেবো, মা। ও ঘর থেকে বেরুবে না।”
শর্মিলি সায়লার দিকে তাকালেন। কড়া গলায় বললেন,
“তোমার মেয়েদের বলে দাও ওই দিকে যেন না যায়। আর হাবিবকে আমি বলছি ভেতরে এসে বসতে। যতসব ঝামেলা আমার ঘাড়ে জুটেছে!”
শর্মিলি বেরিয়ে গেলেন। শিরিন যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। বিন্তু ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে বলল,
“ব্যাপারটা কি, আপা? তোমার অমিত সাহেব তো দেখছি ডেঞ্জারাস। শ্বশুর বাড়িতে লুকিয়ে লুকিয়ে এসে এভাবে ঘুমিয়ে পরলো?”
শিরিন হাসলো। বিন্তুর হাত চেপে ধরে বলল,
“চুপ কর, বিন্তু। আস্তে কথা বল।”
শর্মিলি বাইরের বসার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। উনার উদ্দেশ্য হাবিবকে ওখান থেকে ভেতরের ঘরে এনে বসানো। কিন্তু ঘরের দরজায় দাঁড়াতেই উনার ভ্রু কুঁচকে গেল। অমিত সোফার উপরে পা তুলে বসেছে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে খুব আগ্রহ নিয়ে হাবিবের সাথে গল্প করছে। সে বলছে,
“হাবিব ভাই, আপনি বুদ্ধিমান মানুষ। আপনি কেন এত ছোট একটা মেয়েকে বিয়ে করছেন বুঝতে পারছি না। আপনি ব্যবসায়ী মানুষ। এই মেয়ে আপনার ব্যবসার কি বুঝবে?”
হাবিব জবাব দিলো,
“বুঝবে না বলেই বিয়ে করছি। ঘরের বউয়ের ব্যবসা বোঝার প্রয়োজন কি?”
অমিত হেসে বলল,
“আপনাকে যতটা ভেবেছিলাম, তার থেকে বেশি বুদ্ধিমান মনে হচ্ছে। এই বাড়িটা আপনার কেমন লাগে?”
“ভালো। তবে বেশ পুরানো বাড়ি। নতুন ফ্ল্যাট করতে পারলে ভালো হতো। আমার পরিচিত একজন কন্ট্রাক্টর আছে। মামার সাথে কথা বলে দেখবো ভাবছি।”
“বলছেনটা কি? বিয়ের আগেই হবু শ্বশুরবাড়ি ভাঙতে চাইছেন? আপনি দেখছি পাকা ব্যবসায়ী।”
“ভুল কিছু তো বলছি না। পুরানো বাড়ি আর কতদিন?”
অমিত চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,
“আমার আবার পুরানো আর্কিটেকচার খুব পছন্দ। আমি এই বাড়ি ভাঙতে দেবো না।”
হাবিব তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“আপনি এই বাড়ির ব্যাপারে কথা বলার কে?”
অমিত স্পষ্ট গলায় বলল,
“আপনি যা, আমিও তা। আমিও এই বাড়ির হবু জামাই। আমি শিরিনকে শীঘ্রই বিয়ে করতে চলেছি। আপনি বয়সে বড় হলেও সম্পর্কে আপনার চেয়ে বড় হবো আমি।”
হাবিব আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে রইলো। দরজা থেকে আরও এক জোড়া চোখ অমিতের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখ শর্মিলির। উনি হতভম্ব হয়ে গেছেন। এই ছেলের নাকি জ্বর! কই? দেখে তো বোঝা যায় না!
.
#চলবে………..