চড়ুই নীড়ে বসবাস পর্ব-০২

0
60

#চড়ুই_নীড়ে_বসবাস
#আলো_রহমান(ফারজানা আলো)
#পর্ব:২
.
বিন্তু যখন বাড়ি ঢুকলো, তখন সন্ধ্যা হয়েছে। সায়লা মাগরিবের নামাজ আদায় করে বিছানায় বসেছেন। হেমন্তের বৃষ্টিতে ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব এসেছে। উনি গায়ে একটা চাদর জড়িয়েছেন। অন্তু একটা বই কোলে নিয়ে পাশে বসে গুনগুন করছে। আজ সে সত্যিই পড়ছে। কারণ আজ মায়ের মেজাজ খারাপ। একটু উনিশ বিশ হলেই আপার উপরের রাগটা তার উপরে গিয়ে পরার সমূহ সম্ভাবনা। এই আপার জন্য যে আর কতকিছু তাকে করতে হবে কে জানে! অন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আজ পাত্রপক্ষ শেষ পর্যন্ত আসে নি। কিন্তু তা নিয়ে বিরাট একটা ঝামেলা হয়েছে। পাত্রের বাবা খায়রুল সাহেবকে অপমান করেছেন। কথা দিয়ে কথা বদল করেছেন বলে তাকে কতগুলো মন্দ কথা শুনিয়েছেন। সেই কারণে সায়লাকে কথা শুনিয়েছেন তার ভাবি। সায়লার সব রাগ এখন বিন্তুর উপরে।
বিন্তু ভয়ে ভয়ে ঘরে ঢুকলো। কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা নিজের ঘরে গেল। অন্তু ফিসফিস করে বলল,
“মা, আপা এসেছে। ডেকে আনবো?”
সায়লা গম্ভীর গলায় বললেন,
“না। ওকে নিজে থেকে আসতে দে।”
অন্তু দমে গেল। সে ভেবেছিল ডেকে আনার নাম করে আপাকে খানিকটা সাবধান করে দিয়ে আসবে। কিন্তু তা হলো কই? মা বোধহয় সব বুঝে ফেলেছে।
সায়লা বানু ধমক দিলেন।
“কিরে? থেমে গেলি কেন? পড়।”
অন্তু অনতিবিলম্বে আবার পড়তে শুরু করলো। বিন্তু মায়ের ঘরে এলো মিনিট দশেক পরে। সে ভেজা শাড়ি বদলেছে। গায়ে ওড়না জড়িয়েছে, মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে রেখেছে। গুটিগুটি পায়ে সে মায়ের সামনে এসে দাঁড়ালো। ভীত গলায় বলল,
“মা, আমি বুঝতে পেরেছি যে ভুল করেছি।”
সায়লা গম্ভীর গলায় বললেন,
“বস এখানে।”
বিন্তু বসলো। সাথে সাথেই তার বা গালে সপাটে একটা চড় পরলো। চড়ের শব্দে অন্তু চমকে উঠলো। সে তৎক্ষনাৎ একহাতে বিন্তুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“ও মা, আপাকে মেরো না, মা। মা গো!”
বিন্তু মাথা নিচু করে বসে রইলো। তার চোখে পানি এসে গেছে। সায়লা দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
“তোকে জন্ম দিয়ে কি আমি পাপ করেছি? কেন শত্রুতা করছিস তুই আমার সাথে?”
বিন্তু কান্না জড়ানো গলায় বলল,
“মা! আমি কেন শত্রুতা করবো তোমার সাথে? তুমি ছাড়া কে আছে আমার?”
“শত্রুতা নয়? এই আশ্রয় হারালে কোথায় গিয়ে আমি দাঁড়াবো? কেন এই কান্ড ঘটালি? আমার মুখটা একবার মনে পড়ে নি তোর? মনে হলো না একবার যে তোর মাকে অপদস্ত হতে হবে?”
“মা, আমার আর কোনো উপায় ছিল না। আমাকে তুমি মাফ করে দাও।”
সায়লা ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। সন্দিহান হয়ে জানতে চাইলেন,
“উপায় ছিল না মানে? তুই কি গোপনে কোনো ঘটনা ঘটিয়েছিস? কি করেছিস তুই?”
বিন্তু প্রায় চিৎকার করে বলল,
“মা! কিসব বলছো? আমি কিছুই ঘটাই নি। আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম কারণ আমি এখন বিয়ে করতে চাই না, মা।”
সায়লা বড় করে শ্বাস নিলেন। নিজেকে সামলে শান্ত গলায় বললেন,
“তোর চাওয়াতে কিছু যায় আসে না, বিন্তু। তোর মামা মামী যা বলবেন, তোকে তাই করতে হবে। আর আজ থেকে তুই বাড়ির বাইরে পা দিবি না।”
“মা, আমি…”
বিন্তুর কথা শেষ হলো না। সায়লা তার আগেই ভীষণ এক ধমক দিলেন।
“একদম চুপ। আমি যা বলবো, তোকে তাই করতে হবে। এখন তুই উপরে যা। তোর মামা মামীর কাছে ক্ষমা চেয়ে আয়।”
বিন্তু নিঃশব্দে উঠে গেল। অন্তু ইতস্তত করে বলল,
“মা, আমিও আপার সাথে যাব?”
সায়লা বানু রাগী চোখে তাকালেন। অন্তু দমে গেল। হাসার চেষ্টা করে বলল,
“এমনি বলেছি, মা। আমি যাচ্ছি না। আমি পড়ছি।”
______________________________________________
দোতলায় উঠতেই বা দিকে রান্নাঘর। তার পাশে প্রশস্ত জায়গা জুড়ে খাবার টেবিল সাজানো। ডানে এক বিশাল বৈঠকখানা। এটা তৈরি হয়েছিল বিন্তুর নানার আমলে। পরবর্তীতে খায়রুল সাহেব বাড়ির অনেককিছু পরিবর্তন করলেও এই বৈঠকখানা একই রেখেছেন। বিন্তু যখন উপরে এলো, তখন শর্মিলি টেবিলে চায়ের কাপ সাজাচ্ছিলেন। বিন্তুকে খেয়াল করলেন না উনি। বিন্তু ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে নিচু গলায় ডাকলো,
“মামী, মামা কই?”
শর্মিলি মাথা তুলে তাকালেন। বিন্তুকে দেখে উনার শরীর জ্বলে গেল। উনি গম্ভীর গলায় বললেন,
“অসভ্য মেয়ে! আমার সামনে আসতে লজ্জা করলো না? কার হাত ধরে পালাতে চেয়েছিলি?”
বিন্তু মাথা নিচু করে জবাব দিলো,
“আমি এরকম কিছু করি নি, মামী।”
“আবার নিজের হয়ে সাফাই দিচ্ছিস? তোর লজ্জা নেই?”
“মামী, আমি বুঝতে পেরেছি আমার ভুল হয়েছে। আমাকে ক্ষমা করো।”
শর্মিলি চিৎকার করে বললেন,
“খবরদার, বিন্তু। আমার সামনে তুই ঢং করবি না। তুই কি ভাবিস তোর এভাবে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার মানে আমি বুঝি না? তুই চাস আমাদের মান সম্মান নষ্ট করতে।”
বিন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ক্লান্ত গলায় বলল,
“আমি কেন এরকমটা চাইবো?”
“কারণ তুই আমার মেয়েকে হিংসা করিস। তুই এসব করিস যাতে আমি আমার মেয়েটাকে ভালো বাড়িতে বিয়ে দিতে না পারি। তোদের আমি চিনি না?”
“মামী! এসব কি কথা? আমি শিরিন আপাকে হিংসা কেন করবো? আপাকে আমি খুবই ভালোবাসি।”
“চুপ কর, নির্লজ্জ মেয়ে কোথাকার! তোদের মা মেয়ের মনে শুধু হিংসা।”
বিন্তু কথা বলল না। এই ভদ্রমহিলার সাথে কথা বলা মানে যেচে অপমানিত হওয়া। মাঝেমধ্যে তার ইচ্ছা করে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু তার সে উপায় নেই। বিন্তু অসহায় বোধ করে। আজ যদি তার বাবা থাকতো তাহলে কেউ তাকে এভাবে কথা শুনাতে পারতো না। বিন্তুকে চুপ করে থাকতে দেখে শর্মিলির রাগ বাড়লো। তিনি ধমকে উঠে বললেন,
“এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবি না। যা তোর মামাকে চা দিয়ে আয়। যত্তসব আপদ।”
বিন্তু চা হাতে নিয়ে বৈঠকখানায় গেল। খায়রুল সাহেব সেখানে বসে টেলিভিশন দেখছেন। টেলিভিশনে সন্ধ্যার সংবাদ চলছে। বিন্তু ভেতরে ঢুকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল,
“মামা, চা।”
খায়রুল সাহেব চা নিয়ে বললেন,
“দেখেছিস, বিন্তু? যুদ্ধে ছোট ছোট বাচ্চাদের কী ভয়ানক কষ্ট!”
বিন্তু উত্তর দিলো না। তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া নিয়ে মামা কিছু বলছে না দেখে অবাকও হলো না। মামা চট করে সিরিয়াস কথা শুরু করেন না। উনি প্রথমে এমন কোনো কথা বলেন, যেটা হয়তো পরিস্থিতির সাথে পুরোপুরি প্রাসঙ্গিক নয়। খায়রুল সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,
“কখন ফিরেছিস?”
বিন্তু নিচু গলায় বলল,
“একটু আগে।”
“আজ বেশ ভালো বৃষ্টি হয়েছে। না রে?”
বিন্তু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। খায়রুল সাহেব হালকা কেশে বললেন,
“আজ এভাবে বেরিয়ে গিয়ে ঠিক করিস নি, বিন্তু। আমাকে ওরা অপমান করেছে। আমি দুঃখ পেয়েছি।”
বিন্তু মাথা নিচু করে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করে দাও, মামা। আমি আর কখনো এরকম করবো না। তুমি উনাদের আসতে বলো।”
“ঠিক আছে, বলবো। তুই এখন ঘরে যা।”
বিন্তু বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে নিচে যাচ্ছিলো। তার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। সে ঘুমাতে চায়। সিঁড়িতে পা দিতেই শর্মিলি ডেকে উঠলেন,
“এই মেয়ে! চলে যাচ্ছিস কেন? আমার সাথে রান্নাঘরে কাজ করবি আয়।”
বিন্তু না করতে পারলো না। সেই উপায় নেই। ঘুরে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে শিরিন বেরিয়ে এলো, খায়রুল সাহেবের ছোট মেয়ে। বিন্তুকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
“এসেছিস, বিন্তু? আয়, আমার ঘরে আয়।”
বিন্তু হাসিমুখে বলল,
“ভালো আছ, আপা?”
“আছি। আমার সাথে আমার ঘরে আয়। তারপর কথা বলছি।”
শর্মিলি তাড়াহুড়ো করে বললেন,
“তোর ঘরে যাবে মানে? ওকে আমি ডেকেছি। ও রাতের রান্না করবে আমার সাথে।”
শিরিন হেসে বলল,
“মা, তুমি নিজে একটু কষ্ট করে রান্না করে নাও। ওকে আমি নিয়ে গেলাম।”
কথা শেষ করে বিন্তুকে নিয়ে শিরিন ঘরে চলে গেল। শর্মিলি কিছুই বলল না। তিনি তার এই কন্যাটিকে ভীষণ ভালোবাসেন। মেয়ের কথার উপরে কখনো কিছু বলেন না। বিন্তু হাসলো। ছোটবেলা থেকে মামীর হাত থেকে যে শিরিন আপা তাকে কতবার বাঁচিয়েছি ঠিক নেই। এই বাড়িতে শিরিন আপা না থাকলে তার জীবন আরও বেশি কঠিন হতো। বিছানায় বসে শিরিন বিন্তুর মুখের দিকে ভালো করে তাকালো। বিন্তুর চোখ ভেজা। বাম গাল লাল হয়ে আছে। হয়তো মায়ের হাতে মার খেয়ে এসেছে। শিরিনের মায়া হলো। সে বিন্তুর গায়ে হাত বুলিয়ে কোমল গলায় বলল,
“কখন ফিরেছিস, বিন্তু? সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজেছিস। শরীর ঠিক আছে?”
বিন্তু হেসে মাথা নাড়লো।
“আছে।”
“ফুপু খুব রাগ করেছে, না?”
“হ্যাঁ, খুব।”
“আহা! মন খারাপ করিস না। তোর কি হয়েছে আমায় বলবি? এভাবে চলে গেলি কেন?”
“অনেক কথা বলার আছে, আপা। আমি বলবো। কিন্তু এখন নয়।”
“ঠিক আছে, যখন ইচ্ছা হয় বলিস।”
“তুমি তোমার খবর বলো, আপা। কখন এলে?”
“বিকালে এসেছি। ইউনিভার্সিটি বন্ধ। এসে দেখি বাড়িতে হুলস্থূল বেঁধে আছে। এমন কেউ করে? বোকা মেয়ে তুই, বিন্তু।”
বিন্তু উত্তর দিলো না। শিরিন গলা নিচু করে প্রায় ফিসফিস করে বলল,
“আমি একটা ছেলেকে বিয়ে করবো বলে ঠিক করেছি। এবার ছুটি শেষে যখন ক্যাম্পাসে ফিরবো, তখনই বিয়ে করে ফেলবো।”
বিন্তু হকচকিয়ে গিয়ে বলল,
“বিয়ে! কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করবে?”
“হ্যাঁ, করবো। ছেলেটাকে আমি ভালোবাসি। বাবাকে জানালে বাবা মানবেন না। তাই নিজে নিজেই বিয়ে করবো। বড় আপার মতো ভুল আমি করবো না।”
বিন্তুর বিস্ময় কাটে নি। সে আচ্ছন্ন গলায় বলল,
“কেন মানবেন না?”
“কারণ ও এখনো বেকার।”
“তাহলে কিছুদিন অপেক্ষা করো।”
“না, বিন্তু। অপেক্ষা করাটা ভয়ানক। আমি পারবো না। মা যদি আমায় অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দেয়, তখন কি হবে? আমি কোনো ঝুঁকি নেবো না। একবার বিয়ে হয়ে গেলে তো আর মা আমায় অন্য কোথাও বিয়ে দিতে পারবে না।”
বিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“ছেলেটা তোমার ইউনিভার্সিটিতে পড়ে?”
শিরিন লাজুক হেসে বলল,
“হ্যাঁ। ও খুব ভালো ছেলে।”
“তোমাকে প্রেমপত্র লিখেছিল?”
শিরিন মাথা নেড়ে বলল,
“উঁহু, জীবনেও না। প্রেমপত্র আমি লিখেছিলাম। প্রেম প্রস্তাবও আমি দিয়েছি। তাও আবার এক লাইনের। ও সেই এক লাইনের চিঠির জবাব দিয়েছিল এক শব্দে।”
“এক শব্দে! কিভাবে?”
শিরিন হাসলো। উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগ থেকে একটা ছোট কাগজ বের করলো। বিন্তুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“দেখ।”
বিন্তু কাগজ হাতে নিলো। ভাঁজ খুলতেই একটা মাত্র লাইন চোখে পড়লো। ইংরেজি অক্ষরে নীল কালিতে লেখা একটা লাইন,
” Be my kids’ dad!”
এই লাইনের “my” শব্দটা লাল কালিতে কেটে দিয়ে উপরে লেখা হয়েছে, “our”। বিন্তু বুঝলো, এই শব্দটিই শিরিনের প্রেমিকের উত্তর।
পৃথিবীর সংক্ষিপ্ত এক প্রেমপত্র আর তার সংক্ষিপ্ততম উত্তর দেখে বিন্তু বিস্মিত হলো। শিরিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে হেসে গড়িয়ে পরছে।
.
#চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে