#গোলকধাঁধা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৮
প্রত্যয় শক্ত গলায় বলল,
‘আমি তো সেবাই ভাবছি অন্যকিছু কেন ভাবতে
যাবো বউ?’
ওর চোখেমুখে কুটিল হাসি। সিরাতের
ভেতরটা কেমন কেঁপে ওঠলো। এই লোকের মতলব ওর কাছে একদম ভালো ঠেকছে না। সব কাজ শেষ করে খাবার নিয়ে আবারও ফিরে গেলো। সেখানেও প্রত্যয় ওকে ছাড় দিলো না। হাত ভালো হয়ে যাওয়া স্বত্তেও সিরাতকেই খাইয়ে দিতে হলো ওকে। সবটা যে ইচ্ছে করে করছে তা বেশ জানে ও!
____________
শীতের আগমন ঘটেছে প্রকৃতিতে। চারদিকে ঠান্ডা বাতাস আর কুয়াশার ঘনঘটা। নরম রোদে ঝলমল করে সবকিছু। এ সময়টা সিরাতের বেশ প্রিয়। খুব উপভোগ করে সে, নিজের মতো একলা থাকতে ভালোবাসে। কিন্তু এবার সময় ভিন্ন। পুরোপুরি অন্য একটা পরিবারে এসে চাইলেও নিজের মতো কিছু করা যায় না। মানুষগুলোর মধ্যে ধীরেধীরে নিজেকে মানিয়ে
নেওয়ার চেষ্টা করলেও মিশিয়ে নিতে পারবে না এটা
ও নিশ্চিত। বিকেলে অলস সময় কাটাচ্ছিলো বারান্দার ফুল গাছ গুলোর যত্ন নেওয়ার মাধ্যমে। এমন সময় ফোন এলো। ঘরে গিয়ে রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মায়ের গলা শোনা গেলো, ‘কেমন আছিস?’
‘ভালো। তোমরা কেমন আছো?’
‘আমরা ভালোই আছি। জামাইয়ের শরীরটা এখন কেমন?’
সিরাত দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিলো,
‘হাঁটাচলা করতে পারে এখন, ভালো আছে।’
‘যাক আলহামদুলিল্লাহ, দে না একটু কথা বলি?’
সিরাত তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
‘বাড়ি নেই। বেরিয়েছে।’
মিনারা বেগম অবাক গলায় বললেন,
‘শরীরের এই অবস্থায় বাইরে যেতে দিলি কেন?’
সিরাত কিছুটা রুক্ষ গলায় বলল,
‘হুহ, আমি যেতে দেওয়ার কে? মা-বাবার কথাই শোনে না সেখানে আমি কি করে আটকাবো? বাদ দাও!’
মিনারা বেগম ধমকে বললেন,
‘তুই ওর স্ত্রী। জামাইকে কিভাবে বেঁধে রাখতে হয় সেটাও বুঝিস না যে এই অসুস্থ শরীরে বেরিয়ে যেতে দিলি! গাধী। নারীর বাঁধনে যে পুরুষ একবার পরে সে কিভাবে কথা না শোনে থাকে?’
সিরাত লজ্জায় উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দিলো।
মা এসব কি বললো? ইশ, এই লোকটার জন্য ওকে আর কত অপদস্ত হতে হবে কে জানে! আজ আসুক, হেস্তনেস্ত একটা করেই ছাড়বে!
কিন্তু হেস্তনেস্ত আর করা হলো না। প্রত্যয় বাড়ি
ফিরলো কারো ওপর রেগে। ফোন কলে কিছুক্ষণ চোটপাট চালালো। এরপর কল কেটে রাগ রাগ
ভঙ্গিতেই কিছুক্ষণ পায়চারি করলো ঘরের এ মাথা, ও মাথা। গায়ের পাঞ্জাবি খুলে ফ্রেশ হয়ে হতে গেলো। বারান্দায় বসে ওলের সোয়েটার বুনছিলো সিরাত। প্রত্যয়ের কান্ডগুলো সবটাই দেখেছে সে। সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে তোয়ালে পরে ওয়াশরুম থেকে বেরুলো প্রত্যয়। হাঁক-ডাক ছেড়ে সিরাতকে ডেকে বললো ওর কাপড় বের করে দিতে। ও বারান্দা থেকে এসে কাপড় বের করে দিলো। কিন্তু প্রত্যয় বললো সে এসব পরবে না। অগত্যা সিরাত অন্য একসেট বের করলো, প্রত্যয় আগের মতো এটাও রিজেক্ট করলো। বারবার এমন করায় সিরাত বলেই ফেললো, ‘নিজের কাজ
নিজেই করুন তাহলে। অযথা আমাকে খাটাচ্ছেন কেন?’
প্রত্যয় শক্ত মুখে জবাব দিলো,
‘পারবো না।’
সিরাত বলল,
‘শুনুন, আমি আপনার চাকর নই আমি। পারবো না আপনার এসব কাজ করতে। আপনার অত্যাচার মেনে নেওয়া যাচ্ছে না আর।’
‘কেন? কি করবে তুমি? ডমেস্টিক
ভায়ো’লেন্সের মামলা?’
বিরক্তিতে সিরাতের মাথা ধরে এলো,
‘আপনি আসলেই একটা যা-তা। কথা বলাই বেকার।’
বলে ড্রয়ারের সব কাপড় বের করে দিলো। প্রত্যয় সেসব না ছুঁয়ে প্রথমে বের করা ট্রাউজার আর টি-শার্টটাই পরলো। সিরাত এবার হতভম্ব হয়ে বলল,
‘এটাই যখন পরবেন তখন এত নাটক করলেন কেন?’
প্রত্যয় বিছানায় শুয়ে পড়লো। গমগমে স্বরে বলল,
‘বাইরে থেকে এসে তোমাকে সামনে যেন দেখি
এরপর থেকে। লুকিয়ে-চুরিয়ে থাকলে এমনই হবে।’
সিরাত অবাক হয়ে বলল,
‘লুকালাম কোথায়? আমি তো বারান্দায় ছিলাম।’
‘ভালো করেছো। এখন সব গুছাও বসে বসে।’
প্রত্যয় কটাক্ষ করে জবাব দিলো। এরপর পাশ
ফিরে ঘুমিয়ে পড়লো। সিরাত রাগ নিয়ে সব গুছাতে লাগলো। এই লোকটা ওকে এক ফোঁটা শান্তিও দিচ্ছে না। পা ভাঙ্গার পরও শান্তি দেয়নি, এখন সুস্থ হওয়ার পরও দিচ্ছে না। কোন কুক্ষণে যে লোকটার সাথে
ওর দেখা হয়েছিলো ভাবতেই ওর চোখের কোণে জল জমে গেলো।
__________
সিরাতের মনটা আজ খুব ভালো। বহুদিন পর শান্তিমতো কলেজে এসেছে সে। ক্যান্টিনে বসে
বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো ও। তখুনি সেখানে প্রত্যয়ের প্রতিপক্ষ দলের লিডার সোহান আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা এসে বসলো। সিগারেটে ফুঁ ধোঁয়া ওড়িয়ে সে বয়রা’কে চা-সিঙ্গারা দিতে বললো। পাশের টেবিলে
সিরাতকে দেখতে পেয়েই দাঁত বের করে হেসে
জিজ্ঞেস করলো,
‘কি ব্যাপার ভাবী সাহেবা? কেমন আছেন?’
সিরাত বিব্রত হলো। এই লোকটাকে তার একটুও সুবিধার মনে হয় না। কেমন অশালীন চাহনি।
ও শক্ত গলায় বলল,
‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো!’
সোহান শব্দ করে বিশ্রি ভঙ্গিতে হাসলো,
‘ভালো তো থাকবেনই। যার বিরুদ্ধে এত নাটক,
সিনেমা করলেন শেষমেশ তার গলায়ই ঝুইলা পড়লেন? কিসের অফার করছিলো আপনারে যে
লোভ সামলাতে পারলেন না?’
অনল, রাহী প্রতিবাদ করতে গেলে সিরাত ওদের থামিয়ে দিলো। কথা বাড়ালেই ঝামেলা শুরু করবে অহেতুক। বন্ধুদের ইশারা করলো সেখান থেকে ওঠে যেতে। সোহানের এক চেলা বলল, ‘আরেকটারে ধইরা নিয়া গেছে ভাই। গাছতলায় উত্তম-মধ্যম দিতাছে।’
সোহান সিরাতকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আগে তো প্র্ত্যয় চৌধুরীর নামে কতকিছুই করতেন, এবার তাইলে স্বামীর বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেবেন ভাবীজান? আমরাও শুনি!’
বলে সকলে মিলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।
সিরাতের রাগে গা কাঁপতে লাগলো। ছুটে গেলো
দ্রুত। গিয়ে একজনের কাছে থেকে জানতে পারলো এক মেয়েকে উত্যক্ত করছিলো এই ছেলে, দিয়েছিলো বাজে প্রস্তাবও। সেই মেয়ে এসে বিচার দিয়েছে প্রত্যয়কে। সেইজন্যই ওকে এনে উত্তম-মধ্যম
দেওয়া হচ্ছে। সিরাত বেশ বিরক্ত
হলো এবার নিজের জীবনের ওপর। দ্রুত পায়ে
এগিয়ে গেলো সেদিকে।
প্রত্যয়ের মারধর পর্ব চলছে। আশেপাশে খেয়াল নেই ওর। কিন্তু তক্ষুনি আচমকা মারামারির মাঝখানে কেউ এসে পড়ায় ও ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় তাকে। তাল সামলাতে না পেরে গাছের ডালে বারি খেয়ে প্রচন্ড
ব্যথা পেয়েছে কপালে সিরাত। কেটেও গেছে বেশ খানিকটা জায়গা। হাত-পা ছুঁলে গেছে। রাগের মাথায় প্রত্যয়ের মাথা কাজ করছিলো না, খেয়াল করেনি ধাক্কাটা সে কাকে দিচ্ছে! কিন্তু যখন মাহিন আর অন্যান্য ছেলেরা হায় হায় করে ওঠলো তখুনি ওর
টনক নড়লো। সিরাত নিজেও স্তব্ধ! কপালে হাত
দিতেই ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠলো। প্রত্যয় হতভম্ব হয়ে ওর দিকে দ্রুত এগিয়ে গেলে সিরাত ঘৃণা মিশ্রিত চাহনি নিক্ষেপ করে সেখান থেকে দৌড়ে চলে গেলো। বাকিটা সঙ্গীদের সামলাতে বলে প্রত্যয় নিজেও সেখান থেকে চলে এলো। কিন্তু সিরাতকে আর খুঁজে পেলো না সে কোথাও। তড়িঘড়ি করে বাড়ি চলে এলো, এসে দেখে সিরাত নেই। ফোনও বন্ধ। প্রত্যাশা আর মুশফিকা চৌধুরী ঘাবড়ে গেলেন পুত্রের অস্থিরতা দেখে। প্রত্যয় কাউকে কিছু না জানিয়ে আবারও বেরিয়ে ফোন করলো কাউকে।
এদিকে খুব বেশি আঘাত না লাগলেও কপাল ফুলে গেছে সিরাতের। হালকা কাটাযুক্ত স্থানটা ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে ডিসপেনসারি থেকে। আপাতত
ব্যথানাশক ঔষধ খেয়ে বিছানায় ঘুমিয়ে আছে সোহাকে নিয়ে। বহুদিন পর মেয়ে বাড়ি আসায় শিমুল সাহেব বাজার করেছেন বেশ। বড় মাছ, মাংস এনেছেন তিনি। এদিকে মিনারা বেজায় খুশি। তবে মেয়েকে এভাবে বিধস্ত অবস্থায় দেখে তারা বেশ চিন্তিত ছিলেন। সিরাত জানালো বাড়ি আসার পথে রিকশা থেকে পড়ে ব্যথা পেয়েছে। যাইহোক, মেয়ের জন্য মিনারা ওর পছন্দের ভুনা খিচুড়ি আর মাংস রান্না করছেন।
রাত নয়টা। চার-পাঁচ ঘন্টা পর ঘুম ভেঙেছে সিরাতের।
তবে এমনি এমনি ওর ঘুম ভাঙেনি। পরিচিত এক পারফিউমের সুবাস নাকে ধাক্কা খাচ্ছে বারবার। চোখ কচলে তাকিয়ে দেখলো সোহা নেই। হয়তো মা নিয়ে গেছে ভেবে ওঠে বসার চেষ্টা করতেই ‘আহ’ শব্দ করে ওঠলো। বেশ ব্যথা করছে জায়গাটা। এমন সময়
গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘আমাকে না বলে এখানে এসে একদম ঠিক কাজ
করো নি।’
সিরাত জানে কন্ঠটা কার। তবুও সে চমকে ওঠলো।
পাশ ফিরতেই আধশোয়া অবস্থায় প্রত্যয়কে দেখে
নির্বিকার কন্ঠে বলল,
‘এখানে কেন এসেছেন?’
‘তোমার কি বেশি লেগেছে? চলো ডাক্তারের কাছে যাবে।’
সিরাত উত্তরে বলল,
‘আমি ঠিক আছি। ডাক্তার-ফাক্তারের নাটক করতে হবে না। শুনুন, এসেছেন যখন খেয়েদেয়ে যাবেন।
আর একটা কথা, আমি আপনার সাথে কোনো কথা বলতে চাই না।’
বলে ওঠে চলে গেলো। প্রত্যয় সেদিকে তাকিয়ে থেকে আনমনে বললো, ‘রাগ করে কি হবে! আমি তো ইচ্ছে করে করি নি!’
মায়ের কাছ থেকে সিরাত জানলো আধঘন্টা আগে এসেছে প্রত্যয়। সঙ্গে এনেছে এত এত ফল, মিষ্টি।
সিরাতের কাজিন নীরু তো দুলাভাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু সিরাত এই লোকের নাটকের ওপর চরম বিরক্ত হলো। সোহাকে নিয়ে সে খাবার খেয়ে নিলো। এরপর মাকে গিয়ে বললো সোহাকে নিয়ে সে পড়ার ঘরে থাকবে। প্রত্যয় থাকতে চাইলে যাতে ওর বিছানাপত্র করে দেয়। এরপর ও সোহাকে নিয়ে পড়ার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। প্রত্যয় এসব দেখে মনে মনে ভীষণ রেগে যায়। তবুও সে শান্ত থাকে। একবার বাড়ি যাক, এরপর একে সে দেখে নেবে। শিমুল সাহেব খাওয়ার জন্য ডাকতে এলে ও
জানিয়ে দেয় বাইরে থেকে খেয়ে এসেছে, ক্ষিধে নেই। সিরাতের মা-বাবা লজ্জায় পড়ে যান এবার। কান্ড
দেখে দুজনেই বুঝতে পারেন নিশ্চয়ই ঝামেলা হয়েছে। মিনারা নিজের মেয়ের কান্ডজ্ঞানের অভাব দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে কথা শোনাতে থাকেন। শিমুল সাহেব তাকে এ ব্যপারে নাক গলাতে মানা করেন। সিরাত ঘরে বসে সবই শুনছিলো। তবুও তেমন পাত্তা দিলো না ব্যাপারটাতে। প্রত্যয়ের আজকের কর্মকাণ্ডে বেশ হার্ট হয়েছে ও। সোহাকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়ানি কবিতা পড়তে লাগলো।
তবে ঘন্টা পেরুতেই ও আর শান্ত থাকতে পারলো না। মন খচখচ করতে লাগলো। এই লোক তো ক্ষিধে নিয়ে থাকতেই পারে না, এ নিয়ে কত জ্বালায় ওকে! এতদিনে এসব ওর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। দরজা খুলে বেরিয়ে এসে দেখলো সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। রান্নাঘরে গিয়ে প্লেটে খাবার নিলো। নিজের ঘরের দরজা ঠেলতেই খুলে গেলো। দেখলো প্রত্যয় উল্টো হয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে নেই বুঝে সিরাত শক্ত গলায় বলল,
‘ওঠুন, খেয়ে নিন।’
প্রত্যয় চোখ খুললো,
‘খাইয়ে দাও।’
সিরাত তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,
‘পারবো না। খেলে খান না খেলে আমি যাই।’
প্রত্যয় ওঠে বসলো। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘আমার হাত কেটে গেছে।’
সিরাত সাথে সাথেই বলল,
‘উচিৎ বিচার হয়েছে।
প্রত্যয় ভ্রু কুঁচকে দেখলো ওকে। এরপর গোমড়া
মুখে বলল,
‘আমার ক্ষিধে পেয়েছে।’
হাসি চেপে সিরাত ওকে খাইয়ে দিতে লাগলো।
জানতো গুন্ডা’টা এমন নাটক করবে, তাই ও
আগেই হাত ধুয়ে এসেছে। খাইয়ে দিতে দিতে প্রশ্ন করলো,
‘এসব কাজকর্ম কি আপনি কোনোভাবেই বন্ধ
করবেন না? কি পান এসব করে?’
‘তোমার ঘৃণা।’
সিরাত ভ্রু কুঁচকালো,
‘আমার ঘৃণা আপনার এতো ভালো লাগে?’
‘না তো।’
‘তাহলে করেন কেন?’
প্রত্যয় পানি খেতে খেতে বলল,
‘আচ্ছা, আর করবো না।’
’
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]
চলবে….