ঘর পালিয়ে

0
1101

# ঘর পালিয়ে
——————
রাত তিনটায় ঘরের দরজায় দারুম দুরুম ধাক্কা। এমন ধাক্কা যেনো দরজাই খুলে পড়বে। ধাক্কার শব্দে খান খান করে ভেঙে যায় রাতের নিস্তদ্ধতা। কড়া নাড়ারও শব্দ ভেসে আসছে কানে। একটু থেমে আবার ধাক্কার শুরু। সাথে এক ভয়ার্ত নারীর কন্ঠ –
‘পূরবীর মা দরজা খোলেন, তাড়াতাড়ি। দরজা কেন খুলছেন না, এখনই খোলেন–আমি টিলুর মা !’
ধাক্কার শব্দেই সবার ঘুম ভেঙে যায় তবু ঘরের ভেতরে আমরা চুপ করে আছি। কোন শব্দই করছি না। ঘরও অন্ধকার। দিনের বেলাতেই আমাদের বলে দেয়া হয়েছিল আজকের রাতটি ভয়াণক হবে। আর কোনমতে কাটাতে পারলেই বিপদ শেষ— রাতে কোনমতেই দরজা খোলা যাবে না।
দোতলার জানালার ফাঁকে চোখ রেখে দেখি রাস্তায়ও দাঁড়িয়ে আছে তিন/চার জন। তাদের কারও কারও গায়ে সাদা চাদর জড়ানো। রাতের অন্ধকার ভেদ করে ঐ সাদা চাদরই নজর কাড়ছে বেশী। তাদের কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বা পায়চারি করছে। নিজেদের মধ্যে কথা বলছে উওেজিত ভঙ্গিতে। হয়ত বাইরে আসার সময় বিছানার সাদা চাদরই তুলে নিয়ে গায়ে জড়িয়ে থাকবে । আবার চাদর না হয়ে লেপও হতে পারে। অন্ধকারে ঠিক পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে না বিষয়টি।

ডিসেম্বরের শেষ, ঠান্ডাও কম পড়েনি। বিশেষ করে আজ রাতে। সেই ঠান্ডাকে অগ্রাহ্য করে আমাদের বাসার সামনে রাত দুপুরে প্রতিবেশী টুলির মা’র আগমন। সাথে আরও লোকজন, বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে। ঘটনা মারাত্মক না হলে এই রাতে কেউ ঘরের বাইরে বের হয় না। তবু আমরা খুলছি না দরজা, পাছে বিপদ হয় ।
দশ-পনের মিনিটেও দরজা না খোলায় গজ গজ করতে করতে চলে গেলেন খালাম্মাসহ বাকি সবাই। তবে যাবার সময় গলা আরও চড়িয়ে বলতে বলতে গেলেন, ‘আমি এত ধাক্কালাম আর তারা দরজাই খুললো না।একটু আগেই যে আমিরনকে আমাদের বাসার উঠান দিয়ে যেতে দেখলাম– তাই বলতেই এই শীতের মধ্যে এসেছিলাম। আমিরন গিয়েছে বেশ ভালো হয়েছে, গোল্লায় যাক সব।
এমন লোকদের বাসার মেয়েদের চলে যাওয়াই ভালো– মানুষের উপকার করতে নেই।’
তার ঐ কথা শুনতেই আব্বা-মা ছুটে আসেন নীচতলা থেকে দো’তলায়—ঘরে সবাই আছি কিনা দেখতে। তখনও ঘরে লাইট জ্বালানো হয়নি। অন্ধকারেই আব্বা বলছেন, ‘প্রশ্নই ওঠে না যে আমিরন চলে যাবে।’
আমারও বিশ্বাস হলো না আমিরন চলে গিয়েছে। প্রতিদিনের মত আজও সে আমার আর পূরবী আপার মাঝে ঘুমিয়েছিল। গ্রাম থেকে আসা তার ভাই ‘রমজান’ ঘরে না ঘুমিয়ে ঘুমিয়েছিলেন আমাদের দো’তলার রুমের ঠিক সামনের বারান্দায়। একেবারে দরজার পাশেই– যদি কোন বিপদ আসে তিনিই মোকাবেলা করবেন।
তেমনই প্রস্তুতি। তাছাড়া, দিনেও আব্বা আমিরনকে একবার ডেকে জিজ্ঞেস করেছেন,’এখনও সময় আছে শেষবারের মত বল– তোর এই বিয়েতে মত আছে কিনা?’
আমিরন বলেছে, ‘আপনাদের মতই আমার মত–আপনারা যেখানে দেবেন সেখানেই আমি বিয়ে করবো-আমার নিজের আলাদা কোন মত নেই !’
সেই আমিরন নিজ থেকে এভাবে চলে যায় কী করে ?
অসম্ভব।
লাইট জ্বালাতেই দেখি, সত্যিই আমিরন নেই। দো’তলার রুমের দরজার ছিটকিনি খোলা, আর তার পাল্লা দু’টি ভিড়েয়ে রাখা। শাড়ী পরেই দো’তলার পাশের আমগাছটি বেয়ে নেমে চলে গিয়েছে আমিরন। বারান্দায় শোয়া তার ভাই টেরও পায়নি। আমরাও তার পাশে শুয়ে কিছুই টের পাইনি।
কেমন বেকুব বেকুব মনে হচ্ছে নিজেকে। আমাদের একেবারে মাঝে শুয়ে ছিল সে অথচ বুঝতেই পারলাম না কি করে কী হলো? কি আর করা?
মনকে বোঝাই, যে যেতে চায় তাকে কী আর ধরে রাখা যায়?
সে চলে গিয়েছে নিশ্চিত হতেই আব্বা রাগে গজ গজ করে বললেন, ‘ অমন মেয়ের মুখ আর দেখবো না আমি– যে এভাবে অপমান করে, মুখে চুনকালি ঘষে দেয়। নিজের ভাগ্য নিজের হাতেই নষ্ট করলো আজ সে। মরুক গিয়ে যেখানে খুশী সেখানে।’
আমিরনকে না পেয়ে মা কিছু না বলেই চলে যান নীচ তলায়। কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এসে বলেন, ‘ হতভাগী কিছুই নেয়নি সাথে. শুধু সিল্কের শাড়ী দু’টিই নিয়েছে– ঐ দু’টি শাড়ী ওর বিয়ের জন্যে কিনে কালই ওকে দেখিয়েছিলাম। আমার কানের দুল, গলার চেইন সবই ছিল ওর কাছে।
যাবার সময় সেগুলোও রেখে গিয়েছে ড্রেসিং টেবিলের উপর।’
মায়ের মন খারাপ। আমারও কেমন কান্না পাচ্ছে। আজ ওর বিয়ে হবার কথা ছিল। কত আনন্দ হতো আমাদের–কিছুই হলো না। উল্টা শোকের ছায়া এসে ঘিরে দিয়েছে সবাইকে। আমিরনের ভাই রমজান ভাইয়েরও মন খারাপ। অল্প একটু নাস্তার করেই সে গ্রামে ফিরে যায়।

আট-দশ বছর বয়স থেকে আমিরন আমাদের বাসায়। মা চাকরি করেন। তার হাতেই আমাদের বাসার যাবতীয় ভার। আমাদের অধিকাংশ ভাইবোনই তার হাতে মানুষ। সে নিজেও আমাদের বাসায়ই একটু একটু করে বড় হয়। যখন আমরা ভাঙা দালানে থাকতাম তখনও সে আমাদের বাসায় থাকতো। আমরা একসাথে ঘুমাতাম। কত কী করতাম। ছোটবেলায় আমরা ভাইবোনরা যখন গামছা দিয়ে ‘জাইলা কাছা’ দিয়ে পাছার বাটচিক বের করে হাঁটতাম, হাসাহাসি করে একে অন্যের কাঁধে গড়িয়ে পড়তাম, আমিরনও তখন হাসতো খিলখিলিয়ে।
আমিরন, পূরবী আপার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় হবে আর আমার চেয়ে হয়ত ছয়/সাত বছরের।
তখন আমিরন সবে শাড়ী পরতে শুরু করেছে। এক সকালে উঠে দেখি ঘুমের ভেতর আমিরনের শাড়ী উঠে গিয়েছে পেটের উপর। দেখতেই আমি হৈচৈ শুরু করে দেই সারা বাড়ি জুড়ে–‘তোরা কে কে দেখবি এখনই চলে আয়, আমিরন নেংটু হয়ে গিয়েছে।’
আমার চিৎকারে আমিরনেরও ঘুম ভেঙে যায়। সেও হাসতে হাসতে আমাকে ধমকায়, ‘দূরহ!’
তার হাসি দেখে আমি আরও উৎসাহী হই–গলার আওয়াজ আরও বাড়াই।
সে দৌড়ে এসে আমার মুখ চেপে ধরে।
শান্ত হলে মুখ ছাড়তেই বলি,’আগে আমায় বল, এভাবে কাছা দিয়ে রাতে ঘুমিয়েছিলি কেন আজ?’
আমিরন বলে, ‘আমার পেট খারাপ হয়েছে, তাই।’
সেদিনও সকালে মা নাস্তা বানাচ্ছিলেন আমিরনকে নিয়ে।
মাকে গিয়ে বলি, ‘আমিরনের পেট খারাপ, রাতে কাছা দিয়ে ঘুমায় সে– অফিস থেকে আসার সময় ওর জন্যে একটু ঔষধ নিয়ে এসো।’
মা হাসতে হাসতে বলেন ‘আনবো’–তুই এখন যা, পড় গিয়ে।
রুটি বেলতে বেলতে আমিরনও হাসে মায়ের সাথে। আমি বুঝি না আমিরন কেন হাসছে?
তবে বড় হয়ে বুঝেছিলাম, কোন পেট খারাপ নয়, তার ঋতুস্রাবের ঘটনা ছিল ওটি।

সেই আমিরন এমন করে না বলে চলে গেল।
সেবার আমাদের একমাত্র নারকেল গাছটি ঠাটা পড়ে মরে যায়। সেই গাছের প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশটি নারকেল আমাদের খাটের নীচে। তখন আব্বা-মা আমাদের পাশের রুমে থাকতেন। আর আমরা থাকতাম ভাঙা দালানের মাঝের রুমটিতে। গভীর রাতে আমিরন, পূরবী আপা আর আমাকে ঘুম থেক জাগিয়ে তুলে বলে ‘এই নারকেল খাবি– চল আমরা সবাই মিলে নারকেল খাই, খুব মজা হবে।’
আমরাও তৎক্ষণাৎ রাজী হয়ে যাই।
আমিরন চলে যায় রান্নাঘরে। রান্নাঘর থেকে একটি দা এনে খাটের নীচ থেকে নারকেল বের
করে এক কোপ দিতেই পাশের রুম থেকে আব্বা বলে ওঠেন, ‘ এই কে রে ?’
মুখ আঁটকে আমরা হেসে উঠি– কিছুই বলি না।
কিছুটা নীরবতা ফিরে আসতেই আমিরন আবার কোপ দেয় নারকেলে।
ওমনি আব্বা হাকেন, ‘এই দুষ্টুর দল, তোরা কি করিস এত রাতে–আমি এলাম কিন্তু ?’
এবার আর আমাদের হাসি থামে না। সবাই হাসছি খিল খিল করে। হাসির চোটে পেট ব্যথা হয়ে যাচ্ছে তবু থামছে না হাসি। এরই মাঝে হাসতে হাসতে আমিরন একেবারে দরজা খুলে বাইরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর ফিরে আসে বালতিতে পানি আর ঘর মোছার ন্যাকড়া হাতে নিয়ে । সেই দেখে পূরবী আপা বলে, ‘এই মাঝ রাতে আবার ঘর মুছবি, তুই–তোর কী মাথা খারাপ হলো?’
আমিরন বলে, ‘ হাসতে হাসতে দৌড়ে বাইরে যাবার আগেই প্রসাব করে দিয়েছি– ঠেকাতে পারিনি, ঘরেই পড়েছে সব।’
ওর খবর শুনতেই হাসতে হাসতে আমি আর পূরবী আপা দৌড়ে বাইরের চলে যাই। আপা সরাসরি ঢোকে বাথরুমে আর আমি বাথরুমের ড্রেনের উপরই বসে পড়ি। নারকেল আর খাওয়া হয় না আমাদের।
উওেজনা আর হাসাহাসিতেই কেটে যায় সেই রাতটি।।সেই আমিরন চলে গেল ।
বাসায় কাজ করলেও তার আদর আমাদের থেকে তেমন কম ছিল না। আমাদের মত যখন তখন সে মায়ের মারও খেতো না। যখন সে জামা এবং সালোয়ার-কামিজ পরতো তখন আমাদের মতই তারও জামাকাপড় হতো– কাটিং আলাদা হলেও একই কাপড়ের, একই প্রিন্টের।
পরে যখন তার মা-ভাইয়ের চাওয়ায় সে শাড়ী পরতে শুরু করে তখন থেকে কিছুটা ভিন্নতা আসে তার ড্রেসে। বাসায় থেকেই সে ক্লাস এইটের পড়া শেষ করে ফেলেছিল। আমরা ভাইবোনই তাকে লেখাপড়া শেখাতাম। কখনও কখনও মাও শেখাতেন।

মাস দুয়েক আগের ঘটনা। মা অফিস থেকে লাঞ্চে দু’টোর সময় বাসায় এসে দেখেন আমিরন বাসার কোন কাজই করেনি। এমন কী তখনও দুপুরের রান্না বাকি– প্রতিদিন একটা বাজতেই যেখানে রান্না শেষ হয়ে যায়। লাঞ্চে এসে আমাদের খাইয়ে, নিজে খেয়ে মা আবার অফিসে ফিরে যান। এমনই রুটিন তার।
আজ অফিসের ব্যস্ততায় মা’রও আসতে দেরী হয়েছে।তবুও বাসার রান্না হয়নি।
মা আমিরনকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী করেছিস সারাদিন? এখন বাচ্চারা কী খাবে, আমিই বা কী খাবো ? সময়ও হাতে নেই যে এখন রাঁধবো আমি, তাছাড়া এখনই আবার ফিরে যেতে হবে অফিসে আমাকে।’
আমিরন বলে, ‘এখনই রান্না করছি আমি খালাম্মা, হয়ে যাবে ঝট্পট।’
আমি বলি, ‘আমাদের খিদে নেই মা, অনেক পেয়ারা খেয়েছি আজ!’
মা জিজ্ঞেস করেন, ‘পেয়ারা পেলি কই ?’
অতুল ভাই বলেন, ‘পীরের বাড়ির লালন ভাই দিয়েছে। আরও আছে বাসায়– তুমিও খেত পারো।
বড় এক ব্যাগ দিয়েছে। অনেক বড় বড় পেয়ারা– খুব ভালো।’
‘তোদের কেন এত পেয়ারা দিল সে’ মা জিজ্ঞেস করতেই অতুল ভাই বলে, ‘মাঝে মাঝেইতো দেয় যখন নদীতে গোসল করতে আসে। তবে আজ একটু বেশী দিয়েছে– আজ দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে যে আমিরনের সাথে প্রেম করছিল, তাই! তাইতো আমিরন রান্না করতে সময় পায়নি!’
মা ঝট করে আমিরন গালে এক চড় বসিয়ে দেন– আমাদের সামনেই।
বলেন ‘ আমার খালি বাসায় কোন দূর্ঘটনা ঘটে গেলে আমি তোর মা-ভাইদের কী জবাব দেবো, বল্ ?
ঐ এক কড়া থাপ্পর দিয়ে কিছু না খেয়েই মা চলে যান অফিসে।
ঐ প্রথম আমিরন মার খেলো মায়ের। আমরা অতুল ভাইকে বলি, ‘তুই কেন বলতে গেলি মাকে–কেমন মার খেলো আমিরন?’
অতুল ভাই বলে, ‘আমি কী জানতাম যে মা ওকে মারবে? আমিতো চাইছিলাম মা’ও পেয়ারা খাক।’
মার খেয়েও কোন কান্না না করে আমিরন চলে যায় রাঁধতে। ওর দুঃখে আমরা দুঃখী হয়ে ওর আশেপাশে ঘুরি, কাজে সাহায্য করতে চাই। তবে তার ভাব দেখে মনে হয় না মারে সে খুব একটা কষ্ট পেয়েছে।

সেদিনের পর থেকে আমিরনের বিয়ের খোঁজখবর করা শুরু হয়।
মা তার ভাইকে আমিরনের খবর জানাতেই তিনি বলেন, ‘আমরা গ্রামের লোক। আমাদের ঘরে আরও বোন আছে। তাদেরকেও বিয়ে দিতে হবে । গ্রাম-গঞ্জে প্রেম-প্রীতিকে লোকে ভালো চোখে দেখে না। বোনের প্রেম করে বিয়ে হয়েছে শুনলে আর ওদেরকে আমি বিয়ে দিতে পারবো না। তাছাড়া, আমিরনেরও বিয়ের বয়স হয়েছে। সে আপনাদের জিম্মায়। ওর দ্রুত বিয়ের ব্যবস্হা করেন, যার সাথেই হোক– আমাদের কোন দ্বিমত নেই। আমার মায়েরও সেই মত, মেয়ের বিয়ে হয়ে যাক। তার বিয়ের সময় হয়েছে, বিয়ে দেবার ব্যবস্হা করতে হবে। আপনারা না পারলে আমরা আমাদের বোনকে নিয়ে আসবো বাড়িতে।’
ঢাকা থেকে বাসায় আসতেই আব্বা মায়ের কাছে সব শুনে লালন মিঞাকে ডেকে আনান। বলেন, ‘ তোমার মালিককে নিয়ে আসো আমাদের বাসায় বিয়ে ঠিক করতে– আমরা কথা বলি। আমিরনের মা-ভাই চায় এখনই তার বিয়ে হয়ে যাক। তুমি যদি তোমার মালিককে আনতে পারো তাহলে তোমার কথা বিবেচনা করবো, নইলে ওর বিয়ে অন্য জায়গায় দিতে হবে।’
লালনভাই বলেন, ‘আমার পক্ষে এখন বিয়ে করা সম্ভব না, খালুজান। যেখানে পারেন ওকে বিয়ে দিতে পারেন আপনারা, তাতে আমার কোন আপওি নেই।’
আট-দশদিন যেতেই গ্রামের এক বেসরকারী প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক তার ভাইকে নিয়ে আসে আমিরনকে দেখতে। দুই রকমের মিষ্টিও আনে তারা সাথে–চম্চম আর দানাদার। ছেলের ভাইয়েরও আমিরনকে দেখেই পছন্দ হয়। পাত্র আগেই কয়েক বার মায়ের কাছে কাজে এসে দেখেছে আমিরনকে, চা-বিস্কুট দেবার সময়।
তার এবারের মেয়ে দেখা শুধুই আনুষ্ঠানিকতা।
আমিরনের ভাইয়ের চাওয়াও এমনই কোন পাত্র যাদের আর্থিক অবস্হা ভালো। খাওয়া-পরার কোন কষ্ট নেই। আবার বিয়ের সময় কিছুটা জমিও যদি ওর নামে লিখে দেয়– এমন কেউ।
মা পাত্রকে আমিরনকে কিছু জমি লিখে দেবার প্রস্তাব করতেই তিনি রাজী হয়ে যান। সেদিন দেখে যাবার সময়ও তারা আমিরনকে একটি শাড়ী, একটি আংটি, ও পাঁচ’শ টাকার এক নোট ও এক টাকার একটি নোট দিয়ে যায়। হবু বরের ভাই আমাদের সামনেই তাকে ‘ভাবিজান’ বলে ডাকে।
দুষ্টুমি করে জিজ্ঞেস করে, ‘ভাবিজান আপনার কয় ছেলেমেয়ে?’
আমিরন উওর দেয়, ‘এক ছেলে এক মেয়ে!’
তার উওর শুনে আমি অবাক হয়ে তাকাই ওর দিকে। জিজ্ঞেস করি, তোর আবার কখন ছেলেমেয়ে হলো?
ও বলে, ‘খালাম্মা-খালুইতো আমার সন্তান !’

দিনের আলো ফুটতেই ‘টুলির মা খালাম্মা’ আবার আসেন বাসায়। বলেন, পীরের বাড়িতে গিয়ে এইমাত্র তিনি নিজ চক্ষে দেখে এসেছেন আমিরনকে– সবুজ শাড়ী পরে ঘোমটা তুলে বসে আছে সে।
শুনেছেন, আজ সন্ধ্যায় মাগরিব বাদেই তার বিয়ে ।
দুপুরের দিকে পীরের বাড়ি থেকে কয়েকজন মুরিদান আসে আমাদের বাসায় আব্বাকে পীরের বাড়িতে নিয়ে কথা বলতে। আমিরনের বিয়েতে যোগ দিতে ।
আব্বা আর রাজী হন না যেতে।
বলেন, ‘ওর ভাই চলে গিয়েছে, আমি এখন আর সেখানে একা যেতে পারি না — যে মেয়ে আমাদের কথা একবার ভাবলো না, পরিস্হিতি বুঝলো না, তার বিয়ে সেই নিজে করুক– একা একা।’
এলাকায় পীরের বাড়ির দাপটও অনেক। ওখানে গিয়ে কথা বলা যেমন সহজ নয় আবার বললেও তেমন কোন কাজ হবে না। তাদের দুই ভাতিজা কোমড়ে সব সময় পিস্তল নিয়ে ঘোরে– জমির দখল, টেন্ডারবাজিসহ আরও নানারকম অপরাধের সাথে জড়িত তারা। চার-পাঁচটি খুনের কেসও রয়েছে তাদের নামে। তারাই ঐ বাড়ির মূল চালিকা শক্তি। সবকিছুতে তাদের কথাই শেষ কথা। অন্যের কথা তারা শোনেও না। লালনভাই তাদেরই চাচার ছাতির দোকানে কাজ করে। তাদের বাসায় থাকে। খায়। সেই বাড়িতে গিয়ে আর যাইহোক আলোচনা ফলপ্রসূ হয় না। শুধু আব্বাই না আমিরন ঐ বাড়িতে যেতেই আমরাও পীরের বাড়ির আশেপাশে যাওয়া বন্ধ করে দেই। আমাদের ছাড়াই আমিরনের বিয়ে হয়ে যায়।
সপ্তাহ যেতেই খবর কানে আসে আমিরনের আর সেই দিন নেই এখন । শীতে বিয়ে হলেও তার বরকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকবার অবকাশ পায় না সে আর। ফজরের আজানের আগেই উঠতে হয় তাকে ঘুম থেকে। পীরের বাড়ির শত শত হাড়ি-পাতিল, থালাবাটি মাজতে হয় ঐ কাকভোরেই। পুকুর ঘাটে ঠান্ডায় বসে বসে সে পুকুরের পানিতে ধোঁয় সেগুলো। কোনদিন কল চাপতে চাপতেই তার দিন শেষ।
পীরের বাড়ির হাজারও কাজ করে সে। শত ফাই-ফরমাইশ খাটে। সেখানে পঁচিশ-ত্রিশজন লোকই আছে যারা নানা কাজের তদারকিতে নিয়োজিত। তারা আমিরনকেও চালায়। বিয়ে হলেও বরের সাথে তার দেখা হতে হতে একেবারে রাত এক’টা/দু’টো। তার থাকার ব্যবস্হাও হয়েছে একটি পাটখড়ির বেড়ার মাটির ঘরে। চাল টিনের। ঘরের মেঝেতে খড়ের উপর পাটি বিছিয়ে তার বিছানা। দিনরাত সে কাজ করে , তারই মাঝে যেটুকু সংসার। তবু পাঁচ মাসের মাথাতেই আমিরন গর্ভবতী হয়। তার কিছুদিন যেতেই তাকে গ্রামে শাশুড়ির কাছে পাঠিয়ে দেয় তারা। লালনভাই তখনও তাদের ঐ ছাতির দোকানেই কাজ করছে।

বছর চারেক পর পীরের বাড়ির ওরশে এসে এক সন্ধ্যায় আবার আমিরন আসে আমাদের বাসায়। মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। বলে, ‘এখনই আবার চলে যাবো গ্রামে–বাড়িতে শাশুড়ি একা। বাড়ি ফিরে যাবার আগে একবার এলাম আপনাদের সাথে দেখা করে মাফ চাইতে।
বলে, আজ এসেও লালনের দেখা পেলাম না। শুনলাম, আমার আসার খবর পেয়েই সে নাকি গা ঢাকা দিয়েছে– আমার ভালোইতো আপনারা চেয়েছিলেন সেদিন, শুধু আমিই বুঝিনি।’ আব্বাকে পা ধরে সালাম করেও মাফ চায় সে।
এই ক’বছরেই তিন সন্তানের মা হয়ে গিয়েছে আমিরন। আগের সেই চেহারা আর নেই তার। শরীরের সব হাড় গোনা যায়। জানায়, গ্রামে তাদের অবস্হা মোটেই ভালো নয়– একবেলা খায় তো আরেক বেলা কী হবে তার কোন ঠিক নেই। লালনও এখন আর নিয়মিত টাকা পাঠায় না, গ্রামে যায় না। ফোন করেও তাকে পাওয়া যায় না। শাশুড়িই তাকে পাঠিয়েছিলেন ওরশের সময় যদি সে লালনকে ধরতে পারে।
মা বড় বড় বস্তায় ঘরের চাল, ডাল, আটা, পিঁয়াজ, চিনি, ছোলা ভরতে থাকেন।
আমিরন বলে ‘এত লাগবে না, এত লাগবে না, খালাম্মা।
তবু ভ্যান ডেকে এনে উঠিয়ে দেয়া হয় বস্তাগুলো অতুল ভাইয়ের তদারকিতে।
ঐ ভ্যানে করেই আমিরনও ফিরে যায়। যাবার আগে মা কিছু টাকাও গুজে দেন আমিরনের হাতে। আমিরন চোখের পানি মুছতে মুছতে আঁচলে বাঁধে টাকাগুলো। সেদিন থেকে আবার শুরু হয় আমিরনের আশা-যাওয়া আমাদের বাসায়।
সেবার যাবার সময় মাকে ধরে কাঁদতে কাঁদতে আমিরন বলছিল, ‘আর কিছু না খালাম্মা–আমার ছেলে সাজু বড় হলেই কোন কষ্ট থাকবে না আমাদের। শুধু সেই আশায়ই পথ চেয়ে থাকি–দোয়া করেন, ছেলে যেনো মানুষ হয়।’
চলে যায় আমিরন।
সেই সন্ধ্যাতেই অতুল ভাই মাঠে খেলতে গিয়ে খেলা বাদ দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ছুটে আসে বাসায়।
হাপাতে হাপাতে মাকে বলে, ‘ ‘শুনেছো মা, লালন ভাই নাকি আবার বিয়ে করেছে।
মেয়ে তাদের ছাতির দোকানে পানি দেয়ার কাজ করে– মেয়েটি ন্যাংড়া।’

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে