#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
২৬.
গাড়ির জানালা দিয়ে হাত বের করতেই কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি ভিজিয়ে দিল তার হাত। নীল রঙের চুড়ির রিনরিনে ধ্বনির সাথে বৃষ্টির সুর মিশে যাচ্ছে। আর কোনো শব্দ নেই। গাড়িটা মসৃনভাবে চলছে হাইওয়ে ধরে। চারদিকে এত সবুজ যে চোখ জুড়িয়ে যায়। তনয়া স্বরূপের দিকে তাকাল। খুব আনন্দ নিয়ে সে ড্রাইভ করছে। ঠোঁটের কোণে হাসি লেগে আছে।
গতকালই তারা গাড়িটা পেয়েছে। আর গতকালই তনয়ার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আজ ভোরবেলা স্বরূপ ওকে তুলে দিয়ে পাগল করে ফেলেছে বের হবে বলে। তনয়া চাইছিল একটু ঘুমাতে, কিন্তু স্বরূপের এই পাগলাটে শখটাতে বাঁধা দিতেও ইচ্ছে করছিল না। অগত্যা সে উঠে তৈরি হয়েছে।
তৈরি হতে গিয়ে সে প্রথমবার খেয়াল করেছে ক’দিনে তার চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পড়ে গেছে। গালের হাড় বেরিয়ে পড়েছে। গায়ের রঙও অনুজ্জ্বল হয়ে আছে। মনটাই খারাপ হয়ে গেছে তার। স্বরূপকে সেকথা বলতেই স্বরূপ বলেছে, “কি জানি, তোমাকে তো একরকমই লাগে।”
তনয়া আর কথা বাড়ায়নি। সব চোখ সবকিছু ডিটেক্ট করতে পারে না বোধহয়। তনয়ার আজ আর সাজতে ইচ্ছে হয়নি। গোসল করে নীল শাড়ি পরেছে। সাথে চোখে মোটা করে কাজল, অল্প কিছু ডিজাইনার গয়না আর হাতভর্তি নীল চুড়ি।
ওকে তৈরি দেখে স্বরূপ মুখে কিছু না বললেও তার দুই সেকেন্ড থমকে তাকিয়ে থাকাটা তনয়ার চোখ এড়ায়নি। তার ওটু্ুকুতেই চলবে।
অনেকটা ড্রাইভ করে আসার পর একটা চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি থামাল স্বরূপ। জিজ্ঞেস করল, “চা খাবে?”
“অবশ্যই।”
“নামি চলো।”
ওরা চায়ের দোকানে ঢুকতেই আবার ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। ভেতরে বসে মাটির ভাড়ে চুমুক দিতে দিতে তনয়া খেয়াল করল রাস্তার অপর পাশে একটা লম্বা কদম ফুলের গাছ। সেটা ভর্তি হয়ে আছে সোনারঙা বলের মতো কদম ফুলে। গানটা মনে পড়ে গেল তার, “বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল….”
হুমায়ূন আহমেদের কোনো বইতে হয়তো এরকম একটা লেখা পড়েছে সে, বর্ষার প্রথম কদম যদি কেউ তার ভালোবাসার মানুষকে দেয়, তাহলে সেই ভালোবাসা অটূট থাকে।
তনয়া স্বরূপের হাত চেপে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “আমার কদম ফুল চাই!”
স্বরূপ ভুরু কুঁচকে গাছের দিকে চেয়ে তারপর তনয়ার দিকে চাইল। “এই বৃষ্টির মধ্যে গাছের মাথায় কে উঠবে?”
“প্লিজ! প্লিজ! প্লিজ!”
“তুমি উপায় বলো, আমি ব্যবস্থা করি। আমি গাছে চড়তে পারি। কিন্তু বৃষ্টিতে গাছটা পিচ্ছিল হয়ে আছে। পড়ে হাড়গোড় ভাঙার শখ অন্তত এই মুহূর্তে নেই। এখানে বুড়ো চাওয়ালা ছাড়া আর কেউ নেই। তিনি নিশ্চয়ই কদম পেড়ে দেবেন না।”
তনয়া এবার একটু দমে গেল। ওরা আবার গাড়িতে চড়ে রওনা দিল সামনে। বৃষ্টিধোয়া অসম্ভব সুন্দর পথঘাট। তনয়ার মনে হলো প্রকৃতি তাদের জন্যই নিজেকে সাজিয়ে বসে আছে। ডেকে ডেকে বলছে, আমাকে দেখো, চোখ ভরে দেখো।
তনয়া একসময় স্বরূপকে বলল, “তোমাকে একটা জরুরি কথা বলার ছিল।”
“কী কথা?”
তনয়া কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে বাইরের দিকে চেয়ে রইল। কেমন করে বলবে?
স্বরূপ আবার জিজ্ঞেস করল, “কী কথা বললে না?”
“পরে বলব।”
ওরা আরও অনেকদূর যাবার পর একটা ছোট্ট রেস্তোরাঁয় ভাত, ভর্তা আর হাঁসের মাংস দিয়ে দুপুরের খাবার সারল। এরপর ফিরতি পথ ধরল। তনয়া এত খেয়ে ফেলেছিল যে শরীর ভার হয়ে আসছিল। সে গাড়িতে বসে আর চোখ খোলা রাখতে পারল না, ঘুমিয়ে পড়ল।
যখন ওর ঘুম ভাঙল তখন বিকেল হয়ে এসেছে। আকাশ প্রচন্ড ভার। আবার একগাদা জল ঢালার প্রস্তুতি নিয়ে বসেছে। তনয়া প্রথমটায় কিছু বুঝল না, হঠাৎ খেয়াল হলো, তার ডান হাতে একটা বেলীফুলের মালা জড়ানো। সে দন্ত বিকশিত এক হাসি দিয়ে বলল, “কখন পরালে এটা?”
“একটু আগেই। পেয়ে গেলাম হঠাৎ। তবে কদম জোগাড় করতে পারিনি।”
“প্রয়োজন নেই। কদমের তো ঘ্রাণ নেই বেলীর মতো। এটাই সবচেয়ে সুন্দর।”
স্বরূপ হাসল। মেয়েটা কত অল্পতে খুশি হয়!
হঠাৎই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না সামনে। যদিও দিন এখনো বেশ খানিকটা বাকি। আকাশের রঙ হয়েছে গাঢ় বেগুনী। স্বরূপ রিস্ক নিয়ে ড্রাইভ করতে চাইল না। বৃষ্টি কমা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে গাড়ি থামিয়ে রাখল রাস্তার পাশে।
তনয়া ঠিক এই সুযোগটা সকাল থেকে খুঁজছিল। সে তার জায়গা থেকে উঠে এগিয়ে গিয়ে আচমকাই চুমু খেল স্বামীর ঠোঁটে। ঠিক সিনেমার মতো। তারপর খিলখিল করে হেসে ফেলল। স্বরূপ আর ছাড়ল না তাকে। মনে মনে সে বলল, সময়টা এখানেই থেমে গেলে খুব একটা খারাপ হতো না…
*
পরদিন স্বরূপের অফিস তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেলে সে বিকেলের দিকেই চলে এলো। হাতমুখ ধুয়ে সটান চলে গেল রান্নাঘরে।
তনয়া পিছু পিছু গিয়ে দেখল সদ্য নিয়ে আসা বাজারের ব্যাগ থেকে সে বড় চিংড়ি বের করছে।
তনয়া এগিয়ে গিয়ে বলল, “আমি করছি। তুমি রেস্ট নাও।”
“না, আমি রান্না করব।”
“এখন কী রান্না করবে?”
“স্যুপ। কয়েকটা চিংড়ি বেছে-কেটে দাও তো!”
“আমি স্যুপ রান্না করতে পারি।”
“না, আমার অনেক ক্ষুধা লেগেছে।”
“সেজন্য নিজের হাতে রাঁধতে হবে?”
“হুম। নিজে হাতের রান্নার ক্ষুধা।”
“বাহ! বেশ!”
“জানো তনয়া, আজকে আমার মোবাইলে বারবার স্যুপের অ্যাড আসছিল।”
“এজন্য এত খেতে ইচ্ছে করেছে?”
“হ্যাঁ তবে হঠাৎ স্যুপের অ্যাড আসছিল কেন বলতে পারো?”
“কেন?”
“কারন আমার স্যুপ পছন্দ।”
“তোমার যে স্যুপ পছন্দ এটা আমিও জানি না। মোবাইল জানবে কেমন করে?”
“সেটাই তো আসল কথা। আজ কলিগরা আলোচনা করছিলাম কার কী পছন্দ। আমি স্যুপ বলেছিলাম। তখনই জেনে ফেলল।”
“ওহ তাই বলো।”
“এর থেকে কী বুঝলে?”
“কী বুঝলাম?”
“আমাদের কোনো প্রাইভেসি নেই। ওরা সব শোনে।”
“এটা তো জানা কথাই।”
“তুমি যেসব ক্রিঞ্জি ভালোবাসার কথাটথা বলো না, ওগুলো ওরা শুনে ফেলে। তারপর হাসাহাসি করে।”
“ইশ! কে হাসাহাসি করে? আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হাসতে পারে?”
“পারবে না কেন, ওরা সব পারে।”
“আজেবাজে কথা বন্ধ করবে?”
“মনে আছে গতকাল গাড়িতে বসে কী কী বলছিলে?”
তনয়া রেগে গিয়ে স্বরূপকে জোরে চিমটি দিয়ে চিৎকার করে বলল, “মুখ বন্ধ করবে তুমি?”
“আচ্ছা আচ্ছা! কিন্তু ওইযে পরীক্ষার মধ্যে একদিন বললে…”
স্বরূপ কথা শেষ করতে পারল না। কলিংবেল বাজল।
তনয়া গেল দরজা খুলতে। দরজা খুলে অবাক হয়ে দেখল মিলি দাঁড়িয়ে আছে। ওর চেহারা পুরোপুরি বিধ্বস্ত। মনে হচ্ছে একটা ঝড় বয়ে গেছে ওর ওপর দিয়ে।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
২৭.
বেশ অনেকটা সময় লাগল মিলির স্বাভাবিক হতে। সে যেন কোনো ঘোরের মধ্যে আছে। সেই ঘোর থেকে বের হবার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
তনয়া আর স্বরূপ তার দুই পাশে বসে আছে। তারা বুঝতে পারছে না কী করবে। শুধু মিলিকে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে কী হয়েছে।
মিলি একসময় কথা বলতে পারল। তনয়াকে বলল, “এক গ্লাস পানি দেবে?”
তনয়া পানি নিয়ে এলো। মিলি পানি এক চুমুক খেয়ে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “তেঁতো লাগছে।”
স্বরূপ জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে বলবি? আঙ্কেল আন্টি ঠিক আছেন?”
মিলি মাথা ওপর নিচ করল। “ওরা ভালো আছে।”
“তবে?”
মিলি থেমে থেমে বলল, “আজ অফিসে তাড়াতাড়ি ছুটি হয়েছে। আমি বাসায় চলে গিয়েছিলাম। ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ ছিল। ভেবেছি বাসায় কেউ নেই। চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখি আমাদের বেডরুমের দরজাও ভেতর থেকে বন্ধ।”
“কে ছিল ভেতরে?”
“ওদের দুজনের হাসির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। মেয়েটার ব্যাগ ছিল ডাইনিং টেবিলের ওপর। মেঝেতে ওর ওড়না পড়েছিল। আর কিছু কি বলার বা বোঝার বাকি থাকে?”
সবাই চুপ করে রইল। দৃশ্যটা ভেবেই তনয়ার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। সে দেখল স্বরূপের চোখ লাল হয়ে গেছে। ঠিক একই জিনিস প্রত্যক্ষ করার ভাগ্য তারও একসময় হয়েছিল।
মিলি বলল, “আমি যে গিয়েছিলাম সেটা ওদের জানতে দেইনি। চলে এসেছি। আমি বুঝতে পারছি আমার অবস্থা ভালো না। বাড়িতে এই অবস্থায় যাওয়া সম্ভব না। মা বাবা দুজনের কেউই সহ্য করতে পারবে না৷ আমি কোথায় যাব বুঝতে পারছিলাম না৷ তোর বাসা কাছে দেখে এখানে চলে এলাম।”
স্বরূপ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চল, ওদের হাতেনাতে ধরব আজকে।”
মিলি কাঁপা গলায় বলল, “না, দরকার নেই। আমি আর ওখানে যাব না।”
“সবকিছুর একটা লিমিট থাকে মিলি! একজনকে বিয়ে করে আরেকজনের সাথে শোবে আর আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখব? চিটিং করে এমনি পার পেয়ে যাবে? এত সহজ সবকিছু? বিয়েটা কি ওর কাছে ফাজলামো মনে হয়? ওকে একটা শিক্ষা না দিয়ে ছাড়ব না আমি।”
মিলির চোখে পানি চলে এসেছিল। সে গাল থেকে পানি মুছে বলল, “সে অনেক আগেই লিমিট পার করে ফেলেছে স্বরূপ। আজকেরটা তারই একটা নমুনা ছিল মাত্র।”
“তুই প্রশ্রয় দিয়ে আরও বাড়তে দিয়েছিস।”
মিলি হঠাৎ রেগে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “কেউ নিজের সংসার চোখের সামনে ভাঙাটা প্রশ্রয় দেয় না স্বরূপ! আমি দিনের পর দিন চেষ্টা করেছি ওকে বোঝানোর, ওই মেয়েকে বোঝানোর। কী না করেছি! তুই তো জানিস আমি কোনোদিন কাউকে কিছু রিকোয়েস্ট পর্যন্ত করি না। আর ওর কাছে হাজার বার হাত জোড় করে মিনতি পর্যন্ত করেছি। কোনো মেয়েই চায় না তার সংসার ভেঙে যাক। আমি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেই হাল ছেড়েছি। আজ গিয়ে ধরলে কিছুই হবে না। সব হাতের বাইরে চলে গেছে।”
স্বরূপ বসে পড়ে বলল, “তুই এখন কী করতে চাস?”
“এখন আর কিছু করার নেই৷ ওই বাড়িতে আমি আর যেতে পারব না। সম্ভব না।”
“তাহলে?”
“মা বাবাকে বলতেই হবে। কিন্তু কীভাবে কী বলব সেসব ভাবতে হবে। একটু সময় লাগবে। সেই সময়টা… সেই সময়টুকু আমি তোর বাসায় থাকি?”
মিলির চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিল স্বরূপ। এত অসহায় চোখ সে কমই দেখেছে। বলল, “তোর যতদিন ইচ্ছে থাক। সমস্যা নেই।”
মিলি তনয়ার দিকে তাকাল। তনয়া ওর হাত ধরে বলল, “তুমি থাকো আপু। আমাদের অসুবিধা হবে না।”
মিলি দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে বলল, “আমি একটু বিশ্রাম নেব।”
স্বরূপ তনয়াকে বলল, “একটা ঘর ঠিক করে দাও ওর জন্য।”
তনয়া সব ঘর গুছিয়েই রাখে। তবুও গেস্টরুমের চাদর বদলে ঘরটা আরেকবার সাফ করে দিল। মিলি কোনো কাপড়চোপড় আনেনি। সে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপু তোমাকে আমার জামা দেব? একটু ঢিলে হবে হয়তো।”
মিলি মৃদু হাসার চেষ্টা করে বলল, “দিও। দুই সেট দিলেই হবে।”
তনয়া কয়েক সেট জামা মিলির ঘরে রেখে এলো। মিলি তারপর উঠে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
তনয়া রান্নাঘরে গিয়ে দেখল স্বরূপ গম্ভীর মুখে খুন্তি নেড়ে যাচ্ছে। তনয়া জিজ্ঞেস করল, “কতদূর হলো?”
“হচ্ছে।”
“তুমি এরকম মুড অফ করে থেকো না প্লিজ।”
স্বরূপ কিছু বলল না। তার মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে আছে। বেশি কথা বললে হয়তো তনয়ার ওপর রাগ ঝেড়ে বসবে। তাই চুপ করে রইল। কিন্তু তনয়া কথা বলেই যাচ্ছে। স্বরূপ একটু পর ওর কথার মাঝখানেই বলল, “দেখো তো স্যুপটা। মাথাব্যথা করছে আমার।”
তনয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কী এক ঝামেলা শুরু হলো!
*
পরদিন স্বরূপদের সব বন্ধুরা একত্র হলো সন্ধ্যার দিকে। স্বরূপই সবাইকে ডেকেছে কোনো একটা সমাধান বের করার জন্য। মিলি যদিও নিষেধ করেছিল, স্বরূপ শোনেনি। এদিকে মিলির তার স্বামীকে ফোন করে বলে দিয়েছে, সে আর তার বাড়িতে যাবে না।
সাফাত খুশিই হয়েছে। সে চাইছিল মিলি তাকে ডিভোর্স দিক। তাহলে কেউ বলতে পারবে না সে বউকে ছেড়েছে, বরং বলে বেড়াবে তার বউকে তাকে ছেড়ে চলে গেছে।
এসবকিছু নিয়েই কথাবার্তা হচ্ছিল আজ। মিলি চুপচাপ বসেছিল মাথা নিচু করে। জোর আলাপ আলোচনা হচ্ছিল। রূপাও এসেছে। সে তনয়ার কাছে রান্নাঘরে গেল। তনয়া সবার জন্য নাস্তা বানানোয় ব্যস্ত ছিল।
রূপা গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোর খবর বল।”
তনয়া হাসল, “ভালো।”
“বলেছিলাম না যে স্বরূপের মতো ভালো ছেলে তুই খুঁজলেও পাবি না? কথা কি মিলছে?”
তনয়া মুখ টিপে হেসে বলল, “মনে তো হয়..”
রূপা ওর সাথে কাজে হাত লাাগল, “তারপর সংসার করতে কেমন লাগছে? প্রতিদিন রান্না করতে ভালো লাগে?”
“খুব!”
“এখন লাগবেই, বুঝলি? এরপর বাচ্চাকাচ্চা হবে, গ্যাঞ্জাম বাড়বে, তখন রোজ রান্না করতে অসহ্য লাগবে।”
তনয়া আবারও হাসল। “তোমার বন্ধু আছে তো, আমি না পারলে সে করবে।”
“ও রাঁধতে পারে?”
“হুম। ভালো রাঁধে।”
“বাহ! এ তো জানতাম না।”
ওরা বেশ খানিকক্ষণ সাংসারিক গল্প করল। একসময় মিলির প্রসঙ্গ উঠলে রূপা বলল, “কী মানুষ কী হয়ে যায় ভাবা যায় না। মিলিকে দেখে বিশ্বাস হয় না ও আগের সেই মিলি।”
“মিলি আপু আগে কেমন ছিল?”
“আমাদের সবার থেকে স্মার্ট। ওর পেছনে কত ছেলে ঘুরেছে কোনো হিসেব নেই। ও কাউকে পাত্তা দিত না। নিজের মতো থাকত। ওর ড্রেসআপ, ফিগার দেখলে আমাদেরই চোখ ধাঁধিয়ে যেত এমন অবস্থা ছিল৷ আর ছেলেরা তো খাবি খেত। এখন ওকে যা দেখছিস তার থেকে দশগুণ বেশি সুন্দর ছিল ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়।”
“কী বলো!”
“হুম! ছবি দেখাব তোকে। তখন বুঝবি। এইযে ওর বর, সাফাত ভাই, সে তো পাগল ছিল পুরো। আমাদের দুই ব্যাচ সিনিয়র। পুরো চার বছর ওর পেছনে ঘুরেছে। কত যে পাগলামি করেছে বলার মতো না। সুইসাইড পর্যন্ত করতে গেছে দু’বার। শেষে মিলি ধরা দিয়েছে। তারপর বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় এই অবস্থা। মানুষের কোনো বিশ্বাস নেই রে তনয়া। কার ভেতরে কী আছে কে বলতে পারে!”
তনয়ার গায়ে কাঁটা দিল ব্যাপারটা ভেবে। মিলি আপুর কেমন লাগছে কে জানে!
*
আলাপ আলোচনার তেমন কোনো ফল হলো না। সবাই মিলে সাফাতের সাথে বসতে চাইল, কিন্তু মিলি নিষেধ করে দিল। বলল, “ওর প্রতি আমার আর কোনো ইন্টারেস্ট নেই। ও যা করেছে তার জন্য আমি কোনো আইনি ব্যবস্থাও নিতে চাই না। সিম্পল ডিভোর্স দেব।”
অঙ্কুর বলল, “কিন্তু কেন? তুই কেন একটা শিক্ষা দিতে চাইছিস না? ওর জন্য এত মায়া করার কী আছে?”
মিলি নিস্পৃহ গলায় বলল, “কোনো মায়া নেই আমার। যে মেয়েটার সাথে ও রিলেশনে আছে, ওর সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছি আমি। ফালতু একটা মেয়ে। ছেলেদের মাথা চিবিয়ে খেতে এক্সপার্ট। এক পুরুষের সাথে থাকা ওর ধাঁতেই নেই। সাফাতকে বিয়ে করতে চায় তার টাকার জন্য। আমিও চাই বিয়েটা হোক। তারপর বুঝবে কত ধানে কত চাল। আমাকে কিছু করতে হবে না। ওর সাধের প্রেমিকাই ওর বারোটা বাজাবে। আমি শুধু দেখতে চাই পরের নাটক।”
“তুই ওকে এটা বোঝাতে পারিস তো!”
“কম বোঝাইনি। কিন্তু চোখ থাকতে অন্ধকে কিছু বলে লাভ নেই৷ ও জাস্ট ব্লাইন্ড হয়ে আছে। কী খাইয়েছে কে জানে! যখন নেশা কাটবে তখন দেখবে চারদিকে সব অন্ধকার। ওর ফ্যামিলির সবাই সব জানে। সবাই আমাকে সাপোর্ট করে। যখন মাঝ নদীতে খাবি খাবে তখন ওর পরিবারও বাঁচাতে আসবে না। ওভারল, আমি কিছুই করতে চাই না। চাই ও ওর নিজের ডেকে আনা নিয়তির ফাঁদে পড়ে সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা পাক।”
স্বরূপ জিজ্ঞেস করল, “আর আঙ্কেল আন্টির বিষয়টা?”
মিলি একটু চুপ থেকে বলল, “আমারে আরেকটু ভাবতে হবে।”
বেশ রাত হয়ে এলে ওদের সভা ভাঙল। সবাই যার যার বাড়িতে চলে গেল।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু