চড়ুই নীড়ে বসবাস পর্ব-০১

0
315

#চড়ুই_নীড়ে_বসবাস
#আলো_রহমান(ফারজানা আলো)
#সূচনা_পর্ব

অন্তু বিরক্তি নিয়ে বলল,
“কাঠুরিয়া সৎ ছিল, এই ব্যাপারে আমরা এত নিশ্চিত কি করে? হতেও তো পারে কাঠুরিয়া বোকা ছিল। এতটাই বোকা ছিল যে সোনার কুড়াল আর রূপার কুড়াল চিনতেই পারে নি।”
বর্ণিল ভ্রু কুঁচকালো। গম্ভীর গলায় বলল,
“গল্পটা তাড়াতাড়ি মুখস্থ করো।”
অন্তু মুখ কুঁচকে মোটা ইংরেজি বইটা নিয়ে পড়তে শুরু করলো। বর্ণিল ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললো। অন্তু মেয়েটার চিন্তাভাবনা জটিল ধরণের। মেয়েটাকে পড়াতে তাকে বেশ ভালোই নাকানিচোবানি খেতে হয়। সবেমাত্র অষ্টম শ্রেণিতে পড়া এক কিশোরীর মাথায় এত জটিল ধরণের ভাবনা আসবে কেন? কিশোরীরা হবে সরল, বোকাসোকা। তাদের যা বুঝানো হবে তাই বুঝবে। একেবারে বিন্তুর মতো। বিন্তু যদিও কিশোরী নয়; যুবতী। বর্ণিল অন্তুর মামার মুখে শুনেছে অন্তু আর বিন্তু গুনে গুনে এগারো বছরের ছোট বড়। তবুও মেয়েটার সারল্য বর্ণিলকে মুগ্ধ করে।
অন্তুর মা নাস্তা নিয়ে এলেন। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন,
“অন্তু ঠিকমতো পড়ছে, বাবা?”
বর্ণিল মাথা নেড়ে উত্তর দিলো,
“চেষ্টা করছে।”
অন্তুর মা চলে গেলেন। বর্ণিলের মন খারাপ হলো। নাস্তা দিতে অধিকাংশ সময়ে বিন্তুই আসে। আজ এলো না কেন? বিন্তু গেল কোথায়? ও কি বাড়িতে নেই? অন্তুকে কি জিজ্ঞেস করা যায়? না, থাক। এই মেয়েটাকে ভরসা করা যায় না। অন্তুর মা আবার ফিরে এসে বর্ণিলের সামনে দাঁড়ালেন। বর্ণিল শান্ত চোখে উনার মুখের দিকে তাকালো। অন্তুর মা ইতস্তত করে বললেন,
“ইয়ে…বর্ণিল, বলছিলাম যে এ মাসে তোমার টাকাটা দিতে খানিকটা দেরি হবে বাবা।”
বর্ণিল স্বাভাবিক গলায় বলল,
“অসুবিধা নেই। যখন পারবেন, দেবেন।”
সায়লা বানু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চলে গেলেন। বর্ণিল দীর্ঘশ্বাস চেপে চায়ের কাপ হাতে নিলো। এই ব্যাপারটিতে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। প্রতিমাসেই তার টাকাটা পেতে দেরি হয়। এরকম একটা টিউশনি করানোর মতো ইচ্ছা তার কখনোই ছিল না। সে কাজটা করছে শুধুমাত্র বিন্তুর কথা ভেবে। বিন্তু তাকে খুব অনুরোধ করে বলেছিল যেন ওর ছোট বোন অন্তুকে বর্ণিল পড়ায়। বর্ণিল প্রথমে না বলেছিল। এত নামমাত্র সম্মানীতে পড়ানো এই বাজারে অসম্ভব। ওর মুখ থেকে না শোনার পরে বিন্তুর চোখে পানি এসে গিয়েছিল। খারাপ লাগলেও বর্ণিল সেটাকে গুরুত্ব দেয় নি তখন। কিন্তু দুদিন পরে নিজে থেকেই পড়াতে এসেছে অন্তুকে।
সেই দুদিন বর্ণিল অনেক ভেবেছে। বিন্তুর প্রস্তাব নিয়ে মায়ের সাথেও আলোচনা করেছে। ছোটবেলা থেকেই বিন্তুদের অবস্থা সে দেখে আসছে। সায়লা বানু দুই কন্যাকে নিয়ে ভাইয়ের বাড়িতে থাকেন। শুধু শুধু নয়, ভাড়ায় থাকেন। হ্যাঁ, নিজের ভাইয়ের বাড়িতেও ভাড়া চুকিয়েই থাকতে হয় উনাকে। বরাবর টানাটানির সংসার উনার। বর্ণিলের এখনো মনে আছে, ক্লাস নাইনে টিউশন পড়ার টাকা ছিল না বলে বিন্তু বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি না হয়ে মানবিক বেছে নিয়েছিল। বর্ণিল কারণ জিজ্ঞেস করায় হেসে বলেছিল, “আমার অংক করতে ভালো লাগে না রে।” অথচ বর্ণিল বিলক্ষণ জানতো, বিন্তু মিথ্যা বলছে। ও আজীবন স্বপ্ন দেখেছে রসায়ন নিয়ে পড়াশোনা করার, ঠিক ওর বাবার মতো।
বিন্তু আর অন্তুর বাবা বর্তমান নেই। বিন্তুর বয়স তখন তেরো, আর অন্তুর দুই; ওদের বাবার মৃত্যু তখনই। ওদের বাবার সাথে সায়লা বানু বিয়ে করেছিলেন বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে। তারপর এ বাড়ির কেউ আর যোগাযোগ করে নি তার সাথে। মেয়েকে একবার দেখতে পেলেন না, এই কষ্ট বুকে নিয়ে মারা গেলেন সায়লার মা। টিউশন মাস্টারের সাথে পালিয়েছে বলে রাগ করে সমস্ত সম্পত্তি ছেলের নামে লিখে দিলেন সায়লার বাবা। পনেরো বছর পরে, যখন এ বাড়ির সমস্ত জায়গা থেকে সায়লা প্রায় মুছেই গিয়েছে, ঠিক তখনই এক হেমন্তের ভরসন্ধ্যায় দুই সন্তানকে নিয়ে এই বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়ালেন সায়লা। এই বাড়ির উঠোন জুড়ে তখন মানুষের ঢল; আর উঠোনের ঠিক মাঝে বসানো খাটিয়াতে সায়লার বাবার লাশ।
অন্তু বর্ণিলের দিকে একটা খাতা এগিয়ে দিলো। বলল,
“আমি লিখেছি।”
বর্ণিল ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে খাতা হাতে নিলো। এক পাতার একটা ইংরেজি গল্প লিখতে অন্তু ভুল করেছে মোট সাতটা বানান। বর্ণিল বুঝে উঠতে পারে না এই গর্দভ মেয়েটা বিন্তুর বোন কি করে হয়! বর্ণিল বানানগুলো ঠিক করে দিলো। তারপর খাতাটা আবার অন্তুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“যে বানানগুলো ভুল করেছ সেগুলো তিনবার করে লিখে আমাকে দেখাও।”
অন্তু মুখ কুঁচকে বলল,
“এখনই?”
“হ্যাঁ, এই মুহূর্তে।”
অন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাতা হাতে নিলো। কিছু একটা অজুহাত দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিল সে। হঠাৎ বাইরে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ পেয়ে অন্তু দৌড়ে বাইরে চলে গেল। বর্ণিল কিছুমাত্র বলার সুযোগটাও পেলো না। বাইরে থেকে অন্তুর মামার গলা আসছে। সম্ভবত উনি সায়লা বানুর উপরে চিৎকার করছেন। কেন চিৎকার করছেন, তা স্পষ্ট নয়। বর্ণিল উঠে দাঁড়ালো। বাইরে যাওয়া উচিত হবে কিনা বুঝতে পারছে না সে। শত হলেও, সে বাইরের লোক। বাড়ির লোকেদের কথা কাটাকাটির মাঝখানে পরা মোটেই উচিত না। কিন্তু সে করবে কি? একা একা এই ঘরে বসে থাকারও তো মানে নেই। অন্তু যে আজ আর পড়বে না, তা তো ভালো করেই জানে সে।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বর্ণিল দরজার দিকে এগিয়ে গেল। বাইরের চিৎকার চেঁচামেচি স্পষ্ট হলো। অন্তুর মামা, খায়রুল কবির সাহেব হিসহিসিয়ে বলছেন,
“তোর বড় কন্যা একটা অমানুষ তৈরি হয়েছে। এই মেয়েকে আমি আর বাড়িতে ঢুকতে দেবো না। এত বড় সাহস! আজ পাত্রপক্ষ আসবে জেনেও ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল! এত্ত সাহস!”
বর্ণিলের ভুরু কুঁচকে গেল। বিন্তুকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে মানে? আর ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথায় গেছে? কতক্ষণ বাড়িতে নেই ও?
সায়লা বানু অপরাধীর মতো বললেন,
“ভাইজান, ও কখন বেরিয়ে গেছে আমি টের পাই নি। কোথায় গেছে তাও জানি না।”
খায়রুল সাহেব ধমকে উঠে বললেন,
“কেমন মা তুই? মেয়ে কখন ঘরে ঢুকছে কখন বাইরে যাচ্ছে কিছুই জানতে পারিস না? সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চলল, অথচ তোর বজ্জাত মেয়ে এখনো লাপাত্তা। বিকালে পাত্রপক্ষ এলে আমি কি জবাব দেবো? আমার মানসম্মান থাকবে তাদের কাছে?”
সায়লা প্রায় কেঁদেই ফেলেছেন। মাথা নিচু করে বললেন,
“ভাইজান, কোনোভাবে কি উনাদের অন্যদিন আসতে বলা যায়?”
খায়রুল সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“দেখছি।”
কথা শেষ করে তিনি দোতলায় উঠে গেলেন। উনি চলে যেতেই সায়লার সামনে এসে দাঁড়ালেন উনার স্ত্রী, শর্মিলি। উনি শক্ত করে সায়লার হাত চেপে ধরে বললেন,
“তোমাদের তিন মা ছায়ের কি শত্রুতা আমাদের সাথে? সিন্দাবাদের ভূতের মতো ঘাড়ে চেপে বসে আছ। এখন আবার আমাদের অপমান করার জন্য উঠে পরে লেগেছ। কত বড় অকৃতজ্ঞ তোমরা!”
সায়লা বানু কেঁদে ফেলেছেন। নিচু গলায় বললেন,
“ভাইজানকে অপমান করার কথা আমি কখনো ভাবতে পারি না, ভাবি।”
“নাটক করবে না, সায়লা। তোমরা কি পারো আর কি পারো না, আমার ভালোই জানা আছে। তোমার মেয়েদের জন্য তোমার ভাইজান কি না করেছে! হাজার হাজার টাকা তোমাকে ধার দিয়ে রেখেছে। সেগুলো তো চায়ই নি, উল্টো তার উপর তোমার বেহায়া মেয়ের বিয়ের দায়িত্ব নিজে নিয়েছিল। কিন্তু কি করলো তোমার মেয়ে? নিজে একবার পালিয়ে গিয়ে তো আমাদের মুখে চুনকালি দিয়েছ। এখন বাকি আছে তোমার মেয়ে। আরেকবার আমাদের অপদস্ত করতে আটঘাট বেঁধেছে সে।”
সায়লা কথা বলতে পারলেন না। শর্মিলি চাপা গলায় বললেন,
“দু’মাসের বাড়ি ভাড়াও দাও নি। আর তোমাকে কোনো ছাড় দেবো না, সায়লা। কাল সকালে আমি ভাড়ার সমস্ত টাকা গুনে নেবো। মনে থাকে যেন।”
কথা শেষ করে শর্মিলি হনহন করে দোতলায় চলে গেল। সায়লা হুহু করে কেঁদে ফেললেন। বাইরে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। এর মধ্যে তার মেয়েটা বাইরে, তা নিয়ে কারোর কোনো চিন্তা নেই। তারা ব্যস্ত নিজেদের মান সম্মান নিয়ে। উপরন্তু এতগুলো কথা তাকে শুনিয়ে গেল। বাড়ি ভাড়ার টাকা নিয়েও খোঁটা দিলো। অথচ এই সেই বাড়ি, যেখানে সে ছোট থেকে বড় হয়েছে। এই বারান্দায় সে পুতুল খেলেছে। উঠানে বসে চুল বেঁধেছে। সায়লার চোখে পানি উপচে পরে। সে কি নিজের মেয়ের খোঁজ রাখে না? সে কি করবে? এত বড় মেয়েকে কি সে বেঁধে রাখবে? বেইমান মেয়ে! মায়ের কষ্ট বুঝলো না।
অন্তু এগিয়ে গিয়ে মায়ের হাত ধরে। মলিন গলায় বলে,
“মা, ঘরে চলো।”
সায়লা বানু মেয়ের হাত ধরে পা বাড়ান। দরজার দিকে ঘুরতেই বর্ণিলকে চোখে পড়ে। ছেলেটা কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উনি কোনোমতে চোখের পানি আড়াল করে বললেন,
“বর্ণিল বাবা, তুমি আজ বরং বাড়ি চলে যাও। পরশু আবার এসো।”
বর্ণিলের হড়বড় করে অনেক প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে। বিন্তুর কি বিয়ে দিচ্ছেন? কার সাথে বিয়ে দেবেন ওকে? পাত্রের বুঝি অনেক টাকাপয়সা? এখনই কেন ওকে বিয়ে দেবেন? ওকে পড়াশোনা করতে দিন। আরেকটু সময় দিন। বর্ণিল এসব কিছুই বলে না। নিজেকে সামলে নিয়ে ইতস্তত করে বলে,
“ফুপু, আপনি বললে আমি বিন্তুর খোঁজ করতে পারি।”
সায়লা আঁচলে চোখ মুছে বললেন,
“না, বাবা। এই বর্ষা বাদলের দিনে তুমি কেন শুধু শুধু কষ্ট করবে? ও ভেসে যাক, ও মরুক। ওকে খুঁজতে হবে না।”
কথা শেষ করে তিনি প্রায় ছুটে ঘরে চলে গেলেন। অন্তু এগিয়ে এলো বর্ণিলের সামনে। অসহায়ের মতো বলল,
“বর্ণিল ভাইয়া, আপনি মায়ের কথা শুনবেন না৷ আপাকে খুঁজে আনুন। প্লিজ!”
বর্ণিল হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। খোলা দরজা দিয়ে উঠানের দিকে তাকালো। বাইরে বরিষধরা। প্রবল বৃষ্টিতে এ বাড়ির উঠোন ভেসে যাচ্ছে।
_____________________________

লম্বামতো লোকটার সামনে পরতেই বিন্তুর সম্বিত ফিরলো। লোকটার দিকে তাকাতেই বিন্তু প্রথমবারের মতো বুঝতে পারলো মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। জলের ধারা চারদিক ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সে প্রায় কাকভেজা, অথচ এতক্ষণ বৃষ্টির প্রতি খেয়ালও হয় নি তার। নিজের প্রতি নিজেই অবাক হলো বিন্তু। এতটা আনমনা হয়েও কি কেউ হাঁটে? তার নামকরণের সময় তার বাবা একটা ভুল করেছে। তার নাম হওয়া উচিত ছিল আনমনা।
সামনে দাঁড়ানো ভদ্রলোক ঘাড়টা সামান্য নিচু করে এনে বলল,
“আপনি এভাবে ভিজছেন কেন? কোনো ছাউনির নিচে গিয়ে দাঁড়ান।”
বিন্তু ভুরু কুঁচকে ফেললো। মাথা উঁচু করে ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকালো। বৃষ্টিতে চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে গেছে। কাজেই বিন্তু তার মুখ স্পষ্ট দেখতে পেলো না। সে চশমা খুলে হাতে নিলো। ভ্রু কুঁচকে চোখ ছোট ছোট করে লোকটার মুখ স্পষ্ট করার চেষ্টা করলো। চেষ্টা সফল হলো না। লোকটাকে সে আগের চেয়েও বেশি ঝাপসা দেখছে। তার হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল। তার চোখ এতটা খারাপ?
ভদ্রলোক আবার বলে উঠলো,
“ম্যাডাম, আপনার শাড়িটা একেবারে ভিজে গেছে। আপনি দয়া করে আর ভিজবেন না। কোনো ছাউনির নিচে দাঁড়ান।”
বিন্তু এবার নিজের দিকে দৃষ্টি দিলো। বৃষ্টিতে ভিজে তার শাড়ি শরীরে লেপ্টে গেছে। নিজের উদাসীনতায় নিজের উপরে বিরক্ত হলো সে। শাড়ির আঁচল সামনে টেনে এনে নিজেকে যথাসম্ভব আবৃত করলো। তারপর পা টিপে টিপে রাস্তার ধারের একটা চায়ের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালো। লোকটা তার পিছু পিছু গেল। টঙের বেঞ্চিতে আরও অনেকেই বসে আছে। বিন্তুর অস্বস্তি লাগছে এখানে। ভদ্রলোক দু’কাপ চা নিয়ে বিন্তুর সামনে এলেন। একটা কাপ এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“চা খাবেন?”
বিন্তু ভ্রু কুঁচকালো। অদ্ভুত মানুষ তো। চা এনে তারপর জানতে চাইছে খাবেন কিনা! বিন্তু হাত বাড়িয়ে চা নিলো। হালকা কেশে বলল,
“চায়ের দাম?”
ভদ্রলোক নির্দ্বিধায় উত্তর দিলেন,
“আমি দিয়েছি। চায়ের দাম ১৫ টাকা। আপনি যদি দামটা ফিরিয়ে দিতে চান, তবে আরেকটা বৃষ্টির দিনে এখানে আসতে পারেন। এই দোকানের মালাই চা খুবই ভালো। আমি বৃষ্টির দিনে এখানে চা খেতে আসি।”
“আমি তবে হেঁটে হেঁটে আপনার পছন্দের দোকানে এসে দাঁড়িয়েছি?”
“জ্বি। কিছু মনে না করলে আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই।”
বিন্তু চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,
“চা খাইয়েছেন। এখন নাম ধাম, মোবাইল নম্বর, ধীরে ধীরে এসব জানতে চাইবেন। তাই তো?”
ভদ্রলোক হাসলেন। ভারী দরাজ গলার হাসি। বললেন,
“জ্বি না। আমি জানতে চাইছিলাম এভাবে অন্যমনস্ক হয়ে আপনি রাস্তায় হাঁটছিলেন কেন? আপনি কি কোনো সমস্যায় পরেছেন?”
“সমস্যায় না পরলে কি মানুষ অন্যমনস্ক হতে পারে না?”
“আপনি যতটা হয়েছিলেন, ততটা পারে না। মানুষের ইন্দ্রিয় না চাইতেও কাজ করে, কতকটা স্বয়ংক্রিয়। তখনই কাজ করতে পারে না, যখন মানুষ মাত্রাতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় থাকে। আপনাকে দেখে যে কেউই বলে দিতে পারে আপনি চিন্তিত।”
“সমস্যায় পরলে পরেছি। আমার সমস্যা দিয়ে আপনার কি? কয়েক মিনিটের পরিচয়ে কি আমি আপনাকে নিজের সমস্যা বলতে শুরু করবো?”
“না, তা নয়। আসলে আমি একজন লেখক। মানুষের বাস্তব সমস্যাগুলো নিয়ে লেখার চেষ্টা করি। আপনার বলতে আপত্তি না থাকলে কোনো এক বইতে হয়তো আপনাকে নিয়ে লিখতাম।”
বিন্তুর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সে হাত থেকে চায়ের কাপ পাশের বেঞ্চে নামিয়ে রাখলো। তারপর বিরক্ত গলায় বলল,
“এক কাপ চায়ের বিনিময়ে আপনি আমার ব্যক্তিগত জীবন বাজারে বেঁচতে চান? অদ্ভুত লোক তো আপনি!”
“না। আপনি যেভাবে ভাবছেন…”
উনার কথা শেষ হলো না। বিন্তু উনাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“থামুন আপনি। যত্তসব উটকো ঝামেলা।”
কথা শেষ করে বিন্তু টঙ থেকে রাস্তায় নেমে গেল। বৃষ্টি কিছুটা কমেছে। বিন্তু ভেবেছিল লোকটা তার পিছু পিছু আসবে। তেমনটা হলো না। ভদ্রলোক এলেন না। যেহেতু পিছু করেন নি, সেহেতু তাকে নিতান্তই ভদ্রলোক বলা যায়।
রাস্তায় লোকজন কম। বিকেল পেরিয়েছে কিনা বুঝতে পারছে না বিন্তু। মেঘলা আকাশ দেখে সময় বুঝতে পারা অসম্ভব। তার কি এখন বাড়ি ফেরা উচিত? বিন্তু একটু সামনে এগিয়ে গেল। বামে ঘুরতেই হাইস্কুলের গেটের সামনে বর্ণিলের সাথে দেখা হয়ে গেল। ঝাপসা চশমাতেও বর্ণিলকে চিনতে তার অসুবিধা হলো না। বর্ণিল দ্রুত পায়ে কাদা পেরিয়ে এসে বলল,
“এসব কি, বিন্তু? বাড়িতে অশান্তি পাকিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছিস? বৃষ্টিতে ভিজেছিস কেন? এদিকে ছাতার নিচে আয়।”
বিন্তু গেল না। স্বাভাবিক গলায় বলল,
“তুই এদিকে কি করছিস?”
“তোকে খুঁজতে এসেছি। তোর মা কান্নাকাটি করছে। সকাল থেকে তোর খোঁজ নেই। ফোনটাও ফেলে এসেছিস। বাড়ি চল, বিন্তু।”
বিন্তু শীতল গলায় প্রশ্ন করলো,
“এই বৃষ্টিতে তুই আমায় খুঁজতে এসেছিস, সেই কথা তোর মা জানে?”
বর্ণিল উত্তর দিলো না। বিন্তু নিচু গলায় বলল,
“মামীকে চিন্তায় ফেলা তোর ঠিক না। এমনিতেই আমাকে উনি সহ্য করতে পারেন না। তার উপর আমার জন্য তোকে বর্ষা বাদলা মাথায় ছোটাছুটি করতে দেখলে উনি মেনে নিতে পারবেন না। তুই বাড়ি যা, বর্ণ। আমি একটা রিকশা নিয়ে চলে যাব। তুই চিন্তা করিস না।”
কথা শেষ করে বিন্তু নদীর বাঁধের দিকে এগিয়ে গেল। সেখানে সারি সারি রিকশা দাঁড়ানো। এই বৃষ্টিতে কেউ বাগানবাড়ির দিকে যেতে রাজি হলে হয়।
.
চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে