গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-২৮+২৯

0
469

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
২৮.

মিলি এই ঝামেলার মধ্যেও অফিস কামাই করে না। উল্টো সে যখন অফিসে যায় তাকে দেখলে বোঝা যায় না এতকিছু তার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। বেশ ফিটফাট আর স্বাভাবিক থাকে। তনয়া অবাক হয় ওকে দেখলে। খুব শক্ত মনমানসিকতা না থাকলে এটা সম্ভব না৷ তার নিজের সাথে এরকম হলে সে কেঁদেই অর্ধেক হয়ে যেত। অথচ সে মিলিকে কাঁদতে দেখেছে দুই একবার। তাও চোখে পানি আসার পরপরই সে মুছে ফেলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। এটা আবার একদিক দিয়ে খারাপও, কারন কষ্ট ভেতরে চেপে রাখতে রাখতে ভেতরটা শুকিয়ে মন মরে যায়।

ওরা অফিসের জন্য বেরিয়ে গেলে তনয়া একা হয়ে যায়। কেন যেন এখন তার আর আগের মতো সবকিছুতে মন বসে না। বরং শুয়ে শুয়ে দিন কেটে যায়। শুধু একবার কষ্ট করে ওঠে রান্না করার জন্য। গাছগুলোতে আগের মতো যত্ন নিতে ইচ্ছে করে না। কী হলো তার?

হতে পারে সবকিছুর কারন স্বরূপ। সে তনয়ার সাথে ঠিকমতো কথাই বলে না। মিলির ঘটনাটা তাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে। হয়তো ভাবছে তনয়াও কোনোদিন মিলির স্বামীর মতো করবে! এসব ভাবলে তনয়ার আরও খারাপ লাগতে থাকে৷ নাহ্ আজ স্বরূপ এলে সে এসবের সমাপ্তি ঘটাবেই। আর ভালো লাগছে না। ঘরের ভেতরটা গুমোট দীর্ঘশ্বাসের আড্ডা হয়ে উঠেছে।

আজ সে আগেভাগে রান্নাবান্না শেষ করল। গাছগুলোর যত্ন নিল। সময় নিয়ে গোসল করে সুন্দর একটা শাড়ি পরল। দূরী খালার সাথে গল্পগুজব করল। ফোনে মা বাবার সাথে অনেকক্ষণ কথা বলল। সব মিলিয়ে ওর মন ভালো রইল।

সন্ধ্যায় স্বরূপ ফিরলে তাকে সুন্দর করে চা বানিয়ে দিল। সাথে মাখন দেয়া টোস্ট। স্বরূপ ভালো চা খুবই পছন্দ করে। চায়ে চুমুক দিয়ে সে বলল, “বাহ! চমৎকার হয়েছে। তো, ব্যাপারটা কী?”

তনয়া একটু হেসে বলল, “কিসের ব্যাপার?”

“মনে হচ্ছে কিছু একটা হচ্ছে।”

“কী হবে?”

“সাজগোজ করেছ যে?”

“খেয়াল করেছ তাহলে!”

স্বরূপ চোখ মটকে বলল, “তুমি কি আমাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছ?”

তনয়া রহস্য করে বলল, “বলতে পারো…”

“ওহ, কয়েকদিন তো দূরে দূরে আছি। কত আর ভালো লাগে তাই না?”

দুজনেই হাসল। স্বরূপ চা শেষ করতে করতে অফিসের জরুরি একটা কল আসায় উঠে বারান্দায় চলে গেল। তনয়া গেল কাপ পিরিচ ধুয়ে রাখছে৷ এর মধ্যে মিলি চলে এলো। তনয়া মিলির জন্য চা বসিয়ে দিল। সাথে রাতে খাবার জন্য ভাতও বসাল।

স্বরূপ ততক্ষণে ল্যাপটপে বসে গেছে। অফিসের একটা মেইল সেন্ড করে খেয়াল করল দরজায় টোকা পড়েছে। পর্দার ওপাশ থেকে মিলি বলল, “আসতে পারি?”

স্বরূপ বলল, “আরে, আয়।”

মিলি ঘরে ঢুকল। বিষন্ন মুখ। আজ চেহারাটা একটু বেশিই বিমর্ষ লাগছে।

স্বরূপ জিজ্ঞেস করল, “নতুন কিছু হয়েছ?”

“আমি উকিলের সাথে কথা বলেছি ডিভোর্সের বিষয়ে। সাফাতকে আজ নোটিশ পাঠিয়ে দিলাম। পেয়েছে কিনা কনফার্ম হতে কল করলাম, রিসিভ করল সেই মেয়ে। বলল, সাফাত ওয়াশরুমে গেছে। আমি আর কিছু বলিনি জানিস, কল কেটে দিয়েছি।”

স্বরূপ খেয়াল করল ওর হাত কাঁপছে রাগে। চেয়েও কিছু বলতে পারল না।

মিলি মৃদু স্বরে বলল, “ওটা আমার বাসা ছিল স্বরূপ। ঘরের প্রতিটা ইঞ্চি আমার হাতে সাজানো। ও এতদিন যা করেছে, লুকিয়ে করেছে৷ আমার সামনে তো ভালোই থাকত। এখন সব খোলাখুলি চলছে। যেন হুট করেই সবটা জবরদখল হয়ে গেল। ছেড়ে আসতে হবে জানতাম, কিন্তু এভাবে তা তো ভাবিনি।”

স্বরূপ দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তুই আবার মহান সাজছিস। একবার বল, ওকে সাইজ করে দেই। মেয়েটাকেও দেখে নেব।”

মিলি বাঁকা হাসল, “এত সহজ না স্বরূপ। ও এত অল্পতে পাড় পেয়ে যাবে না। ওর জন্য অনেক বড় শিক্ষা অপেক্ষা করে আছে।”

“তুই কোন ভিত্তিতে বলছিস ও একটা শিক্ষা পাবেই? হতেও তো পারে সারাজীবন তোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ভালো থাকল?”

মিলির হাসিটা এবার চওড়া হলো। সে বলল, “আমি কোনোদিন কাউকে জ্ঞানত কষ্ট দেইনি। আল্লাহর ওপর পুরো বিশ্বাস আমার আছে। হ্যাঁ, আমি ধর্মের সব নির্দেশ ঠিকমতো পালন করি না, কিন্তু আমার বিশ্বাসে কোনো ঘাটতি নেই। আমি জানি, আল্লাহ আমাকে ন্যায়বিচার দেবেন। সেটারই অপেক্ষা করছি। তোদের বিচার আমার চাই না।”

স্বরূপ মিলির দিকে তাকিয়ে রইল। এই মেয়েটাকে সে কখনোই বুঝতে পারেনি। সে নরম নাকি কঠিন এটা পর্যন্ত বোঝা শক্ত।

মিলি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “যাকগে, তোর সাথে শেয়ার করতে ইচ্ছে হলো কথাটা। তাই করলাম। মা বাবাকে কী বলব সেটাও অলমোস্ট ঠিক করে ফেলেছি।”

“কী ঠিক করেছিস?”

“বিশেষ কিছু না। আমি দুই-তিনদিনের মধ্যে চলেও যাব। নিজেকে সামলাতে সময় লাগছে এই যা! যখন বুঝব ঠিকঠাক হয়ে গেছি, তখন বাড়ি চলে যাব। মায়ের কোলে ঘুমালে একটু শান্তি লাগবে বুঝলি!”

“হুম।”

মিলি উঠে চলে গেল নিজের ঘরে। তনয়া চা নিয়ে গিয়ে দেখল মিলি জানালার পাশে বসে রাতের আকাশ দেখছে। সে বলল, “আপু চা এনেছি।”

মিলি হঠাৎ বলল, “তনয়া, একটা কথা বলি তোমাকে?”

“বলো আপু।”

“এত ভালো হয়ে থেকো না৷ একটু খারাপও হতে শেখো। পৃথিবীতে ভালো মানুষের দাম খুব কম। সবাই সস্তা ভেবে বসে।”

তনয়া কিছু বলার মতো খুঁজে পেল না। চুপচাপ বেরিয়ে গেল।

রাতের খাবারের পর সব গুছিয়ে তনয়ার ফুরসত মিলল শোবার ঘরে ঢোকার। স্বরূপ মোবাইলে কী যেন দেখছে। তনয় শোবার প্রস্তুতি নিতে বাথরুমে ঢুকল।

স্বরূপ সোশ্যাল মিডিয়া ঘাঁটছে কোনো কারন ছাড়াই। তার শরীর জ্বলছে। মাথা কাজ করতে চাইছে না। তার সাথে যেটা ঘটেছিল সেই ঘটনাটা এতদিন ধরে চাপা আগ্নেয়গিরির মতো ভেতরে জমা ছিল। সে ভেবেছিল আগুন নিভে গেছে। কিন্তু না, জেগে উঠছে আবার। মানুষ কেমন করে নির্মমভাবে ধোঁকা দিতে পারে? দিনের পর দিন মিথ্যে বলতে পারে? আরেকটা মানুষকে ভেঙেচুরে শেষ করে দিতে পারে?

লোপার সাথে তার শেষবার ভালোভাবে কথা হয়েছিল সেই বিশেষ দিনেই সকালবেলা। আহ্লাদী গলায় মেয়েটা তাকে বলছিল, একা একা ঘুমাতে তার কী ভীষণ খারাপ লাগে! বিয়ের পর সে স্বরূপকে এক মুহূর্তের জন্যও ছাড়বে না। স্বরূপ সেই শেষবারের মতো লোপাকে বলেছিল, “ভালোবাসি।” এরপর এই শব্দ সে আর উচ্চারণ করার সাহস পায়নি। কোনোদিন হয়তো পাবেও না।

সেই মেয়েই বিকেলবেলা অন্য লোকের বাহুলগ্না হয়েছিল তার নিজেরই সেই তথাকথিত একলা বিছানায়। পৃথিবীর সবকিছুর ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে গিয়েছিল তার। মিলির সাথেও কি এটাই হয়নি? মিলি সেদিন জলদি বাসায় না ফিরলে কি জানতে পারত তারই বিছানায় অন্য কারো সাথে তার স্বামীর অভিসার চলে?

চিন্তাগুলো মাথায় দপদপ করছে ওর। মোবাইলটা ছুঁড়ে ফেলল দূরে। কঠিন মুখে বসে রইল।

তনয়া ততক্ষণে শুতে চলে এসেছে৷ সে একপাশে শুয়ে হাত বাড়িয়ে স্বরূপকে ডাকল। স্বরূপ তাকাল না তার দিকে। তনয়া ওর হাত ধরে ঝাঁকুনি দিল, “কী হলো তোমার? শোবে না?”

“না।”

“কেন?” উঠে বসল তনয়া।

“ভালো লাগছে না।”

তনয়া ওর কপালে গালে হাত দিয়ে তাপমাত্রা দেখে বলল, “কী হয়েছে বলোতো? চোখ লাল কেন? শরীর খারাপ লাগছে?”

স্বরূপের রাগটা বের হয়ে আসতে চাইছিল। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না৷ ধাক্কা দিয়ে ওকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “তোমার সমস্যা কী? এত গায়ে পড়া স্বভাব কেন? সব বিষয়ে নাক গলাতে হবে কেন? আমি কি আমার বাসায় চাইলেও একটু একা থাকতে পারব না?”

তনয়ার চোখ পানিতে ভর্তি হয়ে গেল। এত কড়া ভাষায় এমন মেজাজ দেখিয়ে স্বরূপ কখনোই তার সাথে কথা বলেনি। সে তবুও ঠোঁট কামড়ে বলল, “আমি কী করেছি?”

স্বরূপ গলা আরেকটু চড়িয়ে বলল, “কিছুই করোনি তুমি। আমাকে এবার একটু একা থাকতে দিয়ে উদ্ধার করো! মাথা ফেটে যাচ্ছে আমার। তোমার ন্যাকামি দেখার সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই নেই। পরিস্থিতি বোঝো না তুমি? সবসয়ম তো একরকম ভালো লাগে।”

তনয়ার গাল বেয়ে তখন চোখে পানি গড়িয়ে পড়ছে। স্বরূপ যেন হঠাৎ খুব নির্দয় হয়ে উঠল। লোপাও সেদিন খুব কেঁদেছিল তার সামনে। পায়ে ধরেছিল। কাঁদতে কাঁদতে ওর জামা ভিজে গিয়েছিল। কথাটা মনে হতেই স্বরূপের রাগ আরও বাড়ল। বলল, “কিছু হলেই তো চোখের পানিতে পৃথিবী ভাসিয়ে দিয়ে সব ঠিক করে ফেলতে চাও। আদৌ কিছু হয় চোখের পানি দিয়ে? ভুলটা ভুলই থাকে।”

সে উঠে ড্রয়ের থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে নিয়ে বারান্দায় চলে গেল।

তনয়া স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। চোখ দিয়ে আপনাআপনি পানি গড়িয়ে পড়ছে। তার সাথে কেউ কোনোদিন এভাবে কথা বলেনি। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে হওয়ায় তার গায়ে ফুলের টোকা পর্যন্ত পড়তে দেননি তারা। অথচ আজ কতগুলো কঠিন কথা শুনতে হলো। স্বরূপ যেভাবে চিবিয়ে চিবিয়ে মুখ কঠিন করে কথাগুলো বলছিল, তনয়ার মনে হচ্ছিল প্রতিটা কথা কাঁটার মতো বিঁধছে তার গায়ে। এমন কী করেছে সে? কিছুই তো করেনি। অন্য কারো রাগ তার ওপর এভাবে কেন ঝাড়া হবে? সে তো রাগ করার মতো কোনো কথা পর্যন্ত বলেনি। ভুল করলে ভুলের মাশুল হিসেবে কথাগুলো নেয়া যেত নাহয়। কিন্তু বিনা কারনে এসব কেন সে সহ্য করবে?

তনয়া কাঁদতেই থাকল। তার মাথায় স্বরূপের কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হতে লাগল বারবার। মাথা ব্যথা হতে লাগল ক্রমশ। প্রায় সারারাত সে এভাবেই বসে ফুঁপিয়ে কাঁদল। মনের কোথাও ক্ষীণ আশাও ছিল স্বরূপ হয়তো এসে এক্ষুনি ক্ষমা চাইবে। কিন্তু সারারাতে একবারের জন্যও স্বরূপ ঘরে ঢুকল না। বারান্দায়ই সিগারেট পুড়িয়ে রাত কাটিয়ে দিল।

তনয়া একসময় বসে থাকতে না পেরে শুয়ে পড়ল। খুব দু্র্বল লাগছে। কাঁদার শক্তিও একসময় শেষ হয়ে গেছে। তবে ঘুম এলো না।

স্বরূপ সকালে ঘরে এসে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে বেরিয়ে গেল। মিলিও বোধহয় ওর সাথেই বের হলো। তনয়া ঘুমের ভান করে পড়ে রইল। উঠল না, কথা বলার প্রশ্নই আসে না।

ওরা অফিসের জন্য বেরিয়ে গেলে তনয়া উঠল। তার মন বিষিয়ে উঠেছে। স্বরূপ সন্ধ্যায় ফিরেও নিশ্চয়ই একই মূর্তিতে থাকবে। ওর সাথে কথা বলারও রুচি হচ্ছে না। স্বরূপ ঠিকই বলে, সে তাকে ভালোবাসে না। ভালোবাসলে এভাবে কথা বলা যায় না। তারা শুধু কিছু ভালো সময় একসাথে ভাগ করে নিয়েছে। স্বরূপ তার দায়িত্ব পালন করে গেছে এই-ই! এর বেশি কিছু নয়। তনয়ার ক্রমশ মন ভারী হতে লাগল। বারবার স্বরূপের কথা কানে বাজছে৷ না, এখানে আর বেশিক্ষণ থাকবে না সে। চলে যাবে। যার বাসা তাকে একা থাকতে দিয়ে চলে যাবে সে। থাকুক, নিজের যতটা স্পেস লাগে ততটা নিয়ে সে ভালো থাকুক।

তনয়া নিজেকে টেনে ওঠাল কষ্ট করে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাগে ভর্তি করে নিয়ে সে গাড়ি ডেকে বাপের বাড়িতে রওনা দিল।

তনয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না এভাবে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবার। একদিন আগেও কল্পনা করেনি এমন হতে পারে। গাড়িতে উঠে বারবার মনে হচ্ছিল, স্বরূপ একবার নিজের ভুলটা বুঝুক! তাকে স্যরি বলুক। ভালো করে কথা বলুক।

সে বারবার ফোন চেক করে গেল। কিন্তু কোনো কল বা মেসেজ এলো না।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
২৯.

তনয়া ভেবেছিল স্বরূপ সন্ধ্যায় ফিরে তাকে না পেয়ে অবশ্যই ফোন করবে। কিংবা তাকে নিতে চলে আসবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। সে মোবাইল হাতে জানালার পাশে বসে সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত কাটিয়ে দিল।

তনয়াকে হঠাৎ চলে আসতে দেখে আর ওর কান্না দেখে মা বেশ ভয় পেয়ে গেছেন৷ তনয়া কিছু বলছে না দেখে তার আশঙ্কা আরও বাড়ছে। স্বরূপকে ফোন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তনয়া শক্তভাবে নিষেধ করেছে স্বরূপের সাথে যোগাযোগের কোনো চেষ্টা না করতে৷ তিনি একটু পরপর এসে মেয়েকে দেখে যাচ্ছেন। রাত দশটায় যখন খেতে ডাকতে গেলেন তখন দেখলেন তনয়া বিছানায় চুপচাপ শুয়ে আছে। তার গায়ে ভীষণ জ্বর।

*

স্বরূপ অনেকবার কলিংবেল চাপল। দরজা খুলল না। আবারও কেঁদেকেটে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে কি না এই আশঙ্কায় সে চাবি দিয়ে দরজা বাইরে থেকে খুলে ভেতরে ঢুকল। তবে ভেতরে পা দিয়েই তার মনে হলো তনয়া নেই। শোবার ঘরে গিয়ে ভালো করে দেখে বুঝল তনয়া ইচ্ছে করেই চলে গেছে। ঘরে তার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর জায়গা ফাঁকা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল স্বরূপ। এজন্যই বিয়ে করতে চায়নি সে৷ নিজের তিতকুটে জীবনে অন্য কাউকে জড়ানোর কোনো ইচ্ছেই তার ছিল না। সে তো ইচ্ছে করে বিয়ে করেওনি, অন্যরা জোর করেছে, আর যাকে করেছে তারও ইচ্ছে ছিল। এখন তাকে দোষ দিয়ে তো লাভ নেই।

স্বরূপের গতকালের মেজাজ এখন অনেকটা ঠান্ডা। ভেবেছিল আজ ফিরে তনয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু ভালোই হলো। কয়েকদিন আলাদা থাকা উচিত। অন্তত তার মেজাজের উন্নতি হওয়া পর্যন্ত। এখানে থাকলে বরং আরও ঝগড়াঝাটি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। সে ফোন করবে ভেবেও করল না। চলে যাওয়ার সময় তো তাকে বলার প্রয়োজন মনে করেনি। এখন সেই বা কেন যেচে পড়ে খোঁজ নিতে যাবে!

স্বরূপের ক্ষুধা লেগেছিল। রান্নাঘরে গিয়ে দেখল কিছুই রান্না হয়নি। সে ক্লান্ত শরীর নিয়েই রান্না বসিয়ে দিল। অল্প কিছু হলেও করতে হবে। মিলিও তো খাবে।

মিলি ফিরল একটু রাত করে। এসে যখন জানতে পারল তনয়া নেই, তখন সে একটু গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, “আমি থাকায় তোদের কোনো সমস্যা হয়েছে?”

“তোকে নিয়ে কিছু না। অন্য বিষয়ে ঝগড়া হয়েছে।”

“তাই বলে চলে গেল?”

স্বরূপ বলল, “এটা কোনো ব্যাপার না। একসাথে থাকলে ঝগড়া হয়ই। তুই হাতমুখ ধুয়ে খেতে আয়।”

খেতে বসে মিলি অনেকদিন পর স্বাভাবিক সুরে কথা বলল। তাকে বেশ সতেজ লাগছে আজ। স্বরূপের রান্নার বেশ প্রশংসা করল সে। দুজন একসাথে টেবিলটাও গুছিয়ে ফেলল।

স্বরূপ খাওয়ার পর নিজের ঘরে গিয়ে শুয়েছিল, তখন মিলি দরজায় টোকা দিল, “আসতে পারি?”

স্বরূপ উঠে বসে বলল, “হ্যাঁ আয়।”

মিলি ঢুকল। তাকে দেখে স্বরূপের মনে হলো সে সাজগোজও করেছে। কারন কী?

মিলি বিছানায় বসে খুব সহজ গলায় বলল, “বাবা মাকে কী বলব ঠিক করে ফেলেছি।”

“কী বলবি?”

“আগে আমার দিকে তাকা। কী মনে হয়?”

“কী মনে হবে?”

“আরে আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে, আমি কোনো শোকের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি?”

স্বরূপ একটু ভেবে বলল, “তোর চেহারা আগের থেকে খারাপ হয়ে গেছে।”

“আর কথা শুনে কী মনে হয়?”

“স্বাভাবিক।”

“হ্যাঁ, এভাবেই বাসায় যাব। ভাব দেখাব সব ঠিকঠাক আছে। কয়েকদিন এমনিতেই থাকব৷ হাসিখুশিভাবে দিন কাটাব। তারপর একসময় দুজনকে বুঝিয়ে বলব যে সাফাতের সাথে কোনোভাবেই বনিবনা হচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করেও আমরা ব্যর্থ। সবাই তো সবকিছু পারে না। এত স্লোলি বিষয়টা বোঝাব যে তাদের একেবারে পুরো ধাক্কাটা লাগবে না। আর সত্যি কথা বলার তো প্রশ্নই আসে না।”

“কিন্তু আঙ্কেল আন্টি যদি কথা বলতে চায় সাফাত বা তার পরিবারের সাথে?”

“সাফাত তো আর নিজের দোষ স্বীকার করবে না৷ আর ওর পরিবারের লোক মা বাবার কথা জানে। তাদের আমি বলে দিয়েছি তাদের কিছু না বলতে। তারা কিছুই জানবেন না।”

“যাক, ভালো।”

“তোকে আর তনয়াকে কী বলে ধন্যবাদ দেব জানি না। সেদিন বাড়িতে গেলে আমি এভাবে যেতে পারতাম না৷ তোদের কাছে কৃতজ্ঞ রইলাম৷ এখন তুই ওঠ। আমাকে পৌঁছে দিয়ে আয়।”

স্বরূপ অবাক হয়ে বলল, “এখন যাবি?”

“হ্যাঁ।”

“আগে তো বলিসনি।”

“প্ল্যান অন্যরকম ছিল। ভেবেছিলাম পরশু যাব। আরেকটু সময় নেব। কিন্তু আজই যেতে হবে। তনয়া যেহেতু নেই, আমাদের এক ফ্ল্যাটে থাকাটা উচিত হবে না।”

স্বরূপ রেগে গিয়ে বলল, “তুই এত বেশি বুঝিস কেন? আমি মেয়ে হলে কি তুই থাকতিস না? বন্ধুত্বের মধ্যে ছেলে মেয়ের পার্থক্য হবে কেন?”

মিলি একটু হেসে শান্ত স্বরে বলল, “তোর সাথে যে তনয়া কিভাবে থাকে! এত শর্ট টেম্পার কেন তুই? শোন, আমার বাসায় যদি সাফাতের কোনো বান্ধবী এসে থাকত, আমি কখনোই মেনে নিতাম না। তনয়া তো অনেক বড় মনের। সে কতদিন আমাকে থাকতে দিল। আমাদের মনে কোনো সমস্যা নাই থাকতে পারে, কিন্তু বায়োলজিকালি আমরা অপজিট জেন্ডার এবং আমাদের কোনো রক্তের সম্পর্কও নেই। তাই এভাবে থাকাটা অনুচিত। তাছাড়া সমাজ বলেও একটা বিষয় আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, তনয়ার প্রতি আমার অনেকটা কৃতজ্ঞতাবোধ আছে। সেকথা ভাবলে আমি থাকতে পারি না।”

“তোকে দেখতে আধুনিক মনে হলেও ভেতরে ভেতরে তুই অনেক কনজার্ভেটিভ রয়ে গেছিস।”

“হ্যাঁ রে, ঠিক ধরেছিস। নইলে এই দশা দেখতে হতো না। সাফাত যা করছে, আমিও তাই করতাম। ওপেন রিলেশনশিপে থাকতাম৷ আর বাইরে বাইরে ম্যারেটাল স্ট্যাটাসও বজায় থাকত। কিন্তু সবাই তো সবকিছু পারে না। আমি ভেতরে ভেতরে পাক্কা ঘরোয়া বাঙালি নারী। যে যাকগে, এখন উঠতে হবে।”

“তার মানে তুই সত্যিই চলে যাবি?”

“হ্যাঁ। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। খাওয়ার জন্য আরও দেরি হলো। কিন্তু তুই নিজের হাতে রান্না করেছিস দেখে না খেতে যেতে পারলাম না৷ তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে যা, আমি ড্রইংরুমে বসছি।”

স্বরূপ কাঁধ ঝাঁকাল, “ওকে!”

স্বরূপ তৈরি হতে হতে মিলি তনয়ার মোবাইলে একটা মেসেজ পাঠাল,

“তনয়া, আমাকে নিয়েই হয়তো তোমাদের মধ্যে ঝামেলা হয়েছে। আমি আসলে বুঝতে পারিনি এমন কিছু হতে পারে। আগেই বোঝা উচিত ছিল। আমার নিজের সংসার ভাঙার পর আমি চাই না আমার শত্রুর সাথেও এমনটা হোক। আর তুমি তো আমার শুভাকাঙ্ক্ষী। আমি চলে যাচ্ছি নিজের ঠিকানায়। তুমিও নিজের ঠিকানায় ফিরে এসো। আর আমার কারনে কষ্ট পেয়ে থাকলে ক্ষমা করে দিও।”

*

গাড়িটা মিলিদের বাড়ির সামনে আসতেই মিলি বলল, “ভেতরে যেতে হবে না, এখানেই রাখ। তোকে ভেতরে যেতে বলছি না সেজন্য স্যরি। মা বাবাকে জানতে দিতে চাই না যে তোর সাথে এসেছি।”

“ইটস ওকে! অন্য সময় আসব।”

মিলি গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে গিয়েও আবার বসে পড়ে বলল, “স্বরূপ একটা অ্যাডভাইজ দেই। আজকের দিনে লয়্যাল জীবনসঙ্গী পাওয়া কত বড় ভাগ্যের বিষয় তুই জানিস না। যারা পায় না তারা জানে। তাই নিজের সম্পর্ককে হেলাফেলা করিস না৷ তোর মধ্যে কোনো আর্জ দেখলাম না বউকে ফিরিয়ে আনতে। এসব বিষয়ে যত সময় নষ্ট করবি, সম্পর্ক তত ফিকে হতে থাকবে। তনয়া ভালো মেয়ে। তুই ওকে ভালো রাখলে নিজে তারচেয়েও ভালো থাকবি।”

স্বরূপ শুনল। কিছু বলল না৷ মিলি বেরিয়ে চলে গেল গেটের ভেতর।

স্বরূপ ফোন ফেলে এসেছে ভুলে। রাত বাজে এগারোটা৷ বাড়ি ফিরতে ফিরতে স্লো একটা মিউজিক চালিয়ে দিল সে৷ তনয়ার কথা সত্যিই মনে পড়ছে। ও পাশে থাকলে হাবিজাবি কথা বলত, হাসত, দুষ্টুমি করত। এমনিতে বাসায় ফিরে তাকে পাওয়া যায়। আজ তাও যাবে না। স্বরূপের একবার মনে হলো শ্বশুরবাড়িতে চলে যায়৷ তারপর আবার কী মনে করে গাড়িটা নিজের বাসার দিকেই নিয়ে চলল। তনয়ারও বোঝা উচিত সব পরিস্থিতিতে একরকম রোমান্টিকতা চলে না৷ সবারই একটা পার্সোনাল স্পেস থাকা উচিত।

*

তনয়ার জ্বর কমছে না দেখে ভয় পেয়ে তার মা স্বরূপকে বার কয়েক ফোন করলেন৷ ভাবলেন সে এলে হয়তো মেয়েটা একটু সুস্থ হবে। না জানি কত ঝগড়া করে এসেছে! কিন্তু স্বরূপ ফোন তুলল না৷

তনয়া সারাদিন কিছু খায়নি। মা ওর শিয়রে বসে মাথায় জলপট্টি দিতে দিতে বারবার ডাকতে লাগলেন, “মা, ও মা, একটু তাকাও৷ কিছু খেতে ইচ্ছে করে? একটা কিছু মুখে দিলে তো ঔষধটা খাওয়াতে পারি।”

তনয়া অনেকক্ষণ পর চোখ খুলে চাইল। বলল, “খাব।”

“কী খাবে মা?”

“ভাত খাব।”

মা তাড়াতাড়ি ভাত নিয়ে এলেন। কয়েক লোকমা ভাত মুখে তুলে দিলেন। কিন্তু তনয়া খেতে পারল না৷ বমি করে ফেলল। তার আরও দুর্বল লাগছে এখন।

*

বাসায় ফিরে স্বরূপ দেখল তনয়ার মায়ের মোবাইল থেকে বেশ কয়েকটা মিসড কল। তাও অনেকক্ষণ আগের। হয়তো মিটমাট করাতে ফোন করেছিলেন। ঘড়ি দেখল সে। বারোটা বাজে৷ এখন আন্টিকে ফোন করাটা উচিত হবে না। হয়তো শুয়ে পড়েছেন। তারচেয়ে কাল করা যাবে।

সে বিছানা গুছিয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু কিছুতেই ঘুম এলো না। ইনসমনিয়া কি ফিরে এলো? সে গতরাতে ঘুমায়নি, আজ সারাদিন কাজ করেছে, তবুও চোখে ঘুম নেই। তনয়া কি সাথে করে তার ঘুমও নিয়ে গেছে?

বিয়ের পর থেকে স্বরূপের ঘুম ভালো হতো। বিছানায় শুয়ে তনয়ার গায়ের ঘ্রাণে ঘুম চলে আসত। স্বরূপ একসময় বিছানায় গড়াগড়ি খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে বারান্দায় চলে গেল।

তনয়ার লাগানো গাছে হাস্নাহেনা ফুল মাতাল করা ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। যেদিন প্রথম এই গাছটাতে ফুল ফুটেছিল, তনয়া বাচ্চাদের মতো খুশি হয়েছিল। ওর মোবাইলের গ্যালারি ভর্তি এসব ফুলের ছবি।

আশ্চর্য তো! গতকালও এই বারান্দায় পুরো রাত কাটিয়েছে স্বরূপ। কাল তো এসব দেখে তনয়ার ছোটো ছোটো ব্যাপারগুলি মনে পড়েনি৷ সে ঘরেই ছিল সেজন্য? কে জানে!

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে