গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-০৭

0
485

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৭.

তনয়ার কেন যেন মনে হচ্ছিল বিয়েতে কোনো না কোনো ঝামেলা বাঁধবে। সে সকাল থেকে চিন্তা মাথায় করে বসেছিল। কিন্তু বিয়েটা সুন্দরভাবেই কেটে গেল। এমনকি বিয়ের ভিডিও, খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে বিদায় পর্যন্ত এত সুন্দরভাবে হলো যে গাড়িতে উঠে তনয়া নিজের হাতে একটা চিমটি কেটে নিশ্চিত হলো সবটা সত্যি ছিল! কিন্তু ভয় কমল না। রাত এখনো বাকি। আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে আজকের রাত বছরের সবচেয়ে দীর্ঘ রাত!

অবশ্য তার আনন্দও হচ্ছে। প্রচুর ঘোরাঘুরি হবে বলেই মনে হচ্ছে। আগামীকাল গ্রামের বাড়ি, তারপর সেখান থেকে এসে দার্জিলিং! ওদের কোনো প্ল্যান ছিল না বিয়ের পর মধুচন্দ্রিমায় যাবার। কিন্তু দেখা গেল স্বরূপের বন্ধুরা মিলে চমৎকার একটা ট্যুর প্ল্যান করে উপহার দিয়েছে তাদের। প্লেনেট টিকিট থেকে শুরু করে হোটেলে থাকা পর্যন্ত সব বন্দোবস্ত করে রেখেছে। এবার শুধু নির্ধারিত দিনে যাত্রা করা! তনয়ার পাহাড় ভীষণ পছন্দ! স্বরূপেরও কি পছন্দ?

****

বাসর ঘর। অচেনা কোনো বিদেশি ফুল দিয়ে চমৎকার করে সাজানো। শুনেছে স্বরূপের বান্ধবী মিলি ডিজাইনার। তারই ডেকোরেট করা এই বাসর ঘর৷ ঘরে মৃদু একটা আলো জ্বলছে। তাতে যেন বাসরের আবেদন আরো বেড়েছে। কয়েকটা আর্টিফিশিয়াল মোমবাতি জ্বলছে। খোলা জানালা দিয়ে আসছে মৃদু শীতের বাতাস। সবকিছুর মধ্যে তনয়ার ঘুম ঘুম পাচ্ছে। স্বরূপ কোথায় রয়ে গেছে? কেন আসছে না? আজ কি সে আসবেই না? এ কেমন কথা?

তনয়া ঝিমিয়ে পড়ে যাচ্ছিল এমন সময় স্বরূপ ঢুকল। তার গলায় এখনো বিশাল ফুলের মালাটা ঝুলছে। এখনো খোলেনি কেন? আজব তো!

স্বরূপ ঢুলেই বাতি জ্বালাল। বলল, “এই অন্ধকারে বসে আছো কেন?”

তীব্র আলো চোখে এসে পড়ায় চোখ ঢাকল তনয়া। বলল, “মৃদু আলোটা সুন্দর ছিল তো..”

“এভাবেই ঘুমাবে? এই শাড়ি, গয়নাগাটি আর মেকআপ নিয়ে?”

“তা কেন?”

“তাহলে খোলোনি কেন এসব?”

“আপনার জন্যই তো সাজলাম, আপনি ভালো করে দেখেননি পর্যন্ত!”

স্বরূপ হেসে বলল, “আমি ভাবতাম বিয়ের কনেরা সাজে ছবি তোলার জন্য। বরকে দেখানোর জন্য সাজে এমনটা প্রথমবার শুনলাম।”

“দুটোই ইম্পর্টেন্ট।”

“আচ্ছা তাহলে একটু ভালো করে দেখা যাক।”

স্বরূপ হঠাৎ খুব কাছে চলে আসায় তনয়া একটু যেন জড়সড় হয়ে গেল। অদ্ভুত তো! ও মনে মনে চাইছিল মানুষটা কাছে আসুক!

স্বরূপ কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইল। তনয়াকে ভীষণ সুন্দর লাগছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বরূপ মুগ্ধ হলো। মুখে ছোট্ট করে বলল, “দেখলাম।”

তারপর উঠে চলে গেল বারান্দায়। যাবার আগে গলা থেকে মালাটা খুলে রেখে গেল। তনয়া বেশ কিছুক্ষণ বসে রইল। কিন্তু স্বরূপের খবর নেই। সে উঠে বারান্দায় উঁকি দিল। বারান্দায় একটা ইজি চেয়ার। তাতে হেলান দিয়ে বসে জনাব সিগারেট টানছেন। কাছে গিয়ে তনয়া জিজ্ঞেস করল, “এটা কী হচ্ছে? আপনি আমাকে রেখে চলে এলেন?”

“কী করতাম? দেবী পূজা? তুমি কী চাচ্ছ বুঝতে পারছি৷ কিন্তু আজ ওসব পারব না। অনেক টায়ার্ড আমি।”

তনয়ার ভীষণ রাগ হলো। সে বলল, “টায়ার্ড হলে গিয়ে শুয়ে পড়ুন। এখানে কী করছেন?”

“আমার রাতে ঘুম আসে না৷ ঘরটা ফুলের জঙ্গল বানিয়ে রেখেছে। তুমি জঙ্গলে ঘুমাতে পারো। আমি এখানেই থাকব।”

“ফুল পরিষ্কার করে দিচ্ছি। চলুন।”

“তার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি এখানেই ভালো আছি।”

“আপনার শীত করছে না?”

“না তো!”

তনয়া আর কথা খুঁজে পেল না। এই লোকটাকে কী করে শায়েস্তা করা যায়? হঠাৎ একটা বুদ্ধি মাথায় খেলে গেল তার। স্বরূপের হাত থেকে সিগারেটটা টেনে নিল সে। যদিও একটু রিস্কি ছিল, তবু পুড়ে যাবার ভয়ে স্বরূপই ছেড়ে দিল ওটা।

তনয়া সিগারেট ঠোঁটে চেপে ধোঁয়া টেনে নেবার চেষ্টা করল। তারপরেই কাশতে শুরু করল। ভীষণ বাজে একটা জিনিস!

স্বরূপ কঠিন স্বরে বলল, “এটা কেন করলে?”

“আপনি খেতে পারলে আমি কেন পারব না? আমিও খাব।”

“তুমি সিগারেট খাবে?”

“হ্যাঁ আপনার সাথে খাব। যখন সিগারেট খেতে ইচ্ছে করব, আমাকেও বলবেন। দুজন একসাথে বসে টানব। দারুণ মজা হবে, কী বলেন!”

“ফাজলামো বন্ধ করো। সিগারেটটা দাও।”

তনয়া দিল না। আবারও এক টান দিয়ে একদফা কাশল। স্বরূপ এবার ওর হাত থেকে সিগারেট কেড়ে নিয়ে নিভিয়ে ফেলে বলল, “আর নাটক করার কোনো প্রয়োজন নেই। আমিও খাব না।”

“তাহলে ঘরে চলুন।”

“একটা রাত কন্ট্রোল করতে পারছ না?”

“না। আজকে রাতটা শুধুই আমাদের দু’জনের হবার কথা। আমি একা ওখানে বসে থাকব আর আপনি এখানে সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে প্রাক্তনের শোক ওড়াবেন তা চলবে না। আজকে আমাদের মাঝে কোনো তৃতীয় ব্যক্তি থাকবে না।”

তনয়ার এতদিনের নরম ব্যবহার আজ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। সে বড় বেশি অধিকারবোধ নিয়ে কথা বলছে। স্বরূপের একইসাথে রাগ হচ্ছে, আবার তনয়ার এই মূর্তি তাকে সমানভাবে আকর্ষণ করছে।

স্বরূপ হালকা গলায় বলল, “ঘরে আসছি। তার আগে তুমি প্লিজ মেকআপটা ধুয়ে ফেলো।”

তনয়া একইভাবে বলল, “আপনি প্লিজ ব্রাশ করে আসুন। সিগারেটের গন্ধ অসহ্য!”

কিন্তু এরা কেউই কারো কথা শুনল না। স্বরূপ তনয়ার হাত ধরে নিজের কাছে টেনে নিল। তারপর কী হয়েছে তনয়ার সবটা মনে নেই। শুধু একগুচ্ছ গন্ধরাজের সুবাসের মতো ভীষণ ভালোলাবার সুবাস তাকে জড়িয়ে নিল। অসহ্য ভালোলাগায় তার মনে হলো, সে মরে যাবে।

রাত তখন গভীর। দুজনেই ক্লান্ত হয়ে শুয়ে আছে। তনয়া স্বরূপের কানের কাছে মুখ এনে বলল, “ভালোবাসি।”

স্বরূপ সহসা কিছু বলল না। বললে সুন্দর সময়টা হয়তো নষ্ট হয়ে যেত। সে মনে মনে বলল, “Love is just a myth!”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে