চক্ষে আমার তৃষ্ণা পর্ব-৫৫+৫৬+৫৭

0
403

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৫৫
১৪৯.
ডাক্তার রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই অর্পন ছুটে আসে।ডাক্তারের কথা অনুযায়ী পুতুলের অপারেশন করতে হবে এবং সেটা খুব শীঘ্রই।অর্পন ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলে বলল,

অপারেশন কখন শুরু করবেন।

আগামীকাল রাতে অপারেশন শুরু হবে।আজ রেস্টে থাকবে।

আচ্ছা ডাক্তার আপনি আপনার কাজ করুন।আমি যদি না ওহ থাকতে পারি।আমার পরিবার থাকবে।ইনফেক্ট আজকে তাদের লন্ডনে আসার কথা।কোনো সমস্যা হলে আপনি তাদের জানাবেন।ডক্টর চলে যেতেই অর্পন মা’কে ফোন করে।

রাবেয়া জানান তারা এই মাত্র লন্ডন এয়ারপোর্টে আছে।অর্পন হাসপাতালের ঠিকানা।আর এই মুহূর্তের অবস্থানের কথা জানালো।তারা ড্রাইভার দিয়ে জিনিস পত্র অর্পনের ফ্ল্যাটে পাঠাতে ব’লে নিজেরা অন্য গাড়িতে করে হাসপাতালে রওনা হলো।

দরজা খুলে অর্পণ ভীরু পায়ে রুমে প্রবেশ করে।নিজের এত কাছে কারো নিশ্বাসের উপস্থিত পেতেই পুতুল চোখ মেলে তাকায়।হাত বাড়িয়ে স্বামী গাল ছুয়ে দিয়ে জানতে চায় সে ঠিক আছে কি না।অর্পন নিজের গাল থেকে পুতুলের হাতটা নামিয়ে শক্ত করে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

আমি ঠিক আছি।তুমি আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না।আব্বু,আম্মু আসছে।এখন থেকে তোমার পাশে তারা থাকবে সবসময়।অর্পনের কথায় পুতুল চুপচাপ সবটা শুনতে লাগল।কোনো প্রত্তিউত্তর করে নিই।

চোখ বুঝে ঘুমাও।আমি তোমার পাশেই আছি।অর্পণের কথায় পুতুল চোখ মেলে রাখতে চাইলেও পারিনি।ঘুমের ইনজেকশন ডক্টর আরো আগেই পুশ করে দিয়েছিল।তাই না চাইতে ঘুমে তলিয়ে যায়।পুতুল ঘুমিয়ে গেলে।অর্পণ তার কপালে চুমু বসিয়ে আস্তে আস্তে হাত হালকা করে নেয়।

রুম ছেড়ে বাহিরে বের হতেই মায়ের মুখোমুখি হয়।মা’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।রাবেয়া ছেলের শুকনো মুখটা দেখে ভীতু হয়ে পড়েন।ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,

আমার আব্বুটার কি হয়েছে?

অর্পন মায়ের কথার উত্তর দেয়নি।বরং মায়ের কপালে দ্বিতীয় চুমু বসিয়ে বলল,

আমি বাড়িতে যাচ্ছি।কিছু প্রয়োজনী জিনিসপত্ত আনতে।তোমরা ওর পাশে বসো।

তাহলে আমিও যাই তোর সাথে।

না বাবা।তুমি মায়ের সঙ্গে থাকো।তোমার পুতুল আর মায়ের সঙ্গে থাকাটা বেশি প্রয়োজন।আমি যাব আর আসব।অসীম তালুকদারকে জড়িয়ে ধরে।কয়েক মিনিট পর ছেড়ে দিয়ে নিজেই হাঁটতে হাঁটতে আরাভ খান এর বর্ডিগাডদের বলল,

-চলুন!অর্পন চলে যাওয়ার পর একবার পিছন ফিরে তাকায় নিই।

ছেলের এমন কাজে রাবেয়া চিন্তিত হয়ে পড়ে।মনে মনে আল্লাহকে ডাকেন।তার সন্তানের কোনো ক্ষতি না হোক।

আরাভ এর ডেরায় অর্পণ দাঁড়িয়ে আছে।আরাভ খান পায়ের ওপর পা তুলে অর্পণকে পরক্ষ করছে।ছেলেটা তার কথা রেখেছে।

মিস্টার আরাভ খান আমি প্রস্তুত।শুট হিম।

আর ইউ শিয়র।ভেবে বলছো?

হুম।আমি আপনার কথার খেলাফ করিনি।জীবনে সব পাওয়ার আশা আকাঙ্ক্ষা হাতে মুঠোয় নিয়ে মরতে এসেছি।আমি জানি।আমি কারো সাথে কোনো অন্যায় করিনি।সব সময় চেষ্টা করেছি সবাইকে ভালো রাখার।সবাইকে নিয়ে বাঁচার।জীবনের প্রাপ্তির খাতায় কি পেয়েছি?সেইসব মনে করতে চাই না।তবে আমার লক্ষ্য আমার পরিবার কিংবা আমার ভালোবাসা মানুষটির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাইনি।দশের ভালো করতে এবং ভালো রাখার প্রচেষ্টায় রাজনীতির মাঠে নামি।
রাজনীতি আমার রক্তে মিশে গেছে।তাই চাইলেও ছুড়ে ফেলতে পারিনি।আজকে আমি যতটুকু করেছি।আমার জনগনের কথা চিন্তা করেই সাফল্যের প্রথম কয়েকধাপ পার করার পর পরই সবার রংচঙ দেখতে পাই।আমাকে সরাতে যেখানে আমার আপন মামা জড়িত।আমার রাজনীতি মাঠের লোকেরা যেখানে বিশ্বাসঘাতকতা করছে।সেখানে আপনাকে কি বলব?মরতে আমি ভয় পাই না।রাজনীতি মাঠে নামার সময় শপথ নিয়ে মাঠে নেমেছি।দেশে এবং দশের ভালো করতে গিয়ে যদি আমার প্রাণ যায় তো যাক।তবে আপসোস আমি আমার দেশকে একটি সুন্দর এবং উন্নয়ন অধ্যায় দিয়ে যেতে পারব না।

যদি তোমাকে সে সুযোগ দেওয়া হয়।তাহলে দেশের মাটিতে পাপী দের ধ্বংস করে ফেলতে পারবে।দেশের মাটিতে সাধারণ মানুষের এক মুঠো সুখ ফিরিয়ে দিতে পারবে।বর্তমান বাজারে যে যাকে পারছে লুটপাট করে খাচ্ছে।এই দেশে জোর যার মুলুক তার।ধনীদের পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে মরছে গরিব।গরিবের কষ্ট দেখার কেউ নেই।পারবে দেশ শাসন করে সৈরাচারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে।পারবে বাঙালির মুখে এক মুঠো হাসি ফিরাতে।

যদি বলি পারব!

এতটা কনফিডেন্স ভালো নয়।বুঝে শুনে কথা বলো।

অর্পণ তালুকদার পারবে।তার মায়ের দোয়া তার মাথার ওপর সব সময় রয়েছে।বাবা-র ছায়া তার পিছু।বাবা নামক বটগাছের আবরণে তার শরীর ঢাকা।আর তার বউয়ের চোখে তার জন্য তৃষ্ণা।যা এ জম্মে মিটবে না।বউটা তার একটু ভালোবাসা পেতেই ভীষণ খুশি।মেয়েটি তাকে বড্ড ভালোবাসে।

অর্পণের কথা শেষ হতেই তার কাঁধে আরাভ খান হাত রাখে।মুচকি হাসি ফুটিয়ে বলল,

যা-ও দেশের মাটিতে ফিরে।শেষ কর আসো পাপী দের।তাদের বিনাশ করায় তুমি মুক্ত।তোমাকে শুট কিংবা প্রানে মারলাম না।একজন বেঁচে যদি দেশ টাকে অমানুষগুলোর হাত থেকে বাঁচাতে পারে তবে ক্ষতি কি?কোনো ক্ষতি নেই।

আরাভ খান এর কথায় অর্পণ চমকে উঠে।পুরো বিষয়টা বুঝতেই মুখে হাসি ফুটে।আরাভ খান তার বক্তব্য জানিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়।আর অর্পন নিজের দায়িত্ব পালন করতে ফিরে যায়।গাড়িতে বসে ভাবতে থাকে।তাঁকে দেশে ফিরতে হবে।এখন সে নিশ্চিতে যেতে পারে।মা এবং বাবা তার বউয়ের পাশে রয়েছে।তারা ওর দেখভাল সুষ্ঠুভাবেই করবে।কিন্তু সে এ-ই মুহূর্তে রওনা না হলে তার মামা এবং রাজনীতির চেনা মাঝে অচেনা শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারবে না।অনেক হয়েছে ছাড় দিতে দিতে মাথায় উঠেছে।এবার তা নামিয়ে ফেলা দরকার।

১৫০.

অর্পন আজ রাতের টিকিট কে*টে কাউকে না জানিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখার জন্য রাত বারোটায় এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেলো।এইদিকে পুতুলের কোনো হুস নেই।সে ঘুমে বিভোর।সকাল হতে এখনো রাতের অর্ধেক প্রহর বাকি।এইদিকে রাবেয়া হাতের ফোনে ছেলের নামে একটা মেসেজ আসে।যেখানে অর্পন এর গুটিকয়েক শব্দ লিখা রয়েছে।

আসসালামু আলাইকুম আম্মু।আমি চলে যাচ্ছি!শেষবার আপনাকে একবার ব’লে না যাওয়া আমি দুঃখিত। আর ব’লে ওহ আপনি আমায় কখনোই যেতে দিবেন না।তাই না জানিয়ে দেশের মাটিতে ফিরছি।কেনো ফিরছি?কি কারণে ফিরছি?হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছেন।যাই হোক। আপনারা ওর পাশে আছেন।আমি এক দিক দিয়ে শান্তি পাচ্ছি।অন্য দিক দিয়ে কষ্ট লাগছে। এটা হয়তো আমার শেষ কথা।বেঁচে থাকলে অবশ্যই আপনার কাছে ফিরে আসব আর যদি কিছু হয়ে যায়।আব্বু,আপনার যত্ন নিবেন।আর আমার আমানতকে হেফাজতে
রাখবেন।তার সব সপ্নগুলো পূর্নতা পাক।তাকে আমার বিষয়ে এই মুহূর্তে কিছু বলবেন না।সে মানসিক চাপের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে আমার কথা ব’লে তার ক্ষত আর বাড়াবেন।সে দেশে ফিরে আজ না হয় কাল জেনে নিবে।এখন জানলে তার ক্যারিয়ার।তার না বলা কথাগুলো বন্ধ পড়ে রবে।সে লন্ডন থাকতে চাইবে না।তাই আপনার কাছে আমার বিশেষ অনুরোধ তাকে এখন সত্যিটা বলবেন না।সময় করে পরে ব’লে দিয়েন।সবাই ভালো থাকবেন।

ইতি আপনার আদরের সন্তান অর্পণ তালুকদার।

পাঁচ বছর পর…

অভিনন্দন পুতুল।তোমার স্বপ্ন আজ অবশেষে সত্যি হলো।ফাইনালি তুমি ডাক্তার হলে গেলে।তোমার জন্য আস্ত ভালোবাসা জানেমান।রুমি কথায় পুতুল চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।রুমি, পুতুলের ক্লাসমেট।একসাথে পড়াশোনা শেষ করলো।

পুতুলের গায়ে ডাক্তারী এপ্রোন।সবাই তাকে নিয়ে কত খুশি।রাবেয়া তালুকদারের বুকটা গর্বের ভরে গেলো চোখের পানিটুকু লুকিয়ে বলল,

আম্মু বাসায় চলেন।পুতুল নিজের এপ্রোন খুলতে খুলতে গাল ফুলিয়ে বসে রইলো।

যার মানে সে যাবে না।বাংলাদেশে সবার সাথে তার যোগাযোগ হয়।কিন্তু যে মানুষটা তার জীবনে না আসলে লক্ষ্য অবধি পৌছাতে পারতোনা।সে মানুষটা কথা ব’লেই সবাই চুপ হয়ে যায় কেন?তারা কেন বুঝতে চায় না।পুতুল তার স্বামীকে দেখতে চায়।কথা বলতে চায়।তার দুই চক্ষে অনেক তৃষ্ণা।এই সময় যত গড়িয়ে যাচ্ছে।ততোই পুতুলের তৃষ্ণা বাড়ছে।সে পাগলামি করছে।তাইতো পড়া শেষ হতেই দেশে ফিরে চাওয়ার বন্ধবস্ত কম্পিলিট।বাবাকে টিকিট কে*টে আনতে ব’লেছে।তিনি টিকিট নিয়ে এই আসলো ব’লে।পুতুল অপেক্ষা করছে।তার অপেক্ষা অবসান ঘটিয়ে অসীম তালুকদার গাড়ি থেকে নামতেই পুতুল ছুটে আসে।তার চোখের সামনেই বিডি টিকিট দেখাতেই মুখে চমৎকার হাসি ফুটে।

পুতুলের এই হাসি দেখে রাবেয়া দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে এগিয়ে আসে।পুতুল আজই রওনা হবে।তাই বাসায় পৌঁছে নিজের মতো করে সবকিছু গুছিয়ে নিতে ব্যাস্ত।এয়ারপোর্টে যাওয়ার পর অর্পণ তার এখানে আসার দিনগুলো চোখ বুঝে স্মরণ করতে লাগল।ইশ কি মিষ্টি অনুভূতি ছিল?যা এখনো তার মনে দোলা দেয়।

তিনদিন পর…

বাংলাদেশ নিজ গ্রামে সেই রাঙ্গা মাটির পথ।আঁকাবাকা কাঁচা মাটির রাস্তাগুলো আজ ইট পাথরের তৈরি হয়েছে।ক্ষেত খামারে জায়গায় নতুন নতুন বাড়ি ঘর উঠেছে।কত কিছু পরির্বতন হয়েছে এই পাঁচ বছরে।পুতুল নিজের গ্রামের দৃশ্যগুলো মনে করতে করতে নিজ মামুর বাড়িতে প্রথম পা রাখলো।সবার সাথে কথা শেষ করে,সাজুকে টেনে এক কিনারে নিয়ে গিয়ে তার স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করে।তার স্বামী কোথায়?

আপু,ভাইয়া আর নেই।সাজু কেঁদে দিল।চোখের পানি মুছে বলল,

তোমাকে ওখানে রেখে আশার পর এখানে অনেক কিছু ঘটে গেছে।আমি নিজের চোখে এই গ্রামে লা*শ দেখেছি।র*ক্তের স্রোত বয়েছে।আর ভাইয়াকে ওরা সবাই মিলে মিথ্যে মামলা ফাঁসিয়ে….!

সাজুর বাকি কথাগুলো তার কানে ঢুকে নিই।ভাইয়া আর নেই এই কথাটা বারবার কানে বাজছে।সে ধপ করে মাটিতে পড়ে গেলো।
পুতুলের এমন রিয়াকশনে রাবেয়া তাকে ছুঁতে চাইলে তাকে ছুঁতে দিলো না।পুতুল রাস্তার পথে দৌড় দিলো।পুতুলের এমন আচরণে সবাই ভয় পেয়ে যায়।

আপনি বিহীন আমার কিছু নেই।আমি অপূর্ণ।আমি শূন্য।আপনাকে দেখা’র জন্য আমার দুই চক্ষে যে তৃষ্ণা তা আমি কি দিয়ে মিঠাবো?আপনি এত নিষ্ঠুর প্রিয়তম কেন?কেনো আমায় একা ফেলে চলে গেলেন? একটিবার কি আমার কথা আপনার মনে পড়েনি?কি নিয়ে বাঁচব আমি।

চলবে….

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৫৬
১৫১.
স্বাধীন,পুতুলের হাত ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসতেই পুতুল কান্না ভেঙে পড়ে।

আমি যাকে ভালোবেসে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই।সেই আমায় ফাঁকি দিয়ে কেনো চলে যায়?আর চলে যদি যাবে,তবে এত মায়া কেন বাড়ায়?কেনো একটু সুখের আশায় আমায় নতুন করে বাঁচতে শিখায়?কেনো এতটা পথ চলে আসার পর মাঝ পথে ছেড়ে চলে যায়।একটিবার কি আমার কথা মনে পড়েনি।তাঁকে ছাড়া আমি বাঁচব কি করে?

আম্মা তুমি শান্ত হও।সব ঠিক হয়ে যাবে।আমি বলছি।তুমি আমার কথা শুনো।তুমি অনেক কিছুই জানো না।এই পাঁচ বছরে কি কি ঘটেছে?সবাই জানলেও তোমায় সেসব বলার সাহস কারো ছিল না।অর্পন বারবার সবাইকে নিষেধ করেছে।যেনো তুমি কিছু জানতে না পারো।কিন্তু আজ তোমার থেকে কিছু লুকিয়ে রাখা হবে না।তুমি সব জানতে পারবে।তোমার স্বামীকে মিথ্যে মামলার আসামি করা হয়।তাকে দুই বছর জেলে থাকতে হয়।তাকে শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে।সে ভালো ছিল না।তাকে বাঁচানো জন্য সাফিন সাহেব কম চেষ্টা করেনি।অনেকবার ছাড়িয়ে আনতে চাইলো সে ফিরিয়ে আনতে পারেনি।
কারণ অর্পণ ফিরে আসতেই চায়নি।কারণটা তুমি ছিলে।তোমাকে বাঁচাতে অর্পণ নিজেকে আসামি করেছে।আর এসবের পিছনে কলকাঠি তার মামা করেছে।জেলের মধ্যেও তার ওপরের মানসিক,শারিরীক টর্চার চলতো।বিনা অপরাধের শাস্তি ভোগ করতে হ’য়েছে।তার রাজনীতি ক্যারিয়ারে লাল কালির দাগ পড়েছে।পার্টি লোকেরা তার ওপর থেকে সব দায়িত্ব সরিয়ে নিয়েছে।এমনকি তাদের মধ্যে কিছু লোক জেল হাজতে অর্পণকে একেবারে মেরে ফেলার চেষ্টা করে।কিন্তু অর্পণের নানার জন্য কেউ বেশি সুবিধা করে উঠতে পারিনি।দুই বছর পর জেল থেকে প্রমাণসহ মুক্তি মিলে।যে সরকারি টাকার জন্য মিথ্যে মামলা হয়েছিল তা ভুল প্রমাণিত হয়।তার জন্য দুই বছর পর বের হয়ে আসতে পারে।আর প্রমান যদি না হতো তাহলে আরো বেশি শাস্তি ভোগ করতে হতো।

জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তার মামা তাকে মেরে ফেলতে চায়।সে অর্পণকে গুলি করে দেয়।

পুতুল হতভম্ব হয়ে গেছে।সে আর কিছু শুনতে চায় না।বুকের ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে।নিজেকে সামলাতে পারছেনা।মানুষটা কতটা অসহায় ছিল।কতটা কষ্ট পেয়েছে।তাঁকে দেখার জন্য পুতুল মামার হাতদুটো ধরে কেঁদে ওঠে।পুতুল অতিরিক্ত কান্নার ফলে কথা বলতে পারছে না।স্বাধীন,পুতুলের চোখের পানি মুছে বলল,

অর্পণ ভালো নেই।তুমি যখন এসে গেছো।তখন সবকিছু আবার আগের মতো হয়ে যাবে।

১৫২.

রাবেয়া নিজের চোখের পানি আড়ালে মুছতে মুছতে বলল,

অর্পণ বেঁচে আছে।সেইদিন আমার বাবা
জামশেদ উল্লাহ খান ঠিক সময় হাসপাতালে না নিলে হয়তো তাকে বাঁচানো সম্ভব হতো না।গুলিটা অর্পনের বুকে করা হয়।দ্বিতীয় গুলি অর্পণকে করতে নিলেই পুলিশ অফিসার শাফাকাত খানের হাতে গুলি করে দেয়।কিন্তু শাফাকাত দমে যায় নিই।একের পর এক গুলি ছুঁড়ে।তাকে থামাতে পুলিশ গুলি করেন।এক পর্যায়ে শাফাকাত পালিয়ে যাওয়ার পথেই পুলিশের গুলিতেই প্রাণ হারায়।

রাবেয়া কথা শেষ করে পুতুলের দিকে তাকিয়ে বলল,

হ্যা।আমার ছেলে বেঁচে আছে।কিন্তু আগের অর্পণের সাথে এই অর্পণ সম্পূর্ণ আলাদা।আমার ছেলে আগে সবার মন জয় করে চলেছে।কখনোই গম্ভীর ছিল না।ওর মুখে একটু মুচকি হাসি যেটা সবসময় লেগেই থাকতো।কিন্তু জেলের ঘটনা তার ওপর নিজের সাথে এত বড় বিপদ।চোখের সামনে মামার মৃত্যু।নানুর বিছানায় পড়ে যাওয়া এসব মেনে নেওয়াটা ওর পক্ষে কষ্টের ছিল।সময় চলার সাথে সাথে অর্পণ বদলে গেলো।সে এখন গম্ভীর হয়ে থাকে।বাবার বিজনেস সামলায়।যে রাজনীতির জন্য এতকিছু হলো সে রাজনীতি থেকে বিন্দু মাত্র সরেনি।বরং রাজনীতির মাঠটাকে গরম করে রাখে।তার ভয়ে কেউ ভুল কাজ করতে পারে না।পার্টির লোকের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা ব’লে না।যতটুকু বলে তা কাজের জন্য।আর যাদের জন্য জেলে গেলো।তাদের পার্টি থেকে বাদ করে।এবং শাস্তির ব্যাবস্থা করে।নতুন করে পার্টি লোকের কাজ শুরু করে।এখন সময়ের সাথে সাথে রগচটা হয়েছে।কোনো কথা মাটিতে পড়তে দেয় না।সঙ্গে সঙ্গে ওটার সমাধান করবে।তার চিতকার চেচামেচি জন্য পার্টির কেন্দ্রীয় লোকেরা বিরক্ত হয়।কিন্তু যার ধারা সমাজ উন্নয়ন হচ্ছে।তাকে কিছু বলার সাহস হয় না।পুতুল আমার ছেলেটাকে আবার আগের রুপে ফিরিয়ে নিয়ে আসো।ওকে এভাবে দেখতে ইচ্ছে করছে না।ছেলেটা আমার বাড়িতে ফিরে না।কাজের মধ্যে পুরো সময় ডুবে থাকে।তার খাওয়ার কথা,বিশ্রামের কথা মনে থাকে না।এভাবে জীবন চলবে না।তাকে বুঝতে চেষ্টা কর আম্মু।তুমি তাকে সময় দেও।দেখো তুমি এতদিন নিজের ক্যারিয়ার করতে চেয়েছো।আমরা কেউ বাঁধা দেয়নি।কিন্তু তুমি এখন আমার ছেলের দিকে একটু মনযোগ দেও।ওর কষ্টগুলো বুঝতে চেষ্টা কর।নিজের স্বপ্নের পাশাপাশি নিজের ঘর,আর বর দুটোর খেয়াল রাখো।মেয়েরা চাইলে সব কিছুই সম্ভব।তুমি পারবেনা অর্পনকে আবার আগের মতো করতে।ওর কষ্টগুলো ভুলিয়ে নতুন করে চলার পথ দেখাও।আমি জানি আমি ছেলের মা হিসেবে একটু রুড হচ্ছি।কিন্তু কি করব বলো,চোখের সামনে আমার ছেলে শেষ হয়ে গেছে। আর আমি সবটা জেনেও চুপ করে ছিলাম।তোমাকে সময় দিয়েছি।আমার সাধ্য মতো তোমাকে গড়ে তুলতে চেয়েছি।কতটুকু পেরেছি জানি না।এখন শুধু আমার সন্তানের কথা মাথায় আসছে।আর কিছু ভাবার মতো সময় নেই।অর্পণ এখন ঢাকায় আছে।তুমি চাইলে আমি তোমাকে নিয়ে যেতে পারি।পুতুল রাবেয়া হাত ধরে বলল,

আমি আমার স্বামীর কাছে যেতে চাই।প্লিজ, আমাকে নিয়ে চলুন।তাঁকে অনেক কিছু বলার আছে।আমি তাঁকে ছাড়া আর একটা মুহূর্ত থাকতে চাই না।পুতুলের কথায় রাবেয়া মত দিল।এবং অর্পণের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য রওনা হলো।

নিজ অফিস রুমে কাগজপত্র পড়ে নিয়ে সাইন করতে করতে বলল,

সামনে রোজা মাস আসছে।কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নিজের লাভ খুঁজতে চওড়া দামে বিক্রি করবার চিন্তা ভাবনা করবে।তাই তাদের সাবধান কর।যদি রোজার মাসে জনসাধারণের মুখে খাবার না উঠে।তাহলে তাদের কঠোর শাস্তি পেতে হবে।আমি চাই জনগনের মানুষ ভালো থাকুক।খেয়ে,পড়ে বাঁচুক।

হাতের কাজগুলো শেষ করে শহরের খবর এবং পরিস্থিতি জানতে নিজেই বের হয়।নিজের গাড়িতে চড়ে নয়।মুখে মার্কস লাগিয়ে মাথা ক্যাপ পড়ে রিকশার হুডি টান দিয়ে শহর ঘুরে দেখতে দেখতে রিকশাওয়ালা সাথে কথা বলতে লাগল নিজ পরিচয় গোপন করে।আর রিকশাওয়ালা তার বর্তমান পরিস্থিতি খুলে বলতে লাগল।ইট,পাথরের শহরে অলিগলিতে পা রেখেছে।বাজারের মধ্যে প্রবেশ করে সব খবর নিলো।পরিস্থিতি সব কিছু হাতের মুঠোয় আছে।এটা ভেবেই শান্তি লাগছে।সারাদিন পরিশ্রমে শরীরটা নুইয়ে গেছে।এখন একটু বিশ্বাম প্রয়োজন।বাড়িতে ফিরে নিজ ড্রইংরুমে বসে পড়ে।চোখ দুটো বুঝে ঘাড় ঢলতে লাগলো।গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়েছে।এক গ্লাস ঠান্ডা পানি হলে ভালো লাগতো।কিন্তু দিবে কে?সে তোও কোনো কাজের লোক রাখেনি।নিজেরটা নিজে করে খায়।অর্পণের ভাবনার মাঝেই চুরির টুং টাং শব্দ কানে লাগে।সন্দেহের গন্ধ পেতেই চোখ দুটো হুট করে খুলে ফেলে।চোখের সামনে নিজের রমনীকে দেখে অবাক হয়।নিজের কল্পনা ভাবে।বিগত কয়েকবছর ধরে তার সাথে এগুলো হয়।আর সে তা নিরবে গ্রহণ করে।এতটুকুতে যে তার শান্তি খুজে পায়।তাই প্রতিবারের মতো এবারও বউকে বুকে টেনে নিলো।বউয়ের কপালে ভালোবাসার পরশ একে জড়িয়ে ধরে।

আর কত জ্বালাবে?তোমার যন্ত্রণা আমি একটু সুখ খুঁজে নিই।কবে আসবে তুমি?আমি জানি না।তোমার সাথে খুব কথা বলতে ইচ্ছে করে।অনেক কিছু বলার আছে।কিন্তু তুমি তোও আমার পাশে নেই।এখন তোমার ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবার কথা।আমি চাই না আমার জন্য তোমার ক্যারিয়ারে কোনো বাঁধা হোক।তাই তো ও সব কষ্ট লুকিয়ে তোমার থেকে আড়ালে আছি।প্লিজ তাড়াতাড়ি ফিরে আসো।আমি তুমি হীন কষ্টে আছি।তোমাকে যে আমার বড্ড প্রয়োজন।পুতুল,আমার কষ্টগুলো ভুলিয়ে দেও না।আমার দমটা বন্ধ হয়ে আসে।মাঝে মাঝে মনে হয় তোমাকে আমি আর দেখতে পাব না।তোমার আমার পথচলা মনে হয় অতটুকুই সীমানা ছিল।

জানো পুতুল মা যখন জানতে পারে আমি জেলে তখন খুব কান্না করতো। অসুস্থ হয়ে পড়ে।তাও তোমাকে ব’লে নিই।আমি বারণ করি।তখন তোমার প্রথম সেমিস্টারে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে।আমার জন্য তোমার পড়ার ক্ষতি হোক তা চাইনি।তুমি তোমার লক্ষ্য থেকে সরে আসো এটা আমি ভাবতেই পারতাম না।তখন তুমি চলে আসলে আমার সবচেয়ে বড় হার হতো।সবাইকে যে গর্ব করে বলেছিলাম,মেয়েরা বিয়ে পরও স্বামী করে পড়তে পারে।তার শ্বশুর বাড়ি লোকেরা এবং স্বামী সার্পোট পেলে।সেটাতো প্রমান হতো না তুমি চলে এলে।তাই বলিনি।আর বলব না।তুমি আসবে যখন তখন না হয় যেনো।ততদিনে তোমার সুন্দর ভবিষ্যৎ হয়ে যাবে।

চলবে….!

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৫৭
১৫৩.
অর্পণের বুকে মাথা রেখে পুতুল চুপচাপ নিজের অশান্ত বুকের শান্তি ফিরে পায়।এতগুলো দিন তাকে ছাড়া দিবাস্বপ্ন দেখেছে।মন কতটা পুড়ত এই মানুষটির একটু শান্থিধ পাওয়ার।আজ তাঁকে পেয়ে সব ভয়,কষ্ট দূরে দেশে পালিয়ে গেছে।অনেক তোও হলো দূরে থাকা।এখন থেকে না হয় দুইজন পাশাপাশি একসঙ্গে পথ চলব।

পুতুল নিজের মুখটা তুলে ওই গম্ভীর মুখের মানবটিকে দেখতে দেখতে নিজের ডান হাতটা তার গালে রাখে।স্বামীর গালে চুমু বসিয়ে দিলো।নিজের সব জড়াতে কাটিয়ে স্বামীর ওষ্ঠ জোড়া দখলে নিয়ে নিলো।অর্পণের গালে চুমু পেতেই চমকে উঠে।কিছু বলতে নিলেই নিজের অধরের অন্য কারো বিস্তার ঘটে।অর্পন হতভম্ব হয়ে যায়।পুতুল আখিঁ জোড়া মেলে তাকাতেই অর্পনের চোখের সাথে মিলন হলো।লজ্জায় মুখ লুকিয়ে নিলো স্বামীর বুকে।অর্পন,পুতুলের মুখটা তুলে দুই হাতের মাঝে নিয়ে নিলো।

ব.উ…উ..উ!আমার বউ।আমার পুতুল ফিরে এসেছে।এই পুতুল বলো না। তুমি সত্যি আমার কাছে ফিরে এসেছো।আমি কোনো স্বপ্ন দেখছি না তোও।আমার সবটা কেমন যেনো স্বপ্ন মনে হচ্ছে?অর্পন নিজের হাতে চিমটি কাটে।জোরে চিমটি কেটে হাতে ব্যাথা পেয়ে মুখ দিয়ে শব্দ করে উঠে।না সে কোনো স্বপ্ন দেখছে না।তার বউ তারই হ্রদয় মাঝে রয়েছে।সে সত্যি ফিরে এসেছে।পুতুলকে বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।তার কম্পিত বুকের উঠানামার পুতুল চুপচাপ টের পেলো।মানুষটা তাকে কাছে পেয়ে অস্থির হয়ে গেছে।এই পাগল লোকটা তাকে কোন মায়া জড়িয়ে নিলো।নিজে থেকে চাইলেও পালিয়ে যাওয়ার সাধ্য নেই।আর না সে পালাতে যায়।অনেক হলো লুকোচুরি খেলা।এবার একটা সংসার হোক।তাদের ভালোবাসার ঘর হোক।তাদের টোনাটুনির সংসারে নতুন অতিথি আসুক।যার ছোঁয়া সব কালো দিনগুলো ডাকা পরুক।হাসি,আনন্দ ফিরে আসুক তালুকদার বাড়িতে।পুতুল নিজের চিন্তা বাদ দিয়ে অর্পনের দিকে তাকিয়ে বলল,

এ-তোই যখন ভালোবাসেন।তখন দূর দেশে ফেলে একা চলে আসলেন কেন?আপনি ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই।সবটা জেনেও কেনো চলে আসলেন।একটি বার নিজ থেকে খোঁজ নেন নিই।আমি আমার এই পাঁচ বছরের জার্নিটাতে আপনাকে পাশে চেয়ে ছিলাম।খুব ইচ্ছে করতো আপনার কাছে ছুটে আসতে কিন্তু আম্মু আসতেই দিতোও না।তার পিছনে এতো এতো কারণ ছিল আমি কি আর তা জানতাম?কেনো কষ্টগুলো একা একা বয়ে বেড়ালেন।একটিবার কি আমার কথা মনে পড়েনি?যদি মনেই পড়ে তবে এতটা দিন যোগাযোগ করলেন না কেন?

পুতুলের মাথার সাথে নিজের মাথাটা লাগিয়ে বলল,

কে বলল,আমি তোমার কোনো খোজ নেয়নি।সব খবর আমি টাইম টু টাইম পেয়ে যেতাম।আর তোমার পাশে মা,বাবা দু’জনকেই রেখে এসেছি।যাতে তোমার অসুবিধা না হয়।নিজের যতটা কষ্ট হতো তার চেয়ে বেশি শান্তি পেতাম।তুমি মা,বাবা একসাথে আছো।নিরাপদে আছো।এতেই আমার শান্তি হতো।নিজের কথা যদি বলি,তাহলে বলবো।আমার কোনো কষ্ট নেই। এখন এই মুহূর্তে আমি সবচেয়ে সুখী মানুষ। কারণ পাশে তুমি আছো তাই।পুতুলের কপালে দীর্ঘ একটা ভালোবাসার চুম্বন একে বললো,

কখন এসেছো?একা এসেছো না-কি কার সাথে এসেছোও।

হুম এসেছি অনেকখন হলো।আম্মু নিয়ে এসেছে।মায়ের নাম শুনতেই অর্পণ চারদিকে তাকায়।কোথাও দেখতে না পেয়ে পুতুলের দিকে তাকিয়ে বলল।

কোথায়?

পাশের রুমেই আছে।বউকে সোফা বসিয়ে মায়ের কাছে যেতে যেতে বলল,

তুমি বসোও।আমি আম্মু সাথে দেখা করে আসি।

পুতুল মুচকি হেসে মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো।

বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে রাবেয়া।পিছনে ছেলের আসা টের পেয়েই মুখটা ঘুড়িয়ে আকাশ দিকে তাকিয়ে রইলো।

পিছন থেকে মা’কে জড়িয়ে ধরে নরম স্বরে ডাক দিলল।

আম্মু।তুমি কেমন আছ?

কে আম্মু?কার আম্মু?আমি কারো আম্মু নই?আমার কোনো ছেলে নেই।

হুহ,তুমি ব’লেই হলো।তুমি আমার আম্মু।আর আমি তোমার ছেলে।যতই অস্বীকার কর!আমি তোও জানি তুমি আমার মা জননী।আমার জম্মদাত্তী।পৃথিবীর সবকিছু বদলে গেলেও মায়ের মমতা কখনো বদলায় না।মা গো আমি তোমারই খোকা।তোমার অর্পণ বাবা।রাবেয়া ছেলের ওপর বেশিখন রাখ করে থাকতে পারলোনা।ফুফিয়ে কেঁদে ওঠে।ছেলের দিকে অশ্রু নিয়ে তাকাতেই টলমল জল টুপ করে ঝড়ে পড়ে।মায়ের চোখের পানিটুকু নিচে পড়ার আগেই হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

এই চোখে দূঃখের কান্না মানায় না।এই চোখে আনন্দ অশ্রু থাকবে।যা আমার মনে কষ্টের ঘোরাক আনবে না।আনবে খুশির মহল।প্লিজ আম্মু কেঁদোও না।আমার লক্ষ্মী আম্মু।মায়ের চোখের পানিটুকু নিজ হাত দিয়ে মুছে দিলো।

তাহলে কথা তে,আর কখনো এমন করবি না।যদি করিস তাহলে আমি কিন্তু তোর জন্তনায় সত্যি সত্যি মরেই যা…মায়ের শেষ কথাটুকু বলার আগেই হাত দিয়ে মুখ আঁটকে বলল,

এমন কথা বলো না।তোমাদের জন্যই মৃত্যুর ঘর থেকে শত লড়াই করে বেঁচে ফিরেছি।তোমরা আমার বেঁচে থাকার শেষ সম্বল।তোমাদের কিছু হয়ে গেলে আমি যে এতিম হয়ে যাব।মা বিহীন এতিমদের প্রতি কেউ ভালোবাসার চোখে দেখে না।তারা অবহেলায় বাঁচে।আমি সেই অবহেলা মানতেই পারবো না।আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি ওই রকম পরিস্থিতি আর কখনো আসবে না।প্রমিস।

১৫৪.
দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর শেষ করে।দুইটি মানুষের অপেক্ষার সমাপ্তি মিলে একই সুতোই আবার বাঁধা পড়ে নতুন জীবনে।পুতুল আর অর্পণ বিয়ে করছে।এটা তাদের দ্বিতীয়বার বিয়ে।একই প্রিয় দুটো ব্যাক্তি।ভালোবাসাটাকে আজ নিজ থেকে স্বীকৃতি দিতে এগিয়েছে দুইজনই নতুন দিনে।তাদের
এই ভালোবাসা বেঁচে থাকুক আজন্মকাল।বেঁচে থাকুক পুতুল আর অর্পন মতো হাজার হাজার জুটিগুলো।ভালোবাসাগুলো দেখাতেও এক প্রকার শান্তি লাগে।এই বিয়েতে কোনো গর্জিয়াস সাজ নেই।নেই কোনো হৈ-হুল্লোর।যা আছে তা শুধু মধুর সুরে কোরআনের বানী।দশ হাজার এতিমের কন্ঠে কোরআন তিলাওয়াতের মধুর সুর ভাসে চারদিকে।এমন আয়োজন কখনো কোনোদিন কেউ দেখে নিই।এই প্রথম বিয়ের আয়োজন সাধারণের মাঝে ওহ অসাধারণ হয়েছে।কনের গায়ে সাদার উপর ভিত্তি করে শাড়ি।মাথায় সাদা হিজাব পরিধান।গায়ে ফুল হাতার ব্লাউজ।তার দুই হাতে সাদা চকচকে অনেকগুলো চুড়ি।কনেকে মহিলাদের সাথে আলাদা কক্ষে রাখা হয়েছে।বড় পর্দার আড়ালে তার প্রেমিক পুরুষ তার স্বামী বউয়ের সাথে মিলিয়ে সাদা পাঞ্জাবি পরেছে।মাথায় সাদা পাগড়ি।হাতে মায়ের দেওয়া দামী ঘড়ি।পর্দার আড়াল থেকে বউকে দেখা’র জন্য উঁকিঝুকি মারছে।বউকে চোখের দেখা দেখতে না পেয়ে সবার সামনেই ব’লে ফেলল,

এই আমার বউ কই?ছেলের কাজে অসীম তালুকদারের চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।এইদিকে কনে পক্ষের লোক জামাইয়ের এই কথায় হেঁসে উঠে।ঠিকই তোও বেচার বউকে সবাই মিলে লুকিয়ে রাখছে কেন?সামনে নিয়ে আসা হোক।অবশেষে তাকে বরের সামনে নিয়ে আসা হয়।মাথার ওপর আলাদা ওড়না দিয়ে মুখটা ঢাকা।তবুও বউকে কাছ থেকে দেখতে পেয়ে মাশা-আল্লাহ ব’লে বুকে হাত দিয়ে বাপের ওপর ঢলে পরে।ছেলের কাজে অসীম তালুকদার হতভম্ব হয়ে বিরবির করে বলল,

এই ছেলে কার মতো হইছে?আমি তোও কখনোই বিয়ে করতে গিয়ে এমন বেশরমের মতো বউকে খুঁজি নিই।উল্টো খিদা লাগছে জামাইয়ের খাওন দেন ব’লে বন্ধুদের নিয়ে বিয়ের আসরে চিল্লিয়ে শ্বশুর মশাইয়ের বারোটা বাজায়ছি।না এখানে থাকা যাবে না।বেশরম ছেলের মুখে লাগাম নেই।দূরে থাকাই ভালো।অসীম তালুকদার ছেলের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালেন।এইদিকে অর্পণ কাজকর্মের পুতুল লজ্জা পেয়ে যায়।মিলন,সাজু, রিফাত বোনের জামাইয়ের কাজে উচ্চস্বরে হেসে বলল,

দুলামিঞা এতেই এই অবস্থা।আপুকে পুরোপুরি দেখলে ঠিক থাকবেন তো।শেষে আপনার নজর লেগে যাবে আমার আপুর ওপর।

আরে আমার বউ আমি নজর দিব না তোও।নজর দিবে কে আমার বাপ?অসীম তালুকদার খুকখুক করে কেশেঁ উঠেন।বাপের কাশি শব্দ শুনে সেই দিকে তাকিয়ে বলল,

কি হয়েছে এমন যক্ষ্মা রোগীর মতো কাশি দিচ্ছো কেন?
কাজি সাহেব বিয়ে তাড়াতাড়ি পড়ান।বউয়ের মুখ দেখার জন্য বুকটা আমার আকুপাকু করছে।কাজি সাহেব সাদা ফ্রেমের চশমাটা ঠিক করে বিয়ে পড়াতে শুরু করেন।

ইসলামি শরীয়ত মতাবেগ বিয়ে শেষ করে কনে,বরকে পাশাপাশি বসিয়ে দিলো।বড় আয়না মধ্যে নিজের প্রেয়সীকে দেখতেই অর্পণ বিরবির করে ব’লে উঠে সুবহানাল্লাহ।আল্লাহ আমাকে উত্তম জীবনসঙ্গী দান করেছেন।তার কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া।স্বামীর কথাগুলো কানে আসতেই পুতুল আয়না দিয়ে বরের মুখের দিকে তাকায়।বউ তার দিকে মায়া মায়া দৃষ্টিতে তাকাতেই অর্পণ মুচকি হেসে উঠে।স্বামীর হাসিতে পুতুল লাজুকলতা হয়ে মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকায়।এই লোকটার চাহনিতে আজ নিজের জন্য সর্বনাশ দেখতে পাচ্ছে।পুতুলের ভাবনার মাঝেই নিজের হাতের ওপর কারো স্পর্শ পেতেই হাতের দিকে তাকায়।স্বামীর ছোঁয়া অদ্ভুত সুখ সুখ লাগে।

বিয়ে করে কন্যা চলে যাওয়ার সময় এসেছে।আজ পুতুলের বিদায়।এই ঘর,এই মায়ের সঙ্গে কাটানো দিনগুলো মনে পড়ে গেলো।আরো মনে পড়ে মামার কথা যার হাত ধরে ছোট ছোট পায়ে নিজের লক্ষ্যে ঠিক পৌঁছে গেছে।মায়ের পরে মামার অবদান বেশি।যা পুতুল কখনোই কোনো কিছুর বিনিময়ে এই মামার ঋণ কোনোদিনই শোধ করতে পারবে না।মামার ছায়া তার শৈশব,কৈশোর কেটেছে।।এই মাটিতে বড় হয়ে হেসে খেলেছে।ছোট্ট ছোট্ট ভাই গুলো বড় ভাইয়ের মতো তাকে আগলে রাখতে চেষ্টা করেছে।মায়ের ভালোবাসা পেতেই মামী সর্ব প্রথম তার মাথায় হাত রেখেছে।কখনো পর ভাবেনি।সবসময় নিজের মেয়ের মতো আগলে রেখেছেন।কোনো অভাব,কিংবা অভিযোগের সুযোগ দেয়নি।আজ সেই আপনজনদের ছেড়ে কন্যা পরে বাড়ির বউ হয়ে যাচ্ছে।যেটা তার আসল ঘর।তার স্বামীর ঠিকানাই এখন তার বর্তমান ঠিকানা।মেয়েরা এত তাড়াতাড়ি কেন বড় হয়ে যায়।তাদের ছাড়া মা,বাবা কেমনে থাকবে?সেসব ভাবতেই বুকের ভেতর কিছু একটা কামড়ে ধরে।বিধির লিখা নিয়ম মেনে চলায় আমাদের জীবন।এখানে হাসি,কান্না সবকিছুই মিলিয়ে আমাদের এই ছোট্ট জীবনের চাওয়া পাওয়া।

এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে
জীবন দরিয়ায়।
বাপের বাড়ি ছাইড়া কন্যা
শ্বশুরবাড়ি যায় হায়
পুতুল খেলার ছেলেবেলা
মনে পইড়া যায়

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে