#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৮
২৫.
সকালে মোরগদের ডাকে পুতুলের ঘুম ভেঙে যায়।বিছানায় ভাইকে ছোট হাতে ঠিক করে দিয়ে বিছানা ছেড়ে ওঠে।রাণী কাচাঁ মাটির ঘরে পাটের বস্তা ওপর আরাম পেয়ে ঘুম।পুতুল ঘর ছেড়ে বাহিরে বের হতেই দেখে মামী রান্না করছে?মামীকে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিল।
-;পুতুল মা।ভাই কি এখনো উঠেনি?
পুতুল মাথা নাড়িয়ে না বল!যার মানে ভাই এখনো ঘুম।
-;আচ্ছা।তুমি হাত মুখ ধুয়ে আসো।খাবার প্রায় হ’য়ে এলো।পুতুল চলে যেতে নিলেই রেনু আবার তার পায়ের দিকে তাকিয়ে ডাকল।এই পুতুল দাঁড়াও।তোমার পায়ের জুতা কোথায়?
পুতুল রাতের কথা মনে পড়তেই চোখ বড়সড় করে ফেলেছে।রাতের আজব মানুষের জন্যই তো রানী তার ঘরে সারারাত ছিল।মামীর জুতা কথা বলতেই
চুপসে গেলো।এখন কি বলবে সে?মিথ্যে সে বলতে পারবেনা।
-;বুঝেছি রাতে মনে হয় হারিয়ে ফেলেছো।আচ্ছা তুমি যাও।আমি জুতাটা পরে খুঁজে দেব।পুতুল মাথা নাড়িয়ে তাড়াতাড়ি চলে যায়।
পুতুল বালতি ভরা পানি থেকে মগ দিয়ে পানি তুলো।এক জায়গায় বসে দাঁতের মাজন দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করতে লাগল।
লিলিপুট একখান জুতা দড়ি দিয়ে গাছে ঝুলিয়ে রেখেছে অর্পণ।ছোট ছোট ইটের টুকরো পুকুরে ফেলতে ফেলতে বলল,
-;অসভ্য মেয়ে মানুষকে তার পাওনা শাস্তি না দিয়ে আমি এই গ্রাম ছাড়ছি না।তোমার কপালে শনি লেগে গেছে লিলিপুট।অর্পণ কি চিজ বুঝতে পারো নিই?এবার বুঝবে তুমি।
সকাল হয়ে গেলো এখনো তিন তিনটা ছেলে উধাও আছে।কোথায় গেছে কোনো খবর নেই?একে তো অন্যায় করেছে।আবার লুকিয়ে রয়েছে।এদের সাহস দেখে আমি হতবাক হচ্ছি।
আর সাফিন তুমি,তাদের খোঁজে বের করতে পারলে না।
-;ভাইয়া পুরো গ্রামে আমাদের লোক লাগিয়েছি।কিন্তু কেউ সঠিকভাবে বলতেই পারেনি।আমার মনে হয়,ওরা গ্রামে নেই। আর গ্রামে থাকলে অবশ্যই ধরা পড়বে।
-;আসসালামু আলাইকুম চেয়ারম্যান সাহেব।বাড়ি ভিতরে আসতে পারি?
-;কে?
-;আমি হারুন মাস্টার।
-;হারুন মাস্টার এত সকালে কেন?ভেতরে আসুন।
-;জি আসতে হলো।?
-;হঠাৎ।
-;আপনার ছেলে জনাব অর্পণ তালুকদার স্কুল ঠিক মতো যায় না।আপনি স্কুলে যেয়ে হাজিরা খাতা দেখলেই বুঝতে পারবেন।অনুপস্থিতিতে ভরা।তার ওপর দশম শ্রেণি টেস্ট পরীক্ষা দিয়েছে নামে মাএ,গনিতে ফেল আসছে।বাকি সাবজেক্টে টেনেটুনে পাশ করছে।আর তার সাথে দুই ভাই গোল আলু পাইছে একই সাবজেক্টে।টেস্ট পরীক্ষা যে এত খারাপ করছে।তারে কি বোর্ড পরীক্ষা বসতে দেওয়া যায়?আপনি বলুন!হারুন মাস্টার তার অভিযোগ বলে চলে যায়।
চেয়ারম্যান সাহেব অসিম তালুকদার রেগে নিজেই ছেলের জন্য গাড়ি নিয়ে বের হলো।সাফিন ভাইয়ের সাথে যাচ্ছে।সে যেভাবে রেগে আছে।কিছু উল্টাপাল্টা না করে বসে।
২৬.
এই মেয়েকে আমাদের স্কুলে ভর্তি করানো যাবেনা।
-;কেন?কেন করানো যাবেনা?কি সমস্যা?
-;দেখো স্বাধীন,তুমি শান্ত হও।এভাবে শুধু শুধু রেগে যাচ্ছ।মেয়েটি সমাজ থেকে বিতারিত।তাঁকে এবং তার মা কে এক ঘর করা হয়েছিল।তা তুমি ভুলে গেলেও গ্রামের মানুষ কিন্তু ভুলে নিই।নেহাৎ ওর মায়ের মৃত্যুতে গ্রামের কিছু মহিলা শেষ অর্ন্তিম কাজে সাহায্য করেছে।এবং জানাজায় উপস্থিত হয়ে ছিলো।আর সেটা কিন্তু গ্রামের মেয়ে এক সময় ছিল ব’লে।আমি ওকে ভর্তি নিলে আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়বে।এই স্কুলের শিক্ষকতায় আমার সংসার চলে।তোমার জন্য নিজের পরিবারকে না খাইয়ে রাখতে পারব না।আর তাছাড়া মেয়েটা বাক প্রতিবন্ধী।সে কথা বলতে পারেন না।কানে শুনে না।এমন স্টুডেন্ট এখানে কোনোভাবেই এলাউ নয়।ওর জন্য বাকি স্টুডেন্ট সমস্যা হবে।
-;পুতুল হতে পারে আর দশটা বাচ্চাদের মতো নয়।কিন্তু তাই ব’লে এতটা অবজ্ঞা করা কি ঠিক সবুজ?আমি হতবাক হয়ে যাই।তুমি,আমি এক সময় একই সাথে পড়াশোনা করেছি।তোমার পরীক্ষা ফ্রী দেওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না।অথচ সেই আমি তোমার সেমিস্টারে পরীক্ষা টাকা জোগার করে দিয়েছিলাম।ভাগ্যিস তোমার মতো এতটা নিমুক হারাম হতে পারিনি।দ্বিতীয় বার দেখে নিলাম।তুমি,রাফিদ এদের কে আমি আমার কলিজা কেটে খাওয়ালে মনে হয় কম হতো।
আজ চলে যাচ্ছি।আর যাওয়ার আগেই একটা কথা ব’লে যাই।আজ যাকে তুমি এবং তোমরা সবাই অবহেলা করলে,একদিন তারজন্যই আপসোস করবে।আমার কথা মিলিয়ে নিও।আমি স্বাধীন আজ কথা দিয়ে যাচ্ছি।পুতুল কথা বলতে না পারার জন্য ওর পড়াশোনা পিছিয়ে থাকবে না।ওকে আমি নিজের হাতে গৌরব।এমনভাবে মানুষ করব।সবাই একদিন তাকে আপন করে নিতে বাধ্য হবে।আমি দেখিয়ে দিবো।পুতুল নিজের লড়াই নিজে লড়তে পারে।আমার বোন নেই ব’লে।মামা হয়ে তাকে দূর ছাই করব।আমি এমন পাষাণ নই।আমি আমার শেরা ঠাঁই দিয়ে যাব।স্বাধীন পুতুলের হাতদুটো ধরে বলল।
-;আম্মা,আপনি পারবেন না।আপনার এই ছেলের জন্য দেখিয়ে দিতে।আপনার এই মামার মুখ রাখতে পারবেন না?
এতখন দুইজনের কথাই পুতুল সবটা শুনে মাথা নিচু করে কাঁদছিল।আজ তার জন্য মামাকে কতগুলো কথা শুনতে হচ্ছে।সে কি পারবে মামার বলা প্রত্যেকটা কথার মান রাখতে?এই ছোট্ট জীবনে তাঁকে যে বেঁচে থাকতে হলে লড়াই করতে হবে।সে যদি পিছুপা করে তাহলে কি হবে?
পুতুলের নীরবতা দেখে স্বাধীন হাঁটু ভেঙে অফিস রুমে সব শিক্ষকের সামনে বসে পড়ে।দুই হাতে পুতুলের চোখের পানি মুছে বলল,
-;আপনি পিছুপা হলেন তোও হেরে গেলেন আম্মা।এই লড়াই আপনার।যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই যে ভয় পেয়ে ময়দান ছাড়ে।সে কখনো বিজয়ী হয় না।আপনারা পিছিয়ে যাওয়া মানে হেরে যাওয়া।আপনি হেরে গেছেন তোও মরে গেছেন।আপনি কি ভীতু আম্মা?আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?আপনি কি আমার কথার মূল্য বুঝতে পারছেন না?আমি জানি এই ছোট্ট মাথায় আপনার অনেক চাপ পড়ছে।কিন্তু আমি যে নিরুপায় আম্মা।আজ আমি আছি।কাল আমি না ওহ থাকতে পারি। আমরা এই পৃথিবীতে এসেছি স্বল্প সময়ের জন্য।আমাদের একদিন আসল ঠিকানা ফিরে যেতে হবে।আমি না থাকলে আপনি নিজে নিজেকে নিরাপত্ত রাখতে পারবেন।আমি তার ব্যবস্থা করে যাব।আমি জানি আম্মা। এই কঠিন কঠিন কথাগুলো আপনার মস্তিষ্কে চাপ নিতে এখন পারছে না।কিন্তু একদিন ঠিকই এই কঠিন কথাগুলো মানে আপনি বুঝতে পারবেন।
২৭.
স্বাধীন পুতুলকে কোলে নিয়ে গ্রামের স্কুল ছেড়ে চলে এসেছে সেই কখন।কিন্তু তার রেশ রয়ে গেছে স্কুল অফিস রুমে এখনো।স্বাধীন কথাগুলো ওই অফিস রুমের কিছু শিক্ষকের মন ছুয়ে গেছে।কিন্তু হেড স্যার যেখানে তার বন্ধু হয়ে ভর্তি করলো না।তখন তারা চুপচাপ সবটা নিরবে দেখে গেলো।তাদের খারাপ লাগছে এই ছোট মেয়েটি জন্য।সত্যি কি মেয়েটি পড়তে পারবে না?ছোট পুতুল কথা বলতে পারেন না,এটা কি তার অপরাধ?
পুতুল বাসায় এসে ভাইকে বিছানায় পা মেলে দুই হাতে কোলে নিয়ে কাঁদছে।সে কি করবে বুঝতে পারছে না।আজ মায়ের কথা বড্ড বেশি মনে পড়ছে।মা তাকে একা ফেলে কেন চলে গেলো?মা তার পাশে থাকলে সে সাহস পেতো।মায়ের হাসিতে দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন কাজ ওহ পানির মতো সহজ লাগত।কিন্তু মা নেই।তার বাবা থেকেও নেই।এই কষ্টগুলো একটু একটু করে বুকের বাম পাশে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে।
জেলে বসে মা,ছেলে সাজা কাটছে।তাদের মুক্তি কবে হবে জানা নেই?এমন সময় পুলিশ দারোগা এসে জানালো বড় স্যার নাসিমা বেগম কে ডাকছে।তিনি বের হয়ে অফিস রুমের সামনে আসতেই নিজের চাচা শ্বশুর চানঁ মিয়া মশাইকে দেখে আমতা আমতা করল।
-;চাচা আপনি এখানে?
-;হুম দেখতে এলাম তোমায়।কতটা ভালো আছো জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনবোধ করছি না।নিজ চোখে দেখা যাচ্ছে।লজ্জা নেই তোমার।একটা নারী হয়ে এত ছলনা কেমন কর?নারী হয়ে এক নারী ঘর ভাঙ্গলে।আবার আরেক নারীকে মিথ্যে আশা দিয়ে বিয়ের আসর পযন্ত টেনে আনলে।আমাদের সরোয়ার বাড়িটা তুমি কলঙ্ক করে দিলে।তোমাকে আমার ভাই শখ করে তার ছেলের জন্য বউ করেছিল।কিন্তু তুমি বস্তি থেকে উঠে এসে বস্তি রয়ে গেলে।তোমার আবভাব আমার ভাতিজা বুঝতে পেরেছিল।তাই তাড়াতাড়ি বিদায় নিয়েছে।আর যাওয়ার আগেই তার গুনধর ছেলে তোমার জন্য অমানুষ হবে সেটা জানতোও।তাই তার সন্তানের ঘরে বংশের প্রথম সন্তান দুনিয়ায় যে আসুক।মেয়ে কিংবা ছেলে।তার নামে এই সম্পদ।যে বাড়িতে এতদিন ছিলে সেই সাত
শতাংশ জমি,তোমার নাতি পুতুলের নামেই হয়ে গেছে।তার বিয়ে আঠারো বয়সে কোনো যোগ্য পুরুষ সাথে হলে,সেই সম্পত্তির অংশীদার তার স্বামী হবে।মেয়েটি কথা বলতে পারেনা ব’লে কম অত্যাচার করো নিই।তুমি মেয়ে হয়ে মেয়েদের কষ্টে কষ্ট পাও না।ধিক্কার তোমায়।তুমি এবং তোমার ছেলে জেলে পঁচে মর।আর যদি কোনোদিন ছাড়া পাও।সেইদিন সরোয়ার বাড়িতে পা রাখবে না।আমি এটা বলতেই নাতির ঘরে ছেলে অন্তরকে নিয়ে এসেছি।তাঁকে নিয়ে পুতুল সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।দেশ ছাড়ার আগেই অসহায় মেয়েটিকে একটিবার না দেখলে শান্তি পাবো না।আমরা পুরো পরিবার বিদেশে চলে যাচ্ছি।
-;অন্তর চলো।তোমাকে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবো।যার নাম পুতুল।
-;পু..তু.ল।
চলবে…
#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৯
২৮.
ছোট পুতুলকে নিয়ে চিন্তা করছে স্বাধীন। কাল একবার নদীর ওপারের স্কুল যাবে কথা বলতে।সেখানে দেখি কি ব’লে?দুপুরের খাবার খেয়ে স্বাধীন আবার নিজের কাজে চলে যায়।স্বাধীন চলে যেতেই একটা গাড়ি স্বাধীনদের বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে রাখল।বাকিটা পথ হেঁটে আসতে হবে।কারণ রাস্তা সরু আর চিকন।এখানে গাড়ি নেওয়া সম্ভব নয়।গাড়ি থেকে নেমেই হাঁটতে হাঁটতে উঠোনে দাঁড়ায়।রেণু নিজের ছেলে কে ঘুম পাড়িয়ে, রাজিয়া ছেলেকে কোলে নিয়ে বোতলের দুধ খাওয়াচ্ছে।এমন সময় অচেনা দুইজনকে ভর দুপুর বেলা দেখে পুতুলকে দেখতে পাঠালো।কে এসেছে পুতুল জানেনা?তবুও মামীর কথায় ঘর ছেড়ে বাহির আসে।তাঁকে দেখে চানঁমিয়া জড়িয়ে ধরে আদর করতে নিলে সে ভয় পেয়ে পিছনে চলে যায়।পুতুল কে পিছনে চলে যেতে দেখে তিনি ডাকেন।
-;আমায় তুমি ভয় পেলে পুতুল।ভয় পেয়ে ও না। আমি তোমার কোনো ক্ষতি করতে আসেনি।আমি চানঁমিয়া তোমার দাদুর বাড়ির লোক।সম্পর্কে তোমার বড় আব্বু হই।আর এই যে আমার পাশে যাকে দেখছো।সে তোমার বড় ভাই অন্তর।অন্তর এই সেই পুতুল যার কথা তোমাকে আমি একটু আগে ব’লেছিলাম।অন্তর হাই দিলো।কিন্তু পুতুল কোনো কিছু না ব’লে চুপটি করে রইল।রেনু ততক্ষণে পুতুলের ভাইকে কোলে নিয়ে বাহিরে এসে অচেনা দুই জনকে দেখে বলল,
-;আপনারা কারা?কাকে চাই?
-;জি,আমরা পুতুলের দাদুর বাড়ির লোক।পুতুলের মা’কে একটু ডেকে দিবেন।কিছু জরুরি কথা ব’লে চলে যাব।রেনু কি বলবে বুঝতে পারছে না?তবুও মুখ ফুটে বলল।
-;রাজিয়া এখানে থাকেনা।
-;রাজিয়া থাকেনা মানে।সে কোথায় গেছে?সেখানের ঠিকানা দিন।আমরা কথা বলব।
-;সেখানে মৃত্যুর আগে কেউ যেতে পারে না।রাজিয়া এই পৃথিবীতে নেই।সে মারা গেছে একমাসের বেশি হ’য়ে গেছে।
চানঁমিয়া চমকে দিলো।তিনি পিছনে থাকাতেই রাজিয়া ভাই স্বাধীনকে দেখতে পান।
-;মারা..গেছে।কিন্তু কিভাবে?এটা কিভাবে হলো?
-;যে স্বামীকে ভালোবেসে বিয়ে করে ছিল।তার সেই স্বামী তাকে মেরে ঘর ছাড়া করে।আটমাসের গর্ভবতী রাজিয়া চোখের পানি নিয়ে ভাইয়ের কাছে আসে।ভন্ড,প্রতারক স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে খবর।এবং তার কয়েকদিন পরই কলপাড়ে পা পিছলে পড়ে আহত হয়।অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের জন্য সে এবং তার সন্তান দু’জনই মারা গেছে।আমি পারিনি তাকে এবং তার সন্তানকে বাঁচাতে।রেনু আর পুতুল দুইজনই চমকে স্বাধীন দিকে তাকিয়ে রয়।ওদের চোখে,মুখে একটাই প্রশ্ন।স্বাধীন মিথ্যে বলল কেন?
স্বাধীন কথায় তিনি মর্মাহত হন।চোখে তার হতাশা ছাপ।ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল।
-;রাজিয়া স্বামী রাজিয়া মৃত্যু খবরটা জানে?
-;না।আর জানাতে চাই না।কারণ বেঁচে থাকতে যার খবর তারা রাখার প্রয়োজনবোধ করে নিই।আর সে যেখানে মারা গেছে।তাতে তাদের কিছু যায় আসবেনা।বরং ঝামেলা থেকে মুক্তি পেয়ে গেছে।আমি চাই না আমার বোনের ব্যাপারে কেউ আর কিছু জানুক।পুতুল মা তাদের জন্য পানি নিয়ে এসো।অনেক দূর থেকে এসেছেন।তারা নিশ্চয় খুব ক্লান্ত।পুতুল মাথা নাড়িয়ে ঘরে পানি আনতে গেলো।
-;আশা করি আপনাদের আর কিছু বলার নেই।গরিবের বাড়িতে দুপুরে এসেছেন।না খেয়ে যাবেনা।রেনু তাদের খেতে দেও।
-;দাঁড়াও স্বাধীন।আমার কথা এখনো শেষ হয়নি।চানঁ মিয়া কিছু কাগজ বের করে দিলেন।স্বাধীন কাগজটা না নিয়ে চুপচাপ গম্ভীর মুখে তাকিয়ে রইলো।
-;এখানে সরোয়ার বংশের কন্যা পুতুলের নামে সম্পত্তি ভাগ লিখা আছে।পুতুলের দাদা
তার বংশের কথা চিন্তা করেই দলিল লিখিত করে গেছেন।সেখানে ছেলে কিংবা মেয়ে। প্রথম যে সন্তান আসবে।তার নামেই ই সম্পত্তি হয়েছে।যেহেতু প্রথম সন্তান মেয়ে এবং পরবর্তী আর কোনো সন্তান নেই।তাই এই হক পুতুলের।পুতুলের আঠারো পূর্ণ হলেই সে সম্পত্তির মালিক হবে।তার বিয়ে যদি কোনো ছেলের সাথে হয়।তাহলে সে ওহ তার অংশীদার হবে।
২৯.
আপনি মিথ্যে কেন ব’লেন?রাজিয়া নেই ঠিক আছে।কিন্তু তার ছেলে মারা গেছে?
স্বাধীন,রেণুর দিকে তাকিয়ে বলল,
-;আমি যা করেছি ঠিক করেছি।কারণ সরোয়ার বংশধর হিসেবে তাদের ছেলে আগমনে মোস্তফা এবং তার মা এই বাড়িতে কোনভাবে পা রাখুক।তা আমি চাই না।মিলন পুতুলের ভাই।মিলন কে নিতে এই বাড়িতে ছুটে অবশ্যই আসবে।কিন্তু পুতুলের জন্য তাদের মন পুড়বে না।আর আমার বোনের শেষ চিহ্ন তাদের হাতে তুলে দিতে পারবো না।তাই আমি মিথ্যে বলেছি।তারা লোভের জন্য আসবে।পুতুলের পর মিলনই তাদের শেষ ভরসা হবে সম্পত্তের ভাগের অংশের জন্য।একটা মিথ্যে যদি সবকিছুর সমাধান হয়ে যায়।তাহলে সে মিথ্যেই ভালো।
-;আপনি ভুলে যাচ্ছেন।সত্যিটা মিথ্যে ব’লে ঢেকে রাখা যায় না।একদিন না একদিন সত্যিটা প্রকাশ পেয়ে যায়।
-;পরে যদি সত্যিটা প্রকাশ পায়।ততক্ষণে আমি পুতুলের বিয়ে দিয়ে দিবো।আর আমি তখন সত্যিটা সবাইকে জানিয়ে দিবো।তুমি ভয় পাও কেন?আমি থাকতে তোমাদের সাথে খারাপ কিছু হতে দিবোনা।ভরসা রাখ।
-;ভরসা,বিশ্বাস করি ব’লেই চুপ ছিলাম। আপনি পাশে থাকলে আমাদের কিসের ভয়?আপনি আছেন তো আমি আছি।আপনি নেই তো আমরা নেই।
-;তাহলে আজকের কথাগুলো এখানেই সমাপ্ত কর।পুতুলের বিয়ে দিলে তখণ ভাবা যাবে।শুনো,কালকে আমি পুতুল কে সাথে নিয়ে নদীর ওপারে স্কুলের শিক্ষকের কাছে যাবো।আমি চাই পুতুল পড়ুক।অনেক অনেক পড়ুক।পড়াশোনা করে নিজের ভবিষ্যত নিজে গড়ুক।মানুষের মতো মানুষ হোক।শুধু পুতুল নয় রেনু।আমাদের দুই ছেলে সাজু,মিলন পড়বে।ওদের আমি পড়াবো।যে স্বপ্ন পূরণ আমার হয়নি।সেটা ওরা অর্জন করুক।আমি একদিন গৌরব করে বলতে পারব।আমি আমার তিন সন্তানকে পড়াশোনা করিয়েছি।আবার মানুষের মতো মানুষ বানিয়েছি।তাদের চোখে ধনী,গরিব,বড় ছোট ব’লে কিছু না থাকুক।তাদের চোখে সবাই সমান মানুষ মানুষের জন্য একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিক।বিশ্বাস, ভরসা,আস্থায় বাঁচব।
৩০.
অসিম তালুকদার নদীর এপারে রোহিতপুর গ্রামের পথে রওনা হয়েছেন।
এইদিকে রাত হতেই জিহান,রিহানকে নিয়ে সারাদিন না খাওয়া অর্পণ।লিলিপুটকে শিক্ষা দিতেই আজ চুপচাপ পুকুর পাড়ে বসে ছিল।কোনো কিছুতেই তার মনোযোগ ছিলো না।রাগে,কষ্টে কারো বাড়িতে যেতে ভুলে গেল।
কারো কোনো ক্ষতি করেনি।তাদের সারাদিন ধরে না খাওয়া খিদে পেট মোচড় মারছে।পেটের মধ্যে কেমন বুদবুদ শব্দ করছে।রাতের আঁধার নেমে আসে চারদিক থেকে শিয়াল ডাক।কেমন ভয়ংকর অবস্থা? শেয়ালের হাঁক জন্য ঘর ছেড়ে রাতে বের হওয়া মুশকিল।কেউ যদি বাড়ির উঠোনে পাঁচ মিনিটের বেশি দাঁড়িয়ে থাকতে চায়।তাহলে শিয়ালের আক্রমণ থেকে বাঁচা সম্ভব নয়।সে আঘাত করে বসে।ইদানীং শিয়ালের উৎপাত বেশি বেড়ে গেছে।পুতুল তার ভাইকে জড়িয়ে ধরে ঘরে বসে আছে।মামীর ডাক দিয়ে গেছে।তাদের ঘরে শোয়ার জন্য। কিন্তু পুতুল আসেনি।এই ঘরে তার মা ছিলো।মায়ের গন্ধ এখন এই ঘর থেকে পায়।সে এই ঘর ছেড়ে যেতে চায় না।আর ভাইকে ওহ দিতে চায় না।
তাই রেনু চলে গেছে।স্বাধীনের দুপুরে শরীরটা একটু বেশি খারাপ লাগায় তাড়াতাড়ি কাজ থেকে চলে আসে।এখন রাতে অসুস্তা বেড়েছে।স্বাধীন শরীরটা ভালো না থাকায় একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে।এই দিকে পুতুলের মধ্যে ভয়ে ঢুকে গেছে।তার হাত,পা কাপছে।কি করবে বুঝতে পারছে না?তবুও জিদ ধরেছে।মামাদের রুমে যাবে না।কারণ তাদের খাটটা বেশি একটা বড় নয়।তিন জনের শোয়ার খাটে সে এবং ভাই গেলে মামাকে নিচে মাটিতে শুতে হবে।এখন ঠান্ডা পড়ে।এই সময় মাটিতে ঘুমালে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে।তাই সেই রুমে না গিয়ে নিজের রুমে চুপচাপ শুয়ে রইলো।
পুতুলের চোখ বুঝে নিতেই শিয়ালের ডাক ভেসে আসে তাদের উঠোন থেকে।উঠোনের পূর্ব দিকে বাথরুমে চাক বসানো।সেইদিকে চারদিকে কলাগাছে ঘেরা।সে জায়গায় থেকে কেমন ভয়ংকরভাবে ডাকছে।মনে হচ্ছে শব্দগুলো আরো সামনে এগিয়ে আসছে।ভাইকে দুই হাতে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ফুফিয়ে কেঁদে ওঠে।মনে মনে মায়ের শেখানো দোয়া পড়তে থাকে।
».
আল্লা-হুম্মা ইন্নী আসআলুকাল ‘আফওয়া ওয়াল- ‘আ-ফিয়াতা ফিদ্দুনইয়া ওয়াল আ-খিরাতি।আল্লা-হুম্মা ইন্নী আসআলুকাল ‘আফওয়া ওয়াল-‘আ-ফিয়াতা ফী দ্বীনী ওয়াদুনইয়াইয়া,ওয়া আহ্লী ওয়া মা-লী, আল্লা-হুম্মাসতুর ‘আওরা-তী ওয়া আ-মিন রাও‘আ-তি। আল্লা-হুম্মাহফাযনী মিম্বাইনি ইয়াদাইয়্যা ওয়া মিন খালফী ওয়া ‘আন ইয়ামীনী ওয়া শিমা-লী ওয়া মিন ফাওকী। ওয়া আ‘ঊযু বি‘আযামাতিকা আন উগতা-লা মিন তাহ্তী
● “হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষমা ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট ক্ষমা এবং নিরাপত্তা চাচ্ছি আমার দ্বীন, দুনিয়া,পরিবার ও অর্থ-সম্পদের।হে আল্লাহ! আপনি আমার গোপন ত্রুটিসমূহ ঢেকে রাখুন।আমার উদ্বিগ্নতাকে রূপান্তরিত করুন নিরাপত্তায়।হে আল্লাহ! আপনি আমাকে হেফাযত করুন আমার সামনের দিক থেকে, আমার পিছনের দিক থেকে,আমার ডান দিক থেকে,আমার বাম দিক থেকে এবং আমার উপরের দিক থেকে।আর আপনার মহত্ত্বের অসিলায় আশ্রয় চাই আমার নীচ থেকে হঠাৎ আক্রান্ত হওয়া থেকে”।
শিয়ালের একটা শব্দ নয় বেশ কয়েকটা শব্দ আসছে।শিয়াল কতগুলো বাহিরে জানা নেই।একটু পর দামদুম শব্দ হচ্ছে।মনে হয় ঘরে চাল ভেঙে ঘরে ঢুকে যাবে।পুতুল আর নিতে পারলোনা।চিতকার করতে চাইলো পারছে না।ভয়ে কপাল বেয়ে ঘাম ছুটে আসে।এরমধ্যেই মিলনের ঘুম ভেঙে যায়।ছোট দুধের শিশুর উচ্চস্বরে কান্না করছে।সেটা বাহিরে পশুর ভয়ে না-কি বোনের কষ্ট বুঝতে পেরে কান্না করছে জানা নেই।কিন্তু পুতুল আর ঠিক নেই।হাত থেকে ভাই ছিটকে খাটের বিছানায় পড়ে।আর পুতুল তার পাশে বেহুশ হয়ে যায়।
চলবে….
#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-১০
৩১.
জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পরে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে।পাশে হাত দিতেই ভাইকে না পেয়ে পুতুল অস্থির হয়ে যায়।কান্না করে ওঠে।রেনু পুতুল কে জড়িয়ে ধরে শান্ত করতে করতে বলল,
-;তোমার ভাই ঠিক আছে।তার কিছুই হয়নি।এই যে দেখ তোমার মামার কোলে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে।
পুতুল তার ভাইকে কোলে নিতে হাত বাড়িয়ে দেয়।স্বাধীন পুতুলের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে মিলনকে কোলে তুলে দিতেই ভাইকে জড়িয়ে ধরে আদর করে।কপালে হালকা ব্যথা পেয়েছে।কপালটা কেমন লাল হয়ে গেছে।তার ভাই কি খুব কষ্ট পেয়েছে?পুতুল অসহায় চোখে ভাইকে দেখে যায়।
রেণু,স্বাধীন এত বুঝাচ্ছে কিন্তু কাজ হচ্ছে না।পুতুল নিজেকে দায়ী করতে লাগল।
স্বাধীন পুতুলের মাথায় হাত রেখে বলল,
কাল রাতে শিয়াল ডাক শুনতে পেয়েছো তাই না।কিন্তু শিয়ালের মতো দেখতে হলেও শিয়াল ছিল না।ওই জঙ্গিলী পশুগুলো,বেলালদের বাড়ির গোয়াল ঘরের আস্ত গরু খেয়ে ফেলেছে।রাতে গোয়াল ঘরে ঢুকে এমন বিভৎস কর্মকান্ড করেছে।কিন্তু শিয়াল ছিল না।ধারণা করা হচ্ছে ওটা বাঘথাবা।এমন নামই শুনতে পেয়েছি।স্বাধীন পুতুলের মাথায় হাত রেখে বলল,
-;আজ থেকেই তোমরা দু’জন আমাদের সাথে ঘুমাবে।দুই খাট একসাথে বিছানো হবে।এটা নিয়ে আর না বলবে না।আমি তাহলে খুব রাগ করব।খাবার খেয়ে তৈরি হও।আমরা বের হব।
পুতুল মাথা নাড়িয়ে আচ্ছা বল।
৩২.
আম পাতা জোড়া জোড়া
মারবো চাবুক চড়বো ঘোড়া
ওরে বুবু সরে দাড়া
আসছে আমার পাগলা ঘোড়া
পাগলা ঘোড়া খেপেছে
চাবুক ছুড়ে মেরেছে।
উফফ বড্ড লেগেছে।
ইয়াসমিন ম্যাম ছোট বাচ্চাদের থেকে ছড়া শুনছেন।পুতুল স্কুল প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে সবটাই শুনতে পায়।তার স্কুলটা বেশ পচ্ছন্দ হয়েছে। কিন্তু এই স্কুল কি তাঁকে রাখবে।ম্যাম কি ওদের মতো তার সাথে কথা বলবে?তাঁকে নিয়ে যদি মজা করে।তাই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।এরমধ্যেই স্বাধীন তাকে ডেকে নিয়ে গেলো।
গায়ে তার সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি।মাথায় টুপি।চোখে চশমা।মাথার চুল পাকা।দাড়ি বেশ বড় বড়।লোকটা মামা সাথে হেসে কথা ব’লছেন।কিছু কাগজপত্র তৈরি করে মামার থেকে সই নিয়ে বলল।
পুতুল এখানে পড়তে পারবে।যেহেতু এই বছর প্রায় শেষ।বাচ্চাদের পরীক্ষা ডিসেম্বরের এক তারিখ থেকে শুরু।তাই আগামী বছর জানুয়ারীতে তার ভর্তি হবে।বাসায় বসে পড়াশোনা করা-ও স্বাধীন।
-;জি স্যার আমি ওকে পড়াবো।আজ আসি স্যার।তাদের কথায় বুঝতে পারলো তার এখানে ভর্তি হবে।পুতুল মামার হাত ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে স্কুল থেকে বের হয়।সে খুব খুশি তার ভাব ভঙ্গিতে প্রকাশ পাচ্ছে।স্বাধীন খুশি হলো।মেয়েটা পড়তে পারবে বলে আজ কত খুশি হয়েছে।নতুন জায়গায়,নতুন স্কুল।নতুন জামা,বই,চক,বোর্ড।সব কিছু সে পাবে।
আর্দশ লিপি বই,চক,বোর্ড নিয়ে বাসায় পড়াতে লাগল স্বাধীন।সে আওয়াজ করে পড়তে না পারলেও।লিখাটা আয়ত্তে এনেছে।
হাতের লিখা প্রথমে খারাপ হতো।বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পর মোটামুটি ভালো হয়েছে।এখন দিনের অর্ধেকটা সময়ই তার পড়াশোনা যায়।বাকিটা ভাই,আর মামীর কাজের সাহায্যে হাত লাগায়।এটুকু বয়স থেকে সংসারের কাজগুলো বুঝে নিতে শুরু করছে।তার একটু কাজের ভুল করার চেষ্টা করে না।কাজে মনোযোগ দেখে রেণু অবাক হয়।মেয়েটা কথা না ব’লে কি হবে?কাজে,এবং পড়াশোনা করার ইচ্ছে দেখা যায়।তার ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিচ্ছে স্বাধীন,রেনু।দেখতে দেখতে নতুন বছর চলে এসেছে। পুতুল স্কুলে ভর্তি হলো।তার পড়াশোনা করতে খুব ভালো লাগে।বেশ সাচ্ছন্দ্যবোধ করে।স্বাধীন ছেলের ছয় মাস শেষ হলো।সে সাড়া উঠোনে হাপুর পারে।কিন্তু হাঁটতে পারে না। চার হাত,পা দিয়ে সারা বাড়িতে খেলা তার নিত্য রুটিন।এই দিকে মিলন বসতে চেষ্টা করে কিন্তু পারেনা।।দুই ভাই কি যে দুষ্টুমী করে?একসাথে সুয়ে রাখলে একজন, আরেকজনকে হাত,পা গাল,চুল টেনে ধরে।একজন হাসে ব্যাথা দিয়ে।অপরজন ব্যাথা পেয়ে কেঁদে বাড়ি মাথায় তুলে।মিলনটা খুব পাঁজি হয়েছে।সুযোগ পেলে নিজের বিছানায় হিসু করে দেয়।ঠান্ডা বিছানা সুয়ে থাকবে না।সে সাজুর বিছানায় গড়িয়ে এসে সুয়ে এক পা সাজুর ওপর তুলে দেয়।রেণু দুই ছেলের কান্ডে হাসতে থাকে।স্বাধীন দুই ছেলের কাহিনি দেখে চোখ জুড়িয়ে নেয়।
৩৩.
ফেব্রুয়ারীতে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের এসএসসি পরীক্ষা শুরু হবে।অর্পণ পুরো দমে পড়ছে।রোহিতপুর থেকে তাকে তুলে এনেছে।অসিম তালুকদার শুধু এনেই থামেনি।তিন ভাইকে মেরে কাঠের ব্যাট ভেঙে ফেলেছে।সাফিন বড় ভাইকে থামাতে গিয়ে নিজেও একটা আঘাত পিঠে খেয়েছে।তিন ছেলে রেজাল্ট খারাপ করেছে।আবার গ্রামে সব অকাজের জন্যই শিক্ষা দিলো।ভবিষ্যতে যাতে এগুলো না করে।রাবেয়া ছেলের মার দেখেই বেহুশ।জ্ঞান ফিরতেই কান্নাকাটি এবং স্বামীকে গালাগালি করেছে।অসিম তালুকদার বউকে ধমক দিলেন।কিন্তু লাভ হয়নি।ছেলেকে কেন মারবে?সেটার জন্য বাবার বাড়িতে বিচার পাঠিয়ে দিয়েছেন।তারপর থেকেই মায়ের বাপের বাড়ি যাও বন্ধ করে দিয়েছেন অসিম তালুকদার।
অর্পণ জিদ ধরেছে।সে ভালো রেজাল্ট করে দেখাবে।অসিম তালুকদার ওপর জিদ করেই এত মনোযোগ তার পড়াশোনা প্রতি।হারুন কে ব’লে ফরম ফ্লিলাপ করেছেন অসিম তালুকদার।
পড়া শেষ করে খাবার টেবিলে বসে অর্পণ।তার মা খুশি মনে ছেলেকে খেতে দেন।অর্পণ চুপচাপ খেয়ে নেয়।অসীম তালুকদার ছেলের গতিবিধি লক্ষ্য করছেন।ছেলে কখন কোথায় যায়?সব খবর টাইম টু টাইম চলে আসছে।ছেলের অগোচরে ছেলের পেছনে যে চব্বিশ ঘণ্টা গোয়েন্দা লাগিয়েছেন।
নতুন স্কুলে সামনেই মামা নামিয়ে দিয়ে স্যারকে ব’লে চলে গেছে।যাওয়ার আগে ব’লে গেলো।সে ছুটির সময় নিতে আসবে।
পুতুলের থেকে সবাই বড় এবং একটু উগ্র টাইপের।পুতুল ক্লাস রুমে আসতেই তার সাথে কেউ মিশতে এবং একসাথে বসতে চায় না।তাকে দেখে ক্লাসের বাচ্চারা অনীহা প্রকাশ করছে।পুতুল মন খারাপ করে পিছনে বসে পড়ে।ইয়াসমিন ম্যাম ক্লাস করতে এসে দেখে।একটি মেয়ে একা একটি বেঞ্চে পিছনে সিটে বসে আছে।
-;কি ব্যাপার তুমি পিছনে কেন?সবার সাথে বস।
-;পুতুল চুপ।
-;মিস আমরা ওর সাথে বসতে চাই না।মেয়েটা পঁচা।
ইয়াসমিন ম্যাম পুতুলের পোশাক দিকে একবার চোখ বুলিয়ে,অন্য বাচ্চাদের পোশাক দিকে তাকিয়ে বলল।
-;এটা কেমন আচরণ তোমাদের?আমি তোমাদের কাজ থেকে এটা আশা করি নিই।একজনের পোশাক দেখেই তাকে বিবেচনা করে নিলে।সে খারাপ।সে হতে পারে গরিব।কিন্তু তার পোশাক বেশ পরিপাটি মার্জিত।সে কোনো ধনীর দুলালিই নয়।তোমরা তোমাদের বাবার কাছে এক একজন পিন্সেস।কিন্তু এই পুতুলের বাবা নেই।তার মা নেই।সে মামার কাছে থাকে।মামা যা খায়।তাকেও তাই খাওয়া।সে মামার কাছে বড় হচ্ছে।সে ভালো আছে।
পুতুলের সাথে মিশতে চাও না।ঠিক আছে। কিন্তু যদি দেখি কেউ খারাপ আচরণ তার সাথে করেছো।পানিশমেন্ট দিবো।যে আগে আসবে সেই আগেই বসবে।আগে এসে,পিছনে বসলে এবং তা আমার কানে গেলে খবর আছে।মনে থাকে যেন।
ইয়াসমিন ম্যাম সবাইকে পড়াশোনা বুঝিয়ে দিয়ে পুতুল সামনে দাঁড়ায়।মিসকে দেখে মাথা নিচু করে।পুতুলের হাতের লিখা দেখে।এবং বাকি লেখাগুলো কীভাবে লিখতে হবে বুঝিয়ে দিলেন?পুতুল চুপচাপ বুঝে।সেইভাবেই করতে লাগল।
মার্চ মাস চলছে।পুতুলের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা শুরু হবে।পুতুল পড়াশোনা করতে ভালো লাগছে।স্কুল যেতে প্রথমে খারাপ লাগলেও এখন ভালো লাগে।ইয়াসমিন ম্যামের সাথে তার সম্পর্ক ভালোই জমেছে।সে একটু আকটু বুঝতে পারে।এবং ম্যামের কথা মতো সব করতে পারে।এইদিকে অর্পণ পরীক্ষা শেষ।সে স্কুল এসেছে স্যার সাথে কথা বলতে।
স্কুল মেইন গেটের ডান পাশেই সরকারি স্কুল। বাম পাশে কিন্ডারগার্টেন।মেইন গেইট রাস্তা ধরে পাচঁ মিনিট সোজা গেলেই হাইস্কুলের মাঠ দেখতে পাওয়া যায়।চার তলা ভবনটি তার শিক্ষা জীবনের দশ বছরের সমাপ্তি টেনে দিয়েছে।এই হাইস্কুলের পিছনে দেয়াল অর্ধেক ভাঙ্গা।সেই দেয়াল টপকে টিফিন পিরিয়ডে পালিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিত।মাঝে মধ্যে স্কুল থেকে দূরে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সাথে দুই একদিন সিগারেট টেনেছে।যেটা অসীম তালুকদার এখনো জানে না।জানলে খবর আছে।
হারুন স্যার সাথে কথা ব’লে কিছু অংঙ্ক বুঝে নিয়ে বাড়ি পথে ফিরে আসতে নিলেই পুতুলকে দেখতে পায়।এই ফাজিল মেয়ে তার এলাকায় কি করছে?দুই বিনুনি করে গোল ফরাকে পড়ে বসে আছে।বাহিরের কদম ফুল গাছের নিচে।সে এগিয়ে কিছু বলার আগেই স্বাধীন এসে পুতুল কে কোলে নিয়ে চলে যায়।
অর্পণ রেগে পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করে বাসায় চলে যায়।
চলবে….