চক্ষে আমার তৃষ্ণা পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0
362

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৩১
৯৯.
লীলাবালি লীলাবালি
বড় যুবতী সই গো
বড় যুবতী সই গো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে!

পুতুলের গায়ে লাল বেনারসি শাড়ি জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।মাথায় লাল ওড়না দেওয়া।মুখে হালকা মেক-আপ করতে বলা হয়েছিল।কিন্তু পুতুলের কথা তারা শুনে নিই।প্রচুর মেকআপ করায় তার আসল চেহারা লুকিয়ে গেছে।পুতুল মেকআপ পচ্ছন্দ করে না।মামার মুখের দিকে তাকিয়ে বিয়ের সব নিয়ম মেনে যাচ্ছে।তার ভিতর থেকে দীর্ঘ লম্বা শ্বাস বের হয়।পুতুল মন থেকে কেন খুশি হতে পারছেনা?এ কেমন কষ্ট হচ্ছে? পুতুল নিজেই বুঝতে পারছে না।ভেতরে অস্থিরতা কাজ করছে।তবুও মামার মুখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যে হাসি মুখে লাগিয়ে রেখেছে।

তালুকদার বাড়িতে বিয়ের আমেজ পাওয়া যাচ্ছে।দিহানসহ তার পুরো পরিবার তালুকদার বাড়িতে।এখান থেকেই তারা বউ আনতে রওনা হয়েছে।তারা আনন্দের সাথে
সব কিছুতেই সামিল হয়েছে।অসীম তালুকদার ছেলের জন্য বাড়িতে রয়েছেন।আজ কয়েকদিন হলো ছেলেটা ঘর অন্ধকার করে বসে আছে।না কিছু বলছে।না ঘর থেকে বের হচ্ছে।অর্পণ যেমনই থাক।ঘর ছেড়ে সব সময় তার বাহিরে আনাগোনা বেশি ছিল।ঘর কম বাহির ছিল তার আপন দুনিয়ায়।সেই ছেলে ঘর থেকে নড়ছে না।ব্যাপারটা অসীম তালুকদারকে চিন্তায় ফেলেছে।

অর্পণ ঘর অন্ধকার করে তাকিয়ে আছে আকাশে দিকে।চোখ বন্ধ করে ছোট নিশ্বাস ফেলে বলতে লাগলো।

আমি তোমাকে পাওয়ার আশায় হয়তো ভালোবাসি নিই।আমি আমার ভালোবাসার মাঝে নিজের সুখ খুঁজেছি।নিজের এক তরফা ভালোবাসা দাবি নিয়ে কখনোই জোর করতে বা তোমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করিনি।আমি আমার মতো করে তোমায় নিয়ে মনের মাঝে ছোট্ট সংসার সাজিয়ে ছিলাম।আমি জানতাম না।তোমাকে আমার পাওয়া হবে না।যদি জানতাম তবে চাইতাম না।এই এক পাক্ষিক ভালোবাসায় আমায় কাঁদায়।আমি না পারছি কষ্ট গিলে ফেলতে আর না পারছি ভুলে যেতে।এই পোড়া দহনে আমি পুড়ে পুড়ে অঙ্কার হচ্ছি।আমাকে রেখে দিতে তোমার মায়া।আমি শুধু তোমার হয়ে আজীবন থাকতাম।সব কিছুই সীমার মধ্যে থাকলে ভালো লাগে!কিন্তু আমি সীমাহীন ভাবে তোমাকে ভালোবাসি।আর ভালোবাসি ব’লে তোমার সুখে কাঁটা হব না।তুমি যেখানে থাকো।যার সাথে থাক সুখে থাকো।আমার মনের ছোট্র পিঞ্জিরায় তোমার নামটি সব সময় র’বে।আমি চাইলেও পারব না সবটা মুছে দিতে।বেদনায় এত সুখ আগে বুঝে নিই।আমার একপাক্ষিক ভালোবাসার গল্পটা তোমার জন্যই অজানা থাক।তুমি কোনোদিন জানবে না অর্পণ নামের কেউ তোমায় ভালোবাসত।খুব করে চাইতো।আমি আমার মনের কথা কোনোদিন কাউকে জানতে দিব না।এটা নিজের কাছেই নিজেকে ওয়াদা দিলাম।

১০০.
বধূ সাজে কনে ঘরে বসে আছে।বাহির থেকে শুনা যাচ্ছে বর এসেছে,বর এসেছে।মিলন,সাজু,এগিয়ে দুলামিয়াকে সাদরে গ্রহণ করার জন্য দুই দিক থেকে লাল ফিতা ধরে।যার মানে তাদের ডিমান্ড মেনে এই ফিতা কেটে বাড়িতে ঢুকতে হবে।তাদের চাহিদা ছিল পাঁচ হাজার টাকা।যেটা বর পক্ষ মেনে ফিতা কেটে ঢুকে।রিফাত এক গ্লাস শরবত এগিয়ে দিয়ে বলল।

আরে দুলামিঞা ভেতরে যাবেন।তার আগে এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত খাইয়া যান।ট্রেতে করে সাত গ্লাসে সাত রকম শরবত দেওয়া হয়েছে।বর পক্ষ কনফিউজড।বরকে কোনটা খেতে বলবে?রিফাত চালাকি করে বরের হাতে একটা গ্লাস দিয়ে বাকিগুলো বর পক্ষের বন্ধুদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

মিলন ব’লে, এই শরবত যে খাবে না সে পস্তাবে।এ-তো স্বাদের শরবত মিস করেছেন তো মরেছেন।শরবত হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার থেকে ঠকঠক করে খেয়ে দেখান দেখি!
বর পক্ষ শরবত মুখে দিতেই একেক জনের চোখ,মুখের রং বদলে গেলো।সবাই এক চুমুক দিয়ে গড়গড় করে ফেলে দিল।কি বিচ্ছিরি খেতে?বরকে দিয়েছিল নিমপাতা শরবত।সে শরবত এক চুমুক দিয়ে গিলতে সাহস করেনি।মুখের মধ্যে নিয়ে বন্ধুদের রিয়াকশন দেখে নিজের রিয়্যাক্ট করতে ভুলে গেছে।

রেনু মেয়ে জামাইকে বরণ করে মিষ্টি মুখ করিয়ে দেয়।জামাই মিষ্টি মুখ ভয়ে ভয়ে করেছে।এই বুঝি আবার বিপদে পড়লো।কিন্তু তেমন কিছু হয়নি।বেচেঁ গেছে।স্বাধীন বরকে নিজ আসনে বসিয়ে চলে যায়।গ্রামের লোকেরা আশ্চর্য হচ্ছে।বোবা মেয়ের জন্য এত সুন্দর রাজপুত্র আগমন।তারা কি জেনেশুনে নিচ্ছে এমন মেয়ে।এত ভালো ছেলের জন্য নিশ্চয় মেয়ের অভাব হতো না।এরা মনে হয় ছেলে বাড়ির লোকদের ওপর জাদু করেছে।জাদু না করলে এমন সুপাত্র হাতে পায় কি করে?পাড়াপ্রতিবেশীর গুঞ্জন শুনা যাচ্ছে।স্বাধীন সেইসব কানে তুললো না।বরং কাজিকে বিয়ে পড়াতে বলল।

জেভিন ছেলের কবুল বলাটা নিজ কানে শুনতে চাইলোনা।তার চোখে মুখে বিরক্তি।খুঁজে খুঁজে কনের ঘরে সামনে আসে।দরজা লাগিয়ে কনের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

যতই মুখে মেকআপ লাগাও না কেন?গলায় মালা দেও না কেন?ক্ষেতকে ক্ষেতই লাগবে।গাইয়া মেয়ে একটা।আমার হাসবেন্ড কি দেখে তোমায় পচ্ছন্দ করলো বুঝতে পারছি না?

পুতুল বিদেশি ফর্সা মহিলার কথায় কিছুই বুঝতে পারছে না।ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রয়।পুতুলের চুপ থাকাটায় আরো বিরক্ত হয়ে জেভিন চলে যায় বারান্দায়।সেখানেই কিছু মহিলা পান খেতে খেতে পুতুলের কথা বলতে থাকেন।

যত চাই কও।বোবা মাইয়ার কপাল খুলছে।একে তোও বাপ,মা মরা মাইয়া।তার ওপর কথা কইতে পারে না।মামা এতিম ভাগ্নীকে বড়লোক ছেলের কপালে জুটিয়ে দিল। মনে হয় টাকার লোভে পড়ে।শুনছি,ছেলের বাপ,মায়ের মেলা টাহা,পয়সা আছে।
জেভিনের কানে এসব কথা আসতেই আকাশ থেকে পড়লো।গালে হাত দিয়ে বলল,

ওহ মাই গড।এত বড় ধোঁকা।এরা দেখছি চিটার,বাটপার।মেয়ের মামা আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো।এদের টাকার প্রতি এত লোভ।না এই বিয়ে কিছুতেই হতে দেওয়া যাবেনা।এরা চালবাজ।আমি আজই এই বিয়ে ভেঙ্গে দিব।তার আগে পুলিশকে ফোন দিতে হবে।জেভিন পুলিশকে ফোন দিতে দিতে বিয়ের আসরে পৌঁছায়।

১০১.
বন্ধ করুন এই বিয়ে।জেভিন কথায় সবাই চমকে উঠে।দিহান এগিয়ে এসে ব’লে।

আজকে ছেলের বিয়েতে তুমি কি তামাশা শুরু করেছো?

তামাশা আমি নই।এরা করেছে।এদের জিজ্ঞেস কর।এদের কত টাকা চাই?টাকার লোভেই এসব করেছে?কত টাকা পেলে এসব নাটক বন্ধ করবে?পাঁচ লাখ।দশ লাখ,না-কি বিশ লাখ।

জে..ভি..ন।চুপ কর।

কেন চুপ করব?এরা ধোঁকাবাজ।বাটপার।চিটার।টাকা লোভে পড়ে বোবা মেয়েটিকে আমার সুন্দর হ্যান্ডসাম ছেলের গলায় ঝুলিয়ে দিতে চেয়েছে।আমি মা হয়ে এটা মেনে নিবো।একে তোও অশিক্ষিত চাষার গাইয়া মেয়ে।তার ওপর বড় লোক বাড়ির ছেলে দেখে গলায় ঝুলতে যায়।এদেরকে আমি পুলিশে দিব।

দিহান সাহেব নিজের বউকে যত চুপ করাতে চাইছেন।ততই তিনি হাইপার হচ্ছেন।বাড়ির উঠোনে গ্রামের মানুষের ভীর জমেছে।সবাই কানাঘুষা করছে।বাহিরে এত শব্দ শুনে পুতুল ঘর ছেড়ে বারান্দায় দাঁড়ায়।নিজের চোখের সামনে মামাকে বরযাত্রী লোকেরা অপমান করছে।এটা দেখেই কলিজা কেঁপে ওঠে।পুতুল দৌড়ে ছুটে আসে।মামা এবং বরযাত্রী লোকের মাঝে দাড়িয়ে যায়।

চোখের ভাষায় বলছে তাদের অপরাধ কি?

কিন্তু এরপর যে কথাগুলো চারদিক থেকে কানে এসে বিষফোঁড়ন ঘটায়।তাতে পুতুল আর পাঁচটা মেয়ের মতো চোখের পানি ফেলে নিই।বরং শক্ত চোখে তাকিয়ে রয়।দিহান সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে জানতে চায়।

আপনি জানতেন না আমি বোবা?কথা বলতে পারি না।পুতুলের চোখের ভাষাটা তিনি বুঝতে পারেনি।পুতুল একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ভাইকে খাতা,কলম এগিয়ে দিতে বলে।সাজু ছোট নোট বুক,আর কলম বোনের হাতে তুলে দেয়।পুতুল কলম দিয়ে লিখে সেটা দিহান সাহেবের চোখের সামনে ধরেন।

পুতুলের লিখাটা পরে তিনি চোখ নামিয়ে নেন।যার মানে তিনি জানতেন না।পুতুল মামার কষ্ট মাখা মুখটা দিকে না তাকিয়ে বরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

আপনি ও কি আপনার পরিবারের মতো সবটা জানতেন না।

পুতুলের লিখাটা পরে অন্তর না বলল।

তাহলে না জেনে।কোনো খোঁজ না নিয়ে একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চলে আসছেন।এমনটা গল্প,সিনেমাতে হয় শুনেছি।আজ নিজের সাথে হতে দেখছি।পুতুল আবার লিখে সেটা বরের সামনে তুলে ধরে।

এখন আপনারা কি চান?

১০২.
আমরা বিয়েটা ভেঙে দিতে চাই।দেখো আমি বাবা-র এক কথায় তোমার কোনো খোঁজ না নিয়ে বিয়েতে মত দিয়েছিলাম।বাবার কাজে এতটা ভুল হবে আমি যদি একবার জানতাম। কখনোই রাজি হতাম না।একজন শিক্ষিত ছেলে হয়ে তোমাকে যদি বিয়ে করি।লোকে আমায় নিয়ে কটুক্তি করবে।যা আমার পক্ষে
হজম করা সম্ভব নয়।তুমি গ্রামের মেয়ে হওয়াতে আপত্তি ছিল।কিন্তু বাবা বুঝানোর জন্য কোনোরকম রাজি হয়েছিলাম।কিন্তু সেই মেয়ে বোবা হবে।আর এমন মেয়েকে বিয়ে করে বিদেশি বন্ধুদের এবং আত্মীয় স্বজনদের সামনে অপমান হতে চাই না।এমনিতেই কাজিনদের সামনে মান সম্মান শেষ।বিয়েতে ভাগ্যিস অনেক না আসায় বেঁচে গেছি।

বর পক্ষ বিয়ে ভেঙে দিবে শুনে রেনু শাড়ি আঁচলে মুখে গুঁজে কেঁদে ওঠে।স্বাধীনের হাত,পা ঠান্ডা হয়ে আসে।এসব কি হচ্ছে?তার ফুলের মতো মেয়ের গায়ে বিয়ে ভাঙার দাগ লেগে যাবে।সবাই নিন্দা করবে।এতো কষ্ট নিয়ে মেয়েটা বাঁচবে কি করে?
হে আল্লাহ রহম কর!তোমার অসহায় বান্দার প্রতি সহায় হও।

বিয়ে ভাঙ্গার সুর এতখন কানে আসছিল।এখন যেহেতু ছেলে নিজেই ব’লেছে।সে এই বিয়ে করতে পারবেনা।তখন এই কনে সাজে তাকে মানায় না।গলায় থাকা গোলাপ ফুলের মালাটা টেনে ছিঁড়ে ফেললো মাটিতে।

পুতুল ডায়েরিতে কিছু লিখে মামার হাতে কাগজটা খুঁজে দিলো।

মামা তাদের কষ্ট বাড়িয়ে আর লাভ নেই।তারা আমাদের বাড়িতে এসেছিল।না খাইয়ে পাঠিয়েও না।খাইয়ে মেহমানকে রাস্তার পথ চিনিয়ে দেও।

মেয়ের কথায় স্বাধীন নিস্তব্ধ।কি বলবেন কি করবেন বুঝতে পারছে না?মামাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।নিজেই এগিয়ে আসে।দিহান সাহেবকে হাতের ইশারা দিয়ে বলল,

গরিবের বাড়িতে বড়লোকে আত্মীয়তা মানায় না।যদিও ভুলটা আমাদেরই বেশি।তাই সব অন্যায় মাথা পেতে নিচ্ছি।আমি মেয়েটা হয়ত ছোট্ট গ্রামের।কিন্তু আশাটা অনেক বড়।আজ আমাকে নিয়ে যে খেলাটা খেললেন।তা অন্য মেয়ের সাথে করতে যাবেন না।তাহলে তারা এমনই এমনই আপনাদের ছেড়ে দিবে না।আমার সাথে যেটা করলেন।সেটা আমি সারাজীবন মনে রাখব।আপনাদের অবজ্ঞা করার কথা আমার স্মরনে সবসময় থাকবে।
এখন আপনার আসতে পারেন।দরজা ওইদিকে।পুতুল,পূর্ব দিকের দরজা দিকে ইশারায় বুঝিয়ে বলল,তাদের বেরিয়ে যেতে।বর পক্ষ একে একে চলে যেতে নিলেই মিলন বরপক্ষ থেকে নেওয়া টাকাগুলো ফিরিয়ে দিল।

এটা আমাদের দুলামিঞা থেকে পাওয়া হোক ছিল।কিন্তু আপনি আমাদের দুলামিঞা নন।আমরা গরিব হতে পারি।কিন্তু ছোট্ট লোক নই।তাই এই বড়লোকদের টাকা আমাদের চাই না।অন্তরের হাতে টাকাগুলো দিয়ে দেয়।বর পক্ষর সাথে পাড়া প্রতিবেশী চলে যেতেই মিলন,সাজু মেইন গেটের দরজাটা মুখের ওপর বন্ধ করে দেয়।স্বাধীন মেয়ের এই পরিনতির জন্য নিজেকে দায়ী করছে।বিয়ের বাড়ির উঠোনে বসে কপালে হাত দিয়ে কাঁদতে থাকে।পুতুল দৌড়ে এসে মামার দুই চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল,

তুমি কেঁদো না।তোমার চোখের পানি দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়।আল্লাহ যা করেন তা আমাদের ভালোর জন্যই করেন।সবাই আমাকে কথা শুনাচ্ছে।কই আমি তোও এক ফোটা চোখের জল ফেলছি না।

চলবে….

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৩২
১০৩.
তালুকদার বাড়িতে বর পক্ষের সবাই হাজির।বউ ছাড়া সবাই ফিরে এসেছে।অসীম তালুকদার বন্ধুকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চান।কিন্তু তিনি মুখ ভাড় করে সোফায় বসে আছেন।জেভিন স্বামীর ওপর চিতকার চেচামেচি করে দোষারোপ করছে।

অন্তর মাথা নিচু করে বন্ধুদের সাথে টুকটাক কথা বলছে।

কি’রে দিহান ছেলে বিয়ে করেছে।আর তোরা মুখ ভার করে বসে আছিস কেন?ছেলের বউ কোথায়?বউমাকে সামনে আন।মুখটা দেখি।

যেখানে বিয়ে হয়নি।সেখানে বউমা আসবে কোথা থেকে?ওরা আমাদের সাথে চিট করেছে।আমাদের ধোঁকায় রেখে ছেলের গলায় বোবা মেয়েটিকে ঝুলিয়ে দিতে চেয়েছে।ভেবেছে পরে ভুঝুংবাঝুং বুঝিয়ে দিলেই বিশ্বাস করে নিবো।মগের মুল্লুক পেয়েছিল।জেভিন রওয়ার্ড কথায় অসীম তালুকদার দিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,

কোন বাড়ির মেয়ে?তুই তোও সবটা জেনেই বিয়েতে মত দিয়েছিলি।তাহলে বিয়ের আসর থেকে ছেলেকে নিয়ে চলে আসছি কেন?
একটা মেয়ের গায়ে কত বড় দাগ লাগলো বুঝতে পারছি?দিহান তুই বুঝতে পারছি না!

আশ্চর্য।আপনি ওই মেয়ের কথা চিন্তা করছেন।আর আমাদের কি সর্বনাশ হতে যাচ্ছিলো?তার বেলা কি হবে?আমি চাইছি ওদের পুলিশে দিব।মানহানি মামলায় আসামি করব!

ভাবী একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন। আপনারা নিজেরাই আগে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন।তাদের বাড়িতে গিয়ে তাদের কাছে সমদ্ধ রেখেছেন।তারা কিন্তু বিয়ে প্রস্তাব রাখেনি।আর রইলো,মানহানির মামলা ঠুকবেন।সেটা কিন্তু ভুলেও করতে যাবেন না।তাহলে আপনারাই উল্টো ফেসে যাবেন।কারণ বিয়ের পাকা কথা এমনকি বিয়ে আসর পর্যন্ত কনে এবং তার পরিবারকে আশা দিয়ে আপনারাই নিয়েছেন।সেই আসরে বিয়ে আপনারাই ভেঙে এসেছেন।কেন ভেঙেছেন?মেয়ে কথা বলতে পারেনা।হাই ক্লাসের দোয়াই দিচ্ছেন।কিন্তু একবার ভেবেছেন।ওই মেয়েটির কত বড় ক্ষতি হলো?আপনাদের ভুলের জন্য সে কি দ্বিতীয় বিয়ে করার কথা মাথায় আনবে?না,আনবে না।তার জন্য ব্যাপারটা সহজ নয়।তাকে প্রতিপদে কথা শুনতে হবে।বিয়ে আসরে যে মেয়েকে বরপক্ষ না করে দেয়।তারজন্য ভালো প্রস্তাব কি আর আসবে?খোজঁ নিয়ে দেখুন।তাঁকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে এতখনে কথা রটে গেছে।সবার মুখে একটা কথাই থাকবে।
নিশ্চয় মেয়ের মধ্যে কোনো খুত ছিল।তাই বর পক্ষ বিয়ে ভাঙ্গছে।সে অপয়া,অলক্ষ্মী।তার জন্য শুভ কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়া বন্ধ। সে কোথাও থাকতে পারবেনা।সমাজ থেকে বিতারিত হবে।এসব কিন্তু তার জন্য সাধারণ সমস্যা নয়।কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি সে হতে চলেছে।সেইদিন আমার এই বন্ধু খুব আনন্দের সাথে আমাকে সবটা ব’লেছিল।আমি শুনে খুশি হয়েছিলাম।কিন্তু সে এটা বলেনি।মেয়ে বাকপ্রতিবন্ধী।কিংবা ছেলের সাথে মেয়ের আলাদা কথা বলতে দেওয়া হবে,বা হয়েছে।আর নিজে একটু আশেপাশে খোঁজ নিয়ে যাচাই- বাছাই করা।সেসব না করে এত দূর অবধি আগানো কতটা বোকামির কাজ ভাবতে পারছেন।আপনি ছেলের মা তাতেই আপনার মাথায় আগুন জ্বলছে।একবার ভেবেছেন।তাদের কি অবস্থা?

১০৪.

অসীম তুই আমার বন্ধু হয়ে ওদের কথা ভাবছিস।আমাদের দিকটা দেখছিস না।অনেকেই জানে ছেলের বউ নিয়ে আসছি।যখন বিদেশে যাব।তখন সবাই দেখবে বউ ছাড়া এসেছি।বিয়ে না হওয়ার ব্যাপারটা যখন লোকে জানবে তখন ছি,ছি বলবে।লজ্জায় আমার মাথা কাটাঁ যাবে।

ভাবতে চাই নিই।তুই ভাবতে বাধ্য করেছিস।
কেনো তুই সবটা না জেনে এত দূর অবধি গেলি।

বিশ্বাস কর আমি ওর সাথে সরাসরি কথা বলিনি।মেয়েটি সুন্দর আর মার্জিত,এবং কিছুটা শিক্ষিত এতটুকুই জানতাম।আমার দাদা চান মিয়া মেয়েটি সম্পর্কে সব বলেও মেয়েটি কথা না বলতে পারার ব্যাপারটি জানাননি।যখন আমার হাত ধরে কথা দিয়ে বললেন,মেয়েটিকে অন্তরের বউ করতে।মেয়েটা অসহায়,গরিব।তখন ভাবলাম।গরিব একটা মেয়েকে ছেলের বউ করলে মানুষের সহানুভূতি পাব।মানুষের ধারণা বদলাবে।

তাই নিজেই সবটা করে ফেললি।এখন আপসোস হচ্ছে।কারণ মেয়েটি অসহায় গরিব।আর তার ওপরের কথা বলতে পারেনা।আচ্ছা মেয়েটি কথা না বলার পিছনে ওর কি কোনো হাত ছিল।ওহ জম্ম থেকে না-কি কথা বলতে পারেনা।এটা ওপর ওয়ালার ইচ্ছা।সেখানে আমি,তুই, মেয়েটির কোনো দোষ দিয়ে লাভ নাই।

তাহলে তুই কি বলতে চাস?ওই মেয়েকে ছেলের জন্য আনতাম।আমার জন্য আমার ছেলের জীবন নষ্ট করে দিতাম।

না,আমি সেটা বলিনি।যা করেছিস সেটা ভুল করেছিস।অন্যায় করেছিস।এটা মানতে বলছি।স্বীকার করতে বলছি।

এতোই যখন দরদ।তখন আপনি আপনার ছেলের জন্য ওই বোবা গাইয়া মেয়েকে বউ করে আনুন।

ভাবি এখানে আপনার ছেলের সাথে মেয়েটির কথা আসছে।আমার ছেলের সাথে নয়।তবে হ্যা যদি কোনোদিন এমনও পরিস্থিতি হয়ে থাকে।কিংবা আমার ছেলে সবটা জেনে মেয়েটিকে গ্রহণ করে।তাহলে আমি তাঁকে সাদরে গ্রহণ করব।সেখানে থাকবে না কোনো মিথ্যার আশ্বাস।না থাকবে অবহেলা।

অসীম তালুকদার কথায় বিরক্ত হয়ে জেভিন বলল,

এখানে আর এক মুহূর্ত নয়।কাল সকালেই চলে যাব।

পুতুল টিউবওয়েল চাপিয়ে বালতি ভরে মাথায় পানি ঢালছে।মুখে সাজগোছ পানিতে ধূয়ে যাচ্ছে।এত রাতে পুতুলের সামনে রেনু দাঁড়িয়ে আছে।মেয়েটার মনে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে?রেনু বুঝতে চেষ্টা করে লাভ হলো না।ব্যথ চোখে তাকিয়ে ডাক দিল।

পুতুল এত রাতে গোসল করছো ঠান্ডা লেগে যাবে।পানি গায়ে আর ঢেলো না।চলে আসো।
পুতুলের গোসল সম্পূর্ণ করে কলপাড় ছেড়ে ঘরে যেতে নিলেই রেনু বলল,

তুই ঠিক আছিস।কষ্ট পাচ্ছিস।

পুতুল নিচু মাথাটা উচু করে মামীকে চোখের ইশারায় বলল,

আমি ঠিক আছি।আমি কষ্ট পাচ্ছি না।আমার সাথে যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।সেসব ভুলে যেতে চাইছি।বিয়ে নিয়ে আমার মনে অনুভূতিগুলো এখন মৃত মামী।আমি আমার জীবনে আর কাউকে জড়াতে চাই না।আমার ছোট এই জীবনে সুখ পাওয়া থেকে না পাওয়া কষ্টগুলো বেশি।বাবা নামক মানুষটিকে ঘৃনার খাতায় সেই কবে লিখেছিলাম।মনে নেই।আজ নতুন করে আরো একটি ঘৃণার খাতায় নাম উঠে আসলো।সাথে এতটুকু বুঝতে পেরেছি।আমার কপালে ওসব ভালোবাসার মানুষ শব্দটা নেই।কেউ সবটা জেনে আপন করতে আসবে না।যদি কেউ ভুলে ওহ চলে আসে।তাহলে মনে রেখো।ভালোবেসে নয় করুণা করে গ্রহণ করছে।দয়া দেখাচ্ছে।

কিন্তু আমি তোও কারো করুণা,দয়া নিয়ে বাঁচতে চাই না।আমাকে যদি বাঁচতে হয়।তাহলে নিজের সাথে লড়াই করে বাঁচব।এই সমাজের মাঝে থেকে দেখিয়ে দিতে চাই।নিজে নিজেকে ভালোবেসে ওহ বেঁচে থাকা চায়।নিজের লক্ষ্য অবধি যাওয়া চায়।নিজের স্বপ্নটাকে পূরণ করা যায়।পুতুল চাদঁ বিহীন আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আরো বলল,

আমি আমার আল্লাহ কাছেই সব কথা বলবো।যে যারা আমায় কাঁদায়।যারা আমাকে কষ্ট দেয়।তাদের যেন আমার আল্লাহ দেখে নেয়।

১০৫.
আজ সকালের সূর্য তার তেজ দেখাতে ব্যাস্ত।সূর্য সাহেব আজ কার ওপর রাগ দেখাচ্ছে বুঝতে পারছে না।অর্পণের মুখের ওপর সূর্যের আলো এসে পড়তেই উঠে বসে।কোথায় আছে মনে করতেই মনটা খারাপ হয়ে যায়।আজ সে অনেক দূরে।কাল রাতে গ্রামে থাকায় দম বন্ধ লাগছিলো।তাই একবুক কষ্ট নিয়েই কাউকে না জানিয়ে রাতের আধারেরই গ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরে আসে।সিদ্ধান্ত নেয়,সে ওই ছোট গ্রামে আর কোনোদিন ফিরে যাবেনা।কোনোদিন না।

তার ভালোবাসার মানুষটি আজ অন্য কারো ঘরে।সে অন্য কারো ভালোবাসার মায়া ডুবে।সে কোনোদিন জানবেই না।অর্পণ নামের কেউ তাকে খুব করে চাইতো।সেখানে না ছিল দয়া,আর না ছিল করুণা।একবুক নিঃস্বার্থ ভালোবেসেছিল।তার নতুন জীবনের জন্য অনেক অনেক দোয়া রইলো।সে তার নতুন জীবন সঙ্গী সাথেই খুশি থাকুক।আমি না হয় তার থেকে পাওয়া শেষ সৃতি টুকু আঁকড়ে বেঁচে থাকব।পকেট থেকে ছোট রুমালটা হাতে পেচিয়ে বেঁধে নিলো।পাঞ্জাবির হাতাটুকু নামিয়ে ডেকে দিলো।পুতুলের তৈরি নিজের নামটি পাঞ্জাবির হাতার ভিতরে লুকিয়ে রয়েছে।

ভালো থেকেও পুতুল।সুখে থেকো।

এইদিকে একজন নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে যাচ্ছে।সে জানতেই পারলো না।তার প্রিয় মানুষটি অন্য কারো হয়ে যায় নিই।অপরদিকে পুতুল নিজেকে তৈরি করছে নিজের লক্ষ্য অবধি যাওয়া জন্য।

স্বাধীন মেয়ের মুখোমুখি হওয়ার সাহস করতে পারেনি।কয়েকদিন ধরে মুখ লুকিয়ে ভোর হওয়ার আগেই গ্রাম ছাড়া হচ্ছে।আবার মুখ লুকিয়ে রাতের আঁধারের ঘরে এসে চুপটি করে শুয়ে পড়ে।রেনু স্বামীর কাজের জন্য কি বলবে বুঝতে পারছে না।মানুষটার মুখের দিকে তাকানো যায় না।কয়েকদিনে কেমন শুকিয়ে গেছে।মেয়ের চিন্তায় ঠিক মতো খায় না।ঘুমায় না।কেমন ছটপট করে।

চলবে….

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৩৩
১০৬.
পুতুলের বাপ,আমারে আপনি তালাক দিয়েন না।আমার মাইয়ার মুখের দিকে তাকায় রহম করেন।আমি না খাইয়া আপনারর সংসারে আমার পুতুলের নিইয়া আপনার সাথে সারাজীবন থাকুম।তবুও আমারে তালাক দিয়েন না।আমি মইরা যামু।

আজকেই তোরে তালাক দিমু।তুই আমার সামনে আমার মায়ের মুখে মুখে কথা কস।
এক তালাক,দুই তালাক,তিন তালাক বলেই মোস্তফা বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার আগেই রাজিয়ার কোমড়ে জোরে লাথি মেরে চলে যায়।মোস্তফা মুখে তালাক দিতেই রাজিয়া আল্লাহ গোও ব’লে ওখানেই জ্ঞান হারায়।

পুতুল,তোর বাপ আমারে তালাক দিছে।এরপর কেমন থাকুম তার সংসারে?তুই ক?আমি তো এখন পরগাছা।এত ভালোবাসার প্রতিদান আজ বুঝি পাইলাম।বাপ,ভাইয়ের মনে কষ্ট দিচ্ছিলাম না।তার ফল আমি পাইছি।চল,এখান থেকে চইলা যাই।তোরে রাইখা গেলে মা*ইরা ফেলাইব এরা।আমি বাঁইচা থাকতে তোরে এহেনে রাইখা যামু না।মা রা*রি হয়েছি তো কি হইছে?তুই আমার কলিজা মধ্যে থাকবি।আমি তো মা,চাইলেও তোরে ফালাইয়া দিতে পারুম না।এই আল্লাহ দুনিয়ায় কোথাও না কোথাও ঠিক ঠাঁই হইবো,আমগো মা,বেটির।

কালো রাতের আঁধারের ঘুমিয়ে আছে পুতুল। মায়ের পুরোনো কথা এবং দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে।ঘুমের মধ্যে পুতুল অস্থিরতাবোধ করে।ঘুম ভেঙ্গে যায়।কপালের ঘাম টুকু মুছে আকাশের চাঁদটির দিকে তাকিয়ে ডাকে।
মা,ওমা তুমি না আমাকে তোমার বুকে টেনে ব’লেছিলে।তোমার হাতটা কখনো আমার মাথার ওপর থেকে যাবে না।আজ কতগুলো দিন চলে গেছে।তুমি আমার পাশে নেই।তোমার কান্না,তোমার কথাগুলো আজ-ও আমার কানে লাগে।আমি চাইলেও তোমায় ভুলতে পারিনি।মা আমি বড্ড ভেঙে পড়েছি।পুতুল কাদঁতে চায় কিন্তু পারেননা।আমার মনটা আমায় দূর্বল করে।মন ব’লে তুমি পারবে না।আর মস্তিষ্ক ব’লে তোমাকে পারতেই হবে।পুতুল তুমি পারবে।এই লড়াই তোমার একার হলেও এখানে তোমার মা,এবং মামা,মামীর প্রতিদান বেশি।তাদের জন্য আজ তুমি ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন বুনো।তারা ছিলো ব’লে তোমার গল্পটা অন্য রকম হ’য়েছে।আর পাঁচটা মেয়ের মতো নরম মাটি তুমি নও।সব জায়গায় কেঁদে বা ভয় পেয়ে হে’রে যাওয়ার গল্পটা তোমার হয়নি।এক অন্য তুমিই জম্ম নিয়েছো।এক অসীম সাহস রাখো।তুমি পারবে পুতুল তুমি পারবে।

১০৭.
অর্পণ মিটিংয়ে রুমে বসে আছে।প্রত্যেকের ফোন সাইলেন্ট রাখা হয়েছে।মিটিং রুমে পার্টির লোকেরা এসেছে।তারা বিভিন্ন আলোচনায় ব্যাস্ত।কিন্তু অর্পণ কেমন যেন গুরু গম্ভীর মুখে বসে আছে।পার্টির সবার কথা বসে শুনছে।কখনো হুম,হা বলে মত দিচ্ছে।অর্পণ এত চুপচাপ হয়ে যাওয়া।দলীয় পার্টির লোক কামরুজ্জামান চৌধুরী বিষয়টা অনেকখন ধরে দেখছে।গরম চায়ে তার জিহ্বা পুড়ে।তাই একটু আগে আনিয়ে রাখা ঠান্ডা চায়ের কাপে আরামসে চুমুক দিয়ে বলল,

অর্পণ।কি ব্যাপার?আজ এত চুপচাপ কেনো?কোনো সমস্যা?সমস্যা হলে বলতে পারো।
কামরুজ্জামানের কথায় সবাই অর্পণের দিকে তাকিয়ে রয়।অর্পণ নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক রাখা চেষ্টা করে কিন্তু পারেনি।গম্ভীর এবং মোটা স্বরে বলল,

কিছুই হয়নি।আমি ঠিক আছি।প্লিজ মিটিং কন্টিনিউ রাখুন।

আজ কয়েকদিন ধরে অসীম তালুকদার ছেলেকে লাগাতার ফোন করেই যাচ্ছেন।কিন্তু ছেলে তার ফোন তুলছে না।আর না বাড়িতে ফিরে আসার কথা মাথায় আনছে।ছেলের বিহেভিয়ার জন্য অসীম তালুকদার অসন্তুষ্ট হন।

মিটিং শেষ হলেই অফিস রুম থেকে বেরিয়ে আসে।এগিয়ে যায় গাড়ির দিকে।পেছনে বসেই ড্রাইভারকে কলেজের দিকে নিতে বলে।পকেট থেকে ফোনটা বের করে সামনে ধরতেই চোখের সামনে বাবার একশ পাচঁটা মিস কল ভেসে উঠে।কিন্তু বাবাকে দ্বিতীয়বার ফোন করার চিন্তা করে না।শুধু হাতে আঙুলের সাহায্য কি-বোর্ড চাপে।ছোট একটা ম্যাসেজ বাবার কাছে পাঠিয়ে দিয়ে ফোনটা পকেটে ভরে রাখে।

কলেজে নবীন বরণ হচ্ছে।পুতুল প্রথমে আসতে চায় নিই।কিন্তু না এলেও গ্রামের মানুষ কথা শুনাতো।ভাবত বিয়ে ভাঙ্গার জন্য ঘরে খিল দিয়েছি।এক কথা থেকে পাঁচ কথা ছড়াবে।তাই নিজেকে তৈরি করে একদম পরিপাটি হয়ে নিজ কলেজের জন্য বের হয়।মামাকে সাথে আনতে ভুলে নিই।তাকে জোর করে নিয়েই বেরিয়েছে।কলেজ গেইটে অবধি মামা তাকে নামিয়ে অন্য একটা কাজে চলে যায়।এইদিকে অর্পণ কলেজের প্রধাণ অতীত হয়ে এসেছে।তার সাথে কামরুলজামান এমনকি দলের ছেলেরা রয়েছে।অতিথি হিসেবে নিজ আসন গ্রহণ করতেই চোখে পরে তৃতীয় সারিতে বসে থাকা পুতুলের দিকে।সে মনযোগ দিয়ে মাইকিংয়ে বলা কথাগুলো শুনছে।অন্য দিকে তার নজর নেই।এইদিকে অর্পণ চমকে উঠে।একপলক তাকিয়ে চোখ সাথে সাথে সরিয়ে নেয়।অন্য কারো বউকে দেখা উচিত নয়।বিয়ে হতে না হতেই মেয়েটা কলেজে চলে আসলো।মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে।হ্যাঁ,স্বপ্নই হবে।

আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।তাই ভুলভাল দেখছি।পুতুলের দিকে আর একবারও না তাকিয়ে অনুষ্ঠান দ্রুত শেষ করার তাড়া দিল।তার এসব ভালো লাগছে না।সে বের হতে পারলেই যেন বেঁচে যায়।

পুতুলের গায়ে বাসন্তী শাড়ি।মাথায় কালো ওড়না দিয়ে হিজাব পরিধান করা।হাত দু’টোতে রেশমি কাঁচের চুরি।অনুষ্ঠান এখনো শেষ হয়নি।পুতুলের অতিরিক্ত গরম লাগছে তার ওপর মন ভালো লাগছিল না।তাই চলে আসে।কলেজ প্রাঙ্গনে পিছনের দিকটায় এসে দাড়িয়ে রয়।এইদিকে অর্পণের ফোনে জরুরি কল আসে।নিরিবিলি একটুও কথা বলার জন্য কলেজের পিছনে চলে আসে।নিজের ফোনে কথা শেষ করে চলে যেতেই নিলেই আবার চোখের সামনে পুতুলকে হাঁটতে দেখে।ভাবে এটা তার কল্পনা।

নিজের চোখ দুটো হাত দিয়ে চুলকে আবার তাকিয়ে দেখে।না এটা সত্যি। পুতুল এইদিকেই আসছে।পুতুলকে দেখে তার বুকটা ধরপর করে উঠে।বুকের বাম পাশে হাতটা দিয়ে বুকটা শক্ত করে চেপে পালাতে চায়।কিন্তু বেচারা অর্পণ।পালাতে গিয়ে ঠাসস করেই পুতুলের পায়ের সামনেই পরে গেলো।

এইদিকে পুতুল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পরে।চোখের সামনে এমপি সাহেবকে মাটিতে পরতে দেখে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না।পুতুল এগিয়ে আশার আগেই অর্পণ তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে।নিজের হাত দিয়ে পাঞ্জাবিতে থাকা ময়লা পরিষ্কার করতে করতে বলল,

এভাবে তাকিয়ে থাকার মানে কি?জীবনে ছেলে দেখো নিই।এমপি সাহেবের কথায় পুতুল চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রয়।

আবার চোখ বড় বড় করে তাকায়।তুমি কি চোখ দিয়ে ঘায়েল করার ধান্দায় আছো?

পুতুল মাথা নাড়িয়ে না ব’লে।

ওহ বাবা আবার মাথা নাড়িয়ে না বলা হচ্ছে।এই তুমি গ্রাম ছেড়ে এখানে কেনো এসেছো?আমাকে জ্বালাতে,পুড়াতে।তুমি কি বুঝতে পারো না?তোমাকে দেখলেই আমার বুকের ভিতরে অসয্য জন্তনা করে।তুমি আমার সামনে আর কখনোও আসবে না।তোমার জন্য আমাকে পুড়তে হয়।আমি তোমার জন্য আর পুরতে চাই না।দূরে থাকো।স্বামী,সংসার নিয়ে ভালো থাকো।অর্পণ রেগে হনহন করে চলে যায়।পুতুল হা করে তাকিয়ে আছে।এই লোকটা তাকে কি বলল?তার জন্য পুড়ে।কিন্তু কেন?পুতুল আবার কিছু ভাবতে নিলেই অর্পণ তার সামনে আবার এসে দাড়ায়।তার দিকে এক ধ্যাণে তাকিয়ে বলল,

তুমি সত্যি এসেছো?না-কি এটা আমার কল্পনা।যদি কল্পনা হও।তাহলে চোখের সামনে থেকে দূর হও।আমার সামনে আসলেই গুলি করে দিব।

অর্পণ গুলি করে দিবে।এই কথাটা কানে আসতেই পুতুল ঘাবড়ে গেলো।শাড়ির আঁচল ধরে যে পথে এসেছে সেই পথ দিয়ে দৌড়ে চলে যায়।পুতুলের দৌড় দেখে এমপি সাহেব হা করে তাকিয়ে বলল,

এই মেয়ে সত্যি এসেছে।বজ্জাত মেয়েটা আমায় আর শান্তি দিবে না।

১০৮.
অনেকদিন পরে ছেলে নিজ থেকে তাঁকে ফোন করছে ভাবতেই অবাক হয়।অসীম তালুকদার ছেলের ফোন পেয়ে কানে তুলেন।

তোমরা আমার জাত শত্রুর।গ্রামে থাকতে দিবেনা।শহরে আসলেও জ্বালাবা!কেন বাপ?তোমরা আমারে জ্বালানোর জন্য এত উতলা কেন?আমাকে পুড়াতে এত তেল কই পাও?কে দেয় এত টাকা?তোমার বাপ।কিন্তু বুইড়া মরছে উনিশ কটকটি সালে।সে মইরা আমার কপালে তোমারে জুটাইয়া দিয়া গেছে।খবিশ বাপের পোলাটা খবিশ হইছে।তার ঘরে খবিশের বাচ্চা অর্পণ তালুকদার।

এতদিন পরে ছেলে ফোন দিয়েছে।কোথায় সালাম টালাম দিবে।তা না করে কি উল্টাপাল্টা কথা বলছে?অসীম তালুকদার ছেলেকে বলল,

তোমার মাথা ঠিক নেই পড়ে কথা বলো।

আমার মাথা ঠিকই আছে।তোমার ইয়ার গিয়ারে বন্ধুটা কই?তার ছেলেকে বিয়ে করিয়েছে।খুব ভালো কথা।কিন্তু বিদেশে মাটিতে না গিয়ে এখানে কি করছে?

কোথায় আবার চলে গেছে?আর ওর ছেলের বিয়েটা হয়নি।

বিয়ে হয়নি মানে?

হয়নি,মানে হয়নি।অসীম তালুকদার একে একে পুরো ঘটনা বলতেই অর্পণের মনটা খারাপ হয়ে যায়।এতকিছু হয়েছে আর সে জানেই না।পরমুহূর্তেই মুখে হাসি ফুটে।ইয়াহু ব’লে চিৎকার করে উঠে।ফোনের ওপাশে ছেলের হঠাৎ চিতকারে অসীম তালুকদার ভয় পেয়ে যান।বুকে থু থু ছিটান।ধমক দিয়ে বলল,

ইয়ার্কি হচ্ছে।এত সিরিয়াস মোমেন্ট তুমি ফাজলামো কর আমার সাথে।আমি তোমার বিয়াইন লাগি।

আস্তগফিরুল্লাহ।তুমি আমার একমাত্র বাপ লাগো।বিয়াইন হবে কেন?আচ্ছা এখন ফোন রাখছি।পরে কথা বলব।

অর্পণ খুশিতে মনে হয় পাগল হয়ে যাবে।পকেটে ফোনটা রেখে দৌড়ে এদিক থেকে ওদিকে ছুটে যায়।কোথাও পুতুলের দেখা না পেয়ে অনুষ্ঠানে যোগ দেয়।পুতুল এতখন আবৃতি শুনছিল।হঠ্যা অর্পণের চোখে চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে ফেলে।আর অর্পণের ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটে।প্রিয়তমাকে আবার ফিরে পাওয়ার আশায় হাতটা বুকে রেখে দিল।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে