#ঘরে_ফেরার_গান (১)
আমাদের জীবনে সামান্যতম ভুল কখনো কখনো বিশাল প্রভাব ফেলে। জনাব তানভীর খানের করা সামান্য ভুলটাকে নেহাত সামান্য বলা যায় না। তার জীবনের সেরা ভুলটা ছিলো পরিস্থিতির সৃষ্টি মাত্র একটি অপ্রিতিকর ঘটনা। একজন আটত্রিশ বছর বয়সী পুরুষ হয়েও তার কোনো গন্তব্য নেই। তার এই গন্তব্যহীন পথ চলা একজনের খোঁজে। যে দিবে তাকে আহ্বান । গাইবে ঘরে ফেরার গান। আজ রাতটাও তার অফিসেই কেটে যাবে। বারিপ্লাজা এবং উত্তরায় দুটি শো রুমের পাশাপাশি আরো দুটি শো রুম খোলা হবে। নেক্সট টার্গেট তার বাটারফ্লাই অথবা আল হেরার বিল্ডিং এ। ম্যানেজার আশসাব জানতে চান,
‘ স্যারের জন্য ডিনার অর্ডার করবো?’
‘ রেস্টুরেন্ট খোলা আছে আশেপাশে?’
‘শুধুমাত্র বাবুবাজার রোড়ে নতুন রেস্টুরেন্টটি খোলা আছে স্যার। বাকিগুলো এতোক্ষনে ক্লোজ হয়ে গেছে।’
তানভীর এক হাতে গলাবন্ধনী টেনে ঢিলে করে কিছুটা নামিয়ে নেয়। ঘড়িতে মাত্র নয়টা সতেরো। ম্যানেজারের দিকে কনফিউজড লুক দিয়ে জানতে চায়,
‘ ঘড়ির কাঁটা নয়টার ঘরে। এতো আর্লি কেনো শহরের রেস্টুরেন্ট গুলো বন্ধ হবে?’
‘ দুদিন থেকে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। এক মিনিটের জন্য থামাথামির নাম নেই। রোডে পানি জমে মানুষের স্বাভাবিক চলা ফেরার ব্যাঘাত ঘটেছে। ঢোলাদিয়ার দিকে তো বিদ্যুৎ নেই। জেনারেটর দ্বারা চলছে।ফোরকাস্টে দেখাচ্ছে পরশু অব্দি চলবে টানা বর্ষণ।’
জানালার পর্দা সরিয়ে ভারি বর্ষণ অবজার্ভ করলো তানভীর। সত্যি মনে হলো আজ আর থামবেনা। মুষলধারে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে তানভীর। চাকায় জল ছিটিয়ে ছুটে চলে তার হুয়াইট কালার নোহা কার। একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তায় এক হাঁটু পরিমান জল জমে যায়। চলাচলে কি একটা সমস্যা! দশমিনিটের রাস্তা ত্রিশ মিনিটে পৌঁছালো তানভীর। রেস্টুরেন্টের ভেতরে কোনো কাস্টমার নেই। এটিও ক্লোজ হবার পথে । তানভীরকে বসতে দেখে একজন ওয়েটার এগিয়ে এলেন।
‘ রেস্টুরেন্ট কিছুক্ষনের মধ্যে ক্লোজ হয়ে যাবে। আপনি লেট স্যার। ‘
‘ ওকে। লাস্ট কাস্টমার হতে চাই। ‘
‘ কি খাবেন স্যার? ‘
‘ থাই আইটেম। ‘
‘ সরি স্যার। আমাদের সকল স্টাফ ইতোমধ্যে বেরিয়ে গেছেন। আমি এবং একজন শেফ , আমরা এই দুজনই আছি মাত্র। আজ আমাদের বুফে ডে ছিলো। আপনি চাইলে মিট আইটেম গুলো গরম করে সার্ভ করতে পারি। ‘
‘ মিট ছাড়া অন্য কিছু নেই? ‘
‘ সরি স্যার। ‘
তানভীর কিছুক্ষন বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে। টেরেসে সাজানো ক্রিসমাস ট্রি ফেইড়ি লাইট দিয়ে সাজানো। তার উপর ঝম ঝম করে পরছে বৃষ্টিকণা। অর্ডারের আশায় ওয়েটারও দাঁড়িয়ে থাকে যতক্ষন না তানভীর কিছু মেনু ঠিকঠাক বলে।
‘ শেফ, যিনি আছেন উনি কি লোকাল ?’
‘ জি স্যার। ‘
‘ উনাকে বলুন ধোঁয়া উঠা গরম ভাতের ব্যবস্থা করতে। সাথে ঝাল চ্যাপা শুঁটকি ভর্তা উইথ পেঁয়াজ মরিচ দিয়ে পোড়া পোড়া একটা ডিমভাজা। ‘
‘ স্যার!’
‘ এক্সটা পে করবো। হাফ আউয়ার টাইম দিচ্ছি। ‘
‘ ওকে স্যার। ‘
ওয়েটার কিচেনের দিকে দৌড়ে যায়।
‘ গরম ভাত হবে? ‘
‘ হবে।’
‘ ঝাল করে চ্যাপা শুঁটকি ভর্তা করে ফেলো। বেশি করে পেঁয়াজ মরিচ কুচি দিয়ে পোড়া পোড়া করে একটা ডিমও ভেজে দাও। সময় আধাঘণ্টা। ‘
‘ এসব আমাদের রেস্টুরেন্টের ম্যানু না।
‘ লাস্ট কাস্টমার। এক্সটা পে করবে বলেছে। ‘
‘ কি আশ্চর্য! সবাই চলে গেছে। আমি বাসায় কখন যাবো সবুজ ভাই?’
‘ রেস্টুরেন্ট ক্লোজ হবার পর। কিচ্ছু করার নাই।’
সবুজ ঠোঁট উল্টে দাঁড়ায়। লাবিবা বিরক্তি নিয়ে পেঁয়াজ এগিয়ে দেয় সবুজের দিকে।
‘ হেল্প করো। আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে সবুজ নাকের পানি চোখের পানি এক করে ফেলে। লাবিবা দেখা মাত্রই হাত থেকে নাইফ কেড়ে নেয়। সবুজকে দেখে তার গা গুলিয়ে আসে। আঙুল তুলে শাষায় সবুজকে,
‘ এই কি করছো! ছি ছি যাও এখান থেকে। নিশ্চিত আজ তোমার ডার্টি পেটে গেলে লোকটার ডিসেন্ট্রি শুরু হবে। ‘
সবুজ বেসিনে গিয়ে চোখে মুখে পানি দেয়। চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে গেছে। মুখ মুছে লাবিবার পাশে এসে দাঁড়ায়।
‘ কিছুই হবে না। ছোট বেলায় কতো খেয়েছি জানো? ললিপপের সাথে মিক্স করে দারুন টেস্টি ভুলা যায় না।’
লাবিবার কল্পনায় সেই দৃশ্য ভেসে উঠে। গ্লাবস খুলে বেসিনে দৌড়ায়। কয়েকবার ওক্ ওক্ করেও বমি হয় না। সে সবুজকে বলে বেরিয়ে যেতে। উচিত ই হয়নি তাকে কিচেনে ঢুকতে দেওয়া।
ছত্রিশ মিনিট পর টেবিলে ধোয়া উঠা ভাত, চ্যাপা শুঁটকি ভর্তা, আলু ভর্তা,ডিম ভাজা সাথে মগজ ভুনা দেওয়া হয়। তানভীর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সবুজ বলে,
‘ শেফের পক্ষ থেকে। পছন্দ হলে অবশ্যই ট্রাই করবেন।’
‘ ঠিক আছে।’
তৃপ্তিভরে খাওয়া শেষে তানভীর ওয়েটারকে বলে,
‘ শেফ কে ডাকুন। লাস্ট কাস্টমারকে খাতিরদারি করার জন্য তার অবশ্যই টিপস প্রাপ্ত। নিজ হাতে দিতে চাই। ‘
‘ সরি স্যার। শেফ এই মাত্র বেরিয়ে গেছে।’
‘ ঠিক আছে। খাবারগুলোর টেস্ট ভালো ছিলো। স্পেশালি চ্যাপা শুঁটকি ভর্তাটা অসাধারণ ছিলো।’
‘ এসব আইটেম আমাদের ম্যানু বহির্ভূত। ‘
‘নেক্সট টাইম যদি আসি এটাই প্রথমে আবদার করবো।’
‘ ধন্যবাদ স্যার। আবার আসবেন। ‘
তানভীর রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে দেখে হ্যান্ড ব্যাগ হাতে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে গোলাপী রঙের হিজাব, বোরখা। একটা রিকশা যাচ্ছে সামনে দিয়ে। মেয়েটি ডেকে উঠে,
‘ এই মামা যাবেন?’
‘ কই যাবেন?’
‘ সার্কিট হাউজ।’
‘ একশ টাকা।’
‘ বিশ টাকার ভাড়া বৃষ্টির কারণে বড়জোড় পঞ্চাশ টাকাই নেন। এতো চান কেনো মামা? ‘
‘ একশ টাকার নিচে যাবো না। ‘
মেয়েটি দাঁড়িয়ে থাকে আরেকটা রিকশা পাওয়ার আশায়। তানভীরের অফিসে ফিরতে ইচ্ছে করছে না। আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা। নরম বিছানায় কম্বলমুড়ি দিয়ে অনেক ভালো একটা ঘুম হবে মনে হচ্ছে। তাই সে কল করে আশসাবকে জানিয়ে দেয় বাসায় যাচ্ছে,অফিসে ফিরবেনা। ততোক্ষনে রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে। সবুজ বেরিয়েছে তার হিরো মটরসাইকেল নিয়ে। তানভীর গিয়ে গাড়িতে উঠে। সিটবেল্ট লাগিয়ে নেয়। গাড়ি স্টার্ট করে পার্কিং থেকে বের করবে এমন সময় স্পষ্ট কানে আসে, ‘এই লাবিবা, মটরসাইকেলের পেছনে উঠো, তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেই। ‘
‘ রিকশা নিয়ে চলে যাবো সবুজ ভাই। ‘
‘ রিকশা পাবে না। ছাতা মাথায় তাড়াতাড়ি উঠোতো লাবিবা।’
তানভীর স্পষ্ট শুনলো নামটা।
‘ লাবিবা’
যতক্ষনে সে গাড়ি থেকে তাড়াহুড়ো করে স্পটে আসে ততোক্ষনে দূর থেকে শুধু মটরসাইকেলের পেছনের ক্ষীন আলো দেখা যায়।
®লাবিবা তানহা এলিজা