গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-০৩

0
468

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৩.

তনয়া ঠান্ডা মেজাজের মানুষ৷ কিন্তু প্রচন্ড রেগে গেলে তার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। রাগের মাথায় কী করে বসে নিজেও জানে না৷ সেরকমই পাগলাটে রাগ মাথায় চড়ে গেছে তার স্বরূপের কথা শুনে। সে উল্টোদিক ঘুরে কখন চলতে আরম্ভ করেছে নিজেও জানে না। কোনদিকে যাচ্ছে সে খেয়াল পর্যন্ত নেই। হঠাৎ কী একটা হলো, মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। তারপরেই মনে হলো কে যেন তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কোথায়৷ এদিকে মাথার ভেতর প্রচন্ড শব্দে সাইরেন বাজছে।

যখন সম্বিত ফিরল, মাথা কাজ করতে শুরু করল, তখন সে দেখল ফুটপাতের ওপর বসে আছে। স্বরূপ তার হাত ধরে রেখেছে। তনয়া তাকাতেই সে জিজ্ঞেস করল, “পানি খাবে?”

তনয়ার কেমন যেন ক্লান্ত লাগছে। রাস্তার অনেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে মাথা নাড়ল। খাবে না পানি।

স্বরূপ বলল, “গাড়ির নিচে পড়তে আরেকটু হলেই। এমন কেন করছিলে? আমি উল্টোপাল্টা বলেছি, আমাকে গাড়ির নিচে ফেললেও বুঝতাম। অপরাধীর শাস্তি নিজের মাথা পেতে নিতে এই প্রথম দেখলাম। চোখ সার্থক!”

নিজেকে গাড়ির নিচে ফেলার কথাটা স্বরূপ এত সিরিয়াস মুখ করে বলল যে তনয়ার রাগ পড়ে গেল। তবে বাইরে সেটা প্রকাশ করল না। স্বরূপ বলল, “চলো সামনের খাবারের দোকানে গিয়ে বসি। ওরা দুর্দান্ত স্যান্ডউইচ বানায়। খেতে খেতে তোমার প্রশ্ন শুনব। নাকি করবে না? না করতে ইচ্ছে হলে করো না। কিন্তু তোমাকে দেখে ঠিক সুস্থ মনে হচ্ছে না৷ এতটা পথ যেতে পারবে না একা। আবার আমার সাথে তো যাবেই না।”

তনয়ার হাসি পেয়ে গেল। কিন্তু সামলে নিল এবারও। মাথাটা এত জোরে চক্কর দিয়েছিল যে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবারও কেমন টলে উঠল সে। অগত্যা স্বরূপের হাত ধরে উঠতে হলো।

খাবারের দোকানে ভিড় আছে, তবে তারা যেতেই কোণার দিকের একটা টেবিল খালি হয়ে গেল। সেখানে গিয়ে বসল তারা৷ স্বরূপ দুটো স্যান্ডউইচ আর কোল্ড ড্রিংসের অর্ডার দিল।

কেউ কোনো কথা বলল না অনেকক্ষণ। খাবার চলে এলো। তনয়া এবার বলল, “আমি খাব না।”

“ওমা, খাবে না তো এসেছ কেন?”

তনয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আপনাকে প্রশ্নগুলো করতে।”

“শিওর?”

“হুম।”

“তখন করবে না বলে এখন মত বদলালে কেন?”

“সামনে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। ভাগ্য পেছন দিকে ঠেলে দিয়েছে তাই। এবার কথা শেষ না করে গেলে আবার দেখা হয়ে যাবে।”

স্বরূপ মুখে একগাদা খাবার নিয়ে যা বলল তা এরকম শোনাল, “হু, আবার ডেখা হয়া উচিট হবে ড়া..”

তনয়া এবারও হাসি চেপে কোল্ড ড্রিংসের গ্লাসটা টেনে নিয়ে চুমুক দিয়ে সময় নষ্ট না করে বলে ফেলল, “প্রশ্নগুলো সাধারণ জ্ঞানের মতো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণী কোনটি টাইপ না। অন্যরকম। এগুলো কোথা থেকে পেয়েছি সেই গল্প কাউকে বলিনি। সে যাক, প্রশ্ন করি।

ধরুন আপনি হঠাৎ কোনো কারনে খুব আর্থিক সমস্যায় পড়লেন৷ এতটাই দরিদ্র হয়ে গেলেন যে তিন বেলা খাবার জোটে না। দীর্ঘদিন এরকম চলার পর কেউ আপনাকে বলল সে আপনাকে ভাগ্য বদলে দেবার একটা পাথর দেবে, সেই পাথর ধারণ করে আপনার দিন ফিরবে। কিন্তু বিনিময়ে তাকে আপনার সবচেয়ে দামি জিনিসটা উপহার দিতে হবে৷ আপনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি এত দরিদ্র যে খেতে পাই না৷ আমার কাছে দামি জিনিস আসবে কোথা থেকে? তখন সে বলল, আমি এমন একটা জিনিস চাই যার বদলে পৃথিবীর সব নীতিকে কিনে ফেলা যাবে৷

এবার প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, সেই দামি জিনিসটা কী? দ্বিতীয় প্রশ্ন, আপনি উত্তরে কী বলবেন?”

স্বরূপ হেসে বলল, “সহজ প্রশ্ন।”

“হ্যাঁ সেটারই উত্তর জানতে চাই।”

“প্রথমটার উত্তর হলো সততা। কারন সততাই সর্বোত্তম নীতি। আর দ্বিতীয় উত্তরটা হলো, আমি পাথরে বিশ্বাস করি না। হা হা হা।”

তনয়া খানিকটা অবাক হলো। তার প্রশ্নটা সহজ ছিল এটা সত্য। তবে বেশিরভাগ মানুষ উল্টোপাল্টা উত্তর দিয়েছে৷ প্রথমটার উত্তর অনেকে বলতে পারলেও দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তারা বলেছে তারা প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দেবে কারন তারা সৎ! তারপর ইনিয়ে বিনিয়ে নিজেদের সততার সার্টিফিকেট নিজেরাই দিয়েছে৷ অথচ প্রশ্নটা কুসংস্কার নিয়ে ছিল। আবার অনেকে প্রথমটাও বলতে পারেনি কারন তারা হয়তো নিজেদের দামি জিনিস বলতে চারিত্রিক দিকটা ভাবতেই পারেনি।

এই প্রথম সে একটা সঠিক উত্তর পেল। তার মনে হলো, এই উত্তরটা আরও অনেকেই জানত। সে বেশ বুদ্ধিমান মানুষদেরও প্রশ্নটা করেছে। কিন্তু তারা অন্য কোনো কারনে উত্তর দিতে পারেনি। কী কারন? তারা তার জন্য পারফেক্ট ছিল না এজন্য? ভাগ্য কি তাকে জোর করে বোঝাতে চাইছে এই পাগল লোকটা তার জন্য পারফেক্ট?

নাহ, তারচেয়ে বরং বলা যেতে পারে লোকটা তার চোখ খুলে দিয়েছে৷ এই ঠুনকো দুটো প্রশ্ন দিয়ে কাউকে বিচার করা যায় না। বিচার করতে হয় তার ব্যবহার আর ব্যক্তিত্ব দেখে। কথায় বলে, দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য৷

“শুনতে পাচ্ছো?”

তনয়া যখন তাকাল তখন দেখল প্লেট দুটো খালি। স্যান্ডউইচ দুটো উদরসাৎ করে ভদ্রলোক কোন ফাঁকে যেন তার হাত থেকে কোল্ড ড্রিংস সরিয়ে নিয়ে সেটাও সাবাড় করছে। আশ্চর্য লোক!

তনয়াকে তাকাতে দেখে স্বরূপ চোখ বড় করে বলল, “তুমি কি এটা খেতে? আমি ভেবেছিলাম খাবে না। যাকগে, আমার আধখাওয়া জিনিসে নিশ্চয়ই চুমুক দেবে না। মজার ব্যাপার কী জানো, আমার এক প্রেমিকা ছিল, সে আমার মুখ লাগানো বোতলে পানি খেত না। ভাবতাম সে খুব খুঁতখুঁতে মানুষ। তারপর তাকে এমন এমন জিনিস খেতে…”

তনয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে স্বরূপ এবারের মতো মুখ বন্ধ করে ফেলল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চলো তোমাকে রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে আসি।”

“কোনো প্রয়োজন নেই। আমি যেতে পারব।”

ছেলেটা যেন শুনতেই পেল না। তনয়ার শপিং ব্যাগগুলো নিয়ে হাঁটা ধরল বাইরের দিকে। তনয়া পেছন পেছন গেল। তার সবকিছু কেমন যেন তেঁতো লাগছে।

রিকশায় বসার পর স্বরূপ বলল, “এক মিনিট। একটা কথা বলব৷ এই পর্যন্ত আমি যা যা বলেছি সেজন্য এক্সট্রিমলি স্যরি। আমি মেয়েদের পছন্দ করি না, তবে উত্যক্তও করি না। তোমাকে আজেবাজে কথা বলেছি কতকটা বিয়ে ভাঙার জন্য। তোমাদের বাড়ির বড়রা আমাকে বেশ পছন্দ করে ফেলেছে। তাদের সাথে তো আর উল্টোপাল্টা আচরন করা যায় না। এদিকে আমার বাড়ির লোক আর বন্ধুরা পাগল হয়ে গেছে বিয়ে দিতে। ফাইনালি বলেছে তোমার সাথে সেটিং না হলে আর জোরাজুরি করবে না। তাই আর কোনো অপশন ছিল না। যা যা বলেছি ভুলে যেও। আর একটা ভদ্রলোক দেখে বিয়ে করে ফেলো। আশা করছি আমাদের আর দেখা হবে না।”

তনয়া জিজ্ঞেস করল, “আপনি প্রশ্ন দুটোর সঠিক উত্তর জানতে চান না?”

“না আমি ভুল উত্তর দিতে পেরেছি এটা জেনেই খুশি লাগছে। বিদায়।”

স্বরূপ বিদায়বেলায় খুব সুন্দর করে হাসল। তনয়া ওর চোখের ভেতর দিয়ে হৃদয়ের ভেতরের আরও অনেকটা যেন দেখে নিল এক ঝটকায়।

পথে যেত যেতে তনয়ার কেমন বিষাদমাখা মন খারাপ হতে লাগল। মানুষটা যতক্ষণ ছিল ততক্ষণে নরম শীতের চাদরের মতো যেন জড়িয়ে ছিল কোনো এক অনুভূতি৷ এখন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এরকম আর কখনো কারও জন্য হয়নি তার। কেন লাগছে এমন?

বাড়ি ফিরে শপিং ব্যাগগুলো খুলতে গিয়ে দেখল একটা অতিরিক্ত ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর দুই প্যাকেট হাওয়াই মিঠাই!

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে