#ঘরে_ফেরার_গান (৩)
কতো মানুষের নামই তো এক হয়। তানভীর এই ভেবে আর খোঁজ নিতে যায়নি সেই রেস্টুরেন্টে। বর্ষা শেষে এখন শরৎ।আকাশটা ভীষন পরিষ্কার। তানভীর আবার বাবুবাজার রোডে । ভ্যাপসা গরম ছুটেছে। ঠান্ডা কিছু খাওয়া দরকার ভেবে গাড়ি থামায় সেই রেস্টুরেন্টের সামনে। অর্ডার দিয়ে বসে টেরেসে দাড়ায়। ক্ষনে ক্ষনে একটু একটু হাওয়া আসছে এদিকে। এসির বাতাস অপেক্ষা প্রাকৃতিক বাতাস ঢের ভালো। সেসময়ই নিচের দিকে তাকাতেই দেখে হাসি হাসি মুখে একজন রেস্টুরেন্টে ঢুকছে। গোলাপী বোরখা হিজাবে মুখখানাই শুধু দেখা যাচ্ছে। তানভীর বুকে হাত দিয়ে দাঁড়ায়। দৌড়ে ছুটে যায় ভেতর দিকে। ওয়েটার তানভীরের দিকে এগিয়ে এসে বলে,
‘ য়্যার য়্যু ওকে স্যার? ‘
তানভীর থেমে যায়। আশপাশ তাকিয়ে দেখে বেশ কয়েকটা টেবিল ফিলাপ। তানভীর জোরে শ্বাস নেয়। ওয়েটারকে বলে, ‘ আমার অর্ডার মেক হতে কতক্ষন? ‘
‘ এইতো হয়ে যাবে স্যার। আপনি প্লিজ বসুন। ‘
‘ আপনাদের শেফ কি যেনো নাম? উমম মিস লাবিবা নাকি?’
‘ মিসেস লাবিবা স্যার। ‘
তানভীর একটা ফাঁকা ঢুক গিলে। মনের ভেতর আনাগোনা করে কিছু ভয়। মাথায় অপ্রত্যাশিত কিছু বাক্য। সেসবকে পাত্তা না দিয়ে বলে,
‘ উনাকে একবার আমার টেবিলে আসতে বলবেন।’
‘ উনি মাত্র আসলেন। এখন ব্যস্ত আছেন স্যার। ‘
‘ ফ্রি হয়ে আসতে বলবেন। ততোক্ষন আমি অপেক্ষা করছি। ‘
প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর লাবিবাকে তানভীরের দিকে আসতে দেখা যায়।বোরখা ছেড়ে এখন পরনে শেফের কষ্টিউম। তানভীর অর্ডারের ড্রিংকস গুলো এখনো নেয়নি। তার গলা দিয়ে নামবে না সেসব এখন। লাবিবা মিষ্টি কন্ঠে সালাম জানায়।
‘ সরি ফর লেট। আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি স্যার? ‘
তানভীর সামনের চেয়ারে ইশারা করে বসার জন্য।
লাবিবা বসে। এখন আর তার মুখে হাসি নেই।
তানভীর বলে, ‘ লুক এট মি। বিশ মিনিট সময় চাইছি। কিছু কথা আছে আপনার সাথে। ‘
‘ জি স্যার বলুন। ‘
‘ আমি তানভীর খান। নওয়াবগঞ্জ গ্ৰামের লাবিবার হাজব্যান্ড। তুমি কি চিনতে পেরেছো আমাকে?’
লাবিবা অমাইক হাসে।
‘ সরি স্যার আমি আপনাকে চিনতে পারছি না। ‘
‘ বাট আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি। অফ কয়টায় তোমার? আমি নিতে আসবো তোমাকে।’
‘ সরি স্যার। আপনি কোনো আমাকে নিতে আসবেন? আমি সত্যি আপনাকে চিনতে পারছি না। ‘
‘ আবার বিয়ে করেছো?’
‘ মানে? আ’ ম অলরেডি ম্যারিড স্যার। আমার হাজব্যান্ড আছে। ‘
তানভীর ছুটে যায় রিসিপশনের দিকে। সেখান থেকে জেনে নেয় এমপ্লয়িদের ডকুমেন্টস কোথায় আছে এবং ওনার কে? বায়ো তে হাজব্যান্ডের নামের জায়গায় নিজের নামটা পেয়ে তবেই তানভীর ক্ষান্ত হয়।
তানভীরকে বেরিয়ে যেতে দেখে লাবিবা নিজের কাজে ফিরে। সবুজ এসে জিজ্ঞেস করে,
‘ কে লোকটি?’
‘ মি. তানভীর খান। ‘
‘ হুয়াট? তোমার হাজব্যান্ড?’
লাবিবা উত্তর দেয়না।
‘ এই লোকটাই তো একদিন বৃষ্টির মধ্যে এসে শুঁটকি ভর্তা ডিম ভাজি ভাত খেয়ে গেছে। তুমি বললে না কেনো এই তোমার হাজব্যান্ড? তোমার হাতের রান্না খেয়েও লোকটা বুঝতে পারলো না?’
সবুজ থামে। একটু চিন্তা করে বলে,
‘ ওয়েট ওয়েট রাগারাগি হয়েছিলো তোমাদের মধ্যে? কিভাবে কি? আমি না ঠিক বুঝতে পারছিনা। আর এই লোক তো দেখেই বোঝা যায় টাকার কুমির। তুমি কাজ করছো কেনো তবে এই রেস্টুরেন্টে? লাবিবা তাকাও আমার দিকে। ‘
লাবিবাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়েই সবুজ অবাক হয়। লাবিবা কাঁদছে। এই কান্নার মানে কি?
‘ সবুজ ভাই।’
‘ কি হয়েছে? বলো আমাকে। ‘
‘ শরীর খারাপ লাগছে। ছুটির কথা বলে আসুন আমি বেরিয়ে যাচ্ছি বাসার দিকে। ‘
রাতে তানভীর এসে লাবিবাকে পায়না। দুদিন পর জানতে পারে লাবিবা রিজাইন দিয়ে দিয়েছে। তানভীর মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে। এতো খোঁজাখুঁজির পর পেয়েও কি হারালো লাবিবা কে!
তানভীরের মা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না বিয়েটা। আজ বাদে কাল ছেলে ব্যবসায় বসবে তারপর ধুমধাম করে বিয়ে দিবে বান্ধুবীর মেয়ের সাথে যা অনেক আগে থেকেই সে ঠিক করে রেখেছে সেখানে স্কুল পড়ুয়া একটা মেয়েকে ছেলের পাশে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। সব থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে মেয়েটাকে তার দেবরের ছেলে অপহরণ করেছে। ঐ দুশ্চরিত্র ছেলে পালিয়ে গেছে এখন বোঝা এসেছে পরেছে তার ছেলের ঘাড়ে। দুদিন পর তো এটাও মানুষ বলবে এক ভাইয়ের ফেলে দেওয়া জিনিস আরেক ভাই গ্ৰহণ করে। ছি ছি! সে কান্নায় ভেঙে পরে। রাগের মাথায় লাবিবার গালে থাপ্পড় দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। লাবিবা বাবার বাহুতে এসে পরে। সে জলভরা শুধু দেখছে তার দিকে সবাই কেমন কৌতুহলী চোখে তাকাচ্ছে। অল্প বয়সেই ভালো গ্ৰোথ হওয়ায় বাবা তাকে সব সময় আগলে রেখেছে। স্কুল বাদে কোনো বিয়ে বাড়ি অব্দি যেতে দেয়নি। আজ সে কতো লোকের দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। অস্বস্তিতে মায়ের বুকে মাথা গুঁজে রাখে। তার বাবা তানভীরের পরিবারের সাথে কথা বলছে। সেই যে গিয়েছে আর মেয়ের কাছে আসতে পারছেনা। মেয়েকে রেখে যেতে ভরসা পাচ্ছেনা। তার উপর নতুন বেইনীর বিরূপ মনোভাব তাকে ভাবাচ্ছে। সব শেষে তানভীরের বাবা প্রস্তাব রাখে তার ছেলেও এসটাবলিশ হোক আর মেয়েও বাবার কাছে থেকে পড়াশুনা করুক। বয়স আঠারো হলে তারপর অনুষ্ঠান করে ঘরে তোলা যাবে।
সেদিন মেয়েকে নিয়ে ফিরে আসে লাবিবার বাবা। তারপর আর দুই পরিবারের কোনো যোগাযোগ নেই। তানভীরও ততোদিনে ভুলে গেছে যে তার বিয়ে হয়েছিল। তার একটা ছোট্ট বউ আছে। নিজের ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। তার মনে পরে সেদিন যেদিন তার বাবা ফোন করে বলে,
‘ তানভীর তোমার শ্বশুড় মারা গেছে। কাল সকাল নয়টায় জানাজা হবে। ‘
সেদিন রাতেই ঢাকা থেকে রওনা দেয়। প্রায় পাঁচ বছর পর স্মৃতিতে আসে সেই পিচ্চি মেয়েটা। সবুজ সাদা স্কুল ড্রেসে লাল উড়না মাথায় দেওয়া বউ টি। বাবা চাচার সাথে দাঁড়িয়ে শ্বশুড়ের জানাজায় অংশগ্রহণ করে। বাড়ির পাশেই কবর দেওয়া হয়। তানভীরের বাবা জানতে চায়, লাবিবার সাথে দেখা করে আসবে?
বাড়ির ভেতর থেকে গুনগুনিয়ে কান্নার শব্দ আসছে। তানভীর মাথা নাড়িয়ে ভেতরে যায়। তাকে দেখেই মহিলাদের মাঝে গুণগুণ শব্দ উঠে, এইটাই লাবিবার জামাই? জামাইরে লাবিবার কাছে নিয়ে যাও। একটা টুল আনো জামাইরে বসতে দাও। আহারে মেয়েটা স্বামীর বাড়ি যাওয়ার আগেই বাপটা হারালো। বড় ঘরে অনুষ্টান করে তুলে দিতে লাবিবার মা কোথা থেকে এতো টাকা পয়সা জোগাড় করবো?
তানভীর তার চাচার কাছে সকালে সব শুনেছে দুই বছর থেকে মরণব্যাধির চিকিৎসা করতে করতে তাদের প্রায় সব ফুরিয়েছে। এখন শুধু আছে বাড়িটাই। এরমাঝে কয়েকবার মেয়েকে ঘরে তুলার ফরিয়াদ জানিয়েছে ভদ্রলোক। পরে পরে করতে করতে আজ এতোদূর। ভীড় ঠেলে কয়েকজন মহিলা বাড়ির পেছনের ইয়ার্ডে নিয়ে যায় তানভীরকে। সেখানেই কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে যাওয়া মায়ের মাথা কোলে নিয়ে পাথরের মতো বসে আছে লাবিবা। ধুলোবালি লেগে আছে জামাতে। মাথার কোঁকড়া চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। গলার উড়না ঝুলছে একপাশে। সেদিনের পিচ্চি মেয়ে আর নেই। তানভীরের সামনে ব্যাথিত এক রক্তচোখী ফুটন্ত গোলাপ অনাদরে বসে আছে মাটিতে। সে ধীরে ধীরে তার কাছে এগিয়ে যায়। হাঁটু গেড়ে সামনে বসে। মৃদু স্বরে ডাকে,
‘ লাবিবা?’
লাবিবা চোখ তুলে তাকায়। তানভীর কোনো কথা খুঁজে পায় না। দুজনেই দুজনের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়। ভেতরে অনেক কথা জমা আছে। মুখ ফুটে তা প্রকাশ পায় না। চোখের কোনে জল চিকচিক করে। তানভীর অনুভব করে তার বুকে ব্যাথা হচ্ছে। অসহ্য এক ব্যাথা।
বাড়ি ফিরে জানায় লাবিবাকে ঘরে তুলবে।বড় কোনো অনুষ্ঠান লাগবে না। রেজিঃ করতে ছোট একটা অনুষ্ঠান করে ঘরে তুলবে। তানভীরের মা এ সম্পর্কে কিছুই বলে না। তার বান্ধুবী অনেক আগেই তার কথা ফিরিয়ে নিয়েছে। বিবাহিত ছেলের সাথে তাদের মেয়ের বিয়ে দিবে না। তানভীর যে লাবিবাকে দেখে এসেছে পাঁচ বছর আগেই তাকে সামলে রাখতে ব্যর্থ হয়েছিলো তার বাবা। আজ বাবা নেই। তানভীর যদি লেট করে তাহলে এই ফুল নষ্ট হতে সময় লাগবে না। তিনদিনের দোয়ার পরে তানভীরের বাবা যায় লাবিবার মায়ের সাথে কথা বলতে। কিন্তু গিয়ে দেখে দরজায় তালা দেওয়া। প্রতিবেশীদের জিজ্ঞেস করে জানতে পারে বাড়িটা মেম্বারের কাছে বিক্রি করে দিয়ে মা মেয়ে গ্ৰাম ছেড়ে চলে গেছে। কোথায় গেছে জানে না। আত্মীয় স্বজনদের থেকে খবর নেওয়া হয়। হুট করেই দুটো মানুষ উধাও হয়ে গেলো। কেউ কোনো খোঁজ দিতে পারে না। সেই থেকে অশান্তি শুরু। তানভীর নিজেকে দোষী ভাবতে থাকে। তার নিজের দোষে সে লাবিবাকে হারিয়েছে। পরিবার লাবিবা আর তার মাকে দোষ দিলেও তানভীর জানে তারা কোনো অন্যায় করেনি। সকল অপরাধ তার। কোন ভরসাই বা লাবিবা তানভীরকে জানাবে? তার কাছে আসবে? তানভীর কি একবারো তাকে সেই সুযোগ দিয়েছে? না। বুঝিয়েছে তার জীবনে লাবিবার কোনো জায়গা নেই। কিন্তু সেই মেয়েটাই আজ তানভীরের পুরোটা জায়গা দখল করে আছে।
চলবে।