গাঙচিল

0
1964

#গাঙচিল(অনুগল্প)
#নিমিশা_জান্নাত

দেড় ঘন্টা ধরে আব্বু আম্মুর রুমে দরজা বন্ধ করে বসে আছি।বাইরে থেকে সবাই ডাকাডাকি করছে।কিন্তু আমি পণ করেছি আজ বেরোবো না এখান থেকে।ডাকতে ডাকতে বেহুঁশ হয়ে গেলেও না।।
আজ আমার বাসর রাত।সেজন্যই এই রুমে ঘাঁটি গেঁড়ে বসেছি।আব্বু জোড় করে একটা গেঁয়ো ভূতের সাথে আমার বিয়ে দিয়েছে।নাম ঈশান।কিন্ত এমন একটা গাইয়া ছেলের নাম ঈশান কে রাখলো ভেবে পাইনা।লোকটা গ্রামে থাকে,একেবারে অজপাড়াগাঁয়।সেখানকার কলেজের শিক্ষক।কিন্তু চালচলন দেখে ক্ষ্যাত ছাড়া কিছু মনে হয়নি।বয়স্কদের মতো চোখে চশমা পড়ে থাকে।সেই লোক নাকি আমার বর।আজ বিকেলে কাবিন হওয়ার পর আমাদের বাসায় বাসর সাজানো হয়েছে।তখন থেকে আমি এই রুমে আছি।আর ঈশান আমার রুমে।সাধারণত বাসর ঘরে বউয়েরা অপেক্ষা করে,আর আমাদের বেলায় বর অপেক্ষা করছে।হঠাৎই আব্বুর কন্ঠস্বর শুনতে পেলাম,,

—” তনু বাইরে আসো।

—” আব্বু আমি আজকে এই রুমে শোব।

—” সেসব পরে দেখা যাবে।আগে দরজা খুলে বাইরে এসো।

আব্বুকে আমি বরাবরই খুব ভয় পাই।এবার না বেরোলে যা খুশি করে ফেলবে।তাই দরজা খুলে মিনমিন করে আব্বুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।আব্বু ধমক দিয়ে বলে উঠল,,,

—” এসব কি নাটক শুরু করেছো।ভুলে যেওনা তুমি এখন বড়ো হয়েছ।যাও নিজের রুমে যাও।

—” কিন্তু আব্বু,,,,,,,,,

—” আর একটা কথাও শুনতে চাই না আমি।সোজা নিজের রুমে চলে যাও।

আব্বুর ধমক খেয়ে রুমের দিকে হাঁটা শুরু করলাম।ছোট চাচী সাথে আসতে চেয়েছিলেন।আমি না করে দিয়েছি।রুমে ঢুকে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিয়েছি।বিছানায় তাকিয়ে দেখি ঈশান নামক লোকটা খাটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে।লোকটাকে দেখে ভোলাভালা সহজ-সরল মনে হচ্ছে।কাছে গিয়ে সালাম করতে চাইলাম।কিন্তু ওনি ছিটকে দু-হাত পেছনে সরে বললেন,,,

—” এসব কি করছেন,এগুলা করা ঠিক না।

—” নিজের ইচ্ছায় করিনি।চাচী বলে দিয়েছে তাই করেছি।নয়তো কাল সকালে চাচী জিজ্ঞেস করলে মিথ্যে বলতে হবে।আমি মিথ্যে বলিনা।

—” ওহহ আচ্ছা ভালো।

—” হু,আচ্ছা আপনি কি ঘুমাবেন এখন..??

—” না,আমার নতুন জায়গায় ঘুম আসেনা।আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমান।

—” আমারও ঘুম আসছেনা,চলুন গল্প করি।

—” আচ্ছা,,,আমি আপনাকে তুমি করে বলি…???

—” হু,বলেন।আমি আপনার জুনিয়র।স্টুডেন্ট এর বয়সী।।

—” হাহাহাহা তাই।।আচ্ছা তুমি মনে হয় বিয়েতে রাজী ছিলে না।তাহলে তোমার বাবা একমাত্র মেয়েকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দিলেন কেন…???

—” আর বলবেন না,আমাদের পাড়ায় কতগুলো বখাটে আছে।ওদের আড্ডাখানার সামনে দিয়েই আমাকে কলেজে যেতে হত।

—” ওহহ বুঝতে পেরেছি।বখাটেরা তোমাকে বিরক্ত করতো।তাই বাবা তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়েছে।

—” মোটেও না,ওই বখাটেরা আমাকে বিরক্ত করার সাহস কোনদিনই পায়নি।কারন ওই বখাটে দলের লিডার আমার বয়ফ্রেন্ড।আপনাকে বললাম আপনি আবার কাওকে বলবেন না যেন।

—” না না কাওকে বলবোনা।

—” বখাটে লিডারের সাথে দু’বছর ধরে রিলেশনে আছি।আর কিছুদিন আগে বাবা জানতে পেরেছেন।তাইতো আপনার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে আমাকে।

—” তাহলে তুমি কি এখন বখাটে লিডারকে ভুলে যাবে..??

—” আরে না,ভুলে যাব কেন।আমাকে তো আপনি কাল গ্রামে নিয়ে যাবেন।সেখানে দু’মাস থাকবো।তারপর বখাটের সাথে পালাবো।

—” দু’মাস পরে কেন..??

—” কারন ইন্টার পরীক্ষা দিয়ে তারপর পালাবো।সাথে আপনার গ্রামটা ঘুরে দেখাও হবে।

—” ওহহ খুব ইন্টারেস্টিং তোমার লাভ স্টোরি।

বোকা বরের সাথে গল্প করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি।সকালে তিথির ডাকে ঘুম ভাঙলো।উঠে দেখি ওনি একেবারে রেডি হয়ে বসে আছে।সাথে আম্মু আমার ব্যাগও গুছিয়ে দিয়েছে।নাস্তা করে সবার থেকে বিদায় নিয়ে বের হলাম।ট্রেনে করে যেতে হবে বোকা বরের বাড়িতে।ওনার নাকি কেউ নেই,একাই থাকেন।দূরসম্পর্কের একজন মামার মাধ্যমে আমাদের বিয়ে হয়।
সারাদিন ট্রেনেই কেটে গেল।স্টেশনে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে।গ্রামের রাস্তায় চাপা অন্ধকার নেমে এসেছে।ব্যাটারি চালিত টর্চলাইটের আলোতে এগিয়ে চলেছি সামনের দিকে।আমি বোকা বরের হাত ধরে রেখেছি,অন্য হাতে লাইট।আর ওনি দু’হাতে দুটো ব্যাগ নিয়ে এগোচ্ছেন।কিছুদূর গিয়ে একটা বাঁশের সাঁকো চোখে পড়লো,,,

—” তনু,তুমি দাঁড়াও।আমি ব্যাগগুলো ওপারে রেখে আসি।তারপর তোমাকে পাড় করে দিবো।একা একা পাড় হতে পারবে না।

—” কে বলেছে পারবো না,খুব পারবো।দাঁড়ান,,,

—” নিন আমি লাইট ধরছি,এবার আপনি আসুন।

পায়ের হিল খুলে খুব তাড়াতাড়ি সাঁকো পেরিয়ে চলে এসেছি আমি।বোকা বর চোখদুটো রসগোল্লা বানিয়ে আমাকে দেখছে।আমি তাড়া দিতেই ব্যাগগুলো নিয়ে এপাড়ে আসলো।
কলপাড়ে গিয়ে দুজনেই ফ্রেশ হয়ে নিলাম।তারপর বোকা বরের রান্না করা গরম ভাত,আলুভর্তা আর ডাল পেটপুরে খেয়েদেয়ে শুতে আসলাম।তখন ওনি আমাকে ডেকে বললেন,,,

—” তুমি কখনও গ্রামে গিয়েছ..??

—” জি না,এই প্রথম আসলাম।

—” তাহলে তুমি এতো তাড়াতাড়ি সহজভাবে মানিয়ে নিলে কিভাবে..??

—” মানিয়ে নেওয়াটা কোন বড়ো ব্যাপার নয়।নিজের ইচ্ছে থাকলে সবই সম্ভব।আপনি কাল নতুন জায়গা বলে ঘুমাতে পারেননি।কিন্তু আমি পারবো।গুড নাইট।

সকালে মুরগী ডাকার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল।মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি পাঁচটা দশ বাজে।এতো তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙেছে দেখে একটু অবাকই হলাম।তারপর বিছানা ছেড়ে বাইরে এলাম।সামনের খাটে বোকা বর এখনও ঘুমাচ্ছে।ওনাকে না ডেকে বাইরেটা ঘুরে ফিরে দেখছিলাম।বাড়িটা টিনশেড বিল্ডিং।অনেক বছর আগের করা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।তবে কিছুটা আধুনিকতাও আছে।আশেপাশে যতগুলো বাড়ি দেখলাম সবগুলোই কাঁচা টিনের অথবা কাঠের।সাইডে একটা ঝাড়ু পেয়ে উঠানটা ঝাড়ু দিলাম।তারপর নাস্তা বানানোর যুদ্ধে নেমেছি।রান্নাবান্না জানা থাকলেও মাটির চুলায় আগুন জ্বালাতে গিয়ে ছোটখাটো হার্ট-অ্যাটার্ক হয়ে গেছে।পরোটা আর ভাজিটা বেড়ে রেখে কলপাড়ে এসেছি থালাবাসন ধুতে।কোমড়ে আচল গুঁজে টিওবয়েল চেপে পানি ভরছিলাম।তখন বোকা বর এসে আমার হাতের ওপর দিয়ে টিওবয়েল চাপতে লাগলো।আমি সরে দাঁড়াতেই বললো,,,

—” তোমাকে কে বলেছে এগুলো করতে।ঘুম থেকে উঠেছ ভালো কথা।আমাকে ডাকলেই তো আমি সব করে দিতাম।

—” আপনি যে কতো করতেন সেটা আমার বোঝা হয়ে গেছে।বাড়িঘরের অবস্থা তো গোয়ালঘরের মতো।
যাই হোক নাস্তা বানিয়েছি খেয়ে আমার সাথে হাত লাগাবেন।বাড়িটা পরিস্কার করে গোছাতে হবে।

নাস্তা খেয়ে সবকিছু পরিষ্কার করতে লেগেছি।দুজন মিলে বাড়ির ভেতর সহ চারপাশ খুব ভালো করে পরিস্কার করে ফেলেছি।ভেতরটাও সুন্দর করে সাজিয়েছি।তারপর বোকা বরকে বাজারে পাঠিয়েছি সবজি মাছ আনার জন্য।

—————————————–,,

বোকা বরের সাথে দিনগুলো বেশ ভালোভাবেই কেটে যাচ্ছে।ওনি সারাদিন কলেজে থাকে।আমি বাড়ির কাজ করি,টিভি দেখে সময় কাটাই।বিকালে এসে ওনি গ্রামের ভেতরে ঘুরতে নিয়ে যায়।রাতে জোড় করে পড়তে বসায়।পাশের বাড়ির মহিলাদের সাথেও আমার বেশ ভাব হয়েছে।মাঝে মাঝে এসে অনেক সময় গল্প করে।আমিও মনোযোগ দিয়ে শুনি।কখনও কখনও আমি যাই ওনাদের বাড়িতে।আমার সামনে পানের ডালা সাজিয়ে দেয়।গ্রামের মানুষ বুঝি এমনই হয়।

আজ ঘর পরিষ্কার করার সময় অনেকগুলো ছোট ছোট চিরকুট পেলাম।দেখে বোঝা যাচ্ছে এগুলো সকলের চোখের আড়ালে রাখা হয়েছে।চিরকুট গুলো খুলে পড়তে শুরু করলাম,,,

—” চলেই যখন যাবে কেন এসেছিলে আমার জীবনে।একাতো বেশ চলছিল জীবন।এই ছন্দপতন ঘটানোর কি খুব দরকার ছিল..??

—” আমি গোয়ালঘরে থাকতেই বেশী ভালোবাসি।তুমি সাজিয়ে গুছিয়ে রেখোনা।তাহলে তুমি চলে গেলে অসহ্য যন্ত্রণা হবে।

—” এতো ভালো রান্না জানো।বোঝাই যায় না।

—” তোমার এখানে থাকার সময় কমে আসছে।

—” চলে যেতেই হবে।থেকে যাওয়া যায় না।

হাবিজাবি লিখে চিরকুট জমা করেছে।ডাল বসিয়ে এসেছিলাম চুলায়।পোড়া গন্ধ নাকে আসতেই সেদিকে ছুটলাম।
রাতে খেতে বসে বোকা বরকে বললাম,,,,

—” আপনি চিঠি লিখতে পারেন..??

—” না,হঠাৎ এই কথা..??

—” আসলে অনেক দিন হলো এসেছি।তাই ভাবলাম একটা চিঠি লিখি,ফোনে কথা বলতে ইচ্ছে করে না।

—” তুমি নিজেই লিখতে পারো তো।

—” তা পারি,জানেন আমার অনেক বান্ধবী দের আমি প্রেমপত্র লিখে দিয়েছি।তবে নিজের জন্য কখনও লিখিনি।বখাটে লিডার সদা গম্ভীর মানুষ।ওসব চিঠিফিটির ধার ধারে না।

গল্প করতে করতেই খাওয়া শেষ করলাম।বোকা বরের কাছে চিরকুটের কথা জিজ্ঞেস করতে চেয়েও পারিনি।দেখতে দেখতে আমার পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এলো।ঢাকায় ফিরতে হবে।আব্বু বলেছিল ওনাকে আমাকে নিয়ে যেতে।কিন্তু আমি বলেছি আমাকে ট্রেনে তুলে দিলে একাই যেতে পারবো।বোকা বরের মন খারাপ বেশ বুঝতে পারছি।কিন্তু প্রকাশ করছেন না।জিজ্ঞেস করেছিলাম কয়েকবার কিন্তু এড়িয়ে গেছেন।মানুষটা বড্ড চাপা স্বভাবের।
সুটকেস নিয়ে স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছি।আসার সময় খুব মন খারাপ হয়েছিল আমার।খুব মিস করবো নিজের হাতে গড়ে তোলা সংসারটা,পাশের বাড়ির কাকীদের,আর এই বোকা বরটাকে।একেই বুঝি বলে সংসারের মায়া।
ট্রেন ছাড়ার টাইম হয়ে গেছে।বোকা বর আমাকে প্রায় হাজার বার বলেছ,সাবধানে যেও নিজের খেয়াল রেখো।ট্রেনে ওঠার আগে আমি আচমকা বোকা বরের হাত ধরে ফেললাম।ওনি তাকাতেই বললাম,,,,

—” আমার পরীক্ষা শেষ হতে দেড় মাস লাগবে।তার মধ্যে ঢাকায় যাবেন না।কিন্তু শেষ পরীক্ষা দিয়ে যেন আপনাকে আমার সামনে দেখতে পাই।বউ বাপের বাড়ি যাচ্ছে।সময়মতো আনতে যাবেন।আর নিজের খেয়াল রাখবেন আশা করি এই কদিনে বাড়ি ঘর খোয়াড়ে পরিনত করবেন না,আসি।

ঈশানের দিকে আর না তাকিয়ে সোজা সিটে এসে বসলাম।একটু বাদে ট্রেন ছেড়ে দিল।ঈশান এতোক্ষণ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে ছিল।ট্রেনের হুইসেল বাজতেই দৌড়ে এসে জানালার সাইডে দাঁড়ালো।হালকা একটু হাসি দিয়ে বিদায় জানালো আমাকে।
ট্রেন ছুটে চলেছে।সেই সাথে ছুটে চলেছে আমার স্বপ্নগুলো।

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে