#গোলকধাঁধা
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৫
ওয়াশরুম থেকে বেরুতেই প্রত্যয় কটমট করে বলল, ‘আমার নামে নালিশ করলে
কেন? শাস্তি তো তুমি মাথা পেতে নিয়েছো।’
সিরাত বলল, ‘আমি তো নালিশ দিইনি, সত্যটাই বলেছি।’
‘আমি তো ভুলেই গেছিলাম তুমি সত্যবাদী যুধিষ্ঠি।’
প্রত্যয় চটে গেল। সিরাত রাগী গলায় বলল,
‘একদম আজেবাজে কথা বলবেন না। আপনি আসলে বড্ড ইনসিকিউরড, তাইনা?’
‘কে বললো তোমায়?’
সিরাত তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল,
‘চেহারা দেখেই বুঝেছি। আমার বাবা-মায়ের সামনে নিজের ফেইস লসটা ঠিক মানতে পারেন নি। তাই এখন আমার সাথে ঝামেলা করতে এসেছেন।
তাইনা?’
প্রত্যয় কটমট করে বলল, ‘জানো আমি কত করে নিচে সবটা সামলে এসেছি? অন্যের শাস্তি মাথা পেতে নিয়ে আমাকে ফাঁসানোই তোমার ইচ্ছে ছিলো। তাইনা? রাবিশ!’
‘জি, ঠিক আপনার মতো।’
সিরাতের মুখে মুখে তর্ক শুনে রাগ জেঁকে ধরলো প্রত্যয়কে। ওর হাতের কবজি চেপে ধরে কাছে টেনে বলল, ‘মুখ সেলাই করতে আমার হাত একটুও
কাঁপবে না মেয়ে।’
সিরাত ভয় পেলো না। উল্টো হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল, ‘জানি। যে পাবলিক প্লেসে নিজের বউকে অসম্মান করতে পারে তার দ্বারা সবকিছু সম্ভব। আর আপনার বেলায় তো সন্দেহের অবকাশ নেই।’
প্রত্যয় ওর হাত আরও শক্ত করে চেপে ধরতেই ব্যথায় মৃদু আর্তনাদ করলো সিরাত। প্রত্যয় বাঁকা হেসে বলল,
‘এত বউ বউ করছো যে? নিজেকে সত্যিই আমার বউ ভাবছো নাকি?’
সিরাত চোখমুখে ঘৃণা ফুটিয়ে বলল,
‘না ভাবার তো কিছু নেই। আমরা না মেনে নিলেও
সত্য তো পাল্টাবে না। আর এটা স্বীকার করার সাহস আমার আছে, বরংচ আপনি কাপুরুষ। আচ্ছা,
সকলের ছোটখাটো অপরাধে আপনি তাদের যেভাবে শাস্তি দেন, আপনি যে আমার সাথে অন্যায় করছেন তার বিচার কে করবে? বউ পিটিয়ে আর কতদূর!’
প্রত্যয় বিস্ময় নিয়ে ওর হাত ছেড়ে দিলো। দূরে সরে শক্ত গলায় বলল, ‘আমি বউ পেটাই?’
‘সামনে থেকে সরুন তো! আপনার মুখদর্শন করতে অসহ্য লাগছে আমার!’
তীব্র ঘৃণা মেশানো বাক্য। সিরাতের চোখমুখ ভেজা। প্রত্যয় চোয়াল শক্ত করে ওর আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করছে। এই মেয়ে কোন ধাতুতে গড়া কে জানে। এতকিছু করেও ভয় দেখাতে পারলো না, উল্টে কথায় কথায় ওর সাথে বিবাদে জড়াচ্ছে। প্রত্যয় হতবিহ্বল ভঙ্গিতে ওর ভেজা গাল দেখে আনমনেই হাত
বাড়াতে গেলো, ঠিক তখনি দরজায় টোকা পড়লো। প্রত্যাশা চেঁচিয়ে বলল,
‘নিচে সবাই বসে আছে। ভাবী এসো।’
সিরাত চোখমুখ মুছে উত্তর দিলো, ‘আসছি!’
বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো নিচে। প্রত্যয় ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে মনে মনে ফুঁসে ওঠলো। কেন যেন সবকিছু অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। সিরাতকে
যেভাবে শাস্তি দেবে বলে ভেবেছিলো তার কিছুই করতে পারছে সে না ঠিকঠাক।
রাতে খাবার টেবিলে দুই পরিবারের সবাই একসঙ্গে খেতে বসলেন। মুশফিকা চৌধুরী থমথমে চেহারায় আপ্যায়ন করছেন সিরাতের বাবা-মাকে। তবে ছোট্ট সোহার উপর মুখ কালো করে থাকতে পারলেন না বেশিক্ষণ। আসার পর থেকেই বাচ্চাটা যেন
সকলের মনেই জায়গা করে নিয়েছে।
দেড় বছরের ছোট্ট মেয়েটা আধো আধো স্বরে মুশফিকা চৌধুরীকে দিদা, আমির সাহেবকে দাদা বলে সম্বোধন করছে। প্রত্যাশাই শিখিয়ে দিয়েছে ওকে! আমির সাহেব সহাস্যে ওকে কোলে তুলে আদর করছে। এসব দেখে সিরাতের মা মিনারা খাতুন মেয়েকে বললেন, ‘বড়লোক দেইখা তো ভাবছিলাম অহংকারী। এখন তো মানসিকতা দেখি ভালোই।’
সিরাত হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘দুটোই।’
‘জামাই বাবাজি কেমন? অবশ্য আমাদের বাড়িতে যেদিন গিয়েছিলো সেদিন খারাপ মনে
হয় নাই! বড্ড সরল, ভালো!’
সিরাত খানিকটা বিরক্ত হলো, ‘বড্ড ভালো? তাহলে ছেলে বানিয়ে নিয়ে যাও! কিন্তু ওই শয়’তানের কথা আমায় জিজ্ঞেস করবে না।’
মিনারা খাতুন সরল মানুষ। মেয়ের কথার মানে বুঝতে না পেরে চোখ রাঙালেন, ‘এসব কি কথা? পালিয়ে
বিয়ে করেছিস আবার বড় গলা করিস, বেত্তমিজ কোনখানের! একটুর জন্য আমাদের মুখে চুনকালি লেপে নাই।’
সিরাত চুপ রইলো। উত্তর দেওয়ার ভাষা নেই ওর। মিনারা খাতুন এরপর শান্ত গলায় আবারও বললেন,
‘জানিস, তোর বাবা যখন অস্বস্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো ওদের কি কি চাহিদা, শুনে তো ছেলের রাগ! অহেতুক খরচা না করে শুধু দোয়া করতে বললো। এত ভালো ছেলে যে আমাদের কোনো আয়োজন পর্যন্ত করতে দিলো না, উলটে বাবাকে পাঠিয়ে আমাদের দাওয়াত করে আসতে বললো। আজকাল এমন ছেলে পাওয়া যায় নাকি?’
সিরাত এসব শুনে হতাশ হয়ে মিনমিন করে বলল, ‘তোমরা সত্যিই বড্ড বোকা!’
এমন সময় শিমুল সাহেব এলেন। তিনিও এমন অনেক কথাই বললেন। বাবা-মায়ের সাথে অনেক কথা হলো সিরাতের। তবে রাত হয়ে যাওয়ায় শিমুল সাহেব এবার বাড়ি ফিরতে চাইলেন। বিদায় মুহূর্তে সোহা ভীষণ চিৎকারে বাড়ি মাথায় তুলতে লাগলো। সে কিছুতেই সিরাতকে ছেড়ে যাবে না, ওর কোল ছেড়ে নামবে না। আমির সাহেবের ভীষণ মায়া হলো। তিনি অনুরোধ করে বললেন অন্তত আজ রাতটা থেকে যেতে। শুনে সিরাতের বাবা লজ্জায় পড়ে গেলেন। একদমই রাজি হলেন না তিনি এ প্রস্তাব। এ কি কান্ড! মেয়ের বাড়িতে প্রথমদিন এসেই থেকে যাওয়াটা বড্ড লজ্জাজনক ব্যাপার তার কাছে।
অগত্যা সিরাত বাধ্য হয়ে বলল, ‘সোহা থাকুক,
কাল এসে নিয়ে যেও!’
সবাই-ই এ কথায় সহমত জানালো। ওর কথা শুনে প্রত্যয় শিমুল সাহেবকে ভরসা দিয়ে বলল,
‘টেনশন নিবেন না। আমি কাল ওকে পৌঁছে দিয়ে আসবো।’
শিমুল সাহেব মাথা নাড়ালেন। প্রত্যয়কে বললেন, ‘ভালো থেকো। সুখী হও। আমার মেয়েটাকেও সুখে রেখো।’
প্রত্যয় একপলক সিরাতকে দেখলো ও তাচ্ছিল্যভরে হাসছে। কেউ না বুঝলেও ওর দৃষ্টি এড়াতে পারলো না তা। আচমকাই ভীষণ রাগে বুকটা জর্জরিত হয়ে গেলো যেন!
_______
রাতে শুতে গিয়ে হলো ঝামেলা! সোহা কান্না করছিলো, বেশ জ্বালাচ্ছিলো। বহুকষ্টে ঘুম পাড়ানো হয়েছে ওকে। প্রত্যয় শব্দ করে দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করতেই সিরাত ধড়ফড়িয়ে ওঠলো। কখন যে চোখ লেগে এসেছিলো বুঝেনি! প্রত্যয়কে শব্দ করে কাজ করতে দেখে ভস্ম করা দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল, ‘আওয়াজ করছেন কেন? দেখছেন না বাচ্চাটা ঘুমিয়েছে?’
প্রত্যয় ভাবলেশহীন গলায় আলমারি বন্ধ করতে
করতে বলল, ‘তাতে আমার কি?’
‘অসহ্যকর!’
বিরক্তিকর শব্দ করে আবারও ঘুমিয়ে পড়লো সিরাত। প্রত্যয় ল্যাপটপ নিয়ে বসলো। মাঝেমধ্যে আড়চোখে সিরাতকে লক্ষ্য করলো। সোহাকে বুকে আগলে
ঘুমিয়ে আছে। লম্বা চুলগুলো মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে। দৃশ্যটা সুন্দর! প্রত্যয় সোজা হয়ে বসে অনেকক্ষণ মনোযোগ দিয়ে দেখলো। কেমন বাবা
বাবা একটা অনুভূতি হচ্ছে ওর। সোহার মায়াভরা মুখটায় তাকিয়ে দেখলো অনেকক্ষণ।
মা সন্তানকে আগলে ঘুমিয়ে আছে এর থেকে সুন্দর দৃশ্য পৃথিবীতে বোধহয় কমই আছে। প্রত্যয় মনে মনে বলল, ‘সুন্দর!’
বড়লোক বাবা-মায়ের ছেলে প্রত্যয় চৌধুরী। ভার্সিটিতে টপ স্টুডেন্টদের মধ্যে একজন। সুদর্শন চেহারা, পড়াশোনাসহ অন্যান্য কার্যক্রম সব কিছুতে অন্য সবার চেয়ে ছিলো এগিয়ে। সেই সাথে অনেকের স্বপ্নপুরুষও ছিলো। কিন্তু এসবের প্রতি ওর আগ্রহ ছিলো নিতান্তই কম। পড়াশোনা শেষে হঠাৎ করেই একসময় জড়িয়ে পড়ে রাজনীতিতে। আচরণেও আসে পরিবর্তন।
ভার্সিটিতে কেউ যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে তাহলে
তার আর রক্ষে নেই। অমানবিক, নিষ্ঠুর শাস্তি দেয় সবাইকে ওর দলের সদস্যরা। ওদের আচরণে সকলেই একসময় ভয়ে অতিষ্ঠ, তটস্থ হয়ে পড়ে। কেউ খোলাখুলি প্রেম করুক, সিগারেট খাক তো বা কিছু করুক, সেদিন বুঝি আর তার রক্ষে নেই। ভার্সিটি কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানালেও তারা এ বিষয়টাতে তেমন মাথা ঘামায় না। বরংচ এসব আরো বেড়ে যায়। ক্ষমতার জোরে দেখিয়ে এসব অন্যায় চালাতে থাকে সে। কিন্তু একদিন দুজন শিক্ষার্থীর রুম ডেইটে হাতেনাতে ধরে প্রত্যয়ের চেলারা ভীষণ অপমান করে তাদের। এর মধ্যে মেয়েটি এসব নিতে না পেরে সুইসাইড করে। এরপর আরো একজন! তবুও এমন র্যাগিং বা শাস্তি থামেনি! এদিকে সিরাত সবসময়ই
শান্ত প্রকৃতির মেয়ে ছিলো। পড়াশোনায়ও ভালো। প্রত্যয়ের এসব কর্মকান্ড ফার্স্ট ইয়ার থেকে দেখে আসছিলো সে। রাগ হলেও মাথা ঘামায়নি বা সাহস হতো না ওর। কিন্তু পরপর দুজন সুই’সাইড করার পর ওর ভীষণ খারাপ লাগে। দুঃখ হয়।
কিন্তু একদিন ওর চোখের সামনে একজনকে
বেরধড়ক পিটিয়ে রক্তা’ক্ত করে প্রত্যয়ের চেলারা। সেদিন আর চুপ থাকতে পারেনি। প্রতিবাদ করেছিলো। সেখান থেকেই ঝামেলার শুরু ওদের। বন্ধুদের
সাহায্য নিয়ে রক্তা’ক্ত ছাত্রটাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো। প্রত্যয় এসব শুনে রেগে জিজ্ঞেস করেছিলো মাহিনকে, ‘কে ও? খোঁজ নে!’
মাহিন খোঁজ নিয়ে বলল, ‘থার্ড ইয়ারে পরে
ভাইজান। ডাইকা আনমু নাকি? কন খালি একবার।’
‘আন!’
প্রত্যয়ের আদেশে সিরাতকে ডাকা হলো। হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতি দেখানো হলো। কিন্তু কোনোটাতেই কাজ হলো না। উলটো প্রতিবাদ জানালো। প্রত্যয় সেদিন ক্রোধে জর্জরিত হয়ে ফেটে পড়ছিলো। এরপর থেকে ওর এসব কাজে সিরাত ও তার বন্ধুরা বাঁধা দিতে লাগলো। ছাত্রছাত্রীদের মনও খানিকটা পেলো। এমনকি মানববন্ধন পর্যন্ত করলো, সিরাত দিলো নেতৃত্ব! এ কারণে প্রত্যয়ের প্রতিপক্ষও ওর নামে বদনাম, কুৎসা রটানো শুরু করলো। সবাইকে উস্কে দিতে লাগলো। ব্যাপারটা একপর্যায়ে হাতাহাতির পর্যায়েও চলে গিয়েছিলো। দুই পক্ষের সংঘর্ষে
ভার্সিটির পরিবেশ হয়ে ওঠলো উত্তপ্ত। সেদিনই প্রত্যয় মনে মনে সিরাতকে উচিৎ শিক্ষা দেবে বলে ঠিক করেছিলো। পায়ের তলায় জুতো বানিয়ে রাখবে ভেবেছিলো! কিন্তু পায়ের তলায় জুতোর বদলে
এখন সবটাই ঘেটে কেমন ‘ঘ’ হয়ে যাচ্ছে!
এসব ভেবে প্রত্যয় দীর্ঘশ্বাস ফেললো। দমকা ঠান্ডা বাতাস ঠেলে ঘরে ঢুকছে। সোহার ঠান্ডা লাগতে পারে চিন্তা করে প্রত্যয় ওঠে ব্লাঙ্কেট এনে জড়িয়ে দিলো সোহা, সিরাতকে। সবটা মানবিকতার খাতিরে ভেবে নিলো সে!
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]
#চলবে….