চক্ষে আমার তৃষ্ণা পর্ব-২০+২১+২২

0
366

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-২০
৬২.
ফজরের নামাজ পড়ে জায়নামাজে বসে আছে পুতুল।আজ রাজিয়ার মৃত্যু বার্ষিকী।মানুষটা চলে গেছে কতগুলো বছর চলে গেলো।চোখ বুঝতেই মনে পড়ছে এই তো সেই দিনের কথা।মা তাঁকে নিয়ে মামা বাড়িতে উঠলো।মায়ের সাথে তার কত সুন্দর সুন্দর মূহুর্ত পার হয়েছে।কিন্তু তার ছোট ভাইটা মায়ের ভালোবাসা পায় নিই।ওহ তো জানে না।মা তাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে গিয়ে এই সুন্দর ধরনী ছেড়েছেন।

সকাল বেলা মসজিদ থেকে ফজরের নামাজ পড়ে স্বাধীন বাড়িতে পা রাখে।পুতুল গায়ে চাদর জড়িয়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে।ওড়না দিয়ে মাথা ঢাকা।স্বাধীন এগিয়ে আসে।

আম্মা আপনি নামাজ পড়ে ঘুমাতে যান নাই।
পুতুল মাথা নাড়িয়ে না বলল।চিরকুটটা এগিয়ে দিতেই স্বাধীন অবাক হয়ে হাত বাড়িয়ে নিলো।চিরকুটটা খুলতেই ছোট হাতের কিছু অল্পস্বল্প লিখা।স্বাধীন লিখাটুকু পড়ে পুতুল দিকে তাকায়।

আম্মা আপনি মনে রাখছেন এই দিনটার কথা।
আমি তোও মনে করছিলাম আপনি ভুইলা গেছেন।তাই ফজরের নামাজ পড়ে বোনের কবর জিয়ারত করে আসছি।পুতুল ঢোক গিলে মুখ দিয়ে শব্দ বের করা চেষ্টা করে।উ..উ… ছাড়া আরো কোনো শব্দ বের হয়না।কথা বলতে না পেরে ফুফিয়ে কেঁদে ওঠে।স্বাধীন,পুতুলের দুই চোখের পানি মুছে,তার বুকে মাথাটা রেখে জড়িয়ে মাথায় হাত ভুলিয়ে দিতে দিতে বলল।

আম্মা কাঁদে না।চুপ থাকো।আমি তোমারে নিয়া যাইতাছি।

কবর ওপর কয়েকটা ফুল ফুটে আছে,দূর্বলা ঘাস বেশ বড় বড় হয়েছে।পুতুল কবরস্থানের ভিতরে যেতে পারেনি।মেয়েদের কবরে সামনে যেতে নেই।বড় গেইটে সামনে দাঁড়িয়ে দূর থেকে ছাপসা চোখে তাকায়।চোখের পানি টইটম্বুর হতেই দুই হাতে মুছে নিলো।ওই যে,তৃতীয় স্থানে তার মায়ের কবর রয়েছে।তার মায়ের পাশে সারি সারি অনেক কবর রয়েছে।কার প্রিয়জনেরা এখানে কবরে ঘুমিয়ে আছে জানে না।শুধু জানে তার অতি প্রিয় একটি মানুষ এখানে এই কবরে শায়িত।
তার জনম দুঃখী মা।পুতুল গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে মোনাজাত ধরে দুই চোখের পানি ছেড়ে দিল।মোনাজাত শেষে মাটিতে বসে পড়ে।লোহার গেইট হাত ঢুকিয়ে ডাকবার কত আকুতি।তার মা আজ পুতুলের ডাকে সারা দেয় না।যেমন পাঁচ বছর আগে করেছিল।এভাবেই ঘুমিয়ে ছিল বাড়ি উঠোনে।কত ডেকেছে।কিন্তু চোখ মেলে বলে নিই।

পুতুল মা আমার,এই তো আমি।কান্না করে না।তুমি আমার লক্ষ্মী মা।মায়েরা কি কান্না করে?পুতুলকে তার মা আজ-ও আগের মতো হেঁটে এসে বুকে টেনে নেয় নিই।সাদা কাপড় পরে তার মা পর হয়ে গেছে।মায়েরা এত নিষ্ঠুর কেন?তাদের বুকে ধন,তাদের সন্তান ছেড়ে কি করে ঘুমিয়ে আছে এই মাটির কবরে।একটিবার কি মনে পড়ে না সন্তানের কথা?জানতে পারে কি?মা বিহীন এতিম সন্তানগুলো দুনিয়ার মাটিতে কি করে একলা রইবে?স্বাধীন,পুতুলের কান্না দেখে নিজের চোখের পানি লুকিয়ে এগিয়ে আসে।

আম্মা বাসায় চলো।সকাল হয়েছে অনেকক্ষণ।তুমি বাসায় নেই।মিলন,সাজু খুঁজবে তোমায়।চল আম্মা।পুতুল স্বাধীনের কোনো ডাকে সারা দেয় না।স্বাধীন,পুতুলের মাথায় হাত দিতেই চমকে উঠে।পুতুল মায়ের শোকে অজ্ঞান হয়ে গেছে।জ্ঞান নেই।স্বাধীন তারাতাড়ি বাসায় দিকে ছুটে।তার মায়ের মৃত্যু যেইদিন হয়েছিল।মায়ের লাশ কবর দেওয়ার জন্য নিয়ে গেছিলো,এমনভাবে পুতুল অজ্ঞান হয়ে ঘরে কোণে পড়ে থাকে।কেউ জানতে পারেনি এতিম মেয়েটির ওপর কি যাচ্ছে?মামা,বোনকে বিদায় দিতে কবরে নিয়ে গেছে। কি অদ্ভুত তাই না?আমাদের আপন মানুষগুলো একদিন আমাদের কবরে রেখে আসবে।যেমন রাজিয়া বেলায় স্বাধীন ভাই হয়ে রেখে এসেছিল।ঠিক তেমনিভাবে আমার,আপনার।এবং আমাদের সকলের আপনজনেরা এভাবেই একদিন কবরের মাটিতে শায়িত করবে।সেইদিন চিতকার করে বলা হবেনা।তোমরা আমাকে এই মাটির ঘরে রেখে যেওনা। আমি তোমাদের সাথে থাকতে চাই।মা,বাবা,ভাই তোমরা নিয়ে যাও আমায়।আমি একা থাকতে খুব ভয় পাই।যখন দেখবে প্রিয় মানুষগুলো তোমার ডাকে সারা
দিচ্ছে না।তারা কাঁদবে।আহাজারি করতে করতে চলে যাবে।তোমায় রেখে যাবে সাড়ে মাটিতে।

৬৩.
ডাক্তার সাহেবা পুতুলকে কেমন দেখলেন?

দেখুন স্বাধীন সাহেব!মেয়েটি মা হারিয়েছে। হঠ্যাৎ শকটটা নিতে সে পারেনি।আপনার কথা অনুযায়ী এমন ঘটনা আগে ওহ একবার হয়েছে।ঘন্টা পর ঘন্টা জ্ঞান ছিলো না।আজ আবার সেই মায়ের সঙ্গে দেখা করা থেকে শুরু করে পুরনো কথা মনে পড়া।

এতটুকু বাচ্চা মেয়ে।যে বয়সে তার মা,বাবার সাথে থেকে হেসে খেলে সময়গুলো কাটানোর কথা।সেখানে মনের মাঝে পুরনো ক্ষত ঘা রয়েছে।তার ওপর মা হারা সন্তান।বাবা নেই।মানসিক অবস্থা তার কতটুকু ভালো থাকতে পারে বলতে পারেন।আমি জানি আপনি ওকে ভালো রাখার চেষ্টা করেছেন। এবং এখনও করছেন।এতে কোনো ত্রুটি রাখছেন না।পুতুলকে দেখে যতটুকু ধারণা করছি।মেয়েটি ভিতরে ভিতরে গুমরে মরছে।আপনার চোখের সামনে থাকলে হয়তো খারাপ কিছু হচ্ছে না।কিন্তু আপনার চোখের বাহিরে এমন কিছু ঘটেছে বা ঘটছে।যা আপনি জানেন না।সেটা হতে পারে বাড়ি কিংবা বাড়ির বাহিরে।আবার স্কুলের কোনো ব্যাপার নিয়ে ওহ হতে পারে।আশা করব চোখ,কান খোলা রাখবেন।মেয়েটি মা,বাবা নেই।আপনি একমাত্র শেষ ভরসা।আপনার কিছু হয়ে গেলে মেয়েটি ভবিষ্যত খুব একটা সুখের হবে ব’লে আমার মনে হয় না।নিজে সর্তক থাকুন।আর মেয়েটিকে নিরাপত্তায় জোরালো করুণ।হয়তো আপনার চোখ সহজেই কিছু ফাঁকি দিতে পারবে না।

ডাক্তার তার কথা শেষ করে অন্য রোগী দেখতে চলে গেলো।স্বাধীন চিন্তায় পরে যায়।

অসীম তালুকদার সকাল আটটা বাজে বাসায় আসেন।বাড়িতে ঢুকতেই শুনতে পায় তার গুনধর ছেলে কাউকে কিছু না ব’লে হুট করে চলে গেছে।এটা শুনে চিতকার করতে শুরু করেন।

এটা কেমন ভদ্রতা?কাউকে কিছু না ব’লে চলে যাওয়ার মানে কি?কালকে এসেই আজকে হাওয়া।ফাজলামো হচ্ছে না কি?

জিহান,রিহান দুই ভাই একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।যার মানে তারা কিছুই জানে না।অর্পণ হঠাৎ চলে গেলো কেন?কথা ছিল আরো বেশ কয়েকদিন এখানে থাকবে।কিন্তু হঠাৎ এভাবে চলে যাওয়া।

সাফিন ফোন লাগাও গুণধরকে।দেখো সে কোথায় আছে?সাফিন তালুকদার ভাতিজাকে ফোন দিচ্ছেন।কিন্তু অর্পণ ফোন তুলে নিই।দ্বিতীয়বার ফোনে রিং হওয়ার মাঝেই ফোন বন্ধ আসে।যার মানে সে ফোন বন্ধ করে দিয়েছে।অসীম তালুকদার রেগে যান।

এ’কে নিয়ে কি করব আমি?সব সময় দুই ভাইকে নিয়ে যতসব উল্টা পাল্টা কাজ করে।আমার মান সম্মান কিছু রাখেনি।আজ আবার তাদের ওহ সঙ্গে নেয়নি।বাহা..বা কি গুণধর সু পুত্র আমার?

আপনি সব সময় আমার ছেলেটার পেছনে লেগে থাকেন।একবার বাবা হয়ে তাকে বুঝতে চেষ্টা করেছেন।করেন নিই।তা করবেন কেন?আপনি কথায় কথায় বকাঝকা এবং মাঝে মধ্যে গায়ে হাত তুলেন।আমি মা।তাই সন্তানের কষ্ট বুঝতে পারি।আমার সোনা বাচ্চা ছেলে কে নিশ্চয় কিছু ব’লেছেন।তাই কষ্ট পেয়ে সে বাড়ি ছেড়েছে।

অসীম তালুকদার বউকে কিছু না ব’লে হনহন করে দুতলা নিজের রুমে চলে যান।এই মা,ছেলে তাকে পেয়েছে কি?যখন যা করবে মেনে নিবে!

৬৪.
বিকাল বেলা সবুজ ঘাসের বুকে সূর্যের মতো লাল।শেফালী ঘাসে দেপান্তরে মাঠ।অর্পণ বাইকের সাথে পা ঝুলিয়ে বসে আছে।ফোনটা ইচ্ছে করে বন্ধ রেখেছে।আজ সকালে ঘুমটা ভেঙে গেছে।দ্বিতীয় বার চোখে ঘুম আসেনি।বাড়ি থেকে হঠাৎ চলে আসছে।কাউকে কিছু জানা নিই।তার বাপ হয়তো তার চলে যাওয়ার খবর এতক্ষণে পেয়ে গেছে।

অর্পণ তুই এখানে? বাসায় থেকে চলে আসছি কেন?

ভালো লাগছিলো না।তাই ঢাকায় ব্যাক করেছি।পরীক্ষা সামনে।পড়তে হবে।চল হোস্টেলে ফিরে যাই।

তুই পড়ার জন্য চলে আসছি। বিশ্বাস হয় না।

এতে বিশ্বাস করার কিছু নেই।চল।অর্পণ বাইকে উঠে পড়ে।মাহিম বলল,

তুই যা আমি তোর পিছনে আছি।

ওকে।

অর্পণ বাইক টান দিতেই।মাহিম ফোন লাগায় অসীম তালুকদার কে।

আসসালামু আলাইকুম।স্যার,অর্পণকে পেয়ে গেছি।অর্পণ ঢাকায় ফিরেছে।

ওল্লাইকুমুস আসসালাম।ওর দিকে খেয়াল রেখো।অসীম তালুকদার কান থেকে ফোন নামিয়ে রাখেন।একটা মাএ ছেলে।ওর কিছু হয়ে হয়ে গেলে সে বাঁচবে কি নিয়ে?বাবা হয়ে বন্ধুর মতো কখন ছেলের সাথে আচরণ করতে পারেনি।সবসময় গুরু গম্ভীর ভাব মুখে ধরে রাখেন।তিনি ভয় পান।তার অতি আদরে বাঁদর না হয়ে যায়।আর সেই ভয়ের জন্যই ছেলেকে বুকে অবধি জড়িয়ে ধরেন না।রাবেয়া জরায়ুতে টিউমার হয়েছিল।অপারেশন করে ফেলতে হয়েছে।দ্বিতীয় সন্তানের আশা তিনি আর করেন নিই।তার মা,বাবা অপারেশন কথা শুনে নারাজ হলেও ছেলের জন্য বউকে কিছু বলতে পারেনি।তার ওপর পুত্র সন্তান আগেই জম্ম দিয়েছে।হয়তো এরজন্য রাবেয়া প্রতি সন্তুষ্ট প্রকাশ করেন।অথচ অসীম তালুকদারের ঘর আলো করে যেইদিন অর্পণ আগমন ঘটে।অসীম হাসপাতালে দাঁড়িয়ে ব’লেছিল।

ডাক্তার এটা আমার মেয়ে।অসীম তালুকদারের মুখে হাসি লেগেছিল।

মিস্টার তালুকদার আপনার কন্যা সন্তান নয়।পুত্র সন্তান হয়েছে।অসীম তালুকদার অবাক হয়ে যান।ভাবেন।ডাক্তার মিথ্যে ব’লেছে।তাই তোয়ালে থাকা হ্রদ পুষ্ট সন্তানকে চেক করেন।
মেয়ের আশায় যে বাবা বসেছিল।তার পুত্র হয়েছে।যার ভয়ে বউকে আল্টাসোনোগ্রাফি পর্যন্ত করতে দেন নিই।দ্বিতীয়বার বাচ্চার জন্য চেষ্টা করলে জানতে পারে তার স্ত্রী আর কখনো মা হতে পারবে না।তিনি নারাজ হননিই।বরং ছেলেকে দুই হাতে আগলে নেন।দুই বছর পর্যন্ত ছেলে তার কাছে আদরে মানুষ হয়েছে।তারপরে নিজের কাজের জন্য দেশে বাহিরে দিনের পর দিন থাকতে শুরু করে।তখনই ছেলে মায়ের সঙ্গে বেশ মানিয়ে বড় হয়ে উঠেছে।নিজের হুস জ্ঞান বলতে তার মায়ের আঁচল তার প্রিয় হয়ে যায়।আর বাবা সম্পর্কে হয়ে ওঠে একজন শক্ত কঠোর পুরুষ।বাবারা রাগী হয়।তারা কঠোর হয়।তারা কখনোই নরম হয় না।বাবা হয়ে সন্তানের সাথে নরম আচরণটা এখন সময়ের সাথে আসে না।ছেলে বড় হচ্ছে।আর তার মাথার টেনশন বাড়ছে।এলাকায় উল্টা পাল্টা কান্ড ঘটানো থেকে শুরু করে সব কাজ করতে শুরু করেছে।তার সুনামে অসীম তালুকদারের পেট মোচড় মারে।অসীম তার ইহ জম্মে করেন নিই।তা ছেলের দ্বারা অসম্ভবকে সম্ভব করে ছেড়েছে।

চলবে….

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-২১
৬৫.
রাতে বিদ্যুৎ নেই।পুতুল হাতপাখা দিয়ে দুই ভাইকে একটু পর পর বাতাস করছে।বারবার হাত পাখা চালানোর জন্য হাত ব্যাথা হয়ে যায়।পুতুল হাতপাখা নামিয়ে রাখে।

আপু গরম লাগছে।মশা কামড়ায়।
পুতুল কি করবে বুঝতে পারছে না?শীতে কারেন্ট যায় না।গরমের সময় এত জ্বালিয়ে মারে কেন?শীতের সময়টাতে ঠান্ডা কাঁপন ধড়িয়ে দেয়।এক দিক শান্তি লাগে,কারেন্ট নিয়ে প্যারা হতো না ব’লে।আর এখন বিরক্ত লাগছে।কারেন্ট নেই ব’লে।

সময়টা চৈত্র মাস চলছে।দিনের বেলা কাঠ ফাটাঁ রোদ মাথার ওপর থাকে।রাতের বেলা ভ্যাপসা গরমে জান প্রায় শেষ।কপালের ঘাম মুছে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।কিছু কয়লা মাটির হাড়িতে তুলে নেয়।কাগজ পুড়ে ধোঁয়া দিতে থাকে।এতে যদি মশার উত্তপাত কমে।

একে তো গরম,তার ওপর নতুন পাতার সঙ্গে ঝরে পড়া পাতার বিরহবিচ্ছেদ।কেমন একটা রুক্ষ রুক্ষ ভাব!এই যেমন আজকের চৈত্রদিন।দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো।বাইরে ঝিঁঝিপোকার ডাক।তেতে ওঠা রোদ ছিলো। লু হাওয়া বলতে যেমন বোঝায়,তেমন এক গরম বাতাস ঢুকে পড়েছে ঘরের ভেতর। জানালার ওপাশে স্তব্ধ হয়ে আছে আম, কামরাঙা,জারুল,দেবদারু গাছের সারি। প্রত্যেকের গায়ে যেন লেগে আছে নোনতা বুনো গন্ধ।

আপু মশা কমে গেছে।কারেন্ট নেই।পড়া নেই।চলো না আমার বাড়ির উঠোনে খেলতে যাই।পুতুল ইশারায় বলল কি খেলতে চাও?মিলন গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগল।ভেবেই যাচ্ছে।এই ভাবার শেষ হয় না।পুতুল,ভাইয়ের গাল থেকে হাত নামিয়ে দিলো,

আপু জুতা চুরি খেলি।পুতুল মাথা নাড়িয়ে না বললো।

তাইলে হাঁড়িপাতিল দিয়ে খেলি।আচ্ছা এটা বাদ।চল কাগজের নৌকা বানিয়ে পানিতে ভাসিয়ে দেই।

সাজু বিরক্ত হয়ে বলল,

দূর কি কস?এসব বাদ।নাটায় নিয়ে ঘুড়ি উড়াইয়া আসি।মিলন চোখ ছোট্ট করে বলল,

বলদ,রাইতের বেলা কি ঘুড়ি উড়াবি?চোখে তোও দেখবি না?এখন এক চোখ কানা।পরে দেখবি দুই চোখ কানা হইয়া গেছে।

তাইলে তুই বল,কি খেলবি?

একাধক্কা খেলি।

না।

বরফপানি।

না।

মারবেল দিয়ে খেলি চল।

না।

লাটিম ঘুরানো।

না।

ক্রিকেট খেলি।

না।

ফুটবল!

না।

তুই চুপ থাক বানরের নানা ভাই।সব কিছুতেই খালি না,না করে।

আপু এখন তো গরম পড়ছে।তাইলে পুকুরের ঘাটে পিছলা বানিয়ে সিলিপ কাটি।পানিতে গোসল হলো।আর মন ঠান্ডা হবে।পুতুল সাজুকে না বললো,হাতের ইশারার লুকোচুরি খেলতে চায়।যেহেতু রাত,এটাই সঠিক সময়।বাড়ির বাহিরে যেতে হলো না।খেলতে সুবিধা হলো অন্ধকারের জন্য।এতে মিলন,সাজু সায় দিলো।

৬৬.
পাট ক্ষেতে ছাগল বন্দি।
জলে বন্দি মাছ।
সখা গোও…আমার মন বালা না।

কিছু পুরুষ চিকন চাকন,কিছু পুরুষ বুড়ি ওয়ালা।
টাকা পয়সা থাকলে বেশি।তারা বউ পায় ভালা।
সখা গোও…. আমার মন ভালো না।

কে আমার আব্বার মন খারাপ করলো?কিসের জন্য মন ভালা না আব্বা?বউ লাগবো।

চোখের সামনে বাবাকে দেখেই জিহ্বা কামড় দিলো।উল্টো পথে পালানোর চেষ্টা করলে স্বাধীন ধরে ফেলে।সাজু ভীতুর মতো বলল,

আব্বা ছাড়ো।আর গাইতাম না।

আচ্ছা গাইবেন ভালা কথা।কিন্তু এমন অদ্ভুদ গান কোথা থেকে শুনলেন?না ব’লে কিন্তু ছাড়বো না।

ওই মফিজ মামা থেকে।

এই মফিজ কে?

এইপার থেকে ও-ই পারে নিয়ে যায়।নৌকায় করে সেই মফিজ মামা।সে বৈঠা বাইতে বাইতে বলতো।আমি শুনতেই মুখস্থ করেছি।

আজকের পর যেনো এমন গান গাইতে না শুনি।শুনলে কিন্তু গালটা শক্ত করে টেনে লাল করে দিবো।মনে থাকবে।

সাজু মাথা নাড়িয়ে বলল,

আচ্ছা।

স্বাধীন ছেড়ে দিতেই দৌড়ে পুকুর পাড়ে গিয়ে বসে পড়ে।মিলন বরশি দিয়ে মাছ ধরতে বসেছে।হাতে আছে টসটসে লাল পেয়ারা।সাজুকে এইদিকে আসতে দেখে পেয়ারা কামড় বসিয়ে দিলো।

কি’রে বাঁদরের নানা ভাই।তোর আবার কি হইলো?

কিছু না।

কিছু না হইলে এমন ভ্যাটকা মাছের মতো ভ্যাটকাইয়া আছোত কেন?

কই ভ্যাট কাইলাম?

তোর বাঁদর মুখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে।তুই পেঁচা।

আমি পেঁচা হলে তুই কি?

আমি সুন্দর।

তুই সুন্দর।

হুম।আপু বলছে।

আপু সুন্দর তাই আপুর চোখে সব সুন্দরই লাগে।তুই তোও বাঁদরের ভাই বাঁদর!

কি আমি বাঁদর?তবে রে সাজুর বাচ্চা।আজকে তোর একদিন কি আমার একদিন।মিলন পুকুরের কাঁদা মাটিতে হাত দিয়ে কাঁদা মাটি উঠিয়ে সাজুর মুখে ছুঁড়ে মারে।মিলন দেখাদেখি সাজু ওহ কাঁদা ছোড়াছুড়ি শুরু করে।পুতুল পুকুর পাড়ে গিয়ে দেখে মিলন,সাজু কাঁদা দিয়ে ভূত সেজে আছে।পুতুল দুই ভাইয়ের কান্ড দেখে হাসতে থাকে।পুতুলকে হাসতে দেখে দুই ভাই গাল ফুলিয়ে দুইদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকে।

আপু আজকে হাঁসের পুটকি খাইছে।তাই বেশি বেশি হাসতাছে।সাজু’র অদ্ভুত কথায় মিলন রেগে এক ধাক্কা দিলো।মিলন হঠাৎ করে ধাক্কা দেওয়া সাজু পানিতে পড়ে গেলো।

কি কস এগুলো?বাঁদরের নানা ভাই।চুপ থাক।সাজু কোমড় সমান পানিতে পড়ে হা করে তাকিয়ে রয়।মিলন রেগে পুকুরের পানির একটু ওপরে বড় কাঁঠাল গাছে বসে পড়ে।পা পানিতে নামিয়ে দেয়।পুতুল দুটোকে এত ডাকছে তবুও কোনো সাড়া দিচ্ছে না।পুতুল এদের সাথে না পেরে মামাকে ডেকে পাঠায়।

৬৭.
পুতুল পড়াশোনা পাশাপাশি নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে।বাসায় নকশিকাঁথা সেলাই করে।সেগুলো আবার বাজারে বিক্রি হচ্ছে কম দামে।ন্যায্য পাওনা সে পাচ্ছে না।তবুও যা হচ্ছে সে তাতেই খুশি।সামনে শীতের জন্য হয়তো চাহিদা বাড়বে।অর্ডার আরো বেশি আসবে।

‘নকশি কাঁথা’ শব্দের প্রচলন হয়েছে। কাঁথাকে খেতা,কেন্থা ইত্যাদি নামেও অভিহিত করা হয়।

কাঁথা তৈরি হয় সাধারণত পুরনো কাপড়, শাড়ি,লুঙ্গি দিয়ে।সাধারণ কাঁথা বছরের সব সময়ই ব্যবহূত হতে পারে,কিন্তু নকশি কাঁথা বিশেষ উপলক্ষে ব্যবহূত হয় এবং তা পুরুষানুক্রমে স্মারক চিহ্ন হিসেবে সংরক্ষিত থাকে।ভারতের বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের কোনো কোনো অঞ্চলে এ ধরনের কাঁথাকে বলে শুজনি। প্রয়োজনীয় পুরুত্ব অনুযায়ী তিন থেকে সাতটি শাড়ি স্তরীভূত করে সাধারণ ফোঁড়ে কাঁথা সেলাই করা হয় এবং সেলাইগুলি দেখতে ছোট ছোট তরঙ্গের মতো। সাধারণত শাড়ির রঙিন পাড় থেকে তোলা সুতা দিয়ে শাড়ির পাড়েরই অনুকরণে নকশা তৈরি করা হয়। তবে কাপড় বোনায় ব্যবহূত সুতাও কাঁথার নকশা তৈরিতে ব্যবহূত হয়, বিশেষত রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে।

আম্মা।পুতুল হাতের নকশিকাঁথা পাশে রেখে মাথা তুলে।

আম্মা এভাবে আপনি কিছুই করতে পারবেন না।নকশিকাঁথা কাজ করছেন ঠিকই।কিন্তু পারিশ্রমিক হিসেবে যেটা আপনার পাওয়ার কথা।সেটা আপনি পাচ্ছেন না।তাই আমি চাইছি।আপনার এই হাতের কাজ গ্রামের এই ছোট্ট ঝুপড়ি ঘরে আটকে না থাকুক।গ্রামে গঞ্জে এটার সীমাবদ্ধ না হোক।তাই আমি চাই আপনার তৈরি করা কাজগুলো ঢাকায় যাক।ঢাকায় এর চাহিদা ব্যাপক।আবার শুনছি।বিদেশের মাটিতে এই নকশিকাঁথা না-কি বিক্রি করা যায়।বিদেশে একবার আপনার হাতে কাজ পৌঁছে গেলে।আপনি ভাবতে পারছেন চমৎকার সময় হাতে চলে আসবে।মামা কথায় পুতুল নিজের হাতের কাজে চোখ বুলিয়ে নেয়।তার তৈরি করা কাজগুলো কি একদিন সারা বিশ্বের কাছে পৌঁছাবে।এটা কি সম্ভব?বার্মন হয়ে আকাশের চাঁদের দিকে হাত বাড়ানোর মতো ব্যাপারটা।প্রত্যাশার থেকে যদি বেশি হয়ে যায়।ভয় হয়।সে কি পারবে নিজের জন্য একটা আলাদা পরিচয় করতে?পুতুলকে চুপচাপ থাকতে দেখে স্বাধীন হাটু গেড়ে পুতুল মাথায় হাত রাখে।

আম্মা আপনি এত চিন্তা কেন করেন?রিজিক এর মালিক আল্লাহ।তিনি আমাদের জন্য যা ঠিক করে রাখছেন তাই হবে।এত ভেবে কাজ নেই।আপনি হ্যা ব’লে দিন।বাকিটা আমি করে নিবো।

পুতুল মাথা উঁচিয়ে ইশারায় বলল,

মামা তুমি কিভাবে কি করবে?ঢাকায় কাউকে যেতে হবে।আর নয়তো কাউকে আনতে হবে।কাউকে রাখার মতো সামর্থ্য আমাদের নেই।

আম্মা আপনি চিন্তা কইরেন না।ঢাকায় মাসে আমি একবার যাব।আমি হব আপনার হ্যাল্পার।আমিই করব সব।পুতুল সাহস করে কিছু বলতে পারছেনা।তবুও কোনোমতে মত দিল।এখন দেখা যাক কি হয়?

বাড়ির সামনে দিয়ে গান বাজিয়ে ছুটে চলছে একজন লোক।পুতুল,স্বাধীন সে দিকে তাকাতেই দেখলো।মিলন,সাজু কিছু কাঁচা পয়সা দিয়ে বরফ জাতীয় কিছু চেটেপুটে খাচ্ছে।পুতুল এসব চিনে না।কিন্তু স্বাধীন তার
শৈশবের সেই পুরনো সৃতিতে ডুবে গেলো।সে ওহ এক সময় ছুটে যেতো বরফকলের কাছে।চার আনা,আট আনা পয়সা দিয়ে কিনে খেতো সাদা বরফ, লাল-সবুজ আইসক্রিম অথবা নারকেল-পাউরুটি দেওয়া মালাই।হিম হিম ঠান্ডায় জুড়িয়ে যেত শরীর।চৈত্র মাসে যাঁরা রোজা রাখার অভিজ্ঞতা পেয়েছেন,তাঁরা জানেন ইফতারিতে লেবুপাতার গন্ধ,চিনি আর বরফ দেওয়া শরবতের স্বাদ কত মধুর হতে পারে! মাথায় ঘোল ঢালা নিয়ে যতই হাসাহাসি করি না কেন,এক শ,দেড় শ বছর আগে চৈত্র–বৈশাখের তীব্র গরমে ঘোল আর মাঠাই ছিল পরম বন্ধু।স্বাধীন এগিয়ে গিয়ে সাজু,মিলনের হাতে সবুজ,গোলাপি মিশ্রনে বরফি তুলে দিলো।সাজু,মিলন নিজেদের তুই হাতেরগুলো চেটেপুটে খাচ্ছে। পুতুল,রেনু,আর নিজের জন্য নিয়ে বাসায় যায়।মামার খাওয়ার ধরণ দেখে পুতুল মুখে দিলো।গরমের দিন এমন বরফিটা মুখে দিতে বেশ লাগছে।খাবারটা ভীষণ মজা।স্বাধীন,রেনু নাম ধরে ডাকতেই বের হয়ে আসে।একসাথে পরিবারের সবাই মিলে বারান্দায় বসে খেতে লাগলো।সবার ঠোঁটগুলো বিভিন্ন রঙের হয়ে আছে।একে অপরের দিকে তাকিয়ে সবাই একসাথে হেঁসে উঠে।শৈশবগুলো মিষ্টি স্মৃতিবিজড়িত দিনগুলো ভীষণ ভাবে মনকে নাড়া দিয়ে যায়।

শৈশবের সেই দিনগুলি,
ফিরবে না হায়।
শত কাজের ফাঁকেও,
এ মন,ছুটে যায়।

চলবে…..

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-২২
৬৮.
স্বাধীন আজ ঢাকায় যাচ্ছে।পুতুল এই চারমাসে দিন রাত পরিশ্রম করে। নকশিকাঁথায় সুই সুতার সাহায্যে একেক রকমের নকশা করেছে।যেগুলো দেখলেই দুই চোখ শীতল হয়ে যায়।মেয়েটা রাতের অর্ধেকটা সময়-ই খেটেছে।জানি না।ঢাকায় এগুলো নিয়ে গেলে আদোও বিক্রি হবে কি না?তবুও এক বুক আশা নিয়ে পরিবারের সকলের থেকে বিদায় নিয়েছে।বিসমিল্লাহ ব’লে বাড়ি ছেড়ে ঢাকাগামী জন্য ট্রেনে উঠে পড়ে।এই ট্রেন ঢাকা কমলাপুর রেলস্টেশনে থামবে।তারপর পুতুলের তৈরি কাজগুলো ঢাকায় ছড়িয়ে দেওয়ার পালা।ফুটপাতে হকারদের মতো স্বাধীনও হকারগিরি করতে নেমেছে।

শহরের পাকাঁ রাস্তার কিনারে জনসমাগমপূর্ণ স্থানে ফুটপাতে বসে এই বেচা কেনা।স্বাধীনের মতো অনেক হকারদের দেখা মিলছে।যারা ভ্যানগাড়িতে করে বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করছে।অনেকে মাথায় থাকা ছোট টুকরিতে ফেরি কিংবা ছোট খাটো দোকানে বিক্রি করে।গ্রীষ্মের রৌদ্র এবং বর্ষার বৃষ্টি হাত থেকে বাঁচতে বড় ছাতা নিচে আশ্রয় কিংবা বড় পলিথিনের আবরণ ব্যবহার করে।অল্প বয়সী কিশোর ছেলেদের হকারগিরি করছে।কেউ ফুচকা,চটপটি,গুমলি পুড়ি বিক্রি করছে।কেউবা আবার চা,পান,সুপারি,সিগারেট বিক্রি করছে।এদের আয় দৈনিক ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা।দৈনিক বেচা কেনা ভালো হলেই হয়।আর যদি ১৫০থেকে ৩০০ টাকা না হয়।তাহলে বাঁচার লড়াইটা কষ্টে হয়ে ওঠে।তাদের থাকতে হয় এই ঢাকা শহরের অলিগলির রাস্তায়।আজ এই ঢাকার বুকে স্বাধীন ফুটপাতের রাস্তায় বিছানা পেতেছে।বেচাকেনার প্রথম দিনটা ভালো হয়নি।তবুও আশা রাখছে নতুন সকালে হয়তো ভালো কিছু হবে।চোখের পাতা জোড়া বুঁজে নিলো।ওইদিকে তার পরিবার কি করছে জানা নেই?

পুতুল রাত জেগে পড়ছে।সামনে তার পরীক্ষা।সময় খুব একটা নেই।চারমাস নকশিকাঁথার কাজের জন্য সময় দিয়েছে।পড়াশোনা এতটা মনযোগী ছিলো না।যার জন্য অনেক পড়া গুলিয়ে বসে আছে।তবুও আবার রিভিশন দিচ্ছে।পরীক্ষা কোনো ভুল করতে সে চায় না।তার রেজাল্ট খারাপ হলে মামার উচু গলায় বলা কথাগুলো মিথ্যে হয়ে যাবে।তার জন্য মামা কম কষ্ট করেনি।এখনও করে যাচ্ছেন।আর সেই মামা মান রাখতে হলেও তাকে প্রত্যেকবারের মতোও এবারও ভালো রেজাল্ট করতে হবে।

রেনু ঘরে আলো জ্বালিয়ে ছোট ছেলেকে বুকে টেনে নিয়ে বসে আছে।

কি করছে মানুষটা?কি খেয়েছে?কোথায় থাকছে কে জানে?একটু যোগাযোগ করতে পারলে শান্তি লাগতো।স্বামীর চিন্তায় রাতে তার গলা দিয়ে ভাত নামে না।বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও কখনো একটা রাত দূরে থাকেনি।দিনে যতই কাজ থাকুক না কেনো?সেই কাজ শেষ করে ঠিকই সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে আসতো।মানুষটাকে ছাড়া কোনোদিন একা খাবার খায়নি।আজ সে নেই।একা এই ঘরটায় দম বন্ধ হয়ে আসছে।আল্লাহ তুমি কি আমার ডাক শুনতে পাচ্ছো।আমার স্বামী যেখানে থাকুক না কেন?তাকে তুমি ভালো রেখো।তার ভালোতেই আমার সুখ।সে গ্রামে কিংবা শহরে যেখানে রয়েছে।তাকে সুস্থ রেখো।তিনি বিহীন আমরা এতিম।তিনি ছাড়া আমি,আমরা কেউ ভালো থাকব না।তিনি আমাদের বেঁচে থাকার শেষ সম্বল।সেই সম্বলটুকু তোমার ভরসায় ওতো দূর দেশে পাঠালাম।আল্লাহ আমার স্বামীকে তুমি দেখে রেখো।তুমি ছাড়া আমার কারো কাছ থেকে কিছু যাওয়ার নেই।তুমি আমাদের রব।বিপদ আপদে তোমার কাছেই ছুটে যাওয়া।তোমার নামে সেজদা দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া।ওহ আল্লাহ তুমি মুখ ফিরিয়ে নিলে আমরা তোমার বান্দা যাব কোথায়?আল্লাহ তুমি তোমার প্রিয় বন্ধু হযরত মোহাম্মদ (সা:) উছিলায় আমাদের হেদায়েত পথে চালিত কর।আমরা শেষ নবীর উম্মত।আমাদের মতো এতো ভাগ্য ভালো আর কখনো কারো হয়নি।দরজার ওইপাশে দাঁড়িয়ে পুতুল মামীর সব কথা শুনতে পায়।এত রাতে মামীর ঘর থেকে কান্নার শব্দ পেয়ে ছুটে আসে।হালকা করে দখিনা দুয়ার ধাক্কা দিতেই মামীকে জায়নামাজে মোনাজাত অবস্থায় দেখতে পায়।পুতুল নিজের কান্না সংযত করে।দূয়ার চাপিয়ে চলে যায়।

৬৯.
প্রতিদিনের মতো সূর্য পূর্বে দিকে উঠেছে।ভোরে মোরগ ফজরের আজান শেষ হতেই ডাকতে শুরু করেছে।পুতুল ঘর ছাড়ু দিয়ে উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছে।মামী চুপচাপ হাড়িতে রান্না বসিয়েছে।প্রতিদিনের মতো আজ রান্না ঘর থেকে মামী কোনো ডাক দেয় নিই।ডেকে বলেননি,পুতুল এটা দিয়ে যা ওটা দিয়ে যা।কাজের সময় হাতের কাছে কিছু পাচ্ছি না।কোথায় কি রাখিস?এখন এক একটা খুঁজে পাওয়া যায় না।

মিলন,সাজু ঘুম থেকে উঠে পড়েছে।বাড়িতে আজ কেমন নিঃশতব্দো।প্রতিদিনে মতো ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদে যায়নি।বাবা নেই বলে।পুতুল আপু বাড়িতে নামাজ পড়িয়েছে।মা কেমন চুপচাপ?ছোট ভাইটা প্রতিদিনের মতো কান্না করে বাড়ি মাথায় তোলেনি।সেও কেমন ভদ্র হয়ে গেছে।হাত,পা নাড়িয়ে খেলছে বাড়ির বারান্দায় ছোট খাটে।হয়তো সে ওহ বুঝে গেছে বাবা বাড়িতে নেই।মায়ের মন খারাপ।একটু প্যা পু করলেই পিঠে মার পরতে পারে।তাই শান্ত সৃষ্ট হয়ে আছে।কিন্তু বড় দুই ভাই।মিলন,সাজু কি শান্ত থাকবে? মোটেই না।কলপাড়ে হাত মুখ ধুতেধুতে বলল কি কি করবে সারাদিন?স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে চলবে তাদের বিশেষ শলাপরামর্শ আয়োজন।

রেনু খাবার বেড়ে দিতেই মিলন,সাজু চুপচাপ খেয়ে উঠে পড়ে।রেনু আড়চোখে পুতুল প্লেটে তাকায়।

কি হলো?তুমি খাচ্ছ না কেন?খাবার পচ্ছন্দ হয়নি।

পুতুল মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো।যার মানে তার খাবার পচ্ছন্দ হয়নি।

ঠিক আছে।এই খাবার রেখে দেও খেতে হবে না।আমি অন্য কিছু করে দিচ্ছি।রেণু আর কিছু বলতে নিলেই পুতুল সেই সুযোগে হাতের লোকমা ভাতটুকু মামীর মুখে পুরে দেয়।পুতুল জানে,তার মামী কাল থেকে না খাও।এভাবে না খেয়ে থাকলে নিজে ওহ অসুস্থ হবে।ছোট ভাইটা খেতে না পেয়ে কষ্ট পাবে।রেনু রেগে কিছু বলতে পারে না।মুখের খাবার চিবিয়ে খেয়ে পুতুলকে আবার কিছু বলতে নিলেই একই কাজ আবার করে বসে।এভাবেই বেশ কয়েকবার বড় লোকমা তুলে প্লেটের সব ভাত শেষ করে ফেলে।রেনু কিছু বলতে না পেরে দুই চোখের পানি ছেড়ে দেয়।পুতুল তার অন্য হাতে সাহায্যে মামীর চোখের পানিটুকু মুছে দিলো।যার মানে তুমি কেঁদো না।তুমি কাঁদলে আমার কষ্ট হয়।রেনু আর পুতুলের ওপর রাগ করে থাকতে পারে না।দুই হাতে পুতুল কে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে।পুতুল মায়ের মতো মামীর কাছ থেকে ভালোবাসা পেয়ে কেমন চুপটি হয়ে বসে আছে।মামীর গায়ে বুঝি মায়ের গন্ধ লেগে আছে।মামী তাকে জড়িয়ে ধরেছে।মনে হচ্ছে।পুতুল তার মাকে জড়িয়ে গালে গাল লাগিয়ে বসে আছে।

এতটা মায়া কাজ করে কেন?রেনু চেয়ে ও কেন রাগ করতে পারলোনা।এতটা মায়া নিয়ে কেন জন্মেছে পুতুল।

এই মায়া তার ভাই, মামা,মামী দেখতে পায়।কিন্তু বাকিরা ছাড়া।তাদের মধ্যে দুইজন তার রক্ত।তাদের চোখে লোভ দেখা যায়।তারা পুতুলকে আপন ভাবতে পারেনি কেন?কেন আদর দিয়ে একটিবার তাকে বুকে টেনে নেয়নি।বাবা নামক মানুষটাকে আজ চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে ইচ্ছে করছে।তোমার মা,ছেলে দেখে যাও।আমি কতটা সুখে আছি।

৭০.
আমি যদি আজ ছেলে হতাম।আর কথা বলতে পারতাম।তাহলে নিশ্চয় মাথায় করে রাখতে।আমাকে অবহেলা করতে পারতে না।কারণ আমি তোমাদের বংশের বাতি হতাম।শেষ বয়সের বাবার দায়িত্ব নিতাম।কিন্তু আপসোস আল্লাহ তোমাকে কন্যা দান করায় বেজার হয়েছো।ভেবেছো।উচ্ছিষ্ট সে।পরের বাড়ি আমানত হবে।তোমাদের সে দেখবে না।তাই ভেবেছো।আর দিন শেষে কষ্ট দিয়েছিলে আমাকে এবং আমার মা জননীকে।কিন্তু আমার প্রিয় নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন।

প্রথম কন্যা সন্তান হলো সৃষ্টির সেরা উপহার। যার একটি কন্যা সন্তান হবে।সে একটি জান্নাতের মালিক।যার দুটি সন্তান হবে।সে দুই দুইটি জান্নাতের মালিক।আর তিনটি কন্যা সন্তান হবে।সে তিনটি জান্নাতের মালিক।এবং যে তাদেরকে দ্বীনি শিক্ষা দিবে এবং যত্নের সাথে লালন পালন করবে ও তাদের উপর অনুগ্রহ করবে।সেই ব্যক্তির উপর অবশ্যই জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে সুবহানাল্লাহ।আল্লাহ যখন বেশি খুশি হন তখন কন্যা সন্তান দান করেন। অনেকেই কন্যা সন্তান চায় না।কিন্তু একজন মেয়ে তার বাবা মাকে যে পরিমাণ ভালোবাসতে পারে।তা একটি ছেলে শত চেষ্টা করলেও পারেনা। কন্যারা ফুলের মতো নিষ্পাপ।তারা বিশ্বকে সৌন্দর্য দিয়ে ভরিয়ে দেয়।কন্যা সন্তানকে অবহেলা নয়।ভালোবাসতে শিখুন।

স্কুল ছুটির পরে বাসায় এসেছে। দুই জনের একজন বাসায় থাকেনি।স্কুলের ব্যাগ বাসায় রেখেই হাওয়া।পাজামা হাঁটু পর্যন্ত মুড়িয়ে সাজু,মিলন আড়ালি ক্ষেতে নেমে গেছে।ছোট ছোট পুটিমাছ হাত তুলতেই ফসকে বের হয়ে যাওয়া মিলনের রাগ হলো।আবার অন্য মাছ ধরতে নামে।সাজু পর পর কয়েকটা পুটিমাছ তুলেছে।সেগুলো মাটির ছোট কলসে রেখে আবার মাছ ধরতে ব্যস্ত হলো।মিলন মাছ না পেয়ে রেগে আগুন।মিলন স্বাধীনের মাছ ধরার ট্যারা নিয়ে এসেছে।টাকি,পুটি,ছোট কই,চিংড়ি পেয়েছে।টাকি,কই ট্যারা দিয়ে মেরেছে।সব শেষে পুকুরের পাশে আসতেই বাইঙ্ মাছ পেয়েছে মিলন।

ওই বাইঙ্ মাছ পাইছি আমি।আজকে বাসায় যাইয়া,গরম ভাত দিয়া ভাজা মাছ কচমচ করে খামু।সাজু পানি দে।দেখ কেমন করছে সে?

মাছটা সাপের মতো মজরাতে শুরু করছে।কাদার জন্য ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না।সাজু মিলনের হাতে পানি ছুড়ে মারল।মিলন হাতের ওটা দেখে চিতকার মারল।

ওই মিলন।ওই এটা ছাড়।এটা মাছ না।এটা কানা সাপের বাচ্চা।সাজুর কথায় মিলন হাতের দিকে তাকিয়ে একটা চিতকার দিলো।দিক দিশা না পেয়ে হাতে রাখা ওটা দূরে ছুঁড়ে মেরে পাগলের মতো দৌড় দিতে শুরু করলো।

ওই মিলন দাঁড়া।আমারে থুইয়া যাইস না।আমি আইতাছি।কে শুনে কার কথা মিলন দৌড়ের ওপরে আছে।দুইবার পিছলে ক্ষেতে পড়েছে।আবার উঠে দৌড়ের ওপর আছে।
সাজু হাতে ট্যারা আর মাছের কলসি নিয়ে দৌড়ে পিছনে ছুটে।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে