#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৩২.
মাকে কোনোরকমে সামাল দেয়া গেলেও মায়ের প্রশ্ন আর শেষ হয় না। রাতের খাবারের জন্য তেমন কিছুই বাকি ছিল না৷ স্বরূপ কিছু একটা রাঁধতে রান্নাঘরে ঢুকল। মাছ মাংস রাঁধতে দেরি হবে৷ দ্রুত হবে কোনটা? ডিম? ডিম ভাজি নাকি ভুনা? স্বরূপ মাথা চুলকে ভাবছে, এমন সময় মায়ের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল, “তনয়ার জামাকাপড় এই ঘরে কেন?”
স্বরূপের মনে পড়ল তনয়া তার জামাকাপড় মিলিকে পরতে দিয়েছিল। সব গেস্টরুমেই রয়ে গেছে। হায় হায়!
মাকে মিলির কথাটা বুঝিয়ে বলল স্বরূপ। মা প্রশ্ন করতে থাকলেন, “মিলি কবে গেছে? তনয়া কবে গেছে? একই দিনে কেন?” ঘাপলাটা বোধহয় ধরার চেষ্টা করছেন। শেষে বললেন, “মিলিকে এখানেই থাকতে হবে কেন? পৃথিবী থেকে ওর আত্মীয়স্বজন, মেয়েবন্ধু সব গায়েব হয়ে গেছে নাকি?”
স্বরূপ দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ হয়ে গেল।
খাওয়াদাওয়া শেষে মা মিতাকে নিয়ে শুতে চলে গেলে স্বরূপ নিজের ঘরে ঢুকল। মোবাইল হাতে নিয়ে এলোমেলো ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে আবিষ্কার করল, তনয়া একটু আগেই নিজের প্রোফাইলের ছবিটা বদলে দিয়েছে। সেখানে এখন টলটলে চোখের ঠোঁট উল্টানো এক বাচ্চার ছবি। স্বরূপ কিছুক্ষণ সেদিকে চেয়ে রইল। তনয়ার ছোটোবেলার ছবি নাকি এটা? কত কষ্টেই না আছে মেয়েটা! স্বরূপের মনটা আরও একবার আর্দ্র হলো। খুব ইচ্ছে করছে এখন তনয়ার সাথে কথা বলতে।
সে মেসেজ পাঠাল, “তনয়া..”
সীন হয়ে গেল সাথে সাথেই। তবে উত্তর এলো না।
সে উৎসাহ পেয়ে আবার লিখল, “কেমন আছ?”
“প্লিজ রিপ্লাই দাও!”
“চলে এসো। আর কতদিন এভাবে থাকবে?”
“তনয়া!”
“কল করি?”
“ধরো না কেন?”
“আই অ্যাম স্যরি! আর কোনোদিন ওরকম ভুল হবে না। আমি সেদিন বুঝতে পারিনি কী করেছিলাম।”
“আমি ঘুমাতে পারি না, খেতে পারি না, কোনোকিছুতেই মনোযোগ দিতে পারি না। তোমাকে ভীষণ মিস করছি! একটা রিপ্লাই অন্তত দাও।”
“আমি তোমাকে কাল আনতে যাব। আসবে তো? মা এসেছেন। তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হচ্ছেন।”
স্বরূপের প্রথম মেসেজটা দেখে তনয়ার একটা হার্টবিট মিস হয়েছিল। সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে পরের মেসেজ দেখতে থাকল। সত্যিই কি সে স্যরি? এতদিন পর মনে হলো ভুল করেছে?
কিন্তু শেষ দুটো মেসেজ দেখে তার গা জ্বলে গেল। এর মানে সবকিছু তার নিজের জন্য! মা এসেছে বলে এখন তনয়াকে দরকার হয়ে পড়েছে। প্রথমদিন থেকে সে যে ফোন হাতে তীর্থের কাকের মতো বসেছিল তখন তো কারো মনে হয়নি মেসেজ দিয়ে কেমন আছ জিজ্ঞেস করার। এখন ঠেকায় পড়ে সবই সম্ভব হচ্ছে। তিক্ত হয়ে গেল তনয়ার মন। সে উত্তর দেবে না ভেবেও উঠে বসে টাইপ করতে শুরু করল।
স্বরূপ কোনো রেসপন্স না দেখে মোবাইল রেখে শুয়ে পড়েছিল। মিনিট দশেক পর মেসেজের টুং শব্দ হতেই সে তড়াক করে উঠে বসল। তনয়াই পাঠিয়েছে।
“তোমার ঘুম, তোমার খাওয়া, তোমার মনোযোগ, তোমার মা, সবই তো তোমার। আমার কোনটা বলতে পারো? তুমি আপাদমস্তক স্বার্থপর ছিলে, এখনো আছ। আমার ফিলিংসের মূল্য তুমি কখনোই দাওনি। নিজে ভালো ছিলে বলে একসাথে ছিলে। তোমার কাছে আমি কখনোই কি কিছু ছিলাম?
তুমি বাজি ধরেছলে দু’বছর পর তোমাকে বিয়ের জন্য আফসোস করব। কিন্তু আমি এখনই আফসোস করছি। তুমি বাজিতে জিতেছ। Congratulations!”
স্বরূপ মেসেজটা দেখে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। তনয়া সবসময় এত মিষ্টি করে কথা বলে যে তার কাছ থেকে এরকম বাক্য সে কখনোই আশা করেনি। তনয়াকে সে একটু বেশিই সহজভাবে নিয়ে ফেলেনি তো?
সে নিজের মেসেজগুলো পড়ল আবার। খুবই হাস্যকর লাগছে। এভাবে রাগ ভাঙাতে যাওয়ার মতো বোকামি আর হয় না। তার ওপর সে মনের কথা প্রকাশ করতে পারছে না। উল্টোপাল্টা বলায় কথগুলো ভীষণ পলকা মনে হচ্ছে।
সারারাত সে দুচোখের পাতা এক করতে পারল না৷ মনে হলো পৃথিবীতে সবাই তনয়ার পক্ষে চলে গেছে। তাকে একা নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। কেউ তাকে বোঝার চেষ্টা করছে না। কেউ একবারও ভাবছে না সে নিজেও কষ্ট পাচ্ছে। কষ্টটা প্রকাশ করতে পারছে না, কাউকে বোঝাতে পারছে না, নিজের কাছেও এতদিন স্বীকার করেনি। কিন্তু কষ্টটা হচ্ছে তো!
তনয়ার মেসেটাও তার কাছে বড় কঠিন মনে হয়েছে। তার এটা প্রাপ্য ছিল, সে নিজেও কঠিন হয়েছে। তবুও একটা আঘাত তো পেল!
আচ্ছা সে যে ভাবত, প্রেম হবে উত্তাল, প্রবল, প্রচন্ড বেদনার; ঠিক সেই অনুভূতিগুলো কি তার এখন হচ্ছে না? নিজের সব আত্মগর্ব, সব অহংকার, কাঠিন্য ত্যাগ করে তার কি ইচ্ছে করছে না তনয়ার কাছে চলে যেতে? কেন তবে? স্বরূপের চোখে পানি চলে এলো। সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে!
সে ভালোবাসায় জড়াতে চায় না। ভালোবাসায় অনেক কষ্ট। একই কষ্ট বারবার সে কেন পাবে?
*
তনয়া কুশনের কভারে সুতার কারুকাজের ওপর হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। তার মন বিক্ষিপ্ত, অন্যমনষ্ক। বাবা মা আজকে চেপে ধরেছেন৷ এতদিন তারা হয়তো ভেবেছিলেন ওরা নিজেরাই ঠিক করে ফেলবে সবকিছু। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সবকিছু হাতের বাইরে চলে যাওয়ার আগে দেখতে হবে।
বাবা আবারও জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার ভয় কিসের? বলতে চাচ্ছো না কেন কী হয়েছে?”
তনয়া চুপ করে রইল।
“তোমার সাথে কি ওর কথাবার্তা পুরোপুরি বন্ধ?”
তনয়া মাথা নিচু করে ফেলল।
বাবা হঠাৎ রেগে গিয়ে বললেন, “ফাজলামো নাকি? এতদিন হয়ে গেল সে তার স্ত্রীর খোঁজ নিতে এলো না একবারো। যোগাযোগও নেই! তার বউ যে অসুস্থ সে খবরও রাখে না। তার কী এমন রাজকার্য? কী এমন হয়েছিল তোমাদের মধ্যে?”
তনয়া এবারো চুপ করে রইল।
“তাকে নতুন খবরটা দিয়েছ?”
“না।”
বাবা এবার তনয়ার পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “স্বরূপ কি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে মা?”
আদর পেয়ে তনয়া আর নিজেকে আটকাতে পারল না। বাবার বুকে মাথা রেখে কেঁদে ফেলল।
বাবা ওকে শান্ত করে ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করলেন, “কী করেছে সে? আমাকে বলো? বাবা সব ঠিক করে দেবে।”
তনয়ার এবার মনে হলো বলে দেয়াই ভালো। স্বার্থপর লোকটাকে সে কেন ডিফেন্ড করে যাবে? সে সবটাই বলল একটু একটু করে।
বাবা ভেতরে ভেতরে তপ্ত হয়ে উঠলেও মেয়ের সামনে প্রকাশ করলেন না। বললেন, “থাক, তুমি কষ্ট পেও না। নতুন মানুষটার কথা ভাবো। তুমি কষ্ট পেলে তো তারও কষ্ট হবে তাই না? আমরা আজ রাতে বের হবো কেমন? আইসক্রিম খাব, ঘুরব, শপিং করব, তারপর কাল তোমার খালামণির বাসায় বেড়াতে যাব। অনেক আনন্দ হবে। বাকি সব ভুলে যাও।”
তনয়া এত দুঃখের মাঝেও হেসে ফেলল। বাবার কাছে সে এখনো ছোট্ট স্কুলগার্ল রয়ে গেছে। যাকে আইসক্রিম কিনে দিলে সে সব কষ্ট ভুলে যায়।
*
বাবা অফিসের জন্য বেরিয়ে যাবার পরপরই স্বরূপের মা উপস্থিত হলেন তনয়াদের বাসায়। সাথে মিতা। তার প্রথম থেকেই সন্দেহ হচ্ছিল কিছু একটা হয়েছে। ছেলে কিছু বলছে না দেখে নিজেই পুত্রবধূর সাথে দেখা করতে চলে এসেছেন।
তনয়ার মায়ের সাথে কুশল বিমিময় শেষে তিনি তনয়াকে দেখতে চাইলেন। তনয়া শুয়েছিল। স্বরূপের মা এসেছে শুনে ছুটেই এলো। মাকে দেখে কেন যেন খুব কষ্ট হলো তার। শাশুড়ী হলেও খুব ভালো এই মানুষটা৷ তনয়া জড়িয়ে ধরল তাকে। মা তাকে খুব যত্নে ধরে রাখলেন। তার অভিজ্ঞ চোখ তনয়াকে দেখেই বুঝে ফেলল সুখবরের আগমনবার্তা। তবে সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস না করে খবরাখবর জানতে চাইলেন।
প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর সেখান থেকে ফিরলেন মা আর মিতা। ততক্ষণে মায়ের সবটা জানা শেষ। তিনি বুঝতে পারছেন না কী করবেন৷ তবে সবার আগে ছেলেকে কানে ধরে ওই বাড়িতে পাঠাতে হবে। এই সময়ে কেউ রাগারাগি করে? এত আলগা রাগ ছেলেটা রাখে কোথায়?
তনয়ার কথা শুনে মনে হলো না সে এত সহজে মানবে৷ এই সময়টাতে খুব নরম মেয়েরাও কঠিন হয়ে ওঠে। অবহেলা সহ্য করতে পারে না৷
তারও বেশি কিছু বলার ছিল না৷ দোষ তার ছেলেরই। তিনি তবুও ওর হয়ে ক্ষমা চেয়ে এসেছেন। তনয়ার মাকে আশ্বাস দিয়ে এসেছেন, সব ঠিক হয়ে যাবে দ্রুত।
*
স্বরূপ আজও কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছিল না। বসের ঝাড়ির ভয়ে তবু কাজ করে যাচ্ছিল৷ কিন্তু এরপরের ঘটনা তাকে বেশ নার্ভাস করে দিল। তার মোবাইলে তনয়ার বাবার নাম্বার থেকে কল এলো।
“আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। তুমি কোথায়?”
“অফিসে।”
“আজ লাঞ্চ টাইমে আমার অফিসে এসো। কথা আছে।”
“আঙ্কেল আজ অফিসের পর আমি তনয়াকে আনতে যাব। তখনই কথা বলি?”
বাবা অসম্ভব গম্ভীর গলায় বললেন, “তনয়া এখন কোথাও যাবে না৷ তোমার তাকে আনতে যেতে হবে না। তুমি আমার অফিসের সামনে ঠিক দুপুর একটায় উপস্থিত থাকবে।”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৩৩.
বাবার অফিসের সামনেই ছোটো একটা কফিশপে বসেছে তারা। এখানে শুধু কফিই পাওয়া যায় বলে লাঞ্চটাইম ভিড় কম। তবুও কোনার দিকের একটা টেবিলে বসেছে তারা৷
বাবা সময় নষ্ট করলেন না৷ বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের মধ্যে কী হয়েছে?”
স্বরূপ তনয়ার বাবার এই রূপ আগে দেখেনি৷ তিনি বরাবরই তার প্রতি বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলেন৷ এই মানুষটার স্বভাবও খুব নমনীয় বলে স্বরূপের মনে হতো তনয়া বাবার মতো হয়েছে। তবে আজ পরিস্থিতি উল্টো। ভদ্রলোকের চেহারা রীতিমতো মারমুখী।
স্বরূপ বলল, “একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।”
“তাই? সামান্য ভুল বোঝাবুঝির জন্য মেয়ে বাড়িতে এসে পড়ে আছে? জ্বর বাঁধিয়ে ভুগছে?”
স্বরূপ অবাক হলো৷ বলল, “তনয়ার জ্বর হয়েছে?”
“আরও অনেক কিছুই হয়েছে। তুমি তো তাকে জিজ্ঞেস করোনি কী হয়েছে।”
স্বরূপ মাথা নিচু করে রইল। বাবা, জিজ্ঞেস করলেন, “ভুল বোঝাবুঝি কী নিয়ে হলো?”
“আমিই একটু রুড হয়ে গিয়েছিলাম।”
“রুড হওনি, তুমি তাকে অসম্মানজনক কথা বলেছ।”
“আঙ্কেল তখন আমার মাথার ঠিক ছিল না।”
“কেন? তনয়া কী করেছিল যে তোমার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল?”
“ওর জন্য না…”
“তাহলে? অন্য কারো রাগ ওর ওপর ঝেড়েছ?”
“স্যরি আঙ্কেল!”
“তনয়াকে স্যরি বলেছ?”
“বলেছি।”
“কখন?”
“গতরাতে।”
“গতরাতে স্যরি বলার কথা মনে হলো? তোমার এই ব্যবহারটা কবের ছিল? কতদিনের পুরানো?”
স্বরূপ চুপ করে রইল। বাবা বললেন, “হিসেবও ভুলে গেছ মনে হচ্ছে?”
ওপাশে নিরবতা।
বাবা একটু চুপ করে থেকে বললেন, “তনুর যখন জন্ম তখন আমার স্ট্রাগলিং টাইম চলছিল৷ যেখানে চাকরি করতাম সেখান থেকে ছাঁটাই হয়ে গিয়েছিলাম। নতুন চাকরি পাচ্ছিলাম না। তনুর মা ছোটো একটা চাকরি করে সংসার চালাত। চার বছর বেকার ছিলাম সে সময়। মানুষের কথা আর তনুর মায়ের কষ্ট দেখে মনে হতো মরে যাই। শুধু মেয়েটার কথা ভেবে বেঁচে ছিলাম। মা চাকরিতে গেলে সে সারাক্ষণ আমার কাছেই থাকত। বাবা ছাড়া কিছুই বুঝত না মেয়ে। ও যখন আমার দিকে চেয়ে হাসত, মনে হতো পৃথিবীতে আর কিচ্ছু চাই না৷ বড় আদরের মেয়ে আমার।
ও যখন ক্লাস ফোরে পড়ে তখন একবার জ্বরে পড়ল। জ্বরের সময় আমাকে কাছ ছাড়া করতে চাইত না। আমি শুধু ওর জন্য রিস্ক নিয়ে হলেও অনেকদিন ছুটি কাটালাম। সপ্তাহখানেক পর মেয়েটা মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠলেও স্যুপ ছাড়া কিছু খেতে পারত না৷ পুরো এক মাস ভুগেছিল তনু। সেই এক মাস আমিও স্যুপ ছাড়া কিছু মুখে দিতে পারিনি।
আমার হার্টে ছোট্ট একটা সার্জারি হয়েছিল। সে সময় ঠিক এমন করেই সে সারাক্ষণ পাশে থেকেছে। আমি যা খেতে পারতাম সেটুকু খেয়ে থেকেছে। এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল করতে চাইত না৷ মেয়ে ছাড়া কে এত আপন হয় বলো?
আমি দোয়া করব তোমার একটা মেয়ে হোক, তুমিও বুঝবে এত আদরের মেয়েকে বিয়ের পর কষ্ট পেতে দেখে কেমন লাগে।”
“আঙ্কেল…” বলতে বলতেও থেমে গেল স্বরূপ। বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “বাবা, আমার নিজের বাবা নেই। খুব ছোটোবেলায় মারা গেছেন। বাবার আদর ছাড়া একা বর হয়েছি। আমার জীবনটাও একেবারে সহজ ছিল না। সবসময় আমরা যা কাজ করি সেটা কি নিজের কন্ট্রোলে থাকে? ভুল তো মানুষেরই হয় বলুন? আমি খুবই লজ্জিত এবং দুঃখিত। আপনি প্লিজ আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি তনয়াকে নিয়ে যেতে চাই। কথা দিচ্ছি, এরপর আর এমন হবে না।”
বাবা একটু ভেবে বললেন, “বুঝলাম৷ কিন্তু একটা ব্যাপার কী জানো, তোমার এইযে নিজেকে কন্ট্রোল করার ক্ষমতাটা নেই, এই স্বভাবটা পরিবর্তন করতে হবে। তুমি ওকে অসম্মানজনক কথাবার্তা বলেছ। মেয়েটা অনেক আঘাত পেয়েছে। এ ধরনের কথাবার্তা তার সাথে কখনোই বলা হয় না। তুমি একবার এসব বলেছ, রাগ কন্ট্রোল করতে না পারলে আবারও বলবে। বলার সময় চেতনা কাজ করবে না, অবচেতন মন ভাববে কী আর হবে, বড়জোর বউ বাড়ি ছাড়বে, আবার গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে এলেই হবে।”
“না বাবা এরকম হবে না।”
“আমার মনে হয় তোমার নিজের ওপর কাজ করাটা অনেক জরুরি। সমাজ বলো বা ধর্ম, কোনোটাই তোমাকে অকারনে স্ত্রীকে অপমান করার অধিকার দেয়নি। সাদা চোখে ব্যাপারটা খুব ছোটো মনে হয়। এসব অহরহ হচ্ছে। কিন্তু তাই বলে ব্যাপারটাকে জাস্টিফাই করা যাবে ন। তুমি যদি সত্যিই ভালো একজন স্বামী হতে চাও তাহলে ভুলের উপলব্ধি খুব জরুরি। ভুল উপলব্ধির পর তনয়ার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিও। সে তোমাকে ভালোবাসে, তোমার সাথে থাকতে চায়। তাকে সম্মানের সাথে রাখা তোমার দায়িত্ব। বিয়ে করে হাত পা ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলে তো হলো না, অনেক দায়িত্ব আছে মাই বয়!”
বাবা চলে গেলে স্বরূপ ঝিম ধরে বসে রইল অনেকক্ষণ। সব কথা মাথায় ঘুরছে।
হঠাৎ মনে পড়ল অফিসে ঘন্টাখানেকের কথা বলে এসেছে। এদিকে দু’ঘন্টা পার হয়েছে। সে উঠল। জীবনটা বড় বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে!
*
মিলির অফিসে একটা পার্সেল এলো বিকেলের দিকে। খুব সুন্দর র্যাপিং পেপারে মোড়া বাক্স। কে পাঠিয়েছে লেখা নেই। মিলি আগ্রহ নিয়ে খুলল। অনেকদিন কোনো উপহার পায় না সে। কে সেই সহৃদয় ব্যক্তি যার তাকে হঠাৎ উপহার দিতে ইচ্ছে হলো?
প্যাকেট খোলার পর ভেতর থেকে দুটো জিনিস বের হলো। দুটো দেখেই মিলি বেশ অবাক হলো। একটা চিঠি আর একটা পারফিউমের শিশি। পারফিউমটা তার সবচেয়ে পছন্দের। ফরাসি ব্র্যান্ড। এই ব্র্যান্ডটা সে ভীষণ পছন্দ করলেও অতিরিক্ত দামী বলে খুব কম ব্যবহার করে। তার আগের বোতলটা রয়ে গেছে ফেলে আসা সংসারে৷
চিঠির ভাঁজ খুলল মিলি। কয়েক লাইন লেখা, “পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষটির জন্য সামান্য উপহার। আশা করি আপনার পছন্দ হবে। কিছু মানুষকে কমদামী জিনিসে একদম মানায় না।”
মিলির চেহারা কঠিন হয়ে উঠল। সেই লোকটাই! কিন্তু নেহায়েতই উটকো লোক মনে হচ্ছে না। মেয়ে পটানোর জন্য একুশ হাজার টাকার পারফিউম পাঠাতে কলিজা লাগে। নিশ্চয়ই ওড়ানোর জন্য টাকাপয়সা একটু বেশিই হয়ে গেছে।
লোকটার ফোন এলো একটু পরেই।
“পছন্দ হয়েছে?”
মিলি মিষ্টি সুরে বলল, “খুব! ধন্যবাদ।”
“জানতাম পছন্দ হবে।”
“আপনার সাথে দেখা করতে চাই।”
“তাই? করব, এত তাড়া কিসের?”
“আপনাকে একটা রিটার্ন গিফট দেব। আমার শুধু গিফট নিতে ভালো লাগে না। আমার ব্যাপারে এত জানেন, এটাও নিশ্চয়ই জানেন যে আমি উপহারদাতাকে খালি হাতে যেতে দেই না?”
লোকটা হাসল। বলল, “এত তাড়া নেই। কিছুদিন পর দেখা করি। তখন উপহার নেয়া যাবে।”
“উহু, আজই। দেখা না করতে চাইলে আমার অফিসের সামনে আসুন ছয়টার দিকে, আমি বের হয়ে গিফট রেখে যাব।”
“যথা আজ্ঞা!”
ছয়টা পাঁচে বের হলো মিলি। হাতে পারফিউমের বোতল। বের হয়ে আশেপাশে তাকাল। কাউকে দেখে মনে হলো না তাকে খেয়াল করছে। মনে হবারও কথা নয়। লোকটা সাবধান।
সে বিল্ডিংয়ের সামনে রাখা পাতাবাহার গাছের গোড়ার পুরো পারফিউমের শিশি উপুড় করে দিল। তারপর বোতলটা ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে একটা রিকশায় চড়ে বসল।
রাতে লোকটার ফোন এলো।
“আপনার রিটার্ন গিফট দেখে আমি ইমপ্রেসড।”
“ধন্যবাদ।”
“জেদি মেয়েই ভালো লাগে আমার।”
“কিন্তু আমার পেছনে পড়ে থাকা ছ্যাঁচড়া লোকজন পছন্দ নয়।” বলে ফোনটা কেটে দিল মিলি। এই লোক আবার ফোন করবে। জ্বালিয়ে শেষ করে দেবে!
*
স্বরূপ অফিস শেষে তনয়াদের বাসার দিকে রওনা দিল। তার মেজাজ চড়ে আছে। রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম। তার ওপর দুপুরে তনয়ার বাবার একগাদা ঝাড়ি, সেখান থেকে অফিসে গিয়ে বসের ঝাড়ি, সব মিলিয়ে তার মাথা গরম হয়ে গেছে। গাড়িগুলো পুরোপুরি নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক ইঞ্চিও নড়ছে না গত বিশ মিনিট ধরে।
গাড়ির জানালায় টোকা পড়ল। একটা…দুটো…তিনটে…
স্বরূপ পাত্তা দিল না৷ কিন্তু যে টোকা দিচ্ছে তার ক্ষান্তি নেই। সে একপ্রকার অসহ্য হয়ে জানালা খুলল। বাচ্চা একটা ছেলে। হাতে পানির বোতল। ফোকলা দাঁত বের করে সে বলল, “ভাইয়া পানি লইবেন? ঠান্ডা পানি আছে।”
স্বরূপ অত্যন্ত তিক্ত গলায় বলল, “তোদের কি সমস্যা হ্যাঁ, মানুষকে শান্তিতে থাকতে দিবি না? দেখছিলি জানালা খুলছিলাম না, তারপরেও টোকা দিয়ে যাচ্ছিলি৷ কোনো পানি কিনব না। যা ভাগ এখান থেকে! বেয়াদব পোলাপান!”
বাচ্চাটা ছোটো। এই আচমকা ঝাড়ি খেয়ে তার মুখ ছোটো হয়ে গেল। মাথা নিচু করে সরে গেল সে। স্বরূপের জানালার কাচ তুলে দিতে দিতে মনে হলো, সে কেন এটা করল? কাজটা কি খুব খারাপ হয়ে গেল না? বিনা কারনে বাচ্চাটার সাথে এমন ব্যবহার করা কি ঠিক হলো? হয়তো বাচ্চাটা এতিম, ঠিকমতো খেতে পায় না।
ভীষণ অপরাধবোধ নিয়ে সে কাচ নামিয়ে এদিক ওদিক চাইল। বাচ্চাটাকে দেখতে পেল না।
জ্যাম ছুটে গেলে সে গাড়ি ঘুরিয়ে নিজের বাসার দিকে রওনা দিল। তনয়ার বাবা ঠিকই বলেছিলেন। তার এখনো ভুলটা ঠিকঠাক উপলব্ধি হয়নি৷ এখনো শোধরাবার বাকি আছে। আজ তনয়া যদি ফিরে আসেও, কাল সে আবার ওরকম আচরণ করবে না এমন কোনো গ্যারেন্টি নেই।
বাড়ি ফিরে স্বরূপ চুপচাপ মায়ের রান্না খেয়ে নিল। মা তাকে কী যেন বলতে চাইছিলেন। স্বরূপ শুনল না। বলল, “প্রচন্ড মাথাব্যথা করছে মা। কাল ছুটির দিন, কাল শুনব।”
মাও আর জোরাজোরি করলেন না৷
*
গভীর রাতে এলোমেলো ফেসবুক ঘাটছিল তনয়া। রাতে ঘুম আসে না। ভূতের মতো জেগে থেকে চোখের নিচে কালি পড়েছে। অনেক চেষ্টা করেও ঘুম আনানো যায় না৷
ওর এক বন্ধু প্রোফাইলে নিজের ছোটোবেলার ছবির সাথে বাচ্চার ছবি জোড়া লাগিয়ে পোস্ট করেছে৷ ঠিক একইরকম দেখতে দুটো বাচ্চা। কে বলবে মা মেয়ে! শুধু ছবির কোয়ালিটির পার্থক্য।
তনয়ার মাথায় এলো, তার বাচ্চাটা কার মতো দেখতে হবে? তার মতো নাকি বাবার মতো? দুজনের ছোটোবেলার ছবি একত্র করে রাখলে বাচ্চা হবার পর মিলিয়ে নেয়া যাবে।
তনয়া উঠে অ্যালবাম থেকে নিজের ছোটোবেলার ছবি বের করে মোবাইলে সেটা থেকে ছবি তুলে নিল। আবার শুয়ে পড়ল সে। স্বরূপের কি ছবি আছে? এখন তো চাওয়া যাবে না।
হঠাৎ মনে পড়ল স্বরূপের প্রোফাইলে সে ওর ছোটোকালের একটা ছবি দেখেছে! অনেক আগের আপলোড করা। সেটা নিশ্চয়ই এখনো আছে। তনয়া স্বরূপের প্রোফাইলে ঢুকল। শুরুতেই লেখা, “What is love?”
তনয়ার গা জ্বলে গেল। মনে মনে বলল, তোর ভালোবাসার গুষ্টি কিলাই! বাচ্চাটা তোর মতো দেখতে হলেই ভালো হবে। তোকে কাছেও আসতে দেব না, ছুঁতেও দেব না। দূর থেকে দেখে চলে যাবি আর কাঁদবি। দারুণ হবে! বদ কোথাকার!
সে ছবির অপশনে গিয়ে স্ক্রল করতে থাকল। বেশ কয়েক বছর আগের সেই ছোট্টবেলার ছবিটা একসময় সে খুঁজে পেল। দুটো মাত্র দাঁতে কি বিশাল হাসি দিয়ে রেখেছে! চোখ জুড়িয়ে গেল তনয়ার৷ ছবিটা সেভ করে রাখল সে।
ছবিতে অনেকগুলো কমেন্ট এসেছে। সে ক্লিক করল সেখানে। প্রথমেই যে কমেন্টটা ভেসে উঠল সেটা করেছে লোপা চৌধুরী নামের একজন। এই কি সেই লোপা? কমেন্টে লেখা, “ওরে আমার বাবুটা, এত্ত কিউট! উফ! চুমু খেতে ইচ্ছে করছে।”
স্বরূপ সেখানে উত্তর দিয়েছে, “খেতেই পারো। এনি টাইম!”
– আমি তোমার কথা বলিনি, বাচ্চাটার কথা বলেছি।
– বাচ্চাটাই যে আমি।
– উহু, মানি না।
– যখন তোমারও সেম টু সেম একটা হবে তখন বুঝবে এটা বাচ্চা বাকি বাচ্চার বাবা।
– ইশ! কমেন্টে কী দুষ্টুমি কথাবার্তা রে বাবা!
– আচ্ছা পছন্দ না হলে মিষ্টি কথা বলব? I love you.
– I love you too baccha/ bacchar baba.
তনয়া কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। কেন সে এটা দেখল? কেন আজই দেখল? তার এত রাগ হতে থাকল যে ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে দিল দূরে। সেটা দেয়ালে লেগে ভেঙে নিচে পড়ল।
তনয়ার কাঁদতে কাঁদতে বিড়বিড় করতে লাগল, “তুমি আমার সাথে এমন কেন করলে আল্লাহ? আমার কী দোষ ছিল? অতীতে ধাক্কা খাওয়া একটা মানুষকে বিয়ে করে কি ভুল করেছি আমি? তুমি সেজন্য আমার ওপর এত রাগ? এই ছবি তো আমি আগেও দেখেছি। বিয়েরও আগে। কই তখন তো এসব দেখাওনি৷ তাহলে এখন কেন?”
কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেল তনয়ার। কিছুতেই এই প্রাক্তন প্রেমিকযুগলের ন্যাকা কথাবার্তা মাথা থেকে বের করতে পারল না৷
অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলে সে একটু শান্ত হলো। ওয়াশরুমে যাওয়া প্রয়োজন। সে উঠল। বাথরুমের আলো জ্বেলে ভেতরে গিয়ে দাঁড়াতেই হঠাৎ মনে হলো পৃথিবীটা দুলছে। চোখের সামনের সবকিছু তিরতির করে কাঁপছে। পড়ার আগে সে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু হাতে কিছুই ঠেকল না।
*
স্বরূপ আবারও স্বপ্নটা দেখছিল৷ এবারও সে পা পিছলে গেল। ফুলটা ছুটে গেল হাত থেকে। সেটা ভেসে যাচ্ছে অতলে। হঠাৎ ফুলটা বদলে গিয়ে আস্ত মানুষে পরিণত হলো। তনয়া….
চেঁচিয়ে উঠে বসল স্বরূপ। ঘেমে গেছে। দরজায় অবরত আঘাত পড়ছে। লাফিয়ে উঠে দরজা খুলল সে৷ মা ঝড়ের মতো ঢুকে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, “তনয়া হসপিটালে…”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু