গুপ্ত প্রণয় পর্ব-০৬

0
13

#গুপ্ত_প্রণয়
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রতা
#পর্বঃ৬

শুভ্রতা নিজের ঘাড়ে উষ্ণ নোনাজলের অনুভব হতেই সে ঘাবড়ে গেল। লোকটা কি তাহলে কান্না করছে। শুভ্রতা কিছু বলতে নিবে তার আগেই রাদ শুভ্রতাকে ছেড়ে চলে যেতে যেতে বলল
“ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”

শুভ্রতা রাদকে পিছনে ডাকতে গিয়েও থেমে গেল। রাদ হনহনিয়ে বেড়িয়ে যায় রুম থেকে।

শুভ্রতা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, চোখের সামনে রাদের দ্রুত সরে যাওয়া দেখে মনটা বিষণ্ণ হয়ে ওঠে। সে বুঝতে পারছিল না রাদ কেন হঠাৎ এমন আচরণ করল। রাদের সেই উষ্ণ নোনাজল এখনও যেন তার ঘাড়ে অনুভূত হচ্ছে, মনে করিয়ে দিচ্ছে যে রাদের ভিতরে কিছু একটা ভেঙে যাচ্ছে।

শুভ্রতা ধীরে ধীরে বিছানায় বসে, কিন্তু মনটা শান্ত হতে চায় না।
“রাদ কি এমন কোনো কষ্ট লুকিয়ে রেখেছে, যা সে আমাকে জানাতে পারছে না?”

এগুলোই ভাবছিলো শুভ্রতা। হুট করেই শুভ্রতা আবারও উঠে দাঁড়ালো। বাসা থেকে যে জামা কাপড় এনেছিলো সেগুলো কোথায় তা শুভ্রতার জানা নেই। কিন্তু যে গরম পড়েছে এমন কাপড় পড়ে তো ঘুমানো সম্ভব না। আর শাড়ি তো সে সামলাতেও পারবেনা। শুভ্রতা কিছুক্ষণ ভেবে কার্বাট খুললো। সেখান থেকে রাদের একটা কালো রঙের টির্শাট আর একটা কালো রঙের টাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল সে।

শুভ্রতা ওয়াশরুমে ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। তার প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ নিজেকে নিরীক্ষণ করলো। রাদের আচরণ তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। মনের ভেতর অস্থিরতা তাকে ছেড়ে যেতে চাইছে না। রাদের চোখে সেই গভীর বিষাদ যেন ধরা পড়েছে, যা শুভ্রতার কাছে সম্পূর্ণ অজানা ছিল। কেন রাদ কাঁদছিলো? কেন সে কথা না বলেই চলে গেল?

পানি দিয়ে মুখ ধুয়ে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করলো শুভ্রতা। কিন্তু প্রতিবারই রাদের সেই শেষ কথাগুলো তার মনে ফিরে আসছে— “ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।” এটা কি শুধুই ক্লান্তির কথা, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে গভীর কোনো বেদনা?

রাদের কালো টিশার্ট আর টাউজার পরে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে শুভ্রতা বিছানায় শুয়ে পড়লো। তবুও মনটা শান্ত হলো না। সে বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে লাগল। বাড়ির কথাও খুব মনে পড়ছে তার। রুহিকে মিস করছে সে। প্রতিদিন রাতে তো সে ওর সঙ্গে ঘুমায়। কে জানে কি করছে মেয়েটা!

শুভ্রতা গভীর শ্বাস নিয়ে বিছানায় শুয়ে রুহির কথা ভাবতে লাগল। এই বাড়িতে সবকিছুই এত অচেনা, এত নিঃসঙ্গ লাগছে। রুহির হাসিমাখা মুখ, তার চঞ্চলতা সবকিছুই যেন শুভ্রতার মনে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি করছে।

এগুলো ভাবতে ভাবতে শুভ্রতা কখন যে ঘুমিয়ে গেল বুঝতেই পারলো না।

————————-

একটা চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে আফজাল সাহেব। কে.এম সামনেই বসে আছে পায়ের উপর পা তুলে। কে.এম বিরক্তি নিয়ে পাশের ছেলেগুলোরে বলল
“পানি ঢেলে দে ওর উপর জ্ঞান ফিরা।”

কে.এম এর কথামতো একটা ছেলে ঠান্ডা বরফ পানি আফজাল সাহেবের মাথায় ঢেলে দিলো।

ঠান্ডা পানির ঝাপটায় আফজাল সাহেব হঠাৎই জেগে উঠলেন। চোখের পাতা কাঁপছে, শরীরটা ঠান্ডায় কাঁপছে। সামনে কে.এম কে দেখে তার ভয় যেন আরও বেড়ে গেল। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় চেয়ারে বসে থাকা অবস্থায় নিজেকে অসহায় মনে হলো। কে.এম ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো, মুখে এক ধরনের ঠান্ডা, নিষ্ঠুর হাসি। যা তার মাক্সের উপর দিয়ে বোঝা গেলা না।

“আপনার মতো বড় মানুষরা এভাবে পড়ে থাকলে, দেখতেও বেশ কষ্ট লাগে, তাই না?”

কে.এম এক হাত পকেটে ঢুকিয়ে আফজাল সাহেবের মুখের কাছে এসে দাঁড়াল। কে.এম আবারও বলে উঠলো
“আপনার মত লোকেরা নিজেদের ভুল বুঝতে চাইবে না, যতক্ষণ না তাদের ভুলগুলো চোখের সামনে এনে দেয়া হয়।”

আফজাল সাহেব কাঁপা গলায় বললেন, “তুমি যা চাইছ, সেটা তো আমি দিতে পারব না। আমি কিছু জানি না…”

কে.এম মৃদু হেসে বলল
“জানেন, সবই জানেন। শুধু সময়ের অপেক্ষা, আর আমি বিশ্বাস করি আপনি ঠিকই বলে দেবেন।”

তারপর কে.এম হাতের ইশারায় ছেলেটাকে কিছু বলল, যা দেখে আফজাল সাহেবের মনে হলো তার সামনে আরও ভয়ঙ্কর কিছু অপেক্ষা করছে।

“তোমার সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে, আফজাল সাহেব। ভাবো, এই ভুলটা ঠিক কত বড় হতে পারে।”

কে.এম নিঃশব্দে বলল।

সঙ্গে সঙ্গে নীলাকে চোখে কালো কাপড় বাঁধা। হাত বাঁধা অবস্থায় কিছু ছেলে টেনে নিয়ে এলো। আফজাল সাহেব থমকালেন। কে.এম আবারও হেসে বলল
“তা আপনার ব‍্যবসার কি অবস্থা! নারী পাচার কেমন চলছে! নিজের মেয়েকেও তো পাচার করতে যাচ্ছিলেন।”

আফজাল সাহেব চোখ তুলে তাকালো কে.এম এর দিকে। কে.এম একটা ছেলেকে কাছে ডেকে বলল
“ওদের একসঙ্গে আটকে রাখ যে রুমে কোনো দরজা জানালা নেই। আমি আজকে যাই। সময় হলে যোগাযোগ করবো।”

বলেই কে.এম চলে গেল সেখান থেকে।

——————–

রাদ অপেক্ষা করছিলো শুভ্রতা কখন ঘুমিয়ে যাবে। শুভ্রতার সাড়াশব্দ না পেয়ে রাদ রুমে প্রবেশ করলো।

শুভ্রতা ঘুমিয়ে আছে বিছানায়। রাদের টিশার্ট আর টাউজার পড়ে। টাউজার খানিকটা উপরে উঠে গেছে। যার ফলে পায়ের অনেকটা অংশই দৃশ‍্যমান। টিশার্ট উঠে গেছে একটু। যাতে ওর পেটের কিছুটা অংশও দৃশ্যমান। রাদ ঢোক গিললো। নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে রাদ এগিয়ে গেল শুভ্রতার দিকে। একটা কম্বল নিয়ে ঢেকে দিলো শুভ্রতাকে। এসির পাওয়ারটা খানিকটা বাড়িয়ে দিলো।

রাদ শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। তার ভেতরে এক ধরনের অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছিল, কিন্তু সেটা কী সেটা বুঝতে পারছিল না। শুভ্রতার ঘুমন্ত মুখটা দেখেই তার মনটা হালকা হলো।

সে আস্তে আস্তে ফিরে গেল দরজার দিকে।রাদ দরজার কাছে গিয়েও থমকে দাঁড়ালো। শুভ্রতার দিকে একবার ফিরে তাকিয়ে দেখলো সে শান্তভাবে ঘুমাচ্ছে। রাদ ভেতরে ভেতরে অনুভব করল, শুভ্রতাকে এইভাবে রেখে সে যেতে পারবে না।

আস্তে করে দরজা বন্ধ করে রুমের কোণে রাখা চেয়ারে বসে পড়লো। সে ভাবতে লাগল, শুভ্রতা তার জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। রাদের ভেতরে চলতে থাকা কষ্ট, ভেঙে পড়ার কারণ সবটাই যেন শুভ্রতার উপস্থিতিতে হালকা হয়ে যাচ্ছে।

রাদ চেয়ারে বসে থেকেও শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে রইল। তার মনে হচ্ছিল, যতক্ষণ সে এখানে থাকবে, ততক্ষণই তার মন শান্ত থাকবে।

রাদ চেয়ারে বসে শুভ্রতার নিঃশ্বাসের তাল দেখে বুঝল, সে গভীর ঘুমে রয়েছে। রুমে এসির ঠান্ডা হাওয়া বইছে, কিন্তু রাদের মনে অস্থিরতা। শুভ্রতার প্রতি তার ভালোবাসা এত গভীর যে, তার পাশে না থেকে রাদ কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছে না।

চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে রাদের মনে ভেসে উঠতে লাগল তাদের প্রথম দেখা, প্রথম কথোপকথন। শুভ্রতার সরলতা আর মিষ্টি স্বভাব সবসময় তাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু আজকের রাতে রাদ বুঝতে পারল, শুভ্রতাকে সে শুধু ভালোবাসে না—সে তাকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না।

রাত গভীর হচ্ছে, কিন্তু রাদের চোখে ঘুম নেই। সে ধীরে ধীরে চেয়ারের পিঠে হেলান দিয়ে একটু আরাম করার চেষ্টা করল। শুভ্রতার শ্বাস-প্রশ্বাসের মৃদু শব্দ তাকে কিছুটা শান্ত করে তুলল।

হঠাৎ শুভ্রতা ঘুমের মধ্যে একটু নড়ল। রাদ দ্রুত উঠে গিয়ে বিছানার পাশে দাঁড়াল। শুভ্রতা কিছু বললো না, কিন্তু তার মুখের অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছিল যেন কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে। রাদ ধীরে ধীরে তার কপালের ওপর হাত রাখল, যেন তাকে আশ্বাস দিতে চাইছে— “আমি আছি, সব ঠিক আছে।”

শুভ্রতা কিছুক্ষণের মধ্যে শান্ত হয়ে গেল। রাদ তখনও তার পাশে দাঁড়িয়ে, ভেতরে ভেতরে এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করছে।

রাদ কিছুক্ষণ শুভ্রতার পাশে দাঁড়িয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। শুভ্রতা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, আর রাদ তার পাশে থাকার আশ্বাসে নিজেও কিছুটা স্বস্তি অনুভব করছিল।

কিন্তু রাদের মন এখনো শান্ত নয়। সে ভাবছিল, শুভ্রতার প্রতি তার এই অদ্ভুত টান, ভালোবাসার গভীরতা কেন আজ এত তীব্র হয়ে উঠছে। রাদ ধীরে ধীরে বিছানার পাশে বসে পড়ল, যেন শুভ্রতার কাছাকাছি থাকতে পারে।

সে আস্তে করে শুভ্রতার হাতটা ধরল, তার নিজের অজান্তেই। শুভ্রতার নরম হাতের স্পর্শে রাদের ভেতরটা আরও আবেগে ভরে উঠল। তার মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্তে যদি সবকিছু থেমে যায়, শুধু তাদের দুজনের এই ঘনিষ্ঠতা থেকেই যায়, তাহলেই রাদের জীবনের সবকিছু পূর্ণ হবে।

শুভ্রতা হঠাৎ একটু নড়ল, যেন ঘুমের মধ্যে রাদের উপস্থিতি টের পেয়েছে। রাদ হাত সরিয়ে নিতে গিয়েও থেমে গেল। শুভ্রতার হাত ধরা অবস্থাতেই সে তার পাশে থাকলো, কোনো শব্দ না করে। শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে রাদ ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বলল
“তোমার জন্যই বাঁচি আমি।”

শুভ্রতা চোখ না খুলেই একটা মৃদু হাসি দিল, যেন ঘুমের মধ্যেই রাদের মনের কথাটা শুনতে পেয়েছে।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে