গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-৩৪+৩৫

0
452

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৩৪.

স্টিয়ারিংয়ে শক্ত হয়ে বসে যাওয়া আঙুলগুলো সাদা হয়ে আছে। স্বরূপের হাত সামান্য কাঁপছে। মাকে নিয়ে সাবধানে হাসপাতালে পৌঁছাতে পারলে হয়। কী হয়েছে তনয়ার? খারাপ কিছু? কথাটা ভুলে থাকতে ইচ্ছে করছে স্বরূপের। অন্তত হাসপাতালে পৌঁছুনো পর্যন্ত। অথচ বুকের ভেতর জোরে জোরে হাতুড়িপেটা হচ্ছে। সে মাকে আরেকবার জিজ্ঞেস করল, “তোমাকে ওরা কিছুই বলেনি?”

মা কাঠ কাঠ গলায় বললেন, “তুই গাড়ি চালাতে থাক।”

স্বরূপও সেটারই চেষ্টা করছে। কিন্তু গলা শুকিয়ে আসছে। ওর বাবা বলেছিলেন জ্বর হয়েছে। এখন কি সেটা খুব খারাপ পর্যায়ে চলে গেছে?

হাসপাতালের সামনে এসে গাড়ি পার্ক করে নামার সময় মা তার হাত চেপে ধরলেন। স্বরূপ অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে?”

“খবরটা তোকে জানাইনি আমি।”

স্বরূপ সোজা হয়ে বসে বলল, “তুমি জানো কী হয়েছে?”

“হ্যাঁ।”

অস্থির হয় উঠল স্বরূপ, “তাহলে বলছো না কেন?”

মা চোখ বেয়ে নেমে আসা অশ্রু মুছে বললেন, “তনয়া প্রেগন্যান্ট.. কাল রাতে মাথা ঘুরে বাথরুমে পড়ে গিয়েছিল। এখন কী হয়েছে জানি না। তুই ভালোমন্দের জন্য তৈরি থাক…”

কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্বরূপের চোখের সামনে সবকিছু ব্ল্যাঙ্ক হয়ে গেল। সে ঠিকমতো কিছু ভাবতে পারল না৷ তারপর যখন মায়ের দিকে তাকাল, দেখল মা কাঁদছে। স্বরূপের চিৎকার করতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু একটা শব্দও করতে পারল না৷ শুধু বোবা দৃষ্টিতে শূন্যের পানে চেয়ে রইল।

বাচ্চা! ওর একটা বাচ্চা আসার কথা পৃথিবীতে! যার আসাটা অনিশ্চিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগমনবার্তা না শুনেই কি তবে মৃত্যুসংবাদ শুনতে হবে? স্বরূপ পাথরের মতো জমে গেল। বুকের ভেতরটা বরফ হয়ে গেছে। ভয় আর আতঙ্ক চেপে ধরেছে একসাথে।

একটা বাচ্চার তার কত শখ তা কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না। সে বিয়ে না করলেও একটা বাচ্চাকে দত্তক নিত পালার জন্য। তনয়াকে কতবার সে ছোটোখাটো হিন্টস দিয়েছে এ ব্যাপারে, তনয়া বুঝতে পারেনি। সে বোঝানোর চেষ্টাও করেনি। জানত, একটা সময় ঘর আলো হবেই। কিন্তু…

মা এবার স্বরূপকে জোরে ধাক্কা দিলেন। “যাবি না?” স্বরূপ বসেই রইল স্থাণুর মতো। মা তাকে টেনে নিয়ে গেলেন ভেতরে। দোতলায় উঠতেই তনয়ার মা বাবাকে পাওয়া গেল। মা একপাশে দাঁড়িয়ে আঁচল দিয়ে চোক মুছছেন। বাবা পায়চারি করছেন অস্থিরভাবে।

স্বরূপের পা চলছে না৷ সে সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে গেল। পা দুটো প্রচন্ড ভারী হয়ে আছে। টন টন পাথর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে বুকে। এমন লাগছে কেন?

তার মা গিয়ে তনয়ার মাকে ধরলেন, “কী হয়েছে আপা? সব ঠিক আছে তো?”

তনয়ার মা মলিন গলায় বললেন, “ঠিক নাই। প্রেশার কমে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল।”

“আর বাচ্চাটা? বাচ্চাটা ঠিক আছে?”

“আছে, তবে অবস্থা ভালো না। কিছু বলা যায় না। অল্প ব্লিডিং হয়েছে। রক্তশূন্যতাও নাকি দেখা গেছে। রক্ত দেয়া হচ্ছে।”

তনয়ার বাবা এগিয়ে এসে বললেন, “থ্রেটেনড এবরশন। এখন অনেক যত্ন নিতে না পারলে কী হবে বলা যায় না।”

স্বরূপ ধীরে ধীরে হেঁটে এসে মেঝেতেই বসে পড়ল। তার জন্যই এসব হয়েছে, হচ্ছে। সে নিজেকে কী করে ক্ষমা করবে?

বাবা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “তনয়া কি তোমার ওখানে থাকতে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করত না?”

স্বরূপ একটু ভাবল, মনে পড়ল না কিছু।

বাবা ওর ফাঁকা দৃষ্টি দেখে যা বোঝার বুঝে নিয়ে বললেন, “খাওয়ার অনিয়ম হয়েছে খুব!”

স্বরূপ ওভাবেই বসে রইল। মা তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলেন, তেমন একটা লাভ হলো না। স্বরূপের বারবার মনে হচ্ছে, সব হারিয়ে গেছে। হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তার জমানো সবকিছু…

বিকেলের দিকে স্বরূপ তনয়ার প্রথম কথা হলো। তনয়ার অবস্থা একটু ভালোর দিকে যাওয়ার পর বাবা তাকে জিজ্ঞেস করে নিয়েছেন সে স্বরূপের সাথে কথা বলতে চায় কি না। তনয়া অনেকক্ষণ ভেবেচিন্তে বলেছে পাঠিয়ে দিতে।

স্বরূপ যখন ঢুকল তখন বাকিরা বেরিয়ে গেল। স্বরূপ বিছানার কাছে এসে দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল।

এই সেই তনয়া যে তার সাথে ছিল? কেমন করে এমন হয়ে গেল?

তনয়ার শরীর শুকিয়ে এতটুকুন হয়ে গেছে। চোখের নিচে গভীর কালি পড়েছে, ঠোঁটজোড়া শুষ্ক, গায়ের রঙ ফ্যাকাসে। স্বরূপ দাঁড়িয়েই রইল অনেকক্ষণ। বিশ্বাস করতে পারছে না কিছু৷

আচমকা যেন একটা বিষমাখা তীর এসে তার বুকে বিঁধে গেছে। তনয়া এতদিন চোখের আড়াল ছিল, সে তাকে মিস করেছে, কিন্তু এমনটা কল্পনাও করেনি। আজ সামনে থেকে দেখে সহ্য করতে পারছে না।

সবচেয়ে অসহ্যকর বিষয় হচ্ছে, তনয়ার এই অবস্থা শুধুমাত্র তার জন্য হয়েছে। তার অবহেলার কারনে হয়েছে।

স্বরূপের মাথা থেকে সব বেরিয়ে গেল। কোথাকার কোন বিশ্বাসঘাতকতা, বিশ্বাসহীনতা, মেল ইগো, এমনকি বাচ্চাও। শুধু মনে রইল তনয়া। এই একটা মেয়ের সাথে সে খুব বড় ভুল করে ফেলেছে। ভুলটা একদিনে হয়নি৷ সে বিয়ের পর তনয়ার নামমাত্র খেয়াল রেখেছে, ভালোবাসি না বলে হাজারবার কষ্ট দিয়েছে, তার ভালোবাসার কোনো দাম দেবার প্রয়োজনও মনে করেনি৷ আর সবশেষে কতগুলো বাজে কথা শুনিয়েছে৷ অথচ তারা একসাথে অল্প কদিনে কত কত সুন্দর সময় কাটিয়েছে গোনা যাবে না। সে কেন ফুলের মতো একটা মেয়েকে এমন বানিয়ে দিল? সে যে ইচ্ছে করে করেছে তাও নয়…

সে টলোমলো পায়ে তনয়ার বেডের পাশে মেঝেতে বসে পড়ল। ওর হাত আঁকড়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে লাগল। অনেক কথা বলতে চাইলেও কোনো কথা তার মুখ দিয়ে বের হলো না৷

তনয়া চুপ করে দেখল স্বরূপকে। একে দেখে এত মায়া হয় তার! কিন্তু আজ এভাবে কাঁদতে দেখেও যেন তার ভেতরটা সে স্পর্শ করতে পারছে না। ও কেন এসেছে? বাচ্চার কথা শুনে? বাচ্চার খুব শখ স্বরূপের। পথেঘাটে ছোটো ছোটো বাচ্চা দেখলে এগিয়ে গিয়ে আদর করে আসে। নিজের বাচ্চা হলে কী কী করবে সেসব আকারে ইঙ্গিতে নানা সময় বলেছে। ওই ফেসবুকের ছবির কমেন্টে সেই মেয়েটাকেও বলেছিল। বোধহয় তাকেও একই কথা বলত!

তনয়া ওর হাতটা ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু স্বরূপ ছাড়ছে না। তনয়া অধৈর্য হয়ে বলল, “হাতে ক্যানোলা লাগানো। স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। ব্যথা পাচ্ছি তো!”

স্বরূপ হাত ছেড়ে দিল। তনয়ার চোখে চোখ রাখল। চোখের গভীরতা হারিয়ে গেছে। হারিয়েছে নাকি সে নিজেই নষ্ট করেছে?

স্বরূপ করুণ চোখে চেয়ে বলল, “তুমি আমাকে ক্ষমা করবে তনয়া? আমি স্যরি। কতবার স্যরি বললে বোঝনো যাবে আমি সত্যিই অনুতপ্ত জানি না। আমার মুখ দেখাবার জায়গাও নেই।”

তনয়া নিষ্পৃহ গলায় বলল, “কাঁদছ কেন? বাবু ভালোই আছে।”

“কিন্তু তুমি তো ভালো নেই।”

“সেটা তোমার কনসার্ন নয়। তবে ভালো থাকব এখন থেকে। চেষ্টা তো সবসময় ছিল, শুধু সময়টা খারাপ যাচ্ছিল।”

স্বরূপ তনয়ার মুখে হাত বুলিয়ে বলল, “আর খারাপ সময় থাকবে না৷ এখন যা সময় আসবে, সবটা হবে বেস্ট।”

তনয়া তিক্ত হেসে বলল, “তাই নাকি? হতেও পারে। যদি কারো প্রাক্তন অন্তত আমার বাচ্চার জীবনে না ঢুকে পড়ে।”

স্বরূপ আহত চোখে তাকাল। “কী বলছ তুমি!”

তনয়া বলল, “আচ্ছা তোমার বাচ্চার খুব শখ ছিল তাই না? তুমি চেয়েছিলে তোমার আর ওই মেয়েটার সংসার হবে, বাচ্চা হবে, সেটা হলো না বলে তোমার খুব কষ্ট লাগে তাই না?”

স্বরূপ মাথাটা ঝুঁকিয়ে ফেলে বলল, “আমি জানি না তুমি কেন বলছ এসব। প্রাক্তনের কথা উঠছে কেন?”

“স্যরি। আর বলব না।”

“তনয়া ওর সাথে আমার কোনো ধরনের যোগাযোগ নেই। এমনকি মনে মনেও আমি ওর জন্য বিন্দুমাত্র কিছু ফিল করি না। তুমি কেন ওর কথা তুলছো?”

“বললাম তো আর তুলব না।”

“তনয়া… তুমি আমার সাথে যাবে না?”

“কোথায়?”

“তোমার সংসারে।”

“আমার কোনো সংসার নেই।”

“আছে। তুমি নিজের হাতে সাজিয়েছ।”

“নেই৷ তুমি আমাকে বলেছিলে তোমার বাসায় আমি জবরদখল করে রেখেছি। তোমাকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছি না। ওটা আমার সংসার কবে হলো আবার?”

স্বরূপের মনের কাঁটাটা আরেকটু গভীরে গেঁথে বসল। কথাগুলো কত ভারী! অথচ সে নিজেই একসময় এসব বলেছে!

“আমি স্যরি তনয়া! সত্যিই স্যরি!”

তনয়া চোখ বুজে বলল, “আমার খুব ক্লান্ত লাগছে। আর কথা বলতে পারব না। চলে যাও তুমি।”

স্বরূপ আর কথা বলার চেষ্টা করল না। তনয়ার মুখ দেখে মনে হলো না সে আর কোনো কথা শুনবে। যাবার আগে তনয়ার হাতে আর কপালে চুমু খেল স্বরূপ। তনয়া চোখ পর্যন্ত খুলল না। মুখের রেখা শক্ত হয়ে আছে। স্বরূপ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেল।

স্বরূপ সেদিন অনেকটা সময় নিয়ে নামাজ পড়ল। সেজদায় পড়ে সে এত কাঁদল যত সে হয়তো কোনোদিনই কাঁদেনি। তনয়ার জন্য আর বাচ্চার জন্য দোয়ায় শুধু একটা কথাই বলে গেল, “আল্লাহ ওদের সুস্থ রাখুন, শান্তি দিন। আমাকে ক্ষমা করুন।”

মসজিদ থেকে বের হয়ে এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে স্বরূপের মনে হলো তার জীবনটা কেমন অন্যরকম লাগছে। এতদিন কী একটা গরল জমেছিল মনে। অবিশ্বাসের, অসুন্দরের। আজ কান্নার সাথে সব ধুয়ে গেছে। এটাও বিশ্বাস হয়েছে, তার তনয়াকে প্রয়োজন। শুধু জীবন বা শরীরের প্রয়োজন নয়, মনেরও প্রয়োজন। তনয়া যতদিন তার সাথে হেসে কথা না বলবে ততদিন পর্যন্ত তার প্রায়শ্চিত্ত হবে না। সেই প্রায়শ্চিত্তের দিনটা কি কোনোদিন আসবে? তনয়া কি কখনো জানবে সে বাচ্চার কথা ভেবে না, তাকে ভালোবেসে এসেছিল?

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৩৫.

তনয়া পরের দিনে রিলিজ পেয়ে গেল। বাসায় যাবার সময়ও স্বরূপ আরেক দফা বোঝাতে এলো তাকে। তনয়ার বাবাকেও অনেক অনুরোধ করল ওকে যেন তার সাথে যেতে দেয়া হয়। কিন্তু তনয়া কিংবা তার বাবা কেউই রাজি হলো না৷ স্বরূপ বাসায় ফিরল শূন্য হাতে।

এদিকে ওদের ঝামেলা দেখে স্বরূপের মা মিতাকে কোচিংয়ে ভর্তি করিয়ে একই সাথে একটা মেয়েদের হোস্টেল দেখে সেখানে তাকে রেখে গেলেন৷ তার মনে হয়েছে, মিতাকে স্বরূপের কাছে একা একা রেখে যাওয়াটা উচিত হবে না৷ স্বরূপ যদিও বিষয়টা পছন্দ করেনি, কিন্তু মা রাজি হলেন না। ছেলের ওপর বিশ্বাস আছে তার। কিন্তু যুগের ওপর একদম নেই।

মা পাঁচদিন থেকে চলে গেলেন। মা যাওয়ার পরপরই স্বরূপকে একাকীত্ব চেপে ধরল। বাসায় ফিরলেই মনে হয় এটা একটা জ্যান্ত কবরখানা। তনয়াকে দেখতে ইচ্ছে করে, বাচ্চাটা কেমন আছে, কোন পর্যায়ে আছে সব জানতে ইচ্ছে করে। কল্পনায় সে দেখে তনয়া এখানেই আছে। তারা খুনসুটি করছে, বাচ্চার নাম কী হবে, ছেলে হবে নাকি মেয়ে, দেখতে কার মতো হবে এসব নিয়ে ঝগড়া করছে।

এরপর অফিস শেষে তার প্রতিদিনের রুটিন হয়ে দাঁড়াল তনয়াদের বাসায় যাওয়া। যাওয়া হয় ঠিকই, তবে তনয়া তার সাথে কথা বলে না। সে একশটা কথা বললে একটা জবাব দেয়। তাও কাঠ কাঠ জবাব। স্বরূপ তাতেও খুশি ছিল। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই তনয়া দেখা করাও বন্ধ করে দিল।

স্বরূপ ওদের বাসার ড্রইংরুমে ঘন্টা ধরে বসে থাকে। তনয়া আসে না। তার রুমে যাওয়ার সাহস হয় না স্বরূপের। একবার যেতে চেয়েছিল, তনয়া বেশ অপমান করে বলে দিয়েছে তার বাসায় তার বেডরুমে যেন কেউ পারমিশন ছাড়া না ঢোকে।

স্বরূপ বসে থাকলে তনয়ার মা এসে কথা বলত শুরুর দিকে। এখন তিনিও আর আগ্রহ পান না। স্বরূপ একাই বসে থাকে। তনয়ার বাবা এলে ওর সাথে চা খান, দু’একটা কথা বলেন, তারপর চলে যান নিজের ঘরে।

স্বরূপ একসময় বাসায় ফেরে। ভালো লাগে না কিছুই। মাঝরাতে তনয়াকে এলোমেলো মেসেজ পাঠায়,

“কেমন আছো?”
“তোমার একটা ছবি দেবে?”
“বাবু কেমন?”
“ওকে বলে দিও বাবা দেখতে গিয়েছিল।”
“ও কি বাবার কথা বলে?”
“তুমি কি ওকে বাবার কথা জানিয়েছ?”
“I love you.”
“I miss you.”
“Do you miss me?”
“Don’t you love me?”

তনয়া কখনো দেখে, কখনো না দেখেই রেখে দেয়।

স্বরূপ এক ভোরে গাড়ি নিয়ে তনয়াদের বাসার সামনে উপস্থির হলো। তনয়ার বারান্দার দিকে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টিতে। তাকে দেখা হয় না অনেকদিন।

স্বরূপকে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। তনয়া বারান্দায় এসে দাঁড়াল। ওর বারান্দায় কিছু গাছ আছে। সেগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে একসময় রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তিনতলার ওপরে থাকা তনয়াকে একটু অস্পষ্ট দেখা গেলেও স্বরূপ প্রাণভরে দেখে নিল। দিনটা এত চমৎকার কাটল তার!

এরপর থেকে সে সকালেই যায়। তনয়াকে দেখা হয় রোজ। তাকে তনয়া দেখে ফেলেনি। দেখলে হয়তো বারান্দায় আসা বন্ধ করে দিত।

*

মিলি আয়নায় আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিল। লিপস্টিকের শেড আরেকটু গাঢ় হলে কেমন হয়? বেশ হয়! নিজেকে আরেক ধাপ বেশি আত্মবিশ্বাসী মনে হয়। মিলি একটা কালো রঙের ড্রেস পরেছে৷ বেশ দামী ড্রেস। চোখে নীলচে সবুজ কন্টাক্ট লেন্স পরেছে। তাকে আগুন সুন্দরী লাগছে। আজ সেই লোকটার সাথে দেখা করতে যাবে, যে নিজেকে হিমালয় বলে পরিচয় দিয়েছে। লোকটা সোজা ফ্ল্যাটে ইনভাইট করে বসেছে। মিলির মন উত্তেজনায় কাঁপছে। আজ দারুণ আনন্দ হবে!

নিচে নেমে দেখল গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। চড়ে বসল সে।

“You’re looking amazing!”

মিলি হাসল। সে জানে, তাকে ঠিক কী কী করলে সুন্দর দেখায়।

গাড়ি থেকে নেমে সোজা ভেতরে ঢুকে লিফটে চড়ল মিলি। পনেরো তলায় ফ্ল্যাট। লিফট থেকে নেমে ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে মোবাইলের ক্যামেরাতে নিজেকে একবার দেখে নিল সে৷ “হুম পারফেক্ট!”

ডোরবেল চাপল। দরজা খুলে গেল কয়েক সেকেন্ড পর। লোকটাকে প্রথম দেখল মিলি। বেশ সুদর্শন, সুঠামদেহী লোক, স্বীকার করতেই হবে। মিলিকে দেখে সে কয়েক সেকেন্ড হা করে তাকিয়ে রইল। তারপর হাসিমুখে বলল, “Welcome! আজকে আমার ছোট্ট পাখির বাসা ধন্য। পৃথিবীর সবচেয়ে গর্জিয়াস নারীর পদার্পন হতে যাচ্ছে৷ প্লিজ ভেতরে আসুন।”

মিলি ভেতরে ঢুকল। এয়ার ফ্রেশনারের সতেজ সুবাস ঘরময়। পাখির বাসাটা দেখবার মতো। দামী সোফাসেট, ঘরভর্তি অ্যন্টিক, প্রমাণ সাইজের ঝাড়বাতি। রুচি আছে, তবে এত জাঁকজমক বাহুল্য। লোকটা হাসিমুখে বলল, “বসুন। ড্রিংস চলবে?”

মিলি হাসল, “না। কফি চলবে।”

লোকটা চোখ নাচাল। তারপর রান্নাঘরে চলে গেল। মিলি বসেই রইল। জানালা দিয়ে ব্যস্ত অজস্র দানালকোঠা চোখে পড়ছে। লোকটা মিনিট পাঁচেকের মধ্যে কফি নিয়ে উপস্থিত হলো।

মিলি জিজ্ঞেস করল, “আপনার আসল নামটা জানতে পারি এবার?”

“রওনক। আমার পুরো নাম রওনক চৌধুরী।”

“নাইস নেইম!”

“কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

“সমস্যা নেই। আমার গরম পছন্দ নয়।”

“এসির টেম্পারেচার কমিয়ে দেব?”

“নো থ্যাংস! ইটস পারফেক্ট!”

“বাই দ্য ওয়ে, ড্রেসটা আপনার গায়ে চড়তে পেরে বেশ গর্জিয়াস হয়ে উঠেছে!”

মিলি হেসে কফিতে চুমুক দিল। কিছু বলল না।

কফি শেষ হবার আগেই রওনকের মোবাইল বেজে উঠল। সে বোধহয় কলটা কেটে দিত, আবার শেষ মুহূর্তে কী ভেবে কাটল না। রিসিভ করে কথা বলে একটু বিরক্ত হয়ে মিলিকে বলল, “আপনি কি একটু অপেক্ষা করবেন প্লিজ? আমি নিচ থেকে আসছি। কেউ একজন আর্জেন্টলি দেখা করতে চাইছে। প্লিজ কিছু মনে করবেন না।”

“না না, যান। আমি ঠিক আছি।”

“জাস্ট পাঁচ মিনিটে ব্যাক করছি। এনজয় ইয়োর কফি।”

রওনক বেরিয়ে গেলে দরজা আটকে গিল মিলি। তারপর অত্যন্ত দ্রুততার সাথে তার বেডরুমে ঢুকল। ওয়ারড্রব, টেবিলের ড্রয়ের খুঁজে কিছুই পেল না। আলমারির চাবিটা খুঁজতে লাগল। সেটা পাওয়া গেল বেডসাইড টেবিলের ড্রয়েরে একটা কী কেসে।

চাবি দিয়ে দ্রুত হাতে আলমারি খুলল সে। তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগল একটা ক্লু। ঘড়ি দেখল একবার। চার মিনিট হয়ে গেছে। স্বরূপ লোকটাকে কতক্ষণ আটকে রাখতে পারবে কে জানে!

আলমারির একেবারে শেষের তাকে একটা ফাইল পাওয়া গেল৷ ফাইলটা বের করে খোলার সময় কলিংবেল বেজে উঠল। বুকটা ধ্বক করে উঠল একবার৷ “নাহ, এখন দরজা খোলা যাবে না৷”

সে ফাইলটা খুলল। পেয়ে গেল যা চেয়েছিল। অতিরিক্ত হিসেবে পাশেই একটা অ্যালবামও পেল। স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল মিলির বুক থেকে। সে বিশাল একটা ব্যাগ এনেছে। সেটাতে ফাইল আর অ্যালবাম এঁটে গেল। তাড়াতাড়ি ঘরটা গুছিয়ে ফেলল সে। কোনোরকমে বেসিন থেকে হাত আর গলায় সামান্য পানি ছিটিয়ে টিস্যু হাতে দরজা খুলতে গেল। খুলেই মুখটা করুণ করে বলল, “স্যরি। ওয়াশরুমে ছিলাম।”

রওনক হাসল। “ইটস ওকে ডিয়ার। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আপনার কী হলো ভেবে।”

ওরা আবারও সোফায় গিয়ে বসল। লোকটা কীসব হাবিজাবি বকবক করে গেল, মিলির ঠিকঠাক কানে গেল না। সে অপেক্ষা করছে দ্বিতীয় কলিংবেলের আওয়াজের। পাঁচটা তো বাজে। আসবে তো সে?

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে