চড়ুই নীড়ে বসবাস পর্ব-০৩

0
203

#চড়ুই_নীড়ে_বসবাস
#আলো_রহমান(ফারজানা আলো)
#পর্ব:৩
.
সকাল থেকে আকাশ মেঘলা। বৃষ্টি যদিও থেমেছে, তবুও থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বর্ণিল চিন্তিত হয়ে বিছানায় বসে আছে। সম্ভবত সকাল দশটার মতো বাজে। মেঘের কারণে মনে হচ্ছে সদ্য ভোর হয়েছে। বর্ণিল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। বিন্তুদের বাড়ির সামনে একটা সাদা রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সে একদৃষ্টিতে সেদিকেই দেখছে। আজ তার অন্তুকে পড়াতে যাওয়ার কথা ছিল বিকাল তিনটায়। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঘন্টাখানেকের ভেতরে সেখানে উপস্থিত হবে। ব্যাপারটা যে কী ঘটছে সেটা জানতে সে অস্থির হয়ে আছে। বিন্তুর বিয়ে কি সত্যি সত্যিই হচ্ছে? অবশ্য হলেও আশ্চর্য কি? এই বয়সী মেয়ের বিয়ের তোরজোড় হবে, সেটাই বরং স্বাভাবিক। বর্ণিল দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
দরজা খুলে বর্ণিলের ঘরে প্রবেশ করলেন তার মা, নাজমা। তিনি খুব কঠিন ধরণের মহিলা। একমাত্র ছেলেকে মানুষ করেছেন খুব কড়া শাসনে। অতি আদরে ছেলে নষ্ট হয়ে যাবে, সেই সম্ভাবনাই কোনোভাবে তৈরি করতে চান নি। নাজমা ছেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ছেলের বিচলিত মুখ লক্ষ্য করে চিন্তিত হলেন। কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,
“তোমাকে বিচলিত মনে হচ্ছে, বর্ণ। কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করছো?”
বর্ণিল মায়ের দিকে তাকালো। শান্ত গলায় বলল,
“না।”
“সকাল দশটা বাজে। নয়টায় নাস্তার টেবিলে আসার কথা। আজ এলে না?”
“সবসময় যন্ত্রের মতো চলতে ভালো লাগে না, মা। ক্ষুধা পায় নি, তাই খেতে আসি নি।”
“মানুষের শরীর এক প্রকার যন্ত্রই, বর্ণ। আর তুমি ভালো করেই জানো যে তোমার বাবা এসব অনিয়ম পছন্দ করেন না।”
“মা, সবকিছু বাবার কোর্ট নয়।”
নাজমা কঠিন গলায় বললেন,
“এভাবে কথা বলবে না। চুপচাপ খেতে এসো।”
বর্ণিল উঠে দাঁড়ালো। আলমারি থেকে শার্ট বের করতে করতে বলল,
“আমি আজ খাব না। বেরোচ্ছি।”
“সাত সকালে যাবে কোথায়? আজ তোমার ক্লাস নেই বলেই তো জানি।”
“অন্তুকে পড়াতে যাব, মা।”
নাজমা ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। ছেলেটাকে কি এই মেয়ের হাত থেকে কোনোভাবেই পুরোপুরি বের করে আনা যাবে না? উনি তাড়াহুড়ো করে বললেন,
“না, তুমি এখন যাবে না। বিন্তুকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে। আমি চাই না এই সময় তুমি সেখানে যাও।”
বর্ণিল শান্ত চোখে মায়ের দিকে তাকালো। দৃঢ় গলায় বলল,
“মা, আমি যাব।”
নাজমা কোনোমতে রাগ চাপা দিয়ে বললেন,
“বর্ণ, আমি তোমাকে অনুমতি দিয়েছিলাম অন্তুকে পড়ানোর। তুমি আমাকে সেটা বন্ধ করতে বাধ্য করো না। আমি ওই বাড়িতে গিয়ে সায়লার সাথে কথা বলি, তেমনটা তুমি নিশ্চয়ই চাও না।”
বর্ণিল হকচকিয়ে গেল। বিরক্তিতে ছেয়ে গেল তার চোখমুখ। হাতের শার্টটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে চেয়ারে বসলো। নাজমা চোখ বন্ধ করে বড় করে শ্বাস নিলেন। ছেলের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন,
“আমি যা করি, তোমার ভালোর জন্যই করি। মা কখনো সন্তানের খারাপ চায় না।”
“ভালো খারাপ আপেক্ষিক বিষয়, মা। তোমার কাছে যা ভালো, আমার কাছে তা নাও হতে পারে।”
“তুমি এখন রেগে আছ। মাথা ঠান্ডা হলে তারপর এসব নিয়ে কথা বলা যাবে। আপাতত তুমি ঘরেই বসো। আমি খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
নাজমা বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। বর্ণিল দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিজের জীবনটা আজীবনই কি তার মায়ের সিদ্ধান্তেই চলবে? কে জানে!
________________________________________
পাত্রপক্ষকে নিচের বসার ঘরে বসানো হয়েছে। মোট অতিথি চারজন। পাত্রের বাবা, বড় ভাই, বড় চাচী আর পাত্র নিজে। উনাদের সামনে খায়রুল সাহেব বসে আছেন। পাশে শর্মিলিও আছেন। উনার এই পরিবারটাকে কেমন ছোটলোক বলে মনে হচ্ছে। কথাবার্তা, আচার আচরণ, সবেতেই ছোটলোকি। কিছুক্ষণ আগে মিষ্টি খেতে গিয়ে পাত্রের বড় চাচী বলেছেন, “এসব সস্তার মিষ্টি আমাদের খাওয়ার অভ্যাস নেই। আমরা শহরের সব দামী মিষ্টি আপনাদের জন্য এনেছি। সেখান থেকে আমাদের দিলেও তো পারতেন।” কথা শুনে শর্মিলির গা জ্বলে গেছে। কথাবার্তার এ কী ধরণ! সস্তার মিষ্টি মানে? এই ভদ্রমহিলাকে একেবারেই সহ্য করতে পারছেন না শর্মিলি। পাত্রী দেখতে এসেছে? নাকি খেতে?
পাত্রের বাবা মুখ খুললেন। চোখেমুখে গম্ভীর ভাব এনে বললেন,
“ভাইসাহেব, গতকাল আপনার ভাগ্নি যা করেছে তারপর এখানে আসাটা আমাদের শোভা পায় না। কিন্তু তবুও আমরা এসেছি। কারণ আপনাদের মেয়ের বয়স কম। এই বয়সে ভয় পেয়ে এমন অনেকেই করে ফেলে। আশা করি, এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না।”
খায়রুল সাহেব মাথা নাড়লেন। “নিশ্চয়ই হবে না।”
পাত্রের বড় চাচী বললেন,
“আমাদের ছেলে সোনার টুকরা। এই বয়সেই ব্যবসা বাণিজ্যে ভালো নাম করেছে। টাকা পয়সার অভাব নেই। এলাকায় গিয়ে শুধু হাবিব নামটা উচ্চারণ করা, দেখবেন সবাই সম্মানে মাথা নিচু করে ফেলবে। এত অল্প বয়সে এত মান সম্মান বানিয়েছে, তবুও কিন্তু আমাদের কোনো চাহিদা নাই।”
শর্মিলি মুখে হাসি টেনে বললেন,
“কিছু মনে করবেন না। ছেলের বয়স কিন্তু ভালোই মনে হচ্ছে। কম বলে কিন্তু মনে হচ্ছে না।”
ভদ্রমহিলা দমে গেলেন। শুকনো গলায় বললেন,
“ওর বয়স বেশি নয়।”
সায়লা বসার ঘরে ঢুকলেন। অতিথিদের জন্য নতুন করে নাস্তা আনা হয়েছে। সাথে শিরিন এসেছে। নাস্তা টেবিলে রাখতেই শর্মিলি বলে উঠলেন,
“এই মিষ্টি খেয়ে দেখুন। হুট করে আবার সস্তা বলে ফেলবেন না যেন। এগুলো কিন্তু আপনারাই এনেছেন।”
কথা শেষ করে শর্মিলি ভেতরে চলে গেলেন। এই লোকগুলোকে তার সহ্য হচ্ছে না। শিরিন শরবতের গ্লাসগুলো টেবিলে রাখতেই পাত্রের ভাই আর বড় চাচীর ফিসফিস কানে এলো। উনারা বলাবলি করছেন, “মেয়ে রূপসী শুনেছিলাম। এখন তো দেখছি গায়ের রঙ কালো।”
শিরিন হেসে উঠলো। ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভয় নেই। এই কালো মেয়েকে আপনারা দেখতে আসেন নি। আমি আমার বোনকে নিয়ে আসছি।”
শিরিন ভেতরে চলে গেল। বিন্তু নিজের ঘরে তৈরি হচ্ছিলো। শিরিনকে দেখতে পেয়েই এগিয়ে গেল। মলিন গলায় বলল,
“শাড়ি পরিয়ে দাও, আপা।”
শিরিন রাগী গলায় বলল,
“রাখ তোর শাড়ি! বিন্তু, তুই এই বিয়েতে না করে দিবি।”
বিন্তু হকচকিয়ে গিয়ে বলল,
“কেন?”
“কারণ এরা মোটেও ভালো মানুষ নয়। এসে থেকে নিজেদের টাকাপয়সা দেখিয়ে চলেছে। অসহ্য!”
বিন্তু হাসলো। “টাকাপয়সা থাকলে তো দেখাবেই, আপা।”
“চুপ কর, বিন্তু। পাত্রকে আমি দেখে এসেছি। কাঠের মূর্তির মতো বসে আছে। একটা যেন জড় পদার্থ। অপদার্থ একটা!”
“ওরা বড়লোক বলেই তো মামা আমার জন্য এই পরিবার পছন্দ করেছেন।”
“তুই বাবাকে না করে দিবি, বিন্তু। ছেলের বয়স মাত্রাতিরিক্ত। এত বয়স্ক একজনকে কেন বিয়ে করবি?”
বিন্তু উত্তর দিলো না। হেসে বলল,
“শাড়ি পরিয়ে দাও, আপা।”
শিরিনের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। রাগী গলায় বলল,
“পারবো না। যা পরে আছিস, তাই পরে যা।”
তারপর হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেল। বসার ঘরের সামনে যেতেই পাত্রের বড় চাচীর কথা কানে এলো। তিনি বিপুল উৎসাহ নিয়ে সায়লাকে বলছেন,
“আপনার মেয়ের কপাল ভালো যে কালকে এরকম একটা কান্ড করার পরেও আমরা তাকে দেখতে আসতে রাজি হয়েছি। সাথে করে হীরার আংটি এনেছি। মেয়ে পছন্দ হলে পরিয়ে দিয়ে যাব। এই দেখুন, আপা। এই আংটি আমাদের ছেলে বিদেশ থেকে এনেছে। এর দাম দেড় লাখ টাকা।”
শিরিনের ভ্রু কুঁচকে গেল। এই মহিলা বড্ড বেশি কথা বলে। এদের সাথে বিন্তু সংসার করবে কি করে?
_______________________________________________
বিন্তু বাইরের টানা বারান্দায় বসে আছে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। বাইরে আবার টিপটিপ করে বৃষ্টি পরছে। বিন্তু আধো অন্ধকারে হাতের আংটির দিকে তাকিয়ে আছে। পাত্রপক্ষ তাকে পছন্দ করেছে। খুব শীঘ্রই বিয়ের দিন ঠিক করবে বলে গেছে। যার সাথে বিয়ে, বিন্তু জানে না সে কেমন মানুষ। তার দিকে একবার তাকিয়েও দেখে নি। দেখতে ইচ্ছা করে নি। তার জীবন তার হাতে নেই। তাকে কেউ কখনো বোঝে নি। তার ভীষণ বিষন্ন লাগছে। বিয়ের আনন্দ বলে যে কিছু আছে, তেমনটা সে অনুভব করতে পারছে না। ইচ্ছে করছে মনের প্রবল দুঃখের গল্পগুলো কাউকে বলতে। কিন্তু কে বুঝবে তার এসব কথা?
দরজায় কড়া নড়লো। বিন্তু উঠে গিয়ে দরজা খুললো। বর্ণিল এসেছে। বিন্তু ভেতরের দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল,
“ও, তুই! অন্তু ঘুমিয়ে আছে। আমি ডাকছি।”
বিন্তু চলে যাচ্ছিলো। বর্ণিল ডাকলো,
“দাঁড়া, বিন্তু। শুনে যা।”
বিন্তু ঘুরে দাঁড়ালো। বর্ণিল কাছে এগিয়ে এসে বলল,
“তোর সাথে কথা আছে আমার। খুব জরুরি।”
“শুনছি। বল।”
“তোকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল?”
বিন্তু স্পষ্ট গলায় জবাব দিলো,
“হ্যাঁ। আমাকে পছন্দ করেছে। এই যে, আংটিও পরিয়ে গেছে।”
বিন্তু নিজের বাম হাত তুলে ধরলো। বর্ণিল আংটিটার দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলো,
“তুই এই বিয়েতে রাজি?”
বিন্তুর বুকে মোচড় দিলো। সে চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল,
“রাজি না হওয়ার কোনো কারণ আছে?”
বর্ণিল অস্থির হয়ে বলল,
“নেই? তুই ভালোবাসিস না আমাকে?”
বিন্তু থমকে গেল। তার সারা শরীর শিহরিত হয়ে কেঁপে উঠলো। সে শত চেষ্টা করেও কথা বলতে পারলো না। বর্ণিল আবার প্রশ্ন করলো,
“উত্তর দে। তুই পারবি আরেকজনের সাথে সংসার করতে?”
বিন্তু ভেতরের সমস্ত আবেগের সাথে লড়াই করে কাঁপা ঠোঁটে উচ্চারণ করলো,
“পারবো। তোকে আমি ঘৃণা করি। তুই আর কখনো আমার সাথে কথা বলতে চেষ্টা করবি না। কোনোদিনও না।”
কথাগুলো শেষ হতেই বিন্তু ছুটে ঘরে চলে গেল। বর্ণিল স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এত অপমানিত আগে কখনো বোধ হয় নি তার।
.
#চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে