গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-১৩

0
444

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
১৩.

তনয়ার পা দুটো ব্যথা করছে। ব্যথা করছে মাথাও৷ গতরাতে ভালো করে ঘুম হয়নি। আর আজ আসার পর থেকে সে বসে আছে বউ সেজে। পুরো গ্রামের লোক ভেঙে পড়েছে তাকে দেখার জন্য৷ ভারী একটা কাতান শাড়ি পরে সে বহুক্ষণ ধরে একই ভঙ্গিমায় বিছানার ওপর বসে আছে সেই বিকেল থেকে। পা পর্যন্ত নাড়াবার উপায় নেই। একগাদা মুরুব্বি গোছের মহিলা পান মুখে দিয়ে খোশগল্পে মেতে উঠেছে। তনয়াকে তাদের ভারি পছন্দ হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তনয়ার কাছে তাদের হাজারো প্রশ্ন জমা হয়েছে। বেশিরভাগ প্রশ্ন তনয়া বুঝতে পারছে না৷ গ্রাম্য টানে বলা কথাগুলো তার মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। তার ওপর ব্যথায় মাথার দুই পাশের রগ টনটন করছে।

শাশুড়ী মা তাকে একসময় এই বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন। ঘরে ঢুকে কীসব বলে যেন মহিলাদের দলটাকে বিদায় করে দিলেন। তনয়াকে বললেন, “তুমি তোমার ঘরে চলো। তোমাকে দেখে তো সুস্থ মনে হচ্ছে না৷ আসতে খুব কষ্ট হয়েছে তাই না?”

তনয়া কিছু বলল না৷ কষ্ট তার সত্যিই হয়েছে। নড়তে গিয়ে সে বুঝল, পুরো শরীর ব্যথা। রাতে ট্রাকের দুলুনি আর বিকেলের গরুর গাড়ির দুলুনি শরীরের জয়েন্টগুলোতে ব্যথা বানিয়ে দিয়েছে।

সে যখন ঘরে ঢুকল তখন দেখল স্বরূপ বসে আছে বিছানায়। তার হাতে একটা বই। ভারি মনোযোগ দিয়ে সে কিছু একটা পড়ছে। তনয়াকে একবার চোখ তুলে দেখে আবার বই পড়ায় মনোযোগ দিল। তনয়া এগিয়ে গেল স্যুটকেসের দিকে। শাড়িটা বদলে ফেলা খুব জরুরি।

স্বরূপের কিছুটা খারাপ লাগছিল সকাল থেকেই। তনয়ার হয়তো তার প্রতি অনেক চাহিদা আছে, অনেক আশা আছে। সেসব সে পূরণ করতে পারছে না৷ চাইলেও পারবে না৷ তার এত অনুভূতি নেই। অনুভূতি সব মরে গেছে। মৃত অনুভূতিগুলো আস্তাকুঁড় থেকে খুঁজে এনে তাদের জীবিত করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে চাইলে বড়জোর কিছুটা অভিনয় করতে পারে। কিন্তু সেটাও এক ধরনের ঠকানো। আর তারও বা কী প্রয়োজন? মেয়েটা তাকে নিজের ইচ্ছেয় বিয়ে করেছে। সে তো জোর করেনি।

*****

ওদের বাড়িটা নতুন৷ আগের টিনের ঘর ভেঙে মাত্র কয়েক বছর আগেই একতলা পাকা দালান তোলা হয়েছে। স্বরূপের ঘরের সাথে এটাচড বাথরুম আছে। বাথরুমে টাইলস লাগানো। বাথরুমটা পছন্দ হয়েছে তনয়ার। সে শাড়িটা খুলে ফেলে ট্যাপ ছেড়ে দিল। প্রচন্ড ঠান্ডা পানি। পানির সাথে যেন বরফকুচি বেরিয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি ট্যাপ বন্ধ করে দিল সে। হাতমুখ ধোঁওয়া হলো না৷

ঝুলিয়ে রাখা জামার দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে সে প্রথমবার জিনিসটা দেখল। কালো, রোমশ বড়সড় একটা আস্ত মাকড়সা দেয়ালে বসে আছে। তনয়া মাকড়সা প্রচন্ড ভয় পায়। তার ইচ্ছে হলো চিৎকার করতে। কিন্তু গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হলো না৷ কোনোক্রমে সে আস্তে আস্তে দরজার কাছে চলে গেল। দরজার ছিটকিনি খুলে গুলির মতো বেরিয়ে পড়ল বাথরুম থেকে।

স্বরূপ চোখ তুলে হা হয়ে গেল। একি অবস্থা! তনয়া তখন কাঁপছে। তার গায়ের স্বল্প কাপড়ের দিকে তখন নজর নেই। স্বরূপ তার কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখল। “তনয়া! কী হয়েছে?”

“মাকড়সা!”

“মাকড়সা?”

“হ্যাঁ।”

স্বরূপ হো হো করে হেসে ফেলল। কেউ মাকড়সা দেখে কেমন করে ভয় পেতে পারে! তবে তনয়ার চেহারা দেখে থমকে গেল। মেয়েটা সত্যিই ভয় পেয়েছে। নইলে এভাবে বের হয়ে আসত না৷

স্বরূপ বাথরুমে ঢুকে মাকড়সাটা মারার জন্য স্যান্ডেল হাতে নিল। তনয়া তখন চেঁচাল, “মারবে না প্লিজ!”

স্বরূপ অবাক হয়ে বলল, “তুমিই তো ভয় পাচ্ছো।”

“সেটা আমার সমস্যা। মাকড়সার না৷ ওকে তাড়িয়ে দাও, তাহলেই হবে।”

স্বরূপ বিড়বিড় করে বলল, “ওকে তাড়াব! ঠিক আছে!”

সে মাকড়সার কাছে গিয়ে বলল, “জনাব মাকড়সা, আপনি কি নিজে থেকে যাবেন নাকি আমি গিয়ে দিয়ে আসব?”

মাকড়সাটা একটু নড়ল৷ স্বরূপ হাত দিয়ে ওটাকে জায়গা থেকে সরিয়ে দিল। মাকড়সা এবার তরতর করে সরে যেতে থাকল। স্বরূপও সাথে সাথে এগুল। “ভাই শুনুন, এরপর থেকে বিশিষ্ট ভদ্রমহিলাদের বাথরুমে ঢুকবেন না৷ এরা বের করে দেবে, কিন্তু জুতোপেটা করতে দেবে না। যাকে বলে, সম্মানের সহিত বের করে দেয়া। আপনার সাথেও তাই হচ্ছে, কী আর করার! আপনি আমার সাথে রাগ করবেন না। আমি কিন্তু কিছু করিনি। সব আমার বউয়ের দোষ। আপনি তো জানেনই বউয়ের কথা না শুনলে কী হাল হতে পারে!”

মাকড়সাটা বোধহয় স্বরূপের বকবক সহ্য করতে না পেরে ঘুলঘুলি দিয়ে বেরিয়ে গেল।

তনয়া হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। স্বরূপ বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলে সে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “আমি দরজা আটকাব না৷ তুমি কিন্তু তাকাবে না।”

স্বরূপ চোখ বড় করে বলল, “তা কেন? তা কেন? দরজা খুলে রাখলে আমি অবশ্যই তাকাব।”

“আমি ড্রেস চেঞ্জ করব!”

“তাতে আমার কী? আমার ড্রেস তো আর চেঞ্জ করছো না।”

তনয়া ফিচেল হেসে বলল, “চাইলে করে দিতে পারি। দেব?”

স্বরূপ আর কথা না বলে বিছানার দিকে গেল। তনয়া বাথরুমে ঢুকে দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে জামা বদলে নিল। বেরিয়ে এসে বলল, “মাকড়সাটা কিন্তু ছেলে না, মেয়ে। সে বউয়ের যন্ত্রণা বুঝবে কেমন করে?”

“তাহলে আমার কথা শুনে যে চলে গেল?”

“তোমার চেহারা পছন্দ হয়নি, তাই চলে গেছে।”

স্বরূপ সাথে সাথে সিরিয়াস হয়ে বলল, “আমাকে কি খুব খারাপ দেখাচ্ছে? জার্নি করলে চেহারা কেমন একটা হয়ে যায়!”

তনয়া হেসে বলল, “হোক তাতে কী? তোমার তো বিয়ে হয়েই গেছে। চেহারা দিয়ে নতুন কাকে পটাতে চাও?”

“আমার এক প্রেয়সী আছে। গ্রামে এলেই রাতে দেখা করতে আসে।”

“হোয়াট?”

“সত্যি। তবে ও মানুষ নয়, পরী।”

“ধুর!”

“আরে সত্যিই! আমি এতদিন ওর জন্যই তো বিয়ে করিনি৷ আজ ও আসবে। আমি এলেই চলে আসে। তোমাকে ও সতীনের মতো দেখবে। তাই ও আসার আগেই ঘুমিয়ে যাও প্লিজ। ওর জন্য তোমার কোনো ক্ষতি হোক আমি চাই না। ও ঘুমন্ত মানুষদের কিছু করে না।”

কথাগুলো স্বরূপ বলল পুরোপুরি গম্ভীর মুখে। তার কথার ধরন দেখে যে কেউ মনে করবে সে সত্যি কথা বলছে।

চারদিক তখন শুনশান। বাইরে ঝিঁঝি পোকার ডাক বাদে আর কোনো শব্দ নেই। ঘরের ভেতর তনয়া আর স্বরূপ শুধু। ঘরটা বিশাল। সেই তুলনায় আসবাব কম। বড় ঘর হওয়ায় আলোটাও কম উজ্জ্বল লাগছে। তনয়ার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। যদিও সে এসব কথায় বিশ্বাস করে না। ভেতরে ভেতরে ঠিকই জানে, স্বরূপ বাজে কথা বলছে। তবুও কেন যেন ভয় লাগছে।

তবে ভয়টা সে প্রকাশ হতে দিল না৷ বলল, “বাজে কথা যত্তসব!”

“ওর নাম চন্দ্রা।” আবারও গম্ভীর মুখে বলল স্বরূপ।

“পরীতে বিশ্বাস করি না আমি।”

“জ্বীনে তো করো! কোরআন শরিফেই জ্বীনের কথা আছে। ও একটা মহিলা জ্বীন।”

তনয়া এবার একটু একটু বিশ্বাস করতে শুরু করল। স্বরূপ সত্যি বলছে না তো? খুব সিরিয়াস মুখে সে কথা বলছে। মনে হচ্ছে না জোক। সে কি প্র্যাক্টিক্যাল জোক করছে? অসম্ভব নয়। তবুও কেমন যেন লাগছে তনয়ার। সে অনেকটা জোর করেই নিজেকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসিয়ে মুখ, হাত, পায়ে ক্রিম লাগাল, চুল বাঁধল। পুরো সময় সে আঁড়চোখে আয়নার ভেতর দিয়ে স্বরূপের দিলে তাকিয়ে রইল। স্বরূপের মুখ পুরোটা সময়ই বেশ গম্ভীর হয়ে রইল।

বাইরে এমন সময় দুম করে একটা শব্দ হলো। মনে হলো গাছের ডাল ভেঙে পড়েছে। অথচ ঝড় বাদলা কিছুই নেই। তনয়া ভয়ে এক দৌড়ে বিছানায় চলে এলো। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “ওটা কিসের শব্দ?”

“ওর আসার সংকেত।”

“তু…তুমি মজা করছো!”

স্বরূপ ওর দিকে শুধু তাকাল। ওর চোখের ভঙ্গি দেখে মনে হলো সে তনয়াকে ভয় পাওয়াবে না বলে চুপ করে আছে।

তনয়া স্বরূপের কাছ ঘেঁষে এলো। বলল, “আমার কিন্তু ভয় করছে এখন।”

“আচ্ছা, শুয়ে পড়ো। বললাম তো ঘুমাতে দেখলে কিছুই বলবে না।”

“ঘুম আসবে না আমার।”

“চোখ বুজে থাকো।”

“চোখ বুজলেই ঘুম আসে নাকি!”

স্বরূপ আচমকা উঠে গিয়ে লাইট বন্ধ করে দিয়ে এলো। তনয়া ছোটোখাটো একটা চিৎকার দিয়ে বলল, “অ্যাই, লাইট বন্ধ করো কেন?”

“নইলে ঘুমাবে কেমন করে?”

“আমার ভয় করছে।”

স্বরূপ তনয়ার পাশে শুয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল বলল, “ভয় নেই, আমি আছ।”

তনয়া ওকে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে ধরল। স্বরূপ মুচকি হাসল। তনয়াকে ভয় পাইয়ে দিতে পেরেছে সে৷ ওকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করছিল তার। যদিও বউ, তবুও জড়তা একটা থেকেই যায়৷ তাছাড়া তনয়ার সামনে সে যেরকম ব্যক্তিত্ব দেখিয়ে চলে তাতে রোজ রোজ কাছে টানলে ও হ্যাংলা ভাববে। ভাববে ওকে ছাড়া স্বরূপের আর চলছে না৷ সেটা ভাবতে দিলে চলবে নাকি? তারচেয়ে তনয়া নিজেই আসুক কাছে।

*****

কিছুটা সময় দু’জন চুপচাপ পড়ে রইল। একসময় স্বরূপ ফিসফিস করে বলল, “ও চলে গেছে।”

“কে?”

“চন্দ্রা।”

“এলো কখন আর গেল কখন?”

“এই মাত্রই। আমাদের ঘুমাতে দেখে চলে গেছে।”

“ওর হিংসে হয়নি?”

“হয়েছে তো। এজন্যই তো কথা বলল না।”

“যাক ভালো হলো।”

“ছাই ভালো! আবার কাল আসবে।”

“আসুক। কাল দেখা যাবে।”

“আজ তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?”

“ওর জন্য কিছু না। এমনিতে পুরো শরীর ব্যথা।”

“সেবা লাগবে?” স্বরূপ যেন অন্য কোনো ইঙ্গিত করল।

তনয়া বুঝেও না বোঝার ভান করে বলল, “না সেবা লাগবে না। শুধু একটু জড়িয়ে ধরে থাকলেই বড় মেহেরবানি হয়।” বলতে বলতে সে হাই তুলল।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে