#ঘরে_ফেরার_গান (২)
‘ লাবিবা ‘
তিন অক্ষরের এই নামটাতেই তানভীর আটকে যায়। ভীষণ আপন অনুভব হয়। সময় থাকতে এই অনুভূতি গুলো কেনো হয়নি? কবুলের এতো জোর! বছরের পর বছর যায় বিন্দু পরিমাণ তার হ্রাস নেই বরং বেড়েই চলেছে। তানভীরের জীবনে লাবিবা একজন অনাকাঙ্খিত ব্যাক্তি। যাদের শুরুটাই হয়েছিলো অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে। আর অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই তাঁদের সমাপ্তি। সমাপ্তি কিনা জানা নেই তবে তানভীর আজো তাকে খুঁজে চলেছে।
তানভীর তখন মাস্টার্স শেষের পথে। পরিক্ষা শেষে হল ছেড়ে বাড়ি ফিরছে। পথিমধ্যেই তার কানে আসে খারাপ কিছু কথা তার চাচাতো ভাই ইকবালের নামে। কোথা থেকে এক মেয়ে তুলে নিয়ে এসেছে। মেয়ে নাবালক। ক্লাস নাইনে পড়ে। মেয়ের বাবা নানা পুলিশ রেব নিয়ে এসে বাসায় হামলা চালিয়েছে। তানভীর তাড়াহুড়ো করে বাড়ি ফিরে। কি হতে চলেছে তার জানা নেই। চেনা পরিচিত দুইজন বড় ভাই আছে একজন এসপি আরেকজনের বাবা হলেন এসপি। তাদের দুজনকেই কল করে। সাহায্য চায়। ইকবালকে যেনো রক্ষা করতে পারে। ইকবাল ছেলেটা ছোট থেকেই একটু সাইকো। তার অতিরিক্ত জেদ আর পাগলামি সামলাতে পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষকে খুব ভোগতে হয়। তানভীর যখন বাড়িতে ঢুকবে তখন বাড়ির সামনে অনেক মানুষের ভীড়। তানভীরকে দেখে সবাই ফিরে ফিরে তাকায়। নিজেদের মধ্যে গসিপ করে। বিষয়টা এরকম মনে হচ্ছে যে সে হচ্ছে আসল অপরাধী। পাড়ার বন্ধুরা ভিড় ঠেলে তানভীরকে বাড়ির গেইট অব্দি পৌঁছে দেয়। পাশ থেকে আশিক বলে, ‘ তোর ভাই মেয়ে কেলেঙ্কারিতে ফেসেছে। এতো শাসন করিস তার পরেও একটা স্ক্যান্ডাল করে ফেললো । ‘
‘ কি করেছে?’
‘ রাস্তা থেকে একটা মেয়েকে তুলে নিয়ে এসে বলছে বিয়ে করবে। মেয়েটা চিৎকার করে করে বাড়ি মাথায় তুলেছে। এখন মেয়ের বাবা আসছে প্রশাসন ম্যানেজ করে। ‘
‘ এখনো এসে পৌঁছায়নি তবে? ‘
‘ না। ‘
‘ মেয়েটা কতোটা ছোট হবে?’
‘ আনুমানিক তেরো চৌদ্দ। ‘
‘ সীট্ ।’
তানভীরকে দেখে ছোট চাচী হাউমাউ করে কেঁদে তানভীরকে জড়িয়ে ধরে।
‘ ওরে বাপরে! তুমি আসছো? তোমার ভাই দেখো কি কান্ড ঘটাইছে। ‘
তানভীর ছোট চাচীর মাথায় হাত রাখে। আশপাশ তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে। সোফায় বাপ চারারা গম্ভীর মুখে বসে আছে। তার সামনেই টি টেবিলের উপর নত মুখে বসে আছে ইকবাল। ডান পাশের গালটা লাল হয়ে আছে। ইকবালের পেছনে গলা জড়িয়ে ধরে তানিয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এক রাউন্ড যে হয়ে গেছে সেটা খুব ভালো করেই বোঝতে পেরেছে। তানভীর জিজ্ঞেস করে,
‘ মা কোথায়?’
চাচী বলে , ‘ ভাবী কি আর ঝামেলার মাঝে আসবে? উপরতলায় বসে টিভি দেখছে। আমার ছেলেটাকে তো দেখতেই পারে না। এখন ছেলে যদি এরকম হয় আমি কি করতে পারি বল? কম চেষ্টা তো আর করি না। ‘
‘ আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি কেঁদো না। মেয়েটাকে কোথায় রেখেছো? ‘
‘ তুলির ঘরে। ‘
তানভীর তুলির ঘরের দরজা নক করে। তুলি এসে দরজা খুলে দেয়। তানভীরকে দেখে যেনো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
‘ ভাইয়া আসছো! ‘
‘ মেয়েটা কোথায়?’
‘ ভেতরে আসো। শুধু কাঁদছে। এইযে থামতে বলছি থামছেই না।’
তানভীর ভেতরে ঢুকে। বিছানার উপর গুটিশুটি হয়ে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছে একটা বাচ্চা মেয়ে। সবুজ সাদা স্কুল ড্রেস তার পড়নে। চুল গুলো দুপাশে দুটো বেণী করা সাদা ফিতা দিয়ে। বড় চোখের গোল গাল দেহের গড়ন। মুখটা যেনো মায়ার আঁধার। এই মেয়েটাকে তুলে নিয়ে এসেছে ইকবাল! তানভীর এগিয়ে যায়। লাবিবা বড় বড় চোখ করে তার দিকেই তাকিয়ে। দুই গালে চোখের জলের দাগ পড়ে গেছে। লাবিবার মাথায় হাত রেখে বলে, ‘ ভয় পেও না। নাম কি তোমার?’
‘ লাবিবা। ‘
‘ কোন স্কুল?’
তুলি বলে, ‘ আমাদের স্কুলেই পড়ে ভাইয়া। ‘
‘ চিনিস ওকে?’
‘ চিনি। নাইনে পড়ে। আমার এইটের বইগুলো ওকে দিয়েছিলাম পড়তে। ‘
‘ আচ্ছা। ‘
লাবিবাকে বলে, ‘ কান্না করে না বেবী গার্ল। তোমার বাবা আসবে তোমাকে নিতে। ইকবালকে আগে চিনতে তুমি?’
লাবিবা মাথা নাড়ায়।
‘ খারাপ ছেলে। স্কুলের ছাদে উঠে সিগারেট খায়। ‘
তানভীরের যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে।
ইকবালকে ড্রয়িং রুম থেকে হাত ধরে নিজের রুমে নিয়ে আসে।ইকবাল যেনো আরো বিরক্ত হয়। তানভীরের সাথে তার সম্পর্ক মোটেই ভালো নয়। সব সময় অকারেন্স ঘটিয়ে আসে। তানভীর শাসন করতে গেলেই ইকবাল গালাগালি শুরু করে। ছোট ভাই কিছু করলে বংশের নাম খারাপ হবে। সেজন্য বাধ্য হয়ে তানভীর ইকবালকে শাসন করে।
‘ মেয়েটাকে কেনো তুলে নিয়ে এসেছিস?’
‘ তোমাকে কেনো বলবো?’
‘ যদি বলিস তাহলে তোকে বাঁচানোর চেষ্টা করবো।’
‘ পাক্কা?’
‘ পাক্কা। ‘
‘ জাহিদের সাথে বাজি ধরেছি রাস্তায় যদি কোনো সুন্দরী মেয়ে পাই তাকে যদি বিয়ে করতে পারি তাহলে ফাইনাল পরিক্ষায় আমাকে সব দেখিয়ে পাশ করিয়ে দিবে। এইবার আর ফেল আসবে না। ‘
‘ মেয়ে তুলতে গিয়ে একটা বাচ্চাকে তুলে নিয়ে এসেছিস তুই।’
‘ কোন এঙ্গেলে লাগে?’
‘ কি? ‘
‘ বাচ্চা?’
‘ ইকবাল ভদ্র ফ্যামিলির ছেলে তুই। এসব তোকে যায় না। ‘
‘ বিশ্বাস না হলে তুলির ঘরে আছে। দেখে আসো যাও। ভাইয়ের বউ হবার পর তো আর ভদ্রতা বজায় রাখতে দেখতেও পারবেনা। ‘
তানভীরের ভীষন রাগ হয়। ইকবালকে বলে,
‘ সরি। তোকে আমি হেল্প করতে পারলাম না। ‘
ইকবাল তানভীরের হাত টেনে ধরে।
‘ আরে ভাই এইটা তো কথা ছিলো না। কিছু একটা ব্যবস্থা করো। বাবা চাচ্চুর হাবভাবে ভরসা করতে পারছিনা। জেলে যেতে হবে আমাকে। ‘
‘ যা ইচ্ছা কর। খারাপ সঙ্গে মিশে খারাপ হয়ে গেছিস। আমার বারণ শুনিস নি। আজ দেখ তোর কি হয়।’
লাবিবার বাবা যখন পুলিশ, নিয়ে আসে ততোক্ষনে তানভীরের যাকে খবর দিয়েছে সেই এসপি দারোগাকে ফোন করে দিয়েছে। বাবাকে দেখে পাখির মতো ছুটে যায় । বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে লাবিবা। কাঁদতে কাঁদতে বাবার বুকেই ক্লান্ত হয়ে মিশে থাকে। তাকে পুলিশ জিজ্ঞেস করে,
‘ এই ছেলেটার সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক আছে? ‘
লাবিবা মাথা নাড়ে। সম্পর্ক নেই।
‘ শত্রুতা আছে?
তাও নেই। লাবিবার সাথে এই ছেলের কোনো লেনাদেনা নেই। যখন বিয়ের আলাপ উঠে তখন লাবিবার আব্বু মেয়ের জম্মনিবন্ধন সাবমিট করে এবং অপহরণ অপরাধে ইকবালকে ধরে নিয়ে যেতে বলে। ইকবালের বাবা বাধ্য হয়ে প্রস্তাব রাখে লাবিবাকে তাঁদের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে। লাবিবার বাবা বেঁকে বসে । কখনোই না। বখাটে ছেলের সাথে তার একমাত্র ফুটফুটে মেয়ের কখনোই বিয়ে দিবে না। নাবালক ছোট্ট মেয়ে তার!
চেয়ারম্যানের কাছে বিচার বসে। পুলিশ এই বিচারের অপেক্ষা করছে। দারোগা তানভীরকে বলে,
‘ তোমার ভাইকে থানায় নিতেই হবে। একেতো অপহরণ করেছে। তার উপর মেয়েটা নাবালক।তোমরা যদি বিয়ে করাতে চাও তাহলে বাল্যবিবাহ হবে। সব মিলিয়ে কঠিন শাস্তি হবে তোমার ভাইয়ের।’
‘ তাহলে কি করবো ভাই?’
‘ আপোষ করে যাও। বিয়ের দিকে এগিও না। ‘
পঞ্চায়েত কি আর তা মানে? তানভীররা অনেক চেষ্টা করেও দমাতে পারে না। বংশের মান সম্মান শেষ। মুখ দেখানোর আর জায়গা রইলো না। ইকবালের বাবা ক্ষুব্দ হয়ে ইকবালকে ডাকে। ততোক্ষনে ইকবাল আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি টের পেয়ে পালিয়েছে এলাকা ছেড়ে। লাবিবার বাবা মিনতি করে,
‘ আমাকে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে দেন চেয়ারম্যান সাহেব। ‘
‘ তা নয় ফিরবে। কিন্তু তোমার মেয়ের তো কলঙ্ক লেগে গেলো। কে বিয়ে করবে তোমার মেয়েকে?’
‘ কি বলেন? আমার মেয়ে নাবালক। বাচ্চা মেয়ে। ‘
‘ তোমার মেয়ের থেকে কতো ছোট ছোট মেয়ের বিয়ে হচ্ছে! তারা কান্দির জামালের মেয়েটা, সেভেনে পড়ে। এক ছেলের সাথে ভেগে গেছে। কয়েকদিন হলো ছেলে বাচ্চা হয়ছে। আর তোমার মেয়ে তো উচা লম্বায় ভালোই ডাঙর হয়ছে। ‘
মেম্বার বলে, ‘ একটা ব্যবস্থা করা দরকার। কলঙ্কিনী মেয়ে গ্ৰামে রাখলে গ্ৰামের পোলাপান গুলা নষ্ট হয়ে যাবে। ‘
নিদোর্ষ মেয়ে সম্পর্কে এমন কথা শুনে লাবিবার বাবা ভেঙে পরে। তাকে গ্ৰামের লোকজন বোঝায় মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে।
তানভীরের বাবাকে বলে, ‘ আপনাদের ছেলে দোষ করেছে এবার আপনারাই মেয়েটার দায়িত্ব নিবেন। ‘
‘ কিন্তু ইকবাল যে পলাতক। কে বিয়ে করবে?’
লাবিবার বাবা বলে, ‘ আমার মেয়েকে আমি নদীতে কেটে ভাসিয়ে দিবো। কিন্তু ঐ বখাটের সাথে বিয়ে দিবোনা মেম্বার সাহেব। মেয়ে আমার নিদোর্ষ এখানে সবাই জানে। কেনো আপনারা আমার মেয়ের গায়ে জোর করে কলঙ্ক লাগিয়ে দিচ্ছেন?’
‘ কতজনের মুখ বন্ধ করবেন আপনি? ‘
ভদ্রলোক কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। চেয়ারম্যান দারোগার সাথে কি যেনো ফিসফিস করে। তানভীরের বাবা বলে,
‘ আমাদের ছেলেকে খুঁজে বের করি। বিষয়টা পরে দেখা যাবে। ‘
‘ আরে মিয়া কিসের পরে দেখা যাবে? এক ছেলে নাই আরেক ছেলে তো আছে। আর মেয়ের বাবা তো বলেই দিছে আপনার ঐ বখাটে ছেলের সাথে বিয়ে দেবেনা মেয়ের। ‘
‘ ভাইসাব আমাদের বড় ছেলে আর আপনাদের মেয়ের বয়সের অনেক ফারাক। নাবালক মেয়ে আপনাদের বাল্যবিবাহ দেওয়া অন্যায় হবে। ‘
‘ ছেলে মানুষের বয়স কোনো বয়সই না। আর রেজিঃ না করালেন আল্লার কালাম পরায়ে রাখেন। তাহলে তো কোনো সমস্যাই না। ‘
তানভীর প্রতিবাদ করে, ‘ অসম্ভব। আমি এই বিয়ে করতে পারবো না। ‘
এলাকার ছেলে গুলো ভিডিও করছে দেখে মারামারি লেগে যায়। তানভীরের বাবা বলে,
‘ চেয়ারম্যান সাহেব আইন সামলাবেন। বংশের মান না বাচাইলেও মেয়েটার মান বাঁচাও আব্বা। ‘
ইউনিয়ন পরিষদেই তানভীর লাবিবার বিয়েটা হয়ে যায়। কে যেনো কোথা থেকে একটা লাল উড়না জোগাড় করে আনে। স্কুল ড্রেস পরে লাল উড়না মাথায় দিয়ে তানভীরের নাম কবুল পড়ে লাবিবা। কি হচ্ছে বোঝে উঠতেই ছোট্ট মনে বেশ কৌতুহল হয়। পুরোটা সময় তানভীরের দিকে কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে থাকে লাবিবা। লম্বা করে রাগী রাগী চেহারার লোকটা! গলায় এডামস এ্যাপল ফুঁসে উঠছে বারবার। নাকটাও বেশ চোখা। কবুল বলেই তানভীর উঠে গেলো একবারের জন্যও লাবিবাকে তাকিয়ে দেখলো না।
®লাবিবা_তানহা_এলিজা