#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৫৮
১৫৫.
পুতুল এই প্রথমবার তালুকদার বাড়ি চৌকাঠে পা রেখেছে।শ্বাশুড়ি মা তাকে সাধরে ঘরে তুলে নিতে চাইলে অর্পণ,পুতুলের হাত ধরে আ*টকে দিল!বলল,
আমার বউ।আমি বাড়িতে নিয়ে ঢুকবো।অর্পন কাউকে কিছু বলতে না দিয়ে পুতুলকে কোলে তুলে চৌকাঠ পেরিয়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে।এইদিকে এতো মানুষের সামনে তাকে কোলে নেওয়া লজ্জা পেয়ে স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলে।অর্পন বউকে নরম সোফায় বসিয়ে নিজেও পাশে বসে।রাবেয়া ছেলে এবং ছেলের বউকে মিষ্টি মুখ করায়।অর্পণের নানা বাড়ির লোকেরা সবাই এসেছে।তার নানি হুইল চেয়ারটায় বসে আছেন।পুতুল তাদের সবাইকে মুখে সালাম দিলো।পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে নিই।আত্মীয় স্বজনেরা নতুন বউয়ের মুখ দেখে বেশ প্রশংসা করলো।ভাইয়ের বিয়েতে তন্নী তার স্বামীসহ নিজের শ্বশুর বাড়ি সবাইকে নিয়ে এসেছে।সময়ের সাথে স্বামী এবং শ্বাশুড়ির মাঝে বেশ পরির্বতন এসেছে।তাদের আগের রাগ ডাকটা নেই।তন্নী ছেলের বয়স পাঁচ বছর চলছে।ছোট ছেলে পুতুলের কোলে চড়ে বসেছে নামার নাম নেই।এইদিকে জামাই মশাই তন্নীর ছেলের পিঠে চিমটি কাটে।মামা,ভাগ্নে একসাথে ইশারায় কথা বলছে।
অর্পণ তার বউয়ের কোল থেকে নামতে ব’লে কিন্তু তন্নী ছেলেও কম দূষ্টু নয়।মামাকে রাগাতে মাথা নাড়িয়ে না করে মামী গলা জড়িয়ে ধরে গালে গাপুসগুপুস কয়েকটা চুমু খেয়ে বসে।এগুলো অর্পণ দেখে দাঁত খটমট করে তাকিয়ে মনে মনে বিরবির করে বলল,
ওরে শালা,বউ আমার আর চুমু খাও তুমি।দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা।অর্পণ তন্নী ছেলের কানের সামনে গিয়ে বলল,
মামা তন্ময়।হবু শ্বাশুড়িকে এত চুমু খেতে নেই।এতে আমার মেয়ের আদরের ভাগটা কম পরে যাবে।
তন্ময় কপাল কুঁচকে বলল,কেন,তোমার মেয়ের আদরের ভাগ কমবে পরবে কেন?
আরে তোকে ভবিষ্যতে আমার মেয়ে জামাই বানাবো।এত আদর হবু শ্বাশুড়িকে করলে তোমার শ্বশুরের কলিজা কাপেঁ বাপ।তাড়াতাড়ি নাম।আমি আমার বউকে নিয়ে কেটে পড়ি।যদি বউ নিয়ে ঘরে যেতে না দিস।আমার মেয়েকে তোর মতো ছেলের কাছে বিয়ে দিতাম না।
মামা,ভাগ্নের ফিসফিস করে কথা বলা দেখে তন্নী এগিয়ে আসে।
কি’রে মামা ভাগ্নে কি এত ফিসফিস করে কথা বলিস?আমাদের কেউ বল।
তন্ময় গালে হাত দিয়ে ভাবুকের মতো করে বলল,
তোমাকে বলা যাবেনা।এটা মামা ভাগ্নের সিক্রেট।
ছেলের কথায় তন্নী কি বলবে বুঝতে পারলোনা?ছেলেকে টেনে ধরে নিয়ে যেতে যেতে বলল,আব্বু এবার নেমে এসো।মামা-মামীকে ঘরে যেতে হবে।আপনি আমার সাথে নিজ ঘরে তাড়াতাড়ি আসুন।রাত কম হয়নি।ঘুমাতে হবে।তন্ময় চলে যাওয়ার সময় মামার দিকে তাকিয়ে ইশারায় কিছু ব’লে চলে যায়।
রাত তখন বারোটা পুতুলকে ঘরে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।কিছুখন পর অর্পণ রুমে প্রবেশ করে।মাথায় পাগড়ি খুলে নিজের রমনীর পাশে বসে।নরম গলায় ব’লে উঠে ধন্যবাদ আমাকে ভালোবেসে আমার জীবনে আসার জন্য।আমাকে এতটা আপন ভাবার জন্য।আমার জীবনে এত সুখ শুধু তোমারই জন্য।আমার ভালোবাসা শুধু আমার আদূরনী বউয়ের জন্য।আজ এই পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার জন্য চলো দুইজন মিলে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ি।স্বামীর কথায় পুতুল মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো।স্বামীর হাতে হাত রেখে ওয়াশরুমের দরজা অবধি গেলো।তাকে ফ্রেশ হতে ব’লে অর্পণ বাহিরে রইলো।পুতুল চলে যেতেই অর্পণ গায়ের পোশাক চেঞ্জ করে নিলো।অর্পণ তৈরি হতেই পুতুল ফ্রেশ হয়ে ওযু করে বের হয়।গায়ে কোনো সাজ্জসজ্জা নেই।একদম সিগ্ধতায় ঘেরা।
পুতুল দুইজনের জন্য জায়নামাজ বিছিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।অর্পন ওযু করে পুতুলের সামনে দাঁড়িয়ে যায় নামাযের জন্য।আর পুতুল স্বামীর পিছনে দাঁড়িয়ে যায়।দুইজনই দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে নিলো।আল্লাহ দরবারে হাত তুলে মোনাজাতে লাখ লাখ শুকরিয়া করলো।
১৫৬.
আকাশ জুড়ে বিশাল তারাদের মেলা বসেছে। সারা আকাশটা জুড়ে তারা জ্বলজ্বল করছে।তাদের মনে হয়তো নতুন সুখ পাখির আগমন ঘটেছে।অর্পণের মতো করে কি তাদের মনেও কেউ কড়া নাড়ছে।যা সয়ণে স্বপ্নে মনের জাগরণে তার প্রিয় মানুষের ছবি একে যায়।আজ চিতকার করে বলতেই চাই।হে আকাশ,হে বাতাস,হে মাটি তোমরা দেখে যাও।আমার হ্রদয় শুধু তার কথা ব’লে।তাঁকে ভালোবাসে আমার এই হ্রদয়।পুতুলকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
আজ আমি পূর্ণ্য পুতুল।তোমায় ভালোবেসে আমি আমাকে তোমার মাঝে সেই কবেই হারিয়ে ফেলেছি।আজ আমি সত্যি খুশি।তোমার স্বপ্ন পূরণ করা তোমার মুখের কথা বলা সবটা আমি ফিরিয়ে দিতে পেরেছি।আমার ভালোবাসা আজ আমার ঘরে।তার ছোঁয়ায় পূর্ণ হোক আমার জীবন।অর্পন,পুতুলকে কোলে তুলে বলল,
সো মিসেস আর ইউ রেডি।পুতুল লজ্জা পেয়ে স্বামীর বুকে মুখটা লুকিয়ে মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো।পুতুলের কাজে অর্পন শব্দ করে হেঁসে এগিয়ে চললো নতুন দিনের সূচনার জন্য।
তন্ময় নিজের রুমে গাল ফুলিয়ে বসে আছে।তন্নী ছেলেকে টেনে শুয়াতেই সে আবার উঠে বসে থাকে।
কি হলো?ঘুমাচ্ছ না কেন?
মামার কাছে যাব।
কি?এত রাতে মামার কাছে যাবে মানে।
মামা ব’লেছে আমায় বউ দিবে।কিন্তু আমায় বউ না দিয়ে সেই ঘরে নতুন বউকে নিয়ে আমার মুখের ওপর দরজাটা ঠাস করে লাগিয়ে দিয়েছে।
তন্নী ছেলের সামনে বসে বলল,
তোমার মামা কাল সকালে উঠলে তার থেকে জেনে নিও।সে এখন ঘুমাচ্ছে।তুমিও ঘুমাও।
না ঘুমাবো না।আগে মামাকে বলো আমার বউ এনে দিতে।
তন্ময় শেষবারের মতো করে বলছি।এবার কথা না শুনলে খুব বকবো।পরে কিন্তু আমাকে দোষ দিতে পারবে না।তন্ময় মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে শুয়ে পড়ে।যার মানে আম্মু বকা দিবে কেন বলল,সে রাগ করেছে।ছেলের রাগ দেখে তন্নী পিছন থেকে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে সুয়ে পরে।
তন্নী,তন্ময় ঘুমিয়ে পড়তেই অন্তর রুমে প্রবেশ করে চুপিচুপি।তন্নীর পিছনে সুয়ে মা,ছেলেকে একসাথে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে।এইদিকে স্বামীই চোখ বুঝতেই তন্নী চোখ মেলে মুচকি হেসে আবার চোখ দুটো বুঝে নিলো।কোনো শব্দ করলো না।
রাত্রি কেটে ভোর হলো সূর্যের নতুন আলোর ছোঁয়ায়,সেই আলোর ছোঁয়ায় শুরু হলো নতুন দিন।পুতুল ফজরের নামাজ পড়ে নিয়েছে।অর্পণ নামাজ পড়ে রুমে প্রবেশ করে পুতুলের হাতটা টেনে বিছানায় বসিয়ে বলল,
আমার জন্য সারারাত ঘুমাতে পারো নিই।এখন একটু ঘুমিয়ে নেও।পুতুল মাথা নাড়িয়ে না বলল।কিন্তু অর্পণ বউয়ের কথায় পাত্তা দিলো না।বউয়ের ভেজা চুলের ভাজে হাত বুলিয়ে দিতেই পুতুল আস্তে আস্তে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো।পুতুল সুয়ে পড়তেই।অর্পন বউয়ের পাশে সুয়ে পরে।
টেবিলের ওপর অনেক রকম নাস্তা দেওয়া হয়েছে।তন্ময় সেগুলো ছুয়ে দেখছে না।তন্নী ছেলের জন্য প্লেটে নাস্তা সাজিয়ে প্লেট এগিয়ে দিতেই সে বলল,
খাব না।
কেনো?
রাগ করেছি।
খাবার সাথে রাগ করেছো।
না।
তাহলে।
মামার সাথে আর তোমার সাথে।
ছেলের রাগের কারণ বুঝতে পেরে তন্নী ছেলের সামনে একটা গিফটের প্যাকেট রাখে।
তন্ময় গিফটের প্যাকেট দেখে খুশি হয়ে চুপচাপ খেতে লাগলো।
দরজায় কেউ কড়া নাড়তেই পুতুলের ঘুম ভেঙে যায়।ঘড়ি দিকে তাকিয়ে দেখে বেলা এগারোটা বেজে গেছে।পুতুল তাড়াহুড়ো করে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে কারো বাঁধনের মধ্যে নিজেকে পেলো।পুতুল নিজেকে ছাড়ানো চেষ্টা করতেই অর্পণের ঘুমটা ভেঙে যায়।সে চোখ দুটো বুঝে থেকেই বলল,
বউ ডিস্টার্ব করে না।আমি ঘুমাচ্ছি।
আপনি ঘুমাচ্ছেন ভালো কথা আমাকে ছাড়ুন।কত বেলা হয়ে গেছে।আল্লাহ বাড়ির সবাই কি ভাববে?এত বেলা করে বাড়ির বউ ঘুমায়।
কেউ কিছু ভাববে না।কারণ সবাই জানে কাল আমাদের বিয়ে হয়েছে।আর স্বামী,স্ত্রী একান্ত সময় কাটানোর পর নিশ্চয়ই এখন পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।এটা স্বাভাবিক।
দূর,আপনি আমাকে ছাড়ুন।আমি উঠবো।অর্পণ আরো কিছু বলার আগেই দরজায় ঠকঠকের শব্দ হলো।অর্পণ কপাল কুঁচকে বলল,
শালার জামাই।শ্বশুরের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাশ।অর্পণ পুতুলকে ছেড়ে দরজাটা খুলে দাড়াতেই।সুরসুর করে তন্ময় রুমে মধ্যে চলে আসে।খাটের ওপর পা দু’টো ঝুলিয়ে বসলো।
পুতুল ভেবেছিল।বড় কেউ এসেছে,মাথায় তাড়াতাড়ি কাপড় টেনে বসতেই তন্ময়ের প্রবেশ দেখে।
কি ব্যাপার আপনি এত সকালে আমার রুমে কেন?তন্নী এই তন্নী।
তন্নীর সাড়া শব্দ না পেয়ে বিরবির করে বলল,
এই তন্নীর বাচ্চাটা কই গেলো?
চলবে….
#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৫৯
১৫৬
দেখতে দেখতে অর্পণ আর পুতুলের সংসার সাত বছরে পরে গেলো।পুতুল নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে যেমন ব্যাস্ত তেমনি সংসারের কাজে যতটুকু পারে সময় দেয়।এতে তার শ্বাশুড়ি মা তাকে কখনোই কিছু ব’লে না।নিজের ক্যারিয়ারের দিকে ফোকাস দিতে ব’লেছেন।পুতুল কপাল করে মনের মতো ঘর,এবং বর দুটোই পেয়েছে।সবাই তাকে পেয়ে যেমন সন্তুষ্ট ঠিক তেমনই সে নিজেকে খুব সুভাগ্যবতী মনে করে।এমন একটা পরিবার কয়জনের ভাগ্যে জুটে।অর্পণ নিজের রাজনীতির নিয়ে পড়ে আছে।হোম মিনিস্টার অর্পনের নানুজান তার কাজ থেকে নিজ উদ্যোগে ইস্তফা নিয়েছেন।বর্তমানে বউ নিয়ে হজ্জ করতে মক্কায় যাচ্ছেন।এখন সব সময় নামাজ কালাম নিয়ে পরে থাকেন।আল্লাহ ইবাদতে মশগুল থাকতে যান।
হাসপাতালে রোগীগুলোকে দেখতে কয়েকজন ডাক্তার মিলে পুরো দুই তলার বেশ কয়েকটা ভবন পরিদর্শন করেন।পুতুল গলায় স্টেথোস্কোপ সব রোগীর সাথে কথা বলে ভালো মন্দ জিজ্ঞাসা করে।রিপোর্টগুলো চেক করে একে অপর ডাক্তারের সাথে কথা ব’লে।সিস্টার,নার্সকে ডেকে কখন কোন সময়ে ওষুধ দিতে হবে তা বিস্তারিত বুঝিয়ে দেয়।
নিজের চেম্বারের বসে ফাইলপত্রগুলো চেক করে কিছু কাগজপত্র ঠিকঠাক করতে থাকে।এমন সময় কেবিনে আন্নাফ চৌধুরী পারমিশন নিয়ে রুমে প্রবেশ করেন।পুতুল দাঁড়িয়ে যায়।সুনামধন্য নাম করা একজন ডাক্তার সাথে কথা ব’লে ভালো লাগলো।মানুষটা গম্ভীর চুপচাপের হলেও ব্যবহার,শিক্ষা সবকিছুতেই ভদ্রতা বজায় রেখেছে।এমনকি পুতুলকে ঠিকঠাক নোটিশ না করে নিজের হাতের ঘড়ি দিকে তাকিয়ে বলল,
আজকে জরুরি বৈঠক বসবে।সেখানে সব ডাক্তার উপস্থিত থাকবে।
সময়টা দুই হাজার বিশ সাল বিদেশের মাটিতে ভয়ংকর রোগের আগমন ঘটেছে।নাম তার কোভিট নাইটিন।এই রোগ সাড়া বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।এমনকি নিজ দেশের মাটিতে এই রোগের রোগী দেখা না-কি মিলছে।পুতুল মিটিং রুমে মনিটরের দিকে তাকিয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে।সবাইকে সর্তক থাকতে বলা হচ্ছে।হাতে সিনিটাইজড করতে এবং মুখে মার্কস ব্যবহার করতে বলা হচ্ছে।আর প্রয়োজন ব্যাতীত ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করছে।দেশের কিছু জায়গায় লকডাউন ঘোষণা হয়েছে।সব কর্মজীবি মানুষ এখন ঘরে বসা।চাকরি নেই পেট কি করে চলবে তাদের জানা নেই।অনেকে গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে।আবার অনেকে না খেয়ে মরতে বসেছে।মাস শেষে ঘর ভাড়ার টাকাগুলো জমা হচ্ছে।ঋণ পরিশোধ করার জন্য উর্পাজনের সুযোগ নেই।সবার কর্মস্থল বন্ধ।কিন্তু ডাক্তারদের কোনো ছুটি নেই।দিন, রাত হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে।চারদিকে মানুষের আহাজারিতে পুতুলের হ্রদয় ভারাক্রান্ত।নিজের চোখের সামনে এত মানুষের মৃত্যু দেখছে।যারা করোনায় মারা গেছে।তাদের লাশটা নিতেও পরিবার কেউ এগিয়ে আসছে না।তাদের মনে ভয় ঢুকেছে।যদি করোনা হওয়া ব্যাক্তির জন্য সবার বিপদ হয়।সেই ভয়ে কেউ এগিয়ে না আসায় লাশগুলো বে আরিশ লাশ হিসেবে একসাথে মাটিতে দাফন করছে কর্তিপক্ষ।পুতুল অর্পণের সাথে ফোনে কথা ব’লে বারবার সবাইকে নিয়ে সাবধানে থাকতে বলছে।পুতুল এই কোভিট নাইটিন জন্য বাড়িতে ফিরতে পারছে না।হাসপাতালে চব্বিশ ঘণ্টা ধরে থাকতে হচ্ছে। অর্পণ পুতুলকে নিয়ে ভয় পাচ্ছে।রোগীর সেবায় নিয়োজিত থেকে না আবার নিজের কোনো বিপদ বাড়ায়।অর্পণ বেশ কয়েকবার পুতুলের সাথে দেখা করতে চাইলেই পুতুল সরাসরি না করে দেয়।এই মুহূর্তে তার কাছে কেউ আসুক সেটা সে চায় না।সে তার পরিবারকে জেনে-বুঝে বিপদে ফেলতে পারেনা।অর্পণের সাথে বেশ কয়েকবার এটা নিয়ে তর্কাতর্কি হয়।অর্পণ মন খারাপ করে বসে থাকে।অর্পণের খারাপ লাগাটা বুঝতে পারে।কিন্তু কি করবে পুতুল? নিজের পরিবার এবং নিজের পেশা কোনোটাই সে তার জীবন থেকে ছুড়ে ফেলতে পারে না।ফোনটা ডিসকানেকটেড করে পেটে হাত রেখে পুতুল নিরবে কেঁদে ওঠে।তার অনাগত সন্তান আসতে চলেছে।কিন্তু পরিস্থিতি এমনই যেখানে কাউকে কিছু বলার সাহস হয়নি।অর্পণ তার সন্তানের কথা জানতে পারলে কখনোই এত বড় রিস্কের মধ্যে থাকতে দিবে না।সে যে করেই হোক এখান থেকে তাঁকে নিয়ে যাবে।পুতুল নিরুপায়।তাই নিজের ক্যারিয়ারকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে।নিজের পরিবারকে এমনকি নিজের স্বামীর থেকে নিজের অনাগত সন্তানের বিষয়টা লুকিয়ে রাখলো।এই দিকে মিলন,সাজুর পড়াশোনা বন্ধ লোক ডাউনের জন্য।তাদের অবসর সময় কা*টাতে কৃষি কাজে হাত লাগিয়েছে।পুকুরের মাছ চাষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ফসলের ক্ষেতে কাজ করছে।স্বাধীন ছেলেদের কাজে আগ্রহ দেখে খুশি হলো।সময় কা*টানোর জন্য হয়তো এই মুহূর্তে এটাই বেস্ট অপশন।স্বাধীনের ছোট ছেলে রিফাত হাফেজি পড়া পড়তে ইন্ডিয়া গেছে এক বছর হলো।তার পড়া শেষ হতে এখন কয়েকবছর বাকি আছে।লক ডাউনের জন্য সেও ইন্ডিয়ার মাটিতে পড়ে আছে।
১৫৭.
অপর্ণ নিজের গ্রামে থেকে পুরো এলাকায় লক ডাউন জারি রেখেছে।অচেনা কেউ গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করতে পারবেনা।আর গ্রাম ছেড়ে কেউ বের হতে পারবে না।গরিবদের জন্য খাবার,পানি,চিকিৎসা ব্যবস্থা রেখেছে।নিজের রাজনীতির প্রয়োজনী কাজ কর্ম সব এখন ঘরে বসেই সাড়ছে।অসীম তালুকদার এখন বিজনেসের কাজগুলো ছেলের থেকে নিয়ে নিজেই ঘরে বসে করেন।যাতে ছেলের ওপর প্রেশার কম পরে।আর নিজেরও সময়টাও কে*টে যায়।রাবেয়া,পুতুল এরা কেউ বাড়িতে আসে না।দুইজন দুই হাসপাতালে রয়েছে।বাড়িতে কোনো কাজের লোক রাখেনি। সবাইকে অগ্রীম বেতন দিয়ে কাজের জন্য লম্বা ছুটি দিয়েছে।বাপ,ছেলে ঘরে বসে নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যাস্ত।সাফিন তালুকদার খুলনা রয়েছে।মাসুদা বেগম তার বাবার বাড়িতে আ*টকা পড়েছেন।এই দিকে মেয়ে এবং মেয়ে জামাই দুইজনের করোনা ধরা পড়ছে।তন্ময় তার দাদা,দাদু কাছে থাকে।তাকে মা,বাবার কাছে যেতে দেয় না।তন্ময় মা,বাবার কাছে যাওয়ার জন্য কান্নাকা*টি করে।খাবার খেতে চায় না।তাঁকে নিয়ে দিহান সাহেব এবং তার বউ জেনিফার চিন্তায় আছেন।তন্ময় দাদা,দাদুর নামে নালিশ করে অর্পণের কাছে।তাকে মামার কাছে নিয়ে যেতে ব’লে।কিন্তু লক ডাউনের জন্য অর্পণ তাকে নিয়ে যেতে পারেনি।এরজন্য মামুর ওপর সে বড্ড অভিমান করেছে।ফোন দিয়ে মামাকে ইচ্ছে করে লাইনে রাখে।কিন্তু কথা বলে না।ভাগ্নের কর্মকান্ড দেখে অর্পণ চুপচাপ তার সকল অভিযোগ মেনে নেয়।তার হাতেও এখন কিছু নেই।মনে মনে আল্লাহ কাছে দোয়া করে।এই পরিস্থিতি কে*টে যাক।সব কিছু আবার আগের মতো হয়ে যাক।চারদিকে মানুষের কষ্টগুলো তাকে পীড়া দিচ্ছে।একমাত্র আল্লাহ ছাড়া এই সমস্যা থেকে মুক্তি দেওয়ার কেউ নেই।
সময় যত যাচ্ছে পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে।মৃত্যু সংখ্যা বেড়ে চলছে।মানুষের ভেতরে একটা আতঙ্ক ঢুকে গেছে।এইদিকে পুতুলের আড়াই মাসের পেটটা আর ছোট নেই।তার পেটের মাঝে ছোট প্রাণটা আস্তে আস্তে বেড়ে উঠছে।তার হাঁটাচলা বেশ ধীর গতিতে চলে।বলতে গেলে নিজেকে পোটেক্ট রাখার চেষ্টা।কোনো খাবার ঠিক মতো মুখে তুলতে পারেনা।যা-ই মুখের সামনে নেয়।আশটা আশটা গন্ধে তার ঘা গুলিয়ে আসে।
এইদিকে অর্পণ তাকে বারবার বাড়িতে ফিরে আসতে ব’লে।কিন্তু নিজের স্বামীর ভয়ে সে বাড়িতে পা রাখে না।কারণ তার স্বামী তাদের অনাগত সন্তানের কথা জানলেই কিছুতেই বাড়ির বাহিরে পা রাখতে দিবেনা।
রাবেয়া নিজের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে আরেক হাসপাতালে আসে।যেখানে পুতুল কাজ করে।তার হাতে পুতুলের রির্পোট রয়েছে।যেখানে উল্লেখ্য করা হয়েছে।পুতুল
প্রেগন্যান্ট।পুতুলের ছয় মাস চলছে।
তার দাদু ভাই আসছে অথচ মেয়েটা তাদের একবার জানানোর প্রয়োজনবোধ করলো না।কিন্তু ঊনি আজকে পণ করে এসেছেন। পুতুলকে ইচ্ছে মতো বকা দিবেন।মেয়েটার সাহস কি করে হয়?এই ভংয়কর কাজটা করার।
নতুন কুড়ি আর কচি পাতার মিষ্টি সবুজ রঙে ভরপুর হয়ে উঠছে বাগান।ছোট্ট পরিসরে ওপর করা এই বাগানটা।কিন্তু শান্তির পরিসরটা অনেকটা বেশি।হাসপাতালের এই কণারটাতে পুতুলের শান্তি প্রিয় জায়গায়। ওর একঘেয়েমী লাগাটা অশান্ত মনের ঠান্ডা করার মতো জায়গায় এটা।পুতুলের শান্ত প্রিয় জায়গায় হঠাৎ শ্বাশুড়ি আম্মার আগমনে গলার মধ্যে মাছের কা*টাঁ আটকে গেলে যেমন হয়।ঠিক তেমনই হয়েছে তার চেহারার অবস্থা।কিন্তু পুতুলের জন্য আজ বিন্দু মাত্র মায়া হলো না।যে মেয়ে নিজের সন্তানের চাইতে নিজের ক্যারিয়ারকে ধ্যান জ্ঞান দিয়ে বসে।তাঁকে তোও আর এমনই এমনই ছেড়ে দেওয়া যায় না।
আসসালামু আলাইকুম মা।কেমন আছেন?
আমি কেমন আছি এটা জিজ্ঞেস আমাকে না করে নিজেকে কর?তুমি কি করে এটা ভাবলে এমন পরিস্থিতি এত বড় রিস্ক নেওয়ার?আর চাই হোক কোনো মা তার সন্তানের থেকে অন্য কিছুতে বেশি প্রায়োরিটি দিতে পারে না।আমি হলেও আমার সন্তানের কথা আমার কাছে সর্বপ্রথম মাথায় আসতো।বাকি সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাক।তবুও আমার সন্তান ঠিক থাকুক।আমি অর্পণকে সবটা জানিয়ে দিয়েছি।এতখনে হয়তো সে খবর পেয়ে গেছে।রাবেয়ার কথায় পুতুল চমকে উঠে।কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে।অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণে জ্ঞান হারিয়ে পরে যেতে নিলেই রাবেয়া পুতুলকে ধরে ফেলেন।এটা কি হচ্ছিল?
অর্পণের ফোনের স্পষ্টে পুতুলের প্রেগন্যান্ট রির্পোটের আসল কপির ছবিটি জ্বল জ্বল করছে।নিজের অনাগত সন্তান আসছে।বাবা হওয়ার অদ্ভুত অনূভুতি কাজ করছে।কিন্তু তার বউ তাকে আরো আগে কেনোও জানালো না।এই খুশির সংবাদ পাওয়ার জন্য কতটা দিন অপেক্ষা করছে।তার মুখের আদোও বুলিতে বা.বা…বাবা ডাকটা শুনতে বড্ড অথৈয্য সে।তার সন্তান আসছে।তাঁকে বাবা ডাকতে কেউ আসছে।অসীম তালুকদার ছেলের পিঠে হাত রাখতেই অর্পণ ঘুরে বাবা জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ছেড়ে দেয়।বলল,
বাবা,তুমি দাদা ভাই হচ্ছো।আম্মু দাদিজান হচ্ছে।তোমাকে কেউ দাদা ডাকতে আমাদের এই তালুকদার বাড়িতে আসছে।তোমাদের খেলার সাথি আসছে।আমাদের নতুন মেহমানের আগমন ঘটেছে।
আমি…আমি বাবা হব।আমার… আমার পুতুল মা হচ্ছে।
ছেলের কথায় অসীম তালুকদার চমকে উঠেন।ছেলের কম্পিত শরীরের অনুভূতি বুঝিয়ে দিচ্ছে এই সন্তান তার কাছে শ্রেষ্ঠ নিয়ামত।আল্লাহ থেকে চেয়ে নেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার।
আমি পুতুলের কাছে যাচ্ছি।তুমি গ্রামের সবাইকে জানিয়ে দেও অর্পণ তালুকদার বাবা হচ্ছে।অর্পণ ফোনটা পকেটে রেখে মুখে মার্কস লাগিয়ে তাড়াহুড়ো করে গাড়ির চাবি নিয়ে বাড়ি থেকে হাসপাতালের গন্তব্যের দিকে ছুটে চলে।ছেলের খুশি দেখে অসীম তালুকদার খুশি হন।তাদের খেলা সাথি আসছে।মিষ্টি মুখ অবশ্যই হওয়া উচিত।অসীম তালুকদার পুরো গ্রামে মিষ্টিমুখ করার জন্য লেগে গেলেন।
ইয়াহু,হুড়রে।আমি মামা হচ্ছি।সাজু আমি মামা হচ্ছি রে।আমাদের নতুন মেহমান আসছে।মিলন লুঙ্গি কাচাঁ মে*রে উরাধুরা উঠোনের মধ্যে ঢোল পিঠিয়ে নাচানাচি শুরু করেছে।স্বাধীনকে অসীম তালুকদার ফোন করে সবটা জানালেন।সেই খুশির মহল রাজীব হকের বাড়িতে বসেছে।রেনুর চোখে আনন্দের অশ্রু।স্বামীর হাতটা শক্ত ধরে বলল,
তাদের পুতুল মা হচ্ছে।সেই ছোট পুতুল মা হবে।তাদের কন্যা আর ছোট নেই।বড় হয়ে গেছে।তার মাঝে আরেকটি প্রান রয়েছে।
নতুন অতিথির আগমনে পুরো গ্রামে মিষ্টি বিতরণ হচ্ছে।এত এত খারাপের মাঝে এক চিলতে রোদ্দুরে দেখা অবশেষে মিলছে।
চলবে….