#ধারাবাহিক গল্প
#চক্রব্যূহ
পর্ব-তিন
মাহবুবা বিথী
পড়শী আজ ক্লাস শেষ করে রাত এগারোটার বাসে নীলফামারীর উদ্দেশ্য রওয়ানা দিয়েছে। ওর বাবা ফোনে জানিয়েছে উনি খুব অসুস্থ। পড়শী যেন খুব শীঘ্রই বাড়ী চলে আসে। তাড়াহুড়ো করে রওয়ানা দেওয়ায় সায়েমকে জানাতে পারেনি। এদিকে সায়েম তার ফন্দি হাসিল করার জন্য পড়শীকে ফোন দেয়। পড়শী ফোনটা রিসিভ করতেই সায়েম বলে,
—-মেরি জান, তোমার কাছে একটা আব্দার আছে। সাহস দিলে বলতে পারি।
—-বলনা,এতো ভনিতা কেন করছো?
—-আগে কথা দাও তুমি আমার আব্দারটুকু রাখবে?
পড়শী একটু ইতস্তত করে বললো,
—-ঠিক আছে কথা দিলাম।
—-কাল তো শুক্রবার। তোমার ভার্সিটি অফ আছে। গাজীপুরে আমার বাবার একটা রিসোর্ট আছে। কাল ওখানে আমরা দু,জন নিয়ে নিরিবিলিতে সময় কাটাবো।
—-আসলে তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি। বাবা হঠাৎ অসুস্থ হওয়াতে আমি নীলফামারীতে রওয়ানা দিয়েছি। তবে তোমাকে কথা দিচ্ছি নীলফামারী থেকে ঘুরে এসে তোমার সাথে সময় কাটাবো।
—+আঙ্কেল অসুস্থ, তুমি তো আমাকে জানাতে পারতে? আমিও তোমার সাথে গিয়ে আঙ্কেলকে দেখে আসতে পারতাম।
—-তোমার কথা শুনে আমার মনটা জুড়িয়ে গেল।
—–সাবধানে যেও।
—ওকে।
প্লানটা ভেস্তে যাওয়াতে সায়েম মনে মনে একটু বিরক্ত হলো। কিন্তু পড়শীর কাজ থেকে কথা আদায় করতে পেরেছে মনে মনে এই সান্তনাটুকুতে সায়েম নিজেকে সন্তষ্ট রাখলো।
পড়শী সকাল সাতটার মধ্যে হিজলতলী গ্রামে পৌঁছে গেল। বাড়িতে পৌঁছে পড়শী অবাক হয়ে গেল। আত্মীয়স্বজনে পুরো বাড়ি ভরপুর। পড়শী একটু অবাক হলো। বাড়িতে সাজগোছ করে অপরিচিত কিছু মেহমানও এসেছে। ওকে দেখে ওর মা দৌড়ে এসে বললো,
—-ঘরে আয় মা।
—-আব্বা কোথায়? আব্বার নাকি শরীর খারাপ? আর বাড়িতে এতো লোকজন কেন?
—-ঘরে আয় সব বলছি।
পড়শী ওর মায়ের পিছু পিছু ঘরে আসলো। ও ওর মায়ের কাছে এক গ্লাস পানি খেতে চাইলো। ওর মা কিচেনে গিয়ে পানির গ্লাস পড়শীর ছোটো বোন আরশীর হাতে পাঠিয়ে দিলো। আরশি পড়শীর হাতে গ্লাস তুলে দিয়ে বললো,
—বুজান,আজ তো তোমার বিয়ে।
আরশির মুখে একথা শুনে পানি মুখে পড়শী বিষম খেলো।এবং ওর মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। এমনসময় ওর বাবা ঘরে এসে বললো,
—-পানিটা ধীরে সুস্থে খাও। রাস্তায় তোর কোনো অসুবিধা হয়নি তো মা?
—-না, তোমার শরীর কেমন?
—-দু,দিন আগে প্রেসারটা একটু বেড়েছিলো। এখন ঠিক আছে।
—-তাহলে আমাকে কেন বললে, তোমার শরীর খারাপ?আমার তো সামনে পরীক্ষা। পড়াশোনার চাপ আছে।
—-দু,একদিনে তোর এমন কোনো সমস্যা হবে না। তোকে বলা হয়নি। একটা ভালো সম্বন্ধ এসেছে। তোর স্কুলের হেডস্যার এই প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। ছেলে কানাডার সিটিজেন। ওখানে নিজের বাড়ি আছে। ব্যবসা আছে। শুধু ছেলের বয়স একটু বেশী। আজ তোকে ওরা দেখতে আসছে। পছন্দ হলেই আকদ করে ফেলবে।
—–আব্বা আমি এখন বিয়ে করবো না।
—-আমি ওদের কথা দিয়েছি। তুইও অমত করিস না।
—-বাবাব আমি পড়াশোনা শেষ করতে চাই।
—-ওরা বলেছে, তোকে পড়াবে।
পড়শীর কোনো আপত্তি আর ধোপে টিকলো না। পড়শী সায়েমকে ফোন করে বলে,ওকে বিয়ে করতে। কিন্তু সায়েম ওকে জানায় লেখাপড়া শেষ না করে ওর পক্ষে পড়শীকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। পড়শী খুবই আহত হয়। রাগ করে পড়শী সায়েমের সাথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। অবশেষে ওর থেকে প্রায় পনেরো বছরের বড় পাত্রের সাথে আকদ হয়ে যায়। পড়শীর হাসব্যান্ডের নাম রাশেদ। পড়শীদের পাশের গ্রামে ওদের বাড়ি। এখন পড়শী বাবার বাড়িতেই থাকবে। ছ,মাস পর কানাডার কাগজপত্র ঠিক করে রাশেদ দেশে এসে পড়শীকে নিয়ে যাবে। আর তখনি অনুষ্ঠান করে পড়শীকে তুলে নিবে।
এক সপ্তাহ পর পড়শী ঢাকায় ফিরে আসে। ভার্সিটিতে আবার ক্লাস শুরু করে। পড়াশোনার মাঝে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চায়। কিন্তু পেরে উঠে না। পড়শী আস্তে আস্তে ডিপ্রেশনে চলে যায়।সায়েমও যেন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো। ও পড়শীর কাছে মাফ চায়। পড়শীও ডিপ্রেশন থেকে বের হতে ওকে ক্ষমা করে দেয়। আবারও পড়শী সায়েমের সাথে সম্পর্কে জড়ায়। এরমাঝে পড়শীর পরীক্ষা শুরু হয়।
যেদিন ওর পরীক্ষা শেষ হবে সেদিন সায়েমের জন্মদিন। সায়েম ওকে নিয়ে জন্মদিন সেলিব্রেট করতে চায়। পড়শী ও আর অমত করে না। পরীক্ষা শেষ করে ক্লাস থেকে বের হয়ে এসে দেখে সায়েম বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সায়েম পড়শীকে বাইকে উঠতে বলে। পড়শী জিজ্ঞাসা করে,
—-আমরা কোথায় যাচ্ছি?
—-গাজীপুরে,আমার বাবার একটা বাংলো বাড়ি আছে। ওখানেই জন্মদিনটা উদযাপন করবো।
—-আমি আবার রাত দশটার মধ্যে হোস্টেলে ফিরতে পারবো তো?
—-আমার উপর তোমার বিশ্বাস নেই?
—-বিশ্বাস আছে বলেই তো এতো কিছুর পর আবারো তোমার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছি।
ঘন্টা দুয়েক পর একটা নির্জন বাংলোবাড়ির সামনে পৌঁছাতেই কেয়ারটেকার এসে দরজা খুলে দেয়। সায়েম পড়শীকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে। প্রথমে ঢুকতেই বিশাল হলরুম, পাশে লিভিং রুম। লিভিংরুমের পাশে দোতলায় উঠার সিঁড়ি। দোতলায় তিনটা বেড রুম। বাড়ীটার সামনে রান্নাঘর আর গ্যারেজ। পড়শীর কাছে বাড়ীটা ভীষণ সুন্দর লাগে। অত্যাধুনিক ফার্ণিচার দিয়ে রুমগুলো সাজানো হয়েছে। এমন একটা বাড়িতে পড়শী জীবনে প্রথম আসলো তাই অবাক হয়ে চারপাশটা দেখছিলো। একসময় সায়পম এসে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
—-সারা রাত কি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে?
সায়েমের কথায় পড়শী ভীষণ লজ্জা পায়। নিজেকে সামলে সায়েমের পিছুপিছু দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। একটা বেশ বড় সড় বেডরুমে সায়েম পড়শীকে নিয়ে প্রবেশ করে। ঘরটা খুব সুন্দর। দখিন দিকে জানালা আছে। ঠান্ডা শীতল বাতাস বইছে। একটা পালঙ্ক রয়েছে। ডেসিং টেবিল আর একসেট সোফা আছে। একটা বড় সেন্টার টেবিলও রয়েছে। জানালার পাশে একটা রকিং চেয়ার রাখা আছে। পড়শী সোফায় বসে পুরো ঘরটাতে চোখ বুলিয়ে নেয়। পড়শী মনে মনে ভাবছে সায়েমরা বেশ বড়লোক। অথচ ও খুব সাধারণ ভাবেই থাকে। ওর পরিবার আর সায়েমদের পরিবার রাত আর দিনের তফাৎ।
সায়েম পড়শীকে নিরব থাকতে দেখে বললো,
—-এতো চুপচাপ কেন পড়শী? তোমার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে?
পড়শী একটু অস্বস্তি নিয়ে বললো,
—-না, আমি ঠিক আছি। আচ্ছা তোমার জন্মদিনে ইনানরা আসবে না?
—-আজ আমি কাউকে ডাকিনি। পুরো সময়টা আমি তোমার সাথে কাটাবো। তুমি একটু বসো। আমি আসছি।
সায়েম পড়শীকে বসিয়ে রেখে বাইরে চলে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পড়শী একা বসে থাকলো। ঘন্টাখানিক পর এ বাড়ির অ্যাসিসটেন্ট ট্রেতে করে কাচ্চিবিরানী, কাবাব, দেশী মুরগীর ভুনা,কাঁচা রসগোল্লা আর আপেলের জুস নিয়ে আসলো। সায়েমও ওর সাথে এসে খাবারগুলো টেবিলে রাখতে সাহায্য করলো। ছেলেটা পড়শীর দিকে কিভাবে যেন তাকালো। ওর তাকানো দৃষ্টি দেখে একটা অস্বস্তিবোধ পড়শীর পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়লো। ছেলেটা খাবারগুলো রেখে চলে গেল। সায়েম পড়শীর পাশে এসে বসলো। তারপর ওর হাত ধরে সায়েম বললো,
—-আমি জানি,তুমি আমার উপর অনেক অভিমান করে আছো। আমি যে তোমার কথা রাখতে পারিনি সে জন্য মর্মে মর্মে শেষ হয়ে যাচ্ছি। আসলে আমি তো এখন নিজের পায়ে দাঁড়াইনি। বিয়ে করে তোমাকে রাখবো কোথায়? তবে এবছর আমার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে। ইনশাআল্লাহ গ্রাজুয়েশন শেষ হয়ে গেলে একটা চাকরি নিশ্চয় যোগাড় করতে পারবো। তখন তুমি যদি চাও তোমাকে আমার বিয়ে করতে আপত্তি নেই।
সায়েমের কথা শুনে পড়শীর মনে হলো এরকম হলে তো ভালোই হয়। ও আসলে দেশের বাইরে যেতে চায় না। সেক্ষেত্রে হয়তো ওর হাসব্যান্ডকে ডিভোর্স দিতে হবে। পড়শীকে নিরব থাকতে দেখে সায়েম বললো,
—-তোমার কি এতে মত নেই?
—-না,মানে অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে। আমার হাসব্যান্ডকে ডিভোর্স দিতে হবে।
—-তুমি চাইলেই সব সম্ভব। আসো আমরা খেয়ে নেই।
ওরা দু,জনে বসে খুব তৃপ্তি করেই খাবারগুলো খেয়ে নিলো। পড়শীরও অনেক খিদে পেয়েছিলো। সকালে একরকম না খেয়ে পরীক্ষা দিতে এসেছে। আসলে পরীক্ষার সময় খেলে টেনশনে ওর বাথরুমের চাপ লাগে। সেজন্য না খেয়ে পরীক্ষা দিতে আসে। এখন বেলা চারটা বাজে। খিদেটাও বেশ চনমনে ছিলো। খাওয়া শেষ করার পর সায়েম ওর গ্লাসে আপেল জুসটা ঢেলে দিলো। নিজের গ্লাসে ঢেলে নিয়ে অ্যাসিসটেন্টকে ডাকার জন্য কলিং বেল বাজালো। ছেলেটা এসে টেবিল পরিস্কার করে এঁটো বাসনগুলো নিয়ে চলে গেল। সায়েম সোফায় পড়শীর পাশে খুব ঘনিষ্ট হয়ে বসলো। পড়শীর কপালে নিজের চুম্বনের তিলক এঁকে দিলো। পড়শীর তরফ থেকে কোনো বাধা না আসাতে সায়েম যেন আরো সাহসী হয়ে উঠলো। পড়শীর রক্তিম অধরে নিজের অধরখানি ডুবিয়ে দিলো। সায়েমের এমন আদরে পড়শী সারাশরীরে শিহরণ ছড়িয়ে পড়লো। এদিকে অক্টোবর মাস। পাঁচটার মধ্যেই ঝুপ করে সন্ধা নেমে যায়। সায়েম পড়শীকে বসিয়ে রেখে আবারও বাইরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর একটা কেক নিয়ে ঘরে আসে। দু,জনে কেক কেটে জন্মদিন সেলিব্রেট করে। এদিকে সন্ধার আলো আঁধারিতে চারিদিক ঢেকে যাচ্ছে। হোস্টেলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য পড়শী সায়েমকে তাড়া দেয়। কিন্তু সেসময় আকাশ কালো করে তুমুল বেগে বাতাস বইতে থাকে। মনে হচ্ছে আশ্বিনি ঝড়। কারেন্ট চলে যায়। সায়েম ঘরে রাখা মোমবাতিটা জ্বালিয়ে দেয়। কিন্ত বাতাসের তোড়ে মোমবাতিটা নিভে যায়। পড়শী জানালা লাগাতে গেলে বাঁজ পড়ার শব্দ শুনতে পায়। ও জানালা না লাগিয়ে সায়েমের পাশে এসে বসে। সায়েম ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। পড়শীও ওকে ধরে রাখে। বাহিরে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। এরকম শীতল ঠান্ডা পরিবেশে দুটো মানুষ নিজেদের অস্তিত্ব ভুলে একে অপরের মাঝে ডুবে যায়।
হঠাৎ পড়শীর ঘুম ভেঙ্গে যায়। তখন এই ঘটনার জন্য ওর ভিতরে পাপবোধ কাজ করতে থাকে।
চলবে