#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
২২.
ওরা যখন পৌঁছুল তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। মা স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ওরা এলে ওদের খাইয়ে বিশ্রাম নিতে বলে স্কুলে চলে গেলেন। বললেন বিকেলে কথা হবে।
রাতে ঘুম না হওয়ায় দুজনই ক্লান্ত ছিল। লম্বা একটা ঘুম দিল ওরা। উঠতে উঠতে দুপুর গড়াল। তনয়া উঠে জানালার পাশে বেশ কিছুক্ষণ থম ধরে দাঁড়িয়ে থাকল৷ ওদের জানালা দিয়ে কিছুদূরে চাষের জমি দেখা যায়। জমির ওপর দিয়ে ক’টা সাদা বক উঠে গেল। বিকেলের রোদে প্রকৃতি নরম আলস্যে ডুবে আছে। রাস্তার একধারে আরাম করে একটা কুকুর ঘুমিয়ে আছে। কোনো একটা পাখি ডাকছে মিষ্টি সুরে। সুরটা অচেনা। কিন্তু ভারি সুন্দর। শালিক পাখিও দেখা গেল কয়েকটা। তনয়া গুনল। এক..দুই..তিন..চার… জোড়া শালিক!
আজ ওদের কোথায় থাকার কথা ছিল আর ওরা কোথায়! তবুও মনটা আরামদায়ক উষ্ণতায় বেশ ভালো লাগতে শুরু করেছে। গতদিনের মন খারাপ ভাব কেটে গেছে।
অঘটনের কোনো আঁচ ওরা এখন পর্যন্ত পায়নি। এত শান্ত সুন্দর পরিবেশে এমন কী হতে পারে? অবশ্য অবিশ্বাসও হয় না তনয়ার৷ এখানে এসেই গতবার কী ভয়ানক অভিজ্ঞতা তার হলো!
শরীরটা কেমন ঝিম ধরেছিল ওর। জামাকাপড় নিয়ে গোসলে ঢুকে গেল।
মা তাড়াতাড়ি ফিরলেন আজ। ছেলের ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বিকেল হয়ে গেছে। এখনো দুপুরের খাওয়া হয়নি। ঘুমাচ্ছে হয়তো এখনো। তিনি দরজায় টোকা দিলেন, “ওঠ তোরা। কত ঘুমাবি?”
স্বরূপের ঘুম এমনিতেই হালকা হয়ে এসেছিল। মায়ের ডাকে উঠে দরজা খুলল।
“তনয়া কোথায়?”
“বাথরুমে বোধহয়।”
“ওহ। তুইও ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়।”
স্বরূপ মায়ের হাত ধরে খাটে বসিয়ে বলল, “কী হয়েছে সেটা আগে বলো।”
মা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “অনেক কিছু। সংক্ষেপে বলি। তোর চাচা জহির তালুকদারের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিল। সে বহুদিন আগের কথা। এখনো ধার শোধ হয়নি, বরং সুদে আসলে বেড়ে বারো লক্ষ টাকা হয়ে গেছে। তোর চাচা দিন আনি দিন খাই মানুষ, সে এত টাকা কেমন করে শোধ করবে? শোধ দিতে না পারলে জমি যাবে। অল্প কিছু জমিই তো তার সম্বল। এবার জহির তালুকদার একটা নতুন প্রস্তাব দিয়েছে।”
“কী প্রস্তাব?”
“তার ছেলে সিরাজের সাথে মিতার বিয়ে দিতে হবে। দিলে সে সব টাকা মাফ করে দেবে।”
“মানে?”
“মানেটা সহজ। তোর সাথে গতবার ঝামেলা হয়েছে। তোকে বা তোর বউকে সে কিছু করতে পারবে না, তোরা শহরে থাকিস। আমাকেও কিছু করতে পারবে না, করলে গ্রামের লোক ছিঁড়ে ফেলবে। তাই আমাদেরই পরিবারের দুর্বল জায়গায় হাত দিয়েছে। মিতা সেদিন তনয়ার সাথেই ছিল বলে ওর ওপরে আক্রোশও আছে। জহির তালুকদারের মতো লোক বারো লাখ টাকা মাফ করে দেবে এমনি এমনি? এক পয়সাও সে কাউকে ছাড় দেয় না। তুই ভাবতে পারিস বিয়ের পর ওরা মিতার সাথে কী কী করবে?”
স্বরূপ অবাক হয়ে বলল, “সে তো আর জোর করে মেয়ে নিতে পারবে না। বিয়ে না দিলেই হলো।”
“এত সহজ নাকি? তোর চাচা রাজি। চাচীও নিমরাজি। এদিকে মিতা মেয়েরা প্রতিদিন আমার কাছে এসে কাঁদে। আমি ওকে বলেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে সাহায্য করব। এদিকে ওকে নরকে ঠেলে দেয়ার প্রস্তুতি চলছে।”
স্বরূপ গুম হয়ে বসে রইল।
মা বললেন, “তোকে ডেকেছি কারন তোর হাত ধরেই এই ঝামেলার শুরু। জানি তুই তোর জায়গায় পুরোপুরি ঠিক ছিলি। কিন্তু আমিও আর কোনো উপায় দেখছি না। অনেক বুঝিয়েছি তোর চাচাকে। এখন তুই বলে দেখ। ওরা এই শুক্রবারেই বিয়ে করাতে চায়। আমার চোখের সামনে আমি এসব হতে দেব না।”
তনয়ার বাথরুম থেকে বের হবার শব্দে মা থামলেন৷ তনয়াকে দেখে বললেন, “খেতে এসো তোমরা।”
উঠে চলে গেলেন তিনি। স্বরূপ জামাকাপড় নিয়ে গোসলে ঢুকল। তনয়া কিছু জানতে পারল না। সে চুল মুছে একটু প্রসাধনী মেখে বাইরে বের হলো। মিতাকে দেখে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। মিতাও জড়িয়ে ধরল ভাবিকে। কিন্তু ছাড়ল না৷ ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল। তনয়া অনেকবার জিজ্ঞেস করল কী হয়েছে৷ কিন্তু কোনো উত্তর পেল না। কোন দুঃখে এত হাসিখুশি একটা মেয়ে ব্যকূল হয়ে কাঁদছে বুঝতে পারল না তনয়া।
*
সন্ধ্যার পর বৈঠক বসল। স্বরূপের দুই চাচা, চাচী, মিতা আর মিতার বড় ভাই মনসুর এসেছে।
স্বরূপই কথা শুরু করল। “চাচা, এইটা কি ঠিক হচ্ছে? সিরাজের মতো একটা ছেলের সাথে মিতার বিয়ে দিলে ওর জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে না?”
“জীবন তো আল্লাহর হাতে। আল্লাহ চাইলে ও সিরাজের ঘরেও ভালা থাকব। আর বিয়া না দিলে যে বাকি সবাইর না খাইয়া মরা লাগব তার কী?”
“চাচা এখনই আপনি দুই রকম কথা বললেন। আল্লাহ যদি মিতাকে দেখতে পারে তাইলে আপনাদেরও দেখবে। আর ধার আপনি করছিলেন তার দায় মিতা কেন নেবে?”
“ধার কইরা কি আমি একলা খাইছি? সবাই খাইছে। মিতাও খাইছে। ওয় পোলা হইলে কামে লাগায় দিতাম, সংসার চালাইতে পারত। হইছে মাইয়া। তো যেইডা করবার পারে সেইডা দিয়াই সংসারডা বাঁচাক৷ ওরে কি এতদিন পাইলা বড় করি নাই আমরা?”
“চাচা আপনার মনে নাই জহির তালুকদারের দুই নাম্বার বউটার কথা? পিটায়া মেরে ফেলল যে? ওদের বাড়ির কোনো বউ সুখে থাকতে পারছে?”
চাচা তার জায়গা থেকে সরবার কোনো লক্ষণ দেখালেন না। বললেন, “গরীব মানুষের আবার সুখ কিসের? বাঁইচা থাকলেই হইল।”
“তো ওকে তো এমন জায়গায় পাঠাচ্ছেন যেখানে বাঁচা মরারও ঠিক নাই।”
“দেখ স্বরূপ, আমার মাইয়ার লাইগা আমার থেকা তোর দরদ বেশি না। আজকা আমি রাস্তায় আইয়া পড়লে আমার সংসারের আটটা পেট তুই চালাবি না।”
মনসুরের ওপরেও ঋণের বোঝাটা ভারী হয়ে চাপছিল। সে টুকটাক কাজকর্ম করে কিছু টাকা দিতে পারলেও এত বড় ঋণ শোধ করার সক্ষমতা তার ছিল না। রোজ বাপের খোঁটা শুনতে শুনতে তার জীবনটাও অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল৷ তাই প্রস্তাবটা পেয়ে সে বোধহয় বাবার চেয়েও বেশি স্বস্তি পেয়েছে। শুরু থেকেই আগুনে ঘি ঢালার কাজটা সে করে যাচ্ছে দায়িত্বের সাথে। স্বরূপের সামনে এতক্ষণ মুখ খুলছিল না সে। এবার সাহস করে খুলে ফেলল, “ভাই আপনে তো আমগো অবস্থা জানেন না৷ মিতা কি এইখানে অনেক সুখে আছে নাকি? ওর বিয়ার বয়স হইছে। বিয়া দেয়ার টাকাও আমগো নাই। ফ্রিতে দিতে পারলে দিব না কেন?”
চাচা ছেলের সাথে গলা মেলালেন, “হ, ওরা কইছে এক কাপড়ে মাইয়া নিব৷ এমন কথা আর কেউ কইব? ওর বিয়া দিতেও যৌতুক দেওন লাগব। সেই টাকা কই পামু আমরা? এর কাছে বিয়া না দিলে মাইয়া সারাজীবন ঘরে পালা লাগব।”
তনয়া এতক্ষণ দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিল চুপচাপ। এবার আর সহ্য করতে পারল না। বলল, “চাচা, মিতা আমাকে বলেছিল ও পড়তে চায়। ভালো পড়াশুনা করে চাকরি করলে সেও আপনাদের সংসারের হাল ধরতে পারবে। মেয়ে তো ফেলনা জিনিস না।”
চাচা তনয়াকে খুব পছন্দ করেন৷ তিনি নরম সুরেই বললেন, “তুমি এর মধ্যে কথা কইয়ো না। বাড়ির বউরা এত কথা কয় না।”
“কেন চাচা? আমি খারাপ কী বলেছি? ওর জীবনটা কেন নষ্ট করছেন? মেয়েটা তো কাঁদতে কাঁদতেই মরে যাবে।”
“ওর লাইগ্যা এত দরদ, তো না দিলাম ওর বিয়া, তুমি আমার ধার শোধ করো। করবা? না করলে আর কথা কইও না।”
তনয়া বলল, “করব।”
ঘরের সবাই ওর দিকে অবাক হয়ে ঘুরে তাকাল। মেয়ে বলে কী!
মা বললেন, “তনয়া, তুমি ঘরে যাও। তোমাকে এখানে কথা বলতে হবে না।”
তনয়া বলল, “না মা, আমি সিরিয়াস! আমার কাছে টাকা আছে। বিয়ের মোহরানার টাকা, তাছাড়া বাবা আমার নামে ফিক্সড ডিপোজিট করে রেখেছেন সেখানেও টাকা আছে। আমি এত টাকা দিয়ে কী করব? টাকার চাইতে একটা মেয়ের জীবন অনেক দামী। আমার বোন নেই। মিতা আমার বোনের মতো। সেদিন ও না থাকলে আমি হয়তো মরেই যেতাম। আমি টাকা দেব মা। এমনি এমনি বলছি না।”
চাচার চোখে পানি চলে এলো। তিনি চোখ মুছে থেমে থেমে বললেন, “না আম্মা, তোমার টাকা আমি নিতে পারমু না। তুমি যে কথাটা কইলা এইডাই অনেক। দোয়া করি অনেক ভালা হউক তোমার।”
“কেন চাচা? কেন নেবেন না?”
চাচা উত্তর দিলেন না।
স্বরূপ চাচার হাত ধরে বলল, “ওর থেকে না নিলেন। আমি দেব। আমি তো আপনার ছেলেই। বাবা চলে যাবার পর এই কথাই বলতেন না আপনি? তাহলে কোনো আপত্তি থাকার তো কথা নয়। আমি ফিরে গিয়েই টাকা পাঠিয়ে দেব৷ আমাকে আগে বললে এত সমস্যা হতো না। ঋণও এত বাড়ত না। আপনি কথা দিন, মিতাকে এখানে বিয়ে দেবেন না।”
চাচা কিছুই বললেন না। এক হাতে স্বরূপের হাত ধরে আরেক হাতে চোখ মুছলেন। ঘরে নিরবতা নেমে এলো। শুধু মিতার কান্নার শব্দ শোনা গেল। সে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
*
সবাই চলে গেলে মা স্বরূপকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুই কোথা থেকে টাকা দিবি? গাড়ি কিনতে যে টাকা জমাচ্ছিলি সেটা দিয়ে দিবি?”
“হ্যাঁ।”
“কত হয়েছে?”
“দশ লাখ হয়েছে।”
“আর বাকিটা?”
“ধার করব তনয়ার থেকে। কী তনয়া, দেবে?”
তনয়া একটু হেসে বলল, “কেন দেব না?”
মা তনয়ার কাছে এসে ওর মাথায় হাত রেখে বললেন, “তোমাকে তোমার মা বাবা কোথা থেকে এনেছে বলো তো?”
“কেন মা?”
“না, জিজ্ঞেস করতাম। আমিও সেখান থেকে একটা লক্ষী মেয়ে আনতাম।”
স্বরূপ ভুরু কুঁচকে বলল, “কেন তোমার ছেলে কি লক্ষী না নাকি?”
“হ্যাঁ, আমার দুই ছেলেমেয়েই সোনার টুকরা।”
*
তনয়া মায়ের সাথে রান্নাঘরে গেল রাতের খাবার তৈরিতে সাহায্য করতে। স্বরূপ ঘরে চলে গেল৷ আজকের এত কান্ড ছাপিয়ে তার মাথায় তনয়ার কথাগুলো ঘুরছে। ওকে এতদিন মিষ্টি একটা মেয়ে মনে হয়েছে। টুকটুকে সুন্দরী নরম মনের একটা মানুষ। কিন্তু আজকে আরেকটা রূপ ওর মন ভরিয়ে দিয়েছে। স্বরূপের কখনো মনে হয়নি মেয়েরা এতটা বড় মনের হতে পারে। আছে তো অনেকেরই, কিন্তু দেয়ার মানসিকতা ক’জনের থাকে? ইউনিভার্সিটিতে পড়া একটা মেয়ে টাকার মর্ম বুঝবে না এমনও তো নয়। আবার ওদের অঢেল টাকাপয়সাও নেই। এইযে এত দূরের সম্পর্কের জন্য এতটা করতে চাওয়া, এজন্য অনেক সাহস লাগে। শুধু শুধু সে মেয়েটাকে দুর্বল ভাবছিল। সে নিজেই টাকা দেবার কথা বলার সাহস পাচ্ছিল না। অনেকদিন ধরে সে গাড়ি কেনার জন্য টাকাগুলো জমিয়েছিল। এইযে সাহসটা পেল, সেটা তনয়ার জোরেই। দেখা যাবে খুব কঠিন সময়ে আপাত দুর্বল দেখতে মেয়েটাই শক্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। সে পেছনে পড়ে গেছে।
সৌন্দর্য কিংবা মাধূর্যের প্রতি ভালোলাগা হয়তো কমে যায় সময়ের সাথে, কিন্তু ব্যক্তিত্বের প্রতি সম্মান কখনো কমে না, সময়ের সাথে সাথে বাড়ে।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
২৩.
সকালে চা খেতে খেতে অনেকক্ষণ গল্প হলো মা ছেলের। তনয়া তখনো ঘুমে। বিয়ের চক্করে গতবার মায়ের সাথে জমিয়ে গল্প করা হয়নি স্বরূপের। তাই নামাজ পড়তে ওঠার পর তনয়া আরেক দফা ঘুমের জন্য শুয়ে পড়লেও সে না শুয়ে মায়ের কাছে গিয়ে বসল। আজ স্কুল ছুটি। মা নাস্তা তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পিঠা বানানো হবে।
গতকাল চাল গুড়ো করে আনা হয়েছে। বাজারের দিকে চাল ভাঙানোর মেশিন থাকলেও মা চাল ভাঙাতে দেন জরীর মায়ের কাছে। বিধবা মহিলা স্বামী মারা যাবার পর তার ফেলে যাওয়া সম্পদ বলতে পেয়েছে ওই এক ঢেকি। মায়ের বড় মায়া হয় গ্রামের গরীব মানুষগুলোর জন্য। এত সামর্থ্য না থাকলেও যার জন্য যতটা পারেন, তিনি করেন।
এসব নিয়েই কথা হচ্ছিল দু’জনের। ভোরের মিষ্টি বাতাস বইছিল সাথে। মা জিজ্ঞেস করলেন, “থাকবি ক’দিন? তোর তো অফিসে ছুটি নেয়া আছে।”
“না মা, আজ রাতেই চলে যাব ভাবছি।”
“কেন? ট্যুরটা কি চাইলে এখন দেয়া যাবে?”
স্বরূপ বলল, “না। তা যাবে না৷ ক্যান্সেল করে দিয়েছি পুরোপুরি। ভাবছি অফিসের ছুটিটাও ক্যান্সেল করব। এখন ছুটিটা কাটালে আর এক বছরে ছুটি দেবে না। তনয়ার অনেক মন খারাপ হয়েছে না যেতে পেরে।”
মা হেসে বললেন, “বিদেশে যেতে হবে এমন কোনো কথা আছে? তারচেয়ে এখন দেশেই কোথাও চলে যা। দেশের ভেতর বেড়াতে তো আর ঝঞ্ঝাট নেই। খরচও অত পড়বে না।”
স্বরূপ একটু ভেবে বলল, “না মা, যেখানে যাবার কথা ছিল সেখানেই যাব৷ দেশে তো চাইলে শুক্র শনিবার করে ঘুরে ফেলা যাবে। পরে ওখানে আর যাবার সুযোগ না পেলে?”
“হুম। আচ্ছা এবার বল তো, বিয়ে করবি না বলে যে মাথার পোকা খেয়ে ফেলেছিলি, এবার কী হলো? কে বিয়ে করল? আর কার বিয়ে করে চেহারা ঘুরে গেল?”
স্বরূপ গালে হাত ছু্ঁইয়ে বলল, “চেহারা ফিরেছে মানে?”
“আয়নায় দেখিস না নাকি? তোর চেহারা যে ভূতের সর্দারের থেকে আস্তে আস্তে মানুষ হচ্ছে বুঝিস নাই?”
স্বরূপ কাঁধ ঝাঁকাল, “কে জানে!”
“ঘুম হয়?”
“হুম।”
“আগে কিন্তু হতো না।”
স্বরূপ ভাবল কথা সত্যি। অথচ নিজের এই ব্যাপারটা সে নিজেই ধরতে পারেনি। ঘুম একটা বড় সমস্যা ছিল। যখন একা ছিল, তার ঘুম আসতে অর্ধেক রাত পেরিয়ে যেত। যাও বা ঘুম হতো, শান্তি লাগত না। আজেবাজে স্বপ্নেরা ভিড় করে ঘুমে বাগড়া দিত। অথচ তনয়ার পাশে শুয়ে ওর সাথে হাবিজাবি বকবক করতে করতে সে কখন ঘুমিয়ে পড়ে নিজেও জানে না। তনয়াই কথার মাঝখানে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ে। ওকে ঘুমন্ত দেখলে স্বরূপেরও ঘুমে চোখ ছোটো হয়ে আসে। অফিসে কে যেন বলছিল তার চোখের ডার্ক সার্কেল কমে গেছে। কোনো প্রোডাক্ট ইউজ করেছে কি না।
গল্পের মাঝে এক বুড়ি এসে হাজির। বুড়ির বয়স হলেও শক্তপোক্ত আছে। হেঁটে হেঁটে গ্রাম পাড়ি দিতে পারে। দুই গ্রামের প্রতিটা বাড়ির গল্প তার জানা।
তার হাতে ছোট্ট পানের বাটা। নিজের বানানো পান কিছুক্ষণ পরপর মুখে না দিলে তিনি কথা বলতে পারেন না।
এসেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কেমুন আছো নানা?”
স্বরূপকে বুড়ি বরাবরই আদর করেন। তিনি এলেই স্বরূপ তার পানের বাটা থেকে নিজেই পান বানিয়ে মুখে পুরে দেয়। আজও তাই করল।
বুড়ি প্রশ্নের উত্তরে সে বলল, “আমি তো ভালোই। আপনি কেমন?”
বুড়ি জাঁকিয়ে বসে বলল, “আল্লায় বালা রাখছে। তা বউ কই? শাশুড়ীডা একলা কাম করে, হ্যায় কী করতাছে?”
মা হেসে বললেন, “ঘুমায়।”
বুড়ি একটু মন খারাপ করে বললেন, “এর লাইগ্যাই কইছিলাম শহরের মাইয়া বিয়া করান লাগব না। আমগো গেরামেই কত বালা মাইয়া পইড়া আছে। হেগোর কারো লগে বিয়া দিলে অহন তুমারে মুখে তুইল্যা খাওয়া দিত। একলা কাম কইরা বউরে খাওয়ান লাগতো না।”
স্বরূপ কী বলবে বুঝতে পারল না। মায়ের হাসি চওড়া হলো। বুড়ি সেটা দেখে বললেন, “হাসির কতা কুনডা কইলাম আমি?”
মা বললেন, “খালা, এইটা আমার সংসার। ওরা বেড়াইতে আসছে। দুইদিনের বউরে দিয়া কাজ করাবো কেন? সে কি মাটির চুলায় রাঁধতে পারে? আমি তো পায়ের উপর পা তুলে খেতে ছেলে বিয়ে করাই নাই। বিয়ে করাইছি যাতে ছেলে ভালো থাকে। সে ভালো আছে। দেখেন তার চেহারা ফিরছে না? ব্যস, আমার আর কিছুই লাগবে না।”
বুড়ি স্বরূপের দিকে তাকিয়ে ওর গালে কপালে হাত বুলিয়ে বললেন, “আহারে! পোলাডা কত হুগাইয়া গেছে। তুমি অইলা মডান মা। শিক্ষিত অইয়া চোক্ষে বেশি দেহো। বউ কী না কী খাওয়ায়, মায়ের কাছে থাকলে পোলার চেহারা এমন অয়?”
মা এবারও হাসলেন। কিছুই বললেন না।
বুড়ি সমালোচনায় আরাম না পেয়ে উঠে চলে গেলেন। অন্য বাড়িতে নিশ্চয়ই বউয়ের দেরিতে ওঠা নিয়ে কথা শুরু করলে চমৎকার আসর বসে যাবে!
ওরা মা ছেলে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে হেসে ফেলল। বুড়ি বরাবরই এমন৷ স্বরূপের মায়ের কোনো কথা পছন্দ না হলেই সে বলবে বেশি শিক্ষিত হয়ে তার মাথাটা গেছে! তবে ওরা রাগ করে না৷ বুড়ির মন ভালো। স্বরূপের বাবা মারা যাবার পর যে ক’জন মানুষ সত্যিকারের পাশে থেকেছে ইনি তাদের একজন।
*
আজও ওরা ফিরবে রাতের ট্রেনে। তনয়ার বিকেলের দিকে হঠাৎ মনে হলো, বিয়েতে তাদের অনেক ছবি আছে ঠিকই, কিন্তু মায়ের সাথে ভালো ছবি নেই। কেন নেই? কারন তাদের মা ছবি তোলার সময় বড়ই লাজুক। তার ওপর ফটোগ্রাফারের সামনে পোজ দেয়াতে তো তার মহা আপত্তি!
মা ঘরে বসে স্কুলের কিছু কাজ নিয়ে বসেছিলেন। তনয়া তাকে টেনে নিয়ে এলো। নিজের মেকআপ সামগ্রী দিয়ে কতকটা জোর করেই সাজিয়ে দিল। মা নিজেকে আয়নাতে দেখে লজ্জা পেয়ে ঘোমটা দিয়ে বসে রইলেন। তনয়া বলল, “মা, আজ কিন্তু ছবি তুলব অনেক। আপনার ছেলেই তুলবে, তাই কোনো অযুহাত শুনব না।”
মা করুন চোখে তাকালেন৷ এ কি যন্ত্রণা!
স্বরূপ গ্রামের বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। তনয়া তাকে ফোন করে বলল, “তাড়াতাড়ি এসো। ইমার্জেন্সি!”
স্বরূপ কিছু বলার আগেই সে ফোন কেটে দিল। স্বরূপ ব্যস্ত হয়ে সাথে সাথে ফোন করল। তনয়া ইচ্ছে করেই ধরল না। সে একপ্রকার হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ফিরল।
তনয়া দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। স্বরূপকে দেখে বলল, “ঘরে গিয়ে দেখো তো মায়ের কী হয়েছে!”
স্বরূপ ছুটে ঘরে ঢুকে দেখে মা নতুন শাড়ি পরে ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। সে ভেবেছিল অসুখবিসুখ হয়েছে। কিন্তু মা তো দিব্যি বসে আছে! কিন্তু ঘোমটা কেন? হচ্ছেটা কী?
তনয়া এসে জোর করে ঘোমটা সরাল। স্বরূপ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তনয়ার ওপর রাগ হয়েও হলো না। মাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। তার মা এত মায়াবী সুন্দর! অথচ তার অতিরিক্ত পরিশ্রম আর আটপৌরে জীবনযাপন সেই সৌন্দর্যকে ঢেকে রেখেছে।
তনয়া বলল, “আমাদের ছবি তুলে দাও এখন।”
*
ট্রেনে বসে ছবিগুলো দেখছিল স্বরূপ। তনয়া আজ তার কাঁধে মাথা রেখে আরামে ঘুমাচ্ছে। তার ঘুম আসছে না কেন যেন। আজ বিকেলটা এত সুন্দর ছিল! আশ্চর্য ব্যাপার হলো, মায়ের সাথে তার কোনো ছবি ছিল না। আজ তোলা হয়েছে। মায়ের মাথার সাথে মাথা ঠেকিয়ে তোলা ছবিটা সবচেয়ে সুন্দর হয়েছে। ছবিটা ওয়ালপেপারে দিতে গিয়ে কী মনে করে দিল না। বরং ওদের তিনজনের কিছু ছবি তুলেছিল টাইমার সেট করে। সেগুলোর একটা দিয়ে রাখল।
তার জীবনে এমন একটা সময় এসেছিল, যখন প্রতি মুহূর্তে মরে যেতে ইচ্ছে হতো। নিজেকে সে রোজ আত্ম-হত্যা থেকে বাঁচিয়ে রাখত একটা মানুষের কথা ভেবে। সেটা ছিল মা।
তবে একাকী শহুরে জীবনে তার সব রঙ উড়ে গিয়েছিল। রঙগুলো একটু একটু করে ফিরে আসছে। যে ফিরিয়ে দিচ্ছে সেও তার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠছে।
সে ফেসবুকে ঢুকল। ‘Love is just a myth’ লেখা নিজের বায়োতে চোখ পড়তেই সে নিজেকে প্রশ্ন করল, “What is love?” সে কি ধীরে ধীরে ভালোবাসায় বিশ্বাসী হয়ে উঠছে? নাকি সংশয়বাদী?
লোপার সাথে তার প্রেম ছিল উত্তাল, বাঁধাহীন, প্রবল! প্রেমের জন্য পাহাড় থেকে ঝাঁপ দেয়াও যেন কোনো ব্যাপার ছিল না৷ অথচ তনয়ার জন্য তার কোনো প্রবল আবেগ কাজ করে না। বরং ও পাশে থাকলে শান্তি লাগে। এটা কি প্রেম? নাকি স্বস্তির জায়গা?
লেখাটা পরিবর্তন করল না সে। কল্পকথারাও হয়তো কখনো সত্যি হয়ে যায়। সে অপেক্ষায় রইল। হয়তো হবে। সে উত্তাল ভালোবাসার টানে ছুটে যাবে এই মেয়েটার কাছে। ভাবতে ভাবতে আপনমনেই হাসল স্বরূপ। এও কি সম্ভব?
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু